1 of 2

৪০. নরকের পুত্রোৎপত্তি

চত্বারিংশ অধ্যায় – নরকের পুত্রোৎপত্তি

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–কালক্রমে পত্নী ঋতুমতী হইলে ক্ষিতিপুত্র নরক, ভগদত্ত, মহাশীর্ষ, মদবান, সুমালী নামে চারিটি পুত্র উৎপাদন করিলেন। ১

তাহারা মহা বলবান, অত্যন্ত বীৰ্য্যবান ও অন্য বীরগণের দুর্দমনীয় হইল। তাহার পর বাণের বাক্যানুসারে অনুসন্ধান করিয়া হয়গ্রীব নামক অসুরকে আনয়ন করত সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করিলেন। ২-৩

হয়গ্রীবের বিষয় শ্রবণ করিয়া মুরুনামে অসুর তথায় উপস্থিত হইল; এবং পৃথিবীতে উপযুক্ত যত অসুর ছিল, সকলেই নরক-ভবনে উপস্থিত হইল। ৪

নরক-ভবনে হয়গ্রীব আগমন করিয়াছে শুনিয়া সুন্দ-নিসুন্দ নামক অসুর দ্বয় সকল সৈন্যের সহিত তথায় উপস্থিত হইল; এবং বিরূপাক্ষ অসুরও সেই স্থানে আগমন করিল। ৫

অসুরগণ একত্র সমবেত হইলে নরক, সমস্ত সৈন্যের সহিত মুরুকে পশ্চিম দ্বারের অধিপতি করিলেন, হয়গ্রীবকে উত্তরদ্বারাধিপতি করিলেন। ৬

পূর্বদ্বারের অধিপতি করিলেন, বিরূপাক্ষকে দক্ষিণদ্বারে এবং সুন্দকে মধ্যে সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিলেন। মুরু ষটসহস্র ক্ষুরান্ত পাশ দ্বারে যোজনা করিল। ৭-৮

নরক, পুররক্ষার জন্য তাহাদিগকে বিশেষ সৎকার করিলেন; এবং পূর্বতন মন্ত্রিদিগকে অবজ্ঞা করিয়া, সৰ্ব্বদা অসুরের সহিত অবস্থান করত আনন্দ লাভ করিতে লাগিলেন। ৯।

তাহার পর ক্ষিতিপুত্ৰ পূর্ব-পরিচিত ভাব পরিত্যাগ করিয়া অসুরভাব গ্রহণ করত দেবতাদিগকে উৎপীড়ন করিতে লাগিলেন। ১০

দেবতা ও মুনিগণকে নিরন্তর অবজ্ঞা করিতে লাগিলেন; নরক হয়গ্রীবের সাহায্যে দেবরাজকে জয় করিলেন। ১১

এইরূপ অসুরভাব বিস্তার করত ক্ষিতিপুত্ৰ নরক ক্ষিতিতে বিচরণ করিতে লাগিলেন; এবং বাণের বাক্যানুসারেই ইন্দ্র ও মুনিদিগকে পীড়ন করিতে লাগিলেন। ১২

হয়গ্ৰীবের সহায়তাবশতঃ নরকবীর দেবরাজকে হঠাৎ পরাজিত করিয়া ত্রিলোকদুল্লভ সৰ্ব্ব-রত্ন-স্রাবী দুঃখ ও বিঘ্ননিবারক অদিতির কুণ্ডলদ্বয়, মুনি শাপে ভয় না করিয়া হরণ করিলেন। ক্ষিতিপুত্র এইরূপ দেবতা ও মুনিদিগের উৎপীড়নে রত হইয়া পঞ্চসহস্র বৎসর প্রাগজ্যোতিষপুরে রাজত্ব করিলেন। ১৩-১৫

ইহার মধ্যে ক্ষিতি মহাভারাক্রান্ত হইয়া ব্রহ্মা বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদিগের শরণাপন্ন হইলেন। তিনি মাধব ও ব্রহ্মাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন। ১৬

যে দানব রাক্ষস দৈত্যদিগকে বিষ্ণু বিনাশ করিয়াছিলেন, তাহারা রাজা নরকের গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং তাহারা অত্যন্ত বলবান, তাহাদের দুর্বহ ভার আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না। তাহারা অসংখ্য–তাহাদের সংখ্যা করিতে আমি সক্ষম হইতেছি না। ১৭-১৮

সেই অসুরদের মধ্যে অষ্টশত সহস্র–প্রধান এবং অত্যন্ত বলবান্; তাহার মধ্যে অত্যন্ত বলসম্পন্ন বলিপুত্ৰ বাণ, বীর কংস, ধেনুক, অরিষ্ট, প্রলম্ব, মল্ল চাণুর, মুষ্টিক, মহাবলবান্ জরাসন্ধ, নরক, হয়গ্রীব, নিসুন্দ, সুন্দ, বিরূপাক্ষ, পঞ্চজন, হিড়িম্ব, বক, জটাসুর, কির্ম্মীর, অনায়ুধ, অলম্বুষ, সৌভ, জরাসন্ধ ও দ্বিবিদ বানর, শ্রুতায়ুধ, মহাদৈত্য শতায়ুধ, ঋষ্যশৃঙ্গপুত্র সুবাহু, অতিবাহু, হিরণ্যপুরনিবাসী কালকঞ্জ প্রভৃতি দৈত্যবর্গের ভার আমি কিছুতেই সহ্য করিতে সক্ষম হইতেছি না। ১৯-২৪

ইহাদের চরণে নিরন্তর দলিত হইয়া দিন দিন বিশীর্ণ হইতেছি। এ সমস্ত দৈত্যের ভার বহন করিতে নিতান্তই অক্ষম হইয়াছি, ইহাদিগকে দেবগণ বিনাশ করুন। না হইলে একেবারে বিশীর্ণ হইব, অথবা পাতালে গমন করিব। ২৫-২৬

মার্কণ্ডেয় বলিলেন, তাহার পর ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর—“আমরা ক্ষিতির ভার মোচন করিব” এই বলিয়া পৃথিবীকে বিদায় করিলেন। ২৭

তাহার পর সকল দেবগণ সনাতন মাধবকে ক্ষিতির ভারাবতরণের জন্য তোষণ করিলেন। ২৮

ভগবান তুষ্ট হইয়া বলিলেন, দেবগণ! তোমরা স্ব স্ব রূপে পৃথিবীর ভারাবতারণের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ কর;–এই কথা বলিয়া স্বয়ং ভারাবতারণের নিমিত্ত দেবকীর গর্ভে অবতীর্ণ হইলেন। দেবগণ সনাতন হরি অবতীর্ণ হইয়াছেন শ্রুত হইয়া পৃথিবীতে রম্ভা ও তিলোত্তমার ন্যায় রূপ ও গুণ সম্পন্না ষোড়শ সহস্র স্ত্রী উৎপাদন করিলেন, তৎপরে সেই মনোহারিণী স্ত্রীগণ হিমবৎপ্রস্থে ক্রীড়া করিতেছে দেখিয়া ভূমিপুত্র নরক হঠাৎ তাহাদিগকে হরণ করিলেন এবং ক্ষণকাল মধ্যেই পরাভূত করিয়া প্রাগজ্যোতিষপুরে লইয়া গেলেন। ২১-৩২

সেই স্ত্রীগণ নরকসমীপে সম্ভোগ বিষয়ে কিছু সময় প্রতীক্ষা করিতে প্রার্থনা করিল-হে ভূমিপুত্র! নারদ এই নগরে যতদিন আগমন না করেন, ততদিন সম্ভোগস্পৃহা নিবৃত্তি করুন, এবং আমাদের রক্ষা করুন। হে বীর! নারদ শীঘ্রই এই নগরে আগমন করিবেন, তাহার আগমন কাল পর্যন্ত অনুগ্রহ করিয়া প্রতীক্ষা করুন। তাহার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইলে তৎপরে আপনার সঙ্গে সম্ভোগ-সুখভোগ করিব। এইরূপ তাহারা কিঞ্চিৎ সময়ের প্রার্থনা করিলে পৃথিবী-পুত্র নরক সেই সময় ব্ৰহ্ম-বাক্য স্মরণ করিয়া তাহাদের কথায় সম্মত হইলেন। ৩৩-৩৬

ইহার মধ্যে বিষ্ণু দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়া নন্দগৃহে বর্ধিত হইতেছিলেন। তাহার পর কংস কেশী ও প্রলম্বাদি দৈত্যগণকে বিনাশ করিয়া সমুদ্র মধ্যস্থিত দ্বারকাতে বাস করিতে লাগিলেন। ৩৭-৩৮

তাহার পর সেই দ্বারকাতে মনুষ্য-রূপধারী কৃষ্ণ-কালিন্দী, রুক্মিণী, নগ্নজিৎ-কন্যা, সত্যা, লক্ষ্মণা, চারুহাসিনী, শীল-সম্পন্না সুশীলা ও জাম্ববতী এই আটটী রমণীর পাণিগ্রহণ করিলেন। ৩৯-৪১

সেই কন্যাদিগের প্রতি সতত অনুরক্ত থাকিয়া ভগবানের ষট্‌ত্রিংশ বৎসর অতীত হইল। সেই সময় বলদেব তাহার সহায় ছিলেন। ৪২

হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ! তৎপরে কৃষ্ণের শাস্ত্র ও অস্ত্র-বিদ্যায় পারদশী প্রদ্যুম্ন শাম্ব প্রভৃতি মহাবলশালী পুত্র জন্মগ্রহণ করিলেন। ৪৩

তাহাদের পরাক্রমে ক্ষিতির ভারভূত বহুদৈত্য বিনষ্ট হইল। তৎপরে কৃষ্ণ, নানাবিধ ক্রীড়াতে রত হইয়া দ্বারকাতে বাস করিতে লাগিলেন। ৪৪

অনন্তর ইন্দ্র নরকের উৎপীড়নে উৎপীড়িত হইয়া নিজগণের সহিত দ্বারকাতে, কৃষ্ণের দর্শনাভিলাষে আগমন করিলেন। ৪৫

দ্বারকায় আসিয়া তিনি লোকনাথ কৃষ্ণকে বহু নমস্কার করত কাঞ্চনময় আসনে উপবেশন করিলেন এবং কৃষ্ণ, তাহার বিশেষ আদর করিলেন। তাহার পর শত্রু, নরকের আচরণ সমুদয় বলিতে লাগিলেন; নরক; পূর্বে যাহা করিয়াছেন এবং বর্তমানে সময়ে যাহা করিতেছেন, আনুপূর্বিক সমস্তই বলিলেন। ৩৮-৪৭

ইন্দ্র বলিলেন, মহাবাহু কৃষ্ণ! আমি যে জন্য আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, সে সমস্তই বলিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন, তাহাতে শঙ্কা করিবেন না। ৪৮

সুরপীড়ক দুষ্ট ভূমি-পুত্র নরক, চিরজীবী হইয়া বিষ্ণু ও ক্ষিতিকর্তৃক প্রতি পালিত হইয়াছে, এ সময়ে দুষ্ট-বিষ্ণু ও ক্ষিতিকে অবজ্ঞা করত বাণের বাক্যানুসারে ব্রহ্মাকে পরিতোষ করিয়াছে এবং ব্ৰহ্মদত্ত বরলাভ করিয়া অত্যন্ত গর্বিত হইয়াছে; মাধব ও ক্ষিতিকে কদাচ স্মরণ করে না। ৪৯-৫১

সেই দুরাত্মা পূর্বে ধর্মশীল দেবারাধনায় রত এবং ব্ৰতশীল ছিল, বর্তমান সময়ে অসুরভাব ধারণ করত সকলকেই পীড়া দিতেছে, মোহবশে অদিতির অমৃত-নিস্যন্দী কুল-দ্বয় হরণ করিয়াছে। ৫২

দেব ও ঋষিগণকে নিরন্তর পীড়া দিতেছে, এবং ব্রাহ্মণদিগের অপ্রিয়কার্যে সর্বদা রত থাকিয়া, দুষ্ট ইচ্ছানুসারে নিরন্তর আমাকেও উৎপীড়ন করিতেছে। ৫৩

অসুর ও দেবতাদিগের জেতা এবং দেবাদির অবধ্য হইয়াছে,–এমন কি আপনার পর্যন্ত সময় প্রতীক্ষা করিতেছে। অতএব সেই পাপাত্মাকে মঙ্গলের নিমিত্ত বিনাশ করুন। ৫৪

আপনার জন্য দেবগণ–দেব ও গন্ধৰ্ব্ব কন্যাগণকে পৰ্বত প্রধান হিমালয়ে রাখিয়াছিলেন। ৫৫

সেই দেবকন্যা ও গন্ধৰ্ব্বকন্যা শতাধিক ষোড়শ সহস্র। ৫৬

সেই সমস্ত কন্যাগণকে বলগর্বিত পাপিষ্ঠ নরক; হয়গ্রীবের সাহায্যে হরণ করিয়াছে। ৫৭

সাগরে পৃথিবীতে ও স্বর্গে যে সকল রত্ন ছিল, সে সমস্তই দেবতা ও মনুষ্য দিগকে উৎপীড়ন করিয়া আত্মসাৎ করত লৌহিত্যনদের তীরে, মণি-পর্বত নিৰ্মাণ করিয়াছে। ৫৮-৫৯

সেই রত্নপৰ্ব্বতে অলকা নামে মনোহর পুরী নিৰ্মাণ করিয়াছে, তাহাতে সেই সকল দেব ও গন্ধর্বকন্যাগণ বাস করিতেছে। ৬০

এবং তাহারা সম্ভোগ-বর্জিত হইয়া একবেণী ধারণ করত আপনারই প্রতীক্ষা করিতেছে। অতএব কৃষ্ণ! আপনি তাহাদিগকে সনাথা করুন। ৬১

ভূমি-পুত্র! যতদিন নারদমুনি আপনার নগরে না আসিবেন, ততদিন আমাদের সঙ্গে সম্ভোগ বিষয়ে আপনি বিরত থাকিবেন। ৬২

এইরূপে সেই কন্যাগণ দুরাত্মা নরকের নিকট সময় প্রার্থনা করিয়া তাহাকে তদ্বিষয়ে নিরস্ত রাখিতেছে। ৬৩

যে সময়ে নারদ প্রাগজ্যোতিষপুরে গমন করিবেন, সেই সময়ে নরককে বিনাশ করিবার জন্য আপনিও সেই নরকভবনে গমন করিবেন। ৬৪

এবং আপনি পাপকৰ্ম্মা দেব ও মনুষ্যগণের কণ্টকস্বরূপ, নরকসদৃশ দুর্দমনীয় নরককেও বিনাশ করুন। ৬৫

তাহার বধের জন্য ক্ষিতিদেবীও পুত্রশোক প্রাপ্ত হইবেন না; যেহেতু দেবী স্বয়ং তাহার বধের জন্য দেবগণের নিকট প্রার্থনা করিয়াছেন। ৬৬

অতএব আপনি পাপিষ্ঠ নরককে বিনাশ করুন; তাহাকে বিনাশ করিয়া স্ত্রী এবং মণিরত্নাদি উদ্ধার করুন। ৬৭

ইন্দ্রের এই কথা শ্রবণ করিয়া, জগৎপতি নারায়ণ, নরক বিনাশ করিবার জন্য সেই সময়েই প্রতিজ্ঞা করিলেন এবং তৎকালেই প্রাগজ্যোতিষ পুরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। ৬৮৬৯

বিষ্ণু সত্যভামার সহিত গরুড়ে আরোহণ করিয়া নরক-পুরে গমন করিলেন এবং ইন্দ্ৰ স্ব-ভবনে স্বর্গে গমন করিলেন। ৭০

মহাদ্যুতি বিষ্ণু ও ইন্দ্র আকাশে গমন করিতেছেন–দেখিয়া যাদবগণ, সূৰ্য্য ও চন্দ্ৰ একত্র উদয় হইয়াছেন মনে করিল। ৭১

তাহাকে দেখিয়া অপ্সরাগণ ও গন্ধৰ্ব্বগণ স্তব করিতে লাগিল; তাহারা ক্ষণকালমধ্যেই উভয়ে অদৃশ্য হইলেন। ৭২।

তৎপরে ক্ষণকালমধ্যেই জগৎপতি নরকের বশীকৃত প্রাগজ্যোতিষ নামে রম্য নগরে উপস্থিত হইলেন। ৭৩

সেই নগর ভয়ঙ্কর মৃত্যুপাশের ন্যায় মুরু নামক অসুরের ক্ষুরান্ত ষটসহস্র পাশের দ্বারা সুগুপ্তভাবে বেষ্টিত। ৭৪

বিষ্ণু সেই পুরী হইতে নারদকে বাহির হইতে দেখিলেন; বিষ্ণু যে সময়ে দ্বারকা হইতে আসিতেছিলেন। ৭৫

সেই সময়ে নারদ প্রাগজ্যোতিষ পরে যাইয়া নরকের সৎকারে সৎকৃত হইলেন এবং নরক তাঁহার সমীপে দেবকন্যাগণের সহিত সম্ভোগের সময় প্রার্থনা করিলেন। ৭৬

তাহার পর নারদ বলিলেন, অদ্য চৈত্রের শুক্লপক্ষীয় পঞ্চমী প্রবৃত্ত হইয়াছে, হে ধরাপুত্র! নবমীতে আপনার বিশেষ বিপদ; তাহার পর চতুর্দশীতে এই স্ত্রীগণ যদি সুন্দররূপে ঋতুস্নাতা হয়, তাহা হইলে আপনি ইহাদের সহিত সুখে সম্ভোগ করিবেন। ৭৭-৭৮

নারদের বাক্য শ্রবণ করিয়া নরক ভীত হইলেন; এবং নগরে বিশেষরূপে সৈন্য নিবেশ করিলেন। ৭১

রাজ্য–রাক্ষসেরা রক্ষা করিতেছিল, এখন আবার বিশেষরূপে চারিদিকে রক্ষার বন্দোবস্ত করিলেন। ভয় ও হাস্যমুক্ত হইয়া নরক সময় প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ৮০

সেই অবসরে গরুড়ধ্বজ কৃষ্ণ, প্রাগজ্যোতিষপুরে উপস্থিত হইয়া পশ্চিম দ্বার আক্রমণ করিলেন। ৮১

ষটসহস্র ক্ষুর নামক পাশসমূহ খণ্ড খণ্ড করিলেন; এবং মুরু নামে দৈত্যকে তাহার অনুচর ও বন্ধুগণের সহিত বিনাশ করিলেন। ৮২

মহাবলসম্পন্ন ষটসহস্র দ্বাররক্ষকদিগকে বিষ্ণু, চক্রের দ্বারা সেই সময়ে বিনাশ করিলে; সহস্ৰ সৈন্যের সহিত মুরুকে যমালয়ে পাঠাইলেন। ৮৩

তাহার ছয় পুত্রকে চক্রের দ্বারা বিনাশ করিলেন এবং অন্যান্য দানবদিগকেও চক্রের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিলেন। ৮৪

তাহার পর জনার্দন, বহুশিলা অতিক্রম করিয়া, বন্ধু-বান্ধবের সহিত নিসুন্দ ও সুন্দকে বধ করিলেন। ৮৫

পূর্বে যে বীর একাকী সহস্র বৎসর দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল এবং শত্রুকে অতিক্রম করিয়া অত্যন্ত পরাক্রান্ত হইয়াছিল। ৮৬

কেশব–সেই হয়গ্রীব বীরকে আক্রমণ করিয়া বিনাশ করিলেন। মহাবল, পরমেশ্বর ভগবান দেবকীপুত্র লৌহিত্য-গঙ্গার মধ্যজলে বিরূপাক্ষ ও সুন্দকে বিনাশ করিয়া, পঞ্চজন বীরকেও বিনাশ করিলেন। ৮৭-৮৮

জগন্নাথ, মহাকায় দুরাসদ মহাবীরদিগকে নিধন করিয়া, প্রাগজ্যোতিষ পুরী প্রাপ্ত হইলেন। ৮১

তাহার পর আকাশস্থ সমস্ত দেবগণ ও নারদমুনি ঈশ্বরকে জয় শব্দের দ্বারা স্তব করিতে লাগিলেন এবং তিনি সেই পুরে প্রবেশ করিলেন। ৯০

শ্ৰীসম্পন্ন অত্যন্ত দীপ্তিশীল প্রকার ও অট্টালিকা দ্বারা ভূষিত পুরীকে বিষ্ণু, ইন্দ্রের অমরাবতী বিবেচনা করিলেন। ১১

সেই পুরে সমস্ত প্রহরিগণের সহিত-ভীরুদিগের ভয়জনক দেবতাদিগের আনন্দবর্ধক মহাযুদ্ধ উপস্থিত হইল, যেরূপ দেবাসুরের যুদ্ধ হয়, সেইরূপই হইল। ৯২

তাহার পর শার্ঙ্গবিনির্মুক্ত বাণের দ্বারা সেই মহাবাহু গরুড়াসীন জনার্দন বহু দানবগণকে বধ করিলেন। ৯৩

তাহার পর অষ্টশত সহস্র ও অষ্ট শত অসুর বিনাশ করিয়া নরকের নিকট উপস্থিত হইলেন। ৯৪

নরক, যুদ্ধে সকল অসুর পতন হইয়াছে শুনিয়া এবং মহাবাহু মহাবলসম্পন্ন গরুড়স্থ কৃষ্ণকে দেখিয়া, বসিষ্ঠের শাপ এবং মাধবের প্রস্তাবিত নিয়ম স্মরণ করিতে লাগিলেন। নারদের বাক্য ও ব্রহ্মার সচ্ছিদ্র বর–সমস্তই স্মরণ হইল। ১৫-৯৬

কেশব কালপ্রাপ্ত হইয়া আগমন করিয়াছেন, অতএব বাণের বাক্য স্মরণ করত যুদ্ধই নিশ্চয় করিলেন। ৯৭

তাহার পর পৃথিবীপুত্র নরক কাঞ্চনময় বজ্রধ্বজ, অষ্ট লৌহচক্ৰযুক্ত, সহস্র অশ্বযুক্ত, বহুতূণীর-বদ্ধ, নানা প্রহরণযুক্ত রথে আরোহণ করিয়া যুদ্ধের নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। ৯৮-৯৯

নরক, সমরের নিমিত্ত মনুষ্যভাব গ্রহণ করিয়া শীঘ্র আগমন করিলেন এবং ক্ষণকালমধ্যেই গরুড়ের উপরিস্থিত কৃষ্ণকে দেখিতে পাইলেন; দেখিলেন, অচ্যুত শঙ্খ-চক্র-গদাধারী কিরীট-কুণ্ডল-বিভূষিত শ্রীবৎস-বক্ষ কৌস্তুভমণি প্রদীপ্ত-বক্ষস্থল পীতাম্বরধারী। ১০০-১০২

অনন্তর প্রাগজ্যোতিষাধিপতি পৃথিবীপুত্ৰ নরক বীর, প্রভু বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। ১০৩

তৎপরে যুদ্ধ করিতে করিতে কৃষ্ণের নিকট কালিকা-সদৃশী কালিকা-মূর্তি দেখিতে পাইলেন; তাঁহার রক্তবর্ণমুখ ও নয়ন, দীর্ঘ কলেবর, করে খড়্গ ও পাশ, তিনি জগদ্ধাত্রী জগন্মোহিনী কামাখ্যাদেবী। ১০৪

নরক জগৎপ্রসবিনী দেবীকে দেখিয়া বিস্ময়ের সহিত ভীত হইল এবং মনে করিল,–যুদ্ধ করাই কৰ্ত্তব্য। অনন্তর নরকাসুর যুদ্ধ করিতে লাগিল। ১০৫

তৎকালে কৃষ্ণ তাহার সহিত, দেবতাদের মধ্যে ও মনুষ্যগণের মধ্যে অভূত পূর্ব অদ্ভুত যুদ্ধ করিলেন। ১০৬

মাধব ভূমিপুত্রের সহিত যুদ্ধ করিয়া দেবরাজের হর্ষোৎপাদন করত তাহাকে বধ করিলেন। ১০৭

সুদর্শন চক্রের দ্বারা হরি নরকের মধ্যদেশ দ্বিখণ্ড করিলেন, সে হত হইয়া ভূমিতে পতিত হইল। ১০৮

চক্র-ছিন্ন ভূমিপতিত নরক-দেহ বজ্র-ভিন্ন গৈরিক পৰ্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ১০৯

পুত্র, ভূমিতে পতিত হইলে তাহার শরীর দেখিয়া বসুধা সেইটি তাহার মৃত্যুকাল ইহাই বিবেচনা করত শোক-বেগ সহ্য করিলেন। ১১০

পৃথিবী স্বয়ং অদিতির কুণ্ডলদ্বয় লইয়া গোবিন্দকে উপঢৌকন দান করিয়া বলিলেন। ১১১

আপনি বরাহাবতারে যখন আমাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন, সেই সময়ে আপনার সংসর্গে আমার গর্ভে নরকের উৎপত্তি হয়, তাহাকে এত দিন আপনি প্রতিপালন করিয়াছেন, অদ্য রণে আপনিই বিনাশ করিলেন। ১১২

সকল অভীষ্টপ্রদ অদিতির এই কুণ্ডলদ্বয় গ্রহণ করুন এবং হে গোবিন্দ। ইহার সন্ততি আপনি সর্বদা রক্ষা করুন। ১১৩

ভগবান্ বলিলেন, দেবি! ভারাবতারণের জন্য নরকের বধ প্রার্থনা করিয়াছিলে বলিয়া আমি তাহাকে বধ করিয়াছি। ১১৪

দেবি। তোমার বাক্যানুসারে ইহার সন্তানদিগকে আমি প্রতিপালন করিব এবং প্রাগজ্যোতিষপুরে পৌত্র ভগদত্তকে অভিষিক্ত করিব। ১১৫

এই কথা বলিয়া মহাবাহু ভগবান্ মধুসূদন অন্তঃপুরে নরকের ধনাগারে প্রবেশ করিলেন। বীর জনার্দন সেই স্থানে রাশিকৃত পর্বতাকার বিবিধ রত্ন দেখিতে পাইলেন। ১১৬-১১৭

মাধব মণি মুক্ত প্রবাল এবং বৈদূর্য্যের পৰ্বত হীরক-পৰ্বত ও রজতময় দেখিলেন। সুবর্ণ সমুদয়, রুক্মনির্মিত দণ্ড, রত্নময় ধ্বজ দেখিলেন। ১১৮

বিচিত্র বাহনসমূহ, যান, শয্যা এবং সুবর্ণখচিত মহামূল্যবান্ অনেক বস্তু দেখিলেন। ১১৯

যে যে মণিরত্নাদি ধনসমূহ নরকভবনে দেখিলেন, সেরূপ অন্যত্র কোথাও দেখেন নাই। ১২০

যে সমস্ত ধনরত্ন নরকভবনে আছে, সেরূপ–কুবের, ইন্দ্র, যম, বরুণ ইহাদের কাহারও নাই। ১২১

কেশব-নারদ ও পৃথিবীর সহিত সার হইতে সারতর পুরধন অবেক্ষণ করিলেন; তাহার মধ্যে তাহাদের গ্রহণীয় বস্তু গ্রহণ করিলেন। পরবীর-প্রহারিণী স্বদত্ত বৈষ্ণবী শক্তিও গ্রহণ করিলেন। ১২২-১২৩

তাহার পর কেশব–পৃথিবী ও নারদসহ নরকপুত্র ভগদত্তকে সেই শ্রেষ্ঠ প্ৰাগজ্যোতিষপুরে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়া বিশেষরূপে অভিনিবেশ করিলেন। ১২৪-১২৫

ক্ষিতি, ভগদত্তকে অভিষিক্ত দেখিয়া তাহার জন্য কেশব সমীপে সেই শক্তি পুনৰ্বার প্রার্থনা করিলেন। ১২৬

কেশবও নারদের অনুমতিতে ক্ষিতির বাক্যানুসারে প্রীত হইয়া সেই শক্তি ভগদত্তকে দিলেন। ১২৭

নরক বরুণকে জয় করিয়া যে কাঞ্চনস্রাবী ছত্র আনয়ন করিয়াছিলেন; কৃষ্ণ স্বয়ং তাহা গ্রহণ করিলেন। ১২৮

সেই ছত্র প্রতিদিন অষ্টভার সুবর্ণ প্রসব করে এবং একক্রোশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ও অর্ধ যোজন দীর্ঘ। ১২৯

কেশব উৎকৃষ্ট রত্ন সকল এবং চতুর্দন্ত মদস্রাবী শ্রেষ্ঠ, চতুর্দশসহস্র গজ– দৈত্যের দ্বারা দ্বারকাতে পাঠাইলেন। ১৩০-৩১

যে সমস্ত দেবকন্যাকে নরক হরণ করিয়াছিলেন, কেশব তাহাদের বেণী মোচন করিলেন। ১৩২

বস্ত্র ও ভূষণাদি দ্বারা তাহাদিগকে ভূষিত করত বিমানে আরোহণ করাইয়া দৃঢ় ও বলবান্ সৈন্য দ্বারা নারদ সহ দ্বারকাতে প্রেরণ করিলেন। ১৩৩

নরক সুরকন্যাগণের জন্য যে দিবাকর-তুল্য প্রভাশীল, রত্নসমূহ-খচিত, মণিপৰ্বত নিৰ্মাণ করিয়াছিলেন। ১৩৪

জগন্নাথ তাহা উৎপাটন করিয়া গরুড়পৃষ্ঠে স্থাপন করিলেন এবং সেইরূপ বরুণের ছত্রও গরুড়ের উপরে তুলিয়া সত্যভামার সহিত তাহাতে আরোহণ করিলেন। ১৩৫

জগৎপতি হরি–ভগদত্ত ও পৃথিবীকে সাদরবাক্য বলিয়া আকাশমার্গে দ্বারকাতে প্রস্থান করিলেন। ১৩৩

অষ্টভার-সুবর্ণস্রাবী ছত্র মণি-পৰ্বত, ও সত্যভামার সহিত কেশবকে বহন করিয়া গরুড় অবলীলাক্রমে গমন করিল। ১৩৭

তাহার পর ক্ষণকামধ্যেই পরবীরবিনাশক কেশব দ্বারকাতে উপস্থিত হইয়া বন্ধুগণ ও সুরগণের সহিত আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন। ১৩৮

অনুরাগ ও বিরাগের কারণ মহামায়া জগন্ময়ী কালিকা জগন্নাথ পরাপর– পতি জগৎকারণ জগৎকর্তা জ্ঞানগম্য জগন্ময় হরিকে এইরূপেই মোহিত করিয়া থাকে। ১৩৯-৪০

মূঢ় ব্যক্তিরা মিত্রকে অনুগ্রহ করেন এবং অমিত্রকেও বিনাশ করেন; এবং যুগলরূপে স্ত্রীতেই সর্বদা রমণ করে। ১৪১

হে বিপ্রগণ! যেরূপে নরকাসুর জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, যেরূপে বরলাভ করিয়াছিল, যেরূপ ব্যবহার করিয়াছে এবং বাণের বুদ্ধিতে যেরূপে ব্ৰহ্মাকে আরাধনা করিয়াছিল, সে সমস্তই আপনাদিগকে বলিলাম। হে দ্বিজোত্তমগণ। আপনাদের আর যে বিষয় জানিতে অভিলাষ হয়, জিজ্ঞাসা করুন। ১৪২-৪৩

চত্বারিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *