4 of 11

২০.১২ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মাস্টার, মণিলাল প্রভৃতি সঙ্গে

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৪শে ফেব্রুয়ারি

দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মাস্টার, মণিলাল প্রভৃতি সঙ্গে

[ঠাকুর অধৈর্য কেন? মণি মল্লিকের প্রতি উপদেশ ]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্নে সেবার পর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মেঝেতে মণি মল্লিক বসিয়া আছেন। আজ রবিবার, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, ১৩ই ফাল্গুন, ১২৯০ সাল।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — কিসে করে এলে?

মাস্টার — আজ্ঞা, আলমবাজার পর্যন্ত গাড়ি করে এসে ওখান থেকে হেঁটে এসেছি।

মণিলাল — উঃ! খুব ঘেমেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তাই ভাবি, আমার এ-সব বাই নয়! তা না হলে ইংলিশম্যানরা এত কষ্ট করে আসে!

ঠাকুর কেমন আছেন — হাত ভাঙার কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি এইটার জন্য এক-একবার অধৈর্য হই — একে দেখাই — আবার ওকে দেখাই — আর বলি, হ্যাঁগা, ভাল হবে কি? রাখাল চটে, — আমার অবস্থা বোঝে না। এক-একবার মনে করি এখান থেকে যায় যাক — আবার মাকে বলি, মা কোথায় যাবে — কোথায় জ্বলতে পুড়তে যাবে!

“আমার বালকের মতো অধৈর্য অবস্থা আজ বলে নয়। সেজোবাবুকে হাত দেখাতাম, বলতাম, হ্যাঁগা আমার কি অসুখ করেছে?

“আচ্ছা তাহলে ঈশ্বরে নিষ্ঠা কই? ও-দেশে যাবার সময় গোরুর গাড়ির কাছে ডাকাতের মতো লাঠি হাতে কতকগুলো মানুষ এলো! আমি ঠাকুরদের নাম করতে লাগলাম। কিন্তু কখন বলি রাম, কখন দুর্গা, কখন ওঁ তৎসৎ — যেটা খাটে।

(মাস্টারের প্রতি) — “আচ্ছা কেন এত অধৈর্য আমার?”

মাস্টার — আপনি সর্বদাই সমাধিস্থ — ভক্তদের জন্য একটু মন শরীরের উপর রেখেছেন, তাই — শরীর রক্ষার জন্য এক-একবার অধৈর্য হন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, একটু মন আছে কেবল শরীরে, — আর ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকতে।

[Exhibition দর্শন প্রস্তাব — ঠাকুরের চিড়িয়াখানা Zoological Garden দর্শন কথা ]

মণিলাল মল্লিক এগ্‌জিবিশনের গল্প করিতেছেন।

যশোদা কৃষ্ণকে কোলে করে আছেন — বড় সুন্দর মূর্তি — শুনে ঠাকুরের চক্ষে জল আসিয়াছে। সেই বাৎসল্যরসের প্রতিমা যশোদার কথা শুনিয়া ঠাকুরের উদ্দীপন হইয়াছে — তাই কাঁদিতেছেন।

মণিলাল — আপনার অসুখ, — তা না হলে আপনি একবার গিয়ে দেখে আসতেন — গড়ের মাঠের প্রদর্শনী।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আমি গেলে সব দেখতে পাব না! একটা কিছু দেখেই বেহুঁশ হয়ে যাব — আর কিছু দেখা হবে না। চিড়িয়াখানা দেখাতে লয়ে গিছল। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম! ঈশ্বরীয় বাহনকে দেখে ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হল — তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে! সিংহ দেখেই ফিরে এলাম! তাই যদু মল্লিকের মা একবার বলে, এগ্‌জিবিশনে এঁকে নিয়ে চল — আবার বলে, না।

মণি মল্লিক পুরাতন ব্রহ্মজ্ঞানী। বয়স প্রায় ৬৫ হইয়াছে। ঠাকুর তাঁহারই ভাবে কথাচ্ছলে, তাঁহাকে উপদেশ দিতেছেন।

[পূর্বকথা — জয়নারায়ণ পণ্ডিতদর্শন — গৌরীপণ্ডিত ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — জয়নারায়ণ পণ্ডিত খুব উদার ছিল। গিয়ে দেখলাম বেশ ভাবটি। ছেলেগুলি বুট্‌ পরা; নিজে বললে আমি কাশী যাব। যা বললে তাই শেষে কল্লে। কাশীতে বাস — আর কাশীতেই দেহত্যাগ হল।

“বয়স হলে সংসার থেকে ওইরকম চলে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করা ভাল। কি বল?”

মণিলাল — হাঁ, সংসারের ঝঞ্ঝাট ভাল লাগে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — গৌরী স্ত্রীকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে পূজা করত। সকল স্ত্রীই ভগবতীর এক-একটি রূপ।

(মণিলালের প্রতি) — “তোমার সেই কথাটি এঁদের বলতো গা।”

মণিলাল (সহাস্যে) — নৌকা করে কয়জন গঙ্গা পার হচ্ছিল। একজন পণ্ডিত বিদ্যার পরিচয় খুব দিচ্ছিল। “আমি নানা শাস্ত্র পড়িছি — বেদ-বেদান্ত — ষড়দর্শন।” একজনকে জিজ্ঞাসা কল্লে — “বেদান্ত জান?” সে বললে — “আজ্ঞা না।” “তুমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জান?” — “আজ্ঞা না।” “দর্শন-টর্শন কিছুই পড় নাই?” — “আজ্ঞা না।”

“পণ্ডিত সগর্বে কথা কহিতেছেন ও লোকটি চুপ করে বসে আছে। এমন সময়ে ভয়ঙ্কর ঝড় — নৌকা ডুবতে লাগল। সেই লোকটি বললে, ‘পণ্ডিতজী, আপনি সাঁতার জানেন?’ পণ্ডিত বললেন, ‘না’। সে বললে, ‘আমি সাংখ্য, পাতঞ্জল জানি না, কিন্তু সাঁতার জানি’।”

[ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু — লক্ষ্য বেঁধা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — নানা শাস্ত্র জানলে কি হবে। ভবনদী পার হতে জানাই দরকার। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু।

“লক্ষ্য ভেদের সময় দ্রোণাচার্য অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ? এই রাজাদের কি তুমি দেখতে পাচ্ছ?’ অর্জুন বললেন, ‘না’। ‘আমাকে দেখতে পাচ্ছ?’ — ‘না’। ‘গাছ দেখতে পাচ্ছ?’ — ‘না’। ‘গাছের উপর পাখি দেখতে পাচ্ছ?’ — ‘না’। ‘তবে কি দেখতে পাচ্ছ?’ — ‘শুধু পাখির চোখ।’

“যে শুধু পাখির চোখটি দেখতে পায় সেই লক্ষ্য বিঁধতে পারে।

“যে কেবল দেখে, ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু, সেই চতুর। অন্য খবরে আমাদের কাজ কি? হনুমান বলেছিল, আমি তিথি নক্ষত্র অত জানি না, কেবল রাম চিন্তা করি।

(মাস্টারের প্রতি) — “খানকতক পাখা এখানকার জন্য কিনে দিও।

(মণিলালের প্রতি) — “ওগো তুমি একবার এঁর (মাস্টারের) বাবার কাছে যেও। ভক্ত দেখলে উদ্দীপন হবে।”


 শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৬৯-এর পূর্বে পণ্ডিতকে দেখিয়াছিলেন। পণ্ডিত জয়নারায়ণের কাশী গমন — ১৮৬৯। জন্ম — ১৮০৪। কাশীপ্রাপ্তি — ১৮৭৩ খ্রীঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *