7 of 11

৩৭.১৩ ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ভক্তসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে

অনেক ভক্তেরা আসিয়াছেন। শ্রীযুক্ত বিজয় গোস্বামী, মহিমাচরণ, নারায়ণ, অধর, মাস্টার, ছোট গোপাল ইত্যাদি। রাখাল, বলরাম তখন শ্রীবৃন্দাবনধামে আছেন।

বেলা ৩-৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বারান্দায় কীর্তন শুনিতেছেন। কাছে নারাণ আসিয়া বসিলেন। অন্যান্য ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন।

এমন সময় অধর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অধরকে দেখিয়া ঠাকুর যেন শশব্যস্ত হইলেন। অধর প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলে ঠাকুর তাঁহাকে আরও কাছে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন।

কীর্তনিয়া কীর্তন সমাপ্ত করিলেন। আসর ভঙ্গ হইল। উদ্যানমধ্যে ভক্তেরা এদিক-ওদিক বেড়াইতেছেন। কেহ কেহ মা কালীর ও রাধাকান্তের মন্দিরে আরতি দর্শন করিতে গেলেন।

সন্ধ্যার পর ঠাকুরের ঘরে আবার ভক্তেরা আসিলেন।

ঠাকুরের ঘরের মধ্যে আবার কীর্তন হইবার উদ্যোগ হইতেছে। ঠাকুরের খুব উৎসাহ, বলিতেছেন যে, “এদিকে একটা বাতি দাও।” ডবল বাতি জ্বালিয়া দেওয়াতে খুব আলো হইল।

ঠাকুর বিজয়কে বলিতেছেন, “তুমি অমন জায়গায় বসলে কেন? এদিকে সরে এস।”

এবার সংকীর্তন খুব মাতামাতি হইল। ঠাকুর মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরা তাঁহাকে খুব বেড়াইয়া বেড়াইয়া নাচিতেছেন। বিজয় নৃত্য করিতে করিতে দিগম্বর হইয়া পড়িয়াছেন। হুঁশ নাই।

কীর্তনান্তে বিজয় চাবি খুঁজিতেছেন, কোথায় পড়িয়া গিয়াছে। ঠাকুর বলিতেছেন, “এখানেও একটা হরিবোল খায়।” এই বলিয়া হাসিতেছেন। বিজয়কে আরও বলিতেছেন, “ও সব আর কেন” (অর্থাৎ তার চাবির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কেন)!

কিশোরী প্রণাম করিয়া বিদায় লইতেছেন। ঠাকুর যেন স্নেহে আর্দ্র হইয়া তাঁহার বক্ষে হাত দিলেন আর বলিলেন, “তবে এসো।” কথাগুলি যেন করুণামাখা। কিয়ৎক্ষণ পরে মণি ও গোপাল কাছে আসিয়া প্রণাম করিলেন — তাঁহারা বিদায় লইবেন। আবার সেই স্নেহমাখা কথা। কথাগুলি হইতে যেন মধু ঝরিতেছে। বলিতেছেন, “কাল সকালে উঠে যেও, আবার হিম লাগবে?”

[ভক্ত সঙ্গে – ভক্তকথাপ্রসঙ্গে ]

মণি এবং গোপালের আর যাওয়া হইল না, তাঁহারা আজ রাত্রে থাকিবেন। তাঁহারা ও আরও ২/১ জন ভক্ত মেঝেতে বসিয়া আছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তীকে বলিতেছেন, “রাম, এখানে যে আর-একখানি পাপোশ ছিল। কোথায় গেল?”

ঠাকুর সমস্ত দিন অবসর পান নাই — একটু বিশ্রাম করিতে পান নাই। ভক্তদের ফেলিয়া কোথায় যাইবেন! এইবার একবার বর্হিদেশে যাইতেছেন। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, মণি রামলালের নিকট গান লিখিয়া লইতেছেন —

“তার তারিণি!
এবার ত্বরিত করিয়ে তপন-তনয়-ত্রাসিত” — ইত্যাদি।

ঠাকুর মণিকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কি লিখছো?” গানের কথা শুনিয়া বলিলেন, “এ যে বড় গান।”

রাত্রে ঠাকুর একটু সুজির পায়েস ও একখানি কি দুখানি লুচি খান। ঠাকুর রামলালকে বলিতেছেন, “সুজি কি আছে?”

গান এক লাইন দু’লাইন লিখিয়া মণি লেখা বন্ধ করিলেন।

ঠাকুর মেঝেতে আসনে বসিয়া সুজি খাইতেছেন।

ঠাকুর আবার ছোট খাটটিতে বসিলেন। মাস্টার খাটের পার্শ্বস্থিত পাপোশের উপর বসিয়া ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন। ঠাকুর নারায়ণের কথা বলিতে বলিতে ভাবযুক্ত হইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আজ নারায়ণকে দেখলুম।

মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, চোখ ভেজা। মুখ দেখে কান্না পেল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওকে দেখলে যেন বাৎসল্য হয়। এখানে আসে বলে ওকে বাড়িতে মারে। ওর হয়ে বলে এমন কেউ নাই। ‘কুব্জা তোমায় কু বোঝায়। রাইপক্ষে বুঝায় এমন কেউ নাই।’

মাস্টার (সহাস্যে) — হরিপদর বাড়িতে বই রেখে পলায়ন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওটা ভাল করে নাই।

ঠাকুর চুপ করিয়াছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, ওর খুব সত্তা। তা না হলে কীর্তন শুনতে শুনতে আমায় টানে! ঘরের ভিতর আমার আসতে হল। কীর্তন ফেলে আসা — এ কখনও হয় নাই।

ঠাকুর চুপ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওকে ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। তা এককথায় বললে — “আমি আনন্দে আছি।” (মাস্টারের প্রতি) তুমি ওকে কিছু কিনে মাঝে মাঝে খাইও — বাৎসল্যভাবে।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তেজচন্দ্রের কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — একবার ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখো, একেবার আমায় ও কি বলে, — জ্ঞানী, কি কি বলে? শুনলুম, তেজচন্দ্র নাকি বড় কথা কয় না। (গোপালের প্রতি) — দেখ্‌, তেজচন্দ্রকে শনি-মঙ্গলবারে আসতে বলিস।

[দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে — গোস্বামী, মহিমাচরণ প্রভৃতি সঙ্গে ]

মেঝেতে আসনের উপর ঠাকুর উপবিষ্ট। সুজি খাইতেছেন। পার্শ্বে একটি পিলসুজের উপর প্রদীপ জলিতেছে। ঠাকুরের কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “কিছু মিষ্টি কি আছে?” মাস্টার নূতন গুড়ের সন্দেশ আনিয়াছিলেন। রামলালকে বলিলেন, সন্দেশ তাকের উপর আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কি, আন না।

মাস্টার ব্যস্ত হইয়া তাক খুঁজিতে গেলেন। দেখিলেন, সন্দেশ নাই, বোধহয় ভক্তদের সেবায় খরচ হইয়াছে। অপ্রস্তুত হইয়া ঠাকুরের কাছে ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা একবার তোমার স্কুলে গিয়ে যদি দেখি —

মাস্টার ভাবিতেছেন, উনি নারায়ণকে স্কুলে দেখিতে যাইবার ইচ্ছা করিতেছেন।

মাস্টার — আমাদের বাসায় গিয়ে বসলে তো হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, একটা ভাব আছে। কি জানো, আর কেউ ছোকরা আছে কিনা একবার দেখতুম।

মাস্টার — অবশ্য আপনি যাবেন। অন্য লোক দেখতে যায়, সেইরূপ আপনিও যাবেন।

ঠাকুর আহারান্তে ছোট খাটটিতে গিয়া বসিলেন। একটি ভক্ত তামাক সাজিয়া দিলেন। ঠাকুর তামাক খাইতেছেন। ইতিমধ্যে মাস্টার ও গোপাল বারান্দায় বসিয়া রুটি ও ডাল ইত্যাদি জলখাবার খাইলেন। তাঁহারা নহবতে ঘরে শুইবেন ঠিক করিয়াছেন।

খাবার পর মাস্টার খাটের পার্শ্বস্থ পাপোশে আসিয়া বসিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — নহবতে যদি হাঁড়িকুড়ি থাকে? এখানে শোবে? এই ঘরে?

মাস্টার — যে আজ্ঞে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *