7 of 11

৩৫.১১ শ্রীরামকৃষ্ণের সব কামনা ত্যাগ — কেবল ভক্তিকামনা

একাদশ পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণের সব কামনা ত্যাগ — কেবল ভক্তিকামনা

শ্রীরামকৃষ্ণ — নারদকে রাম বললেন, তুমি আমার কাছে কিছু বর নাও। নারদ বললেন,রাম! আমার আর কী বাকী আছে? কি বর লব? তবে যদি একান্ত বর দিবে, এই বর দাও যেনতোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে, আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রামবললেন, নারদ! আর কিছু বর লও। নারদ আবার বললেন, রাম! আর কিছু আমি চাই না, যেনতোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধাভক্তি থাকে, এই করো!

“আমি মার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম; বলেছিলাম মা! আমি লোকমান্য চাই না মা,অষ্টসিদ্ধি চাই না মা, ও মা! শতসিদ্ধি চাই না মা, দেহসুখ চাই না মা, কেবল এই করো যেনতোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় মা।

“অধ্যাত্মে আছে, লক্ষ্মণ রামকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাম! তুমি কত ভাবে কত রূপে থাক,কিরূপে তোমায় চিনতে পারব? রাম বললেন, ‘ভাই! একটা কথা জেনে রাখ, যেখানে উজ্ঝিতা(ঊর্জিতা) ভক্তি, সেখানে নিশ্চই আমি আছি।’ উজ্ঝিতা (ঊর্জিতা) ভক্তিতে হাসে কাঁদে নাচে গায়!যদি কারু এরুপ ভক্তি হয়, নিশ্চয় জেনো, ঈশ্বর সেখানে স্বয়ং বর্তমান। চৈতন্যদেবের ওইরূপহয়েছিল।”

ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া শুনিতে লাগিলেন। দৈববাণীর ন্যায় এই সকল কথা শুনিতেছিলেন।কেহ ভাবিতেছেন, ঠাকুর বলিতেছেন, ‘প্রেমে হাসে কাঁদে নাচে গায়’; এ তো শুধু চৈতন্যদেবেরঅবস্থা নয়, ঠাকুরের তো এই অবস্থা। তবে কি এইখানে স্বয়ং ঈশ্বর সাক্ষাৎ বর্তমান?

ঠাকুরের অমৃতময়ী কথা চলিতেছে নিবৃত্তিমার্গের কথা। ঈশানকে যাহা মেঘগম্ভীরস্বরেবলিতেছেন — সেই কথা চলিতেছে।

[ঈশান খোসামুদে হতে সাবধান — শ্রীরামকৃষ্ণ ও জগতের উপকার ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি) — তুমি খোসামুদের কথায় ভুলো না। বিষয়ী লোক দেখলেইখোসামুদে এসে জুটে!

“মরা গরু একটা পেলে যত শকুনি এসে পড়ে।”

[সংসারীর শিক্ষা কর্মকাণ্ড — সর্বত্যাগীর শিক্ষা, কেবল ঈশ্বরের পাদপদ্ম চিন্তা ]

“বিষয়ী লোকগুলোর পদার্থ নাই। যেন গোবরের ঝোড়া! খোসামুদেরা এসে বলবে, আপনিদানী, জ্ঞানী, ধ্যানী। বলা তো নয় অমনি — বাঁশ! ও কি! কতকগুলো সংসারী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত নিয়েরাতদিন বসে থাকা, আর খোসামোদ শোনা!

“সংসারী লোকগুলো তিনজনের দাস, তাদের পদার্থ থাকে? মেগের দাস, টাকার দাস,মনিবের দাস। একজনের নাম করব না। আটশো টাকা মাইনে কিন্তু মেগের দাস, উঠতে বললেউঠে, বসতে বললে বসে!

“আর সালিসী, মোড়লী — এ-সব কাজ কি? দয়া, পরোপকার? — এ-সব তো অনেকহলো! ও-সব যারা করবে তাদের থাক্‌ আলাদা। তোমার ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন দিবার সময়হয়েছে। তাঁকে পেলে সব পাওয়া যায়। আগে তিনি, তারপর দয়া, পরোপকার, জগতের উপকার,জীব উদ্ধার। তোমার ও ভাবনায় কাজ কি?

“লঙ্কায় রাবণ মলো বেহুলা কেঁদে আকুল হলো।

“তাই হয়েছে তোমার। একজন সর্বত্যাগী তোমায় বলে দেয়, এই এই করো তবে বেশহয়। সংসারী লোকের পরামর্শে ঠিক হবে না। তা, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতই হউন আর যিনিই হউন।

[ঈশান পাগল হও — “এ সমস্ত উপদেশ মা দিলেন” ]

“পাগল হও, ঈশ্বরের প্রেমে পাগল হও। লোকে না হয় জানুক যে ঈশান এখন পাগলহয়েছে আর পারে না। তাহলে তারা সালসী মোড়লী করাতে আর তোমার কাছে আসবে না।কোশাকুশি ছুঁড়ে ফেলে দাও, ঈশান নাম সার্থক কর।

ঈশান — দে মা, পাগল করে। আর কাজ নাই মা জ্ঞানবিচারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — পাগল না ঠিক? শিবনাথ বলেছিল, বেশি ঈশ্বরচিন্তা কল্লে বেহেড হয়ে যায়।আমি বললুম, কি? — চৈতন্যকে চিন্তা করে কি কেউ অচৈতন্য হয়ে যায়? তিনিনিত্যশুদ্ধবোধরূপ। যাঁর বোধে সব বোধ কচ্ছে যাঁর চৈতন্যে সব চৈতন্যময়! বলে নাকি কেসাহেবদের হয়েছিল — বেশি চিন্তা করে বেহেড হয়ে গিয়েছিল। তা হতে পারে। তারা ঐহিকপদার্থ চিন্তা করে। ‘ভাবেতে ভরল তনু, হরল গেয়ান!’ এতে যে জ্ঞানের (গেয়ানের) কথা আছে,সে জ্ঞান মানে বাহ্যজ্ঞান।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণ স্পর্শ করিয়া ঈশান বসিয়া আছেন ও সমস্ত কথা শুনিতেছেন।তিনি এক-একবার মন্দিরমধ্যবর্তী পাষাণময়ী কালীপ্রতিমার দিকে চাহিতেছিলেন। দীপালোকেমার মুখ হাসিতেছে, যেন দেবী আবির্ভূতা হইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বেদমন্ত্রতুল্যবাক্যগুলি শুনিয়া আনন্দ করিতেছেন।

ঈশান (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — যে-সব কথা আপনি শ্রীমুখে বললেন, ও সব কথা ওইখানথেকে এসেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি যন্ত্র, উনি যন্ত্রী; — আমি ঘর, উনি ঘরণী; — আমি রথ, উনি রথী; উনিযেমন চালান, তেমনি চলি; যেমন বলান, তেমন বলি।

“কলিযূগে অন্যপ্রকার দৈববাণী হয় না। তবে আছে, বালক কি পাগল, এদের মুখ দিয়েতিনি কথা কন।

“মানুষ গুরু হতে পারে না। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে। মহাপাতক, অনেকদিনেরপাতক, অনেকদিনের অজ্ঞান, তাঁর কৃপা হলে একক্ষণে পালিয়ে যায়।

“হাজার বছরের অন্ধকার ঘরের ভিতর যদি হঠাৎ আলো আসে, তাহলে সেই হাজার বছরেরঅন্ধকার কি একটু একটু করে যায়, না একক্ষণে যায়? অবশ্য আলো দেখালেই সমস্ত অন্ধকারপালিয়ে যায়।

“মানুষ কি করবে। মানুষ অনেক কথা বলে দিতে পারে, কিন্তু শেষে সব ঈশ্বরের হাত।উকিল বলে, আমি যা বলবার সব বলেছি, এখন হাকিমের হাত।

“ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। তিনি যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় — এই সকল কাজ করেন, তখন তাঁকেআদ্যাশক্তি বলে। সেই আদ্যাশক্তিকে প্রসন্ন করতে হয়। চণ্ডীতে আছে জান না? দেবতারা আগেআদ্যাশক্তির স্তব কল্লেন। তিনি প্রসন্ন হলে তবে হরির যোগনিদ্রা ভাঙবে।”

ঈশান — আজ্ঞা, মধুকৈটভ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা স্তব করছেন —

ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্‌কারঃ স্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।।
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে।।[]

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ ওইটি ধারণা।


তুমি হোম, শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞে প্রযুজ্য স্বাহা, স্বধা ও বষট্‌কাররূপে মন্ত্রস্বরূপা এবং দেবভক্ষ্য সুধাও তুমি। হে নিত্যে! তুমি অক্ষর সমুদায়ে হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত এই তিন প্রকার মাত্রাস্বরূপ হইয়া অবস্থান করিতেছ এবং যাহা বিশেষরূপে অনুচার্য ও অর্দ্ধমাত্রারূপে অবস্থিত, তাহাও তুমি। তুমিই সেই (বেদ সারভূতা) সাবিত্রী; হে দেবি! তুমিই আদি জননী। তোমা কর্তৃকই সমস্ত জগৎ ধৃত এবং তোমা কর্তৃকই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। তোমা কর্তৃকই এই জগৎ পালিত হইতেছে এবং তুমিই অন্তে ইহা ভক্ষণ (ধ্বংস) করিয়া থাক। হে জগদ্রূপে! তুমিই এই জগতের নানাপ্রকার নির্মাণকার্যে সৃষ্টিরূপা ও পালনকার্যে স্থিতিরূপা এবং অন্তে ইহার সংহার কার্যে তদ্রূপ সংহাররূপা।

[মার্কণ্ডেয় চন্ডী, ১।৭২ — ৭৬]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *