4 of 11

২০.১০ মহিমাচরণের শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ ও ঠাকুরের সমাধি

দশম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি

মহিমাচরণের শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ ও ঠাকুরের সমাধি

কথা কহিতে কহিতে রাত আটটা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে শাস্ত্র হইতে কিছু স্তবাদি শুনাইতে বলিলেন। মহিমাচরণ একখানি বই লইয়া উত্তর গীতার প্রথমেই পরব্রহ্মসম্বন্ধীয় যে শ্লোক তাহা শুনাইতেছেন —

“যদেকং নিষ্কলং ব্রহ্ম ব্যোমাতীতং নিরঞ্জনম্‌।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং বিনাশোৎপত্তিবর্জিতম্‌ ৷৷”

ক্রমে তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোক পড়িতেছেন —

“অগ্নির্দেবো দ্বিজাতীনাং মুনীনাং হৃদি দৈবতম্‌।
প্রতিমা স্বল্পবুদ্ধীনাং সর্বত্র সমদর্শিনাম্‌ ৷৷”

অর্থাৎ ব্রাহ্মদিগের দেবতা অগ্নি, মুনিদিগের দেবতা হৃদয়মধ্যে — স্বল্পবুদ্ধি মনুষ্যদের প্রতিমাই দেবতা, আর সমদর্শী মহাযোগীদিগের দেবতা সর্বত্রই আছেন।

“সর্বত্র সমদর্শিনাম” — এই কথা উচ্চারণ করিবামাত্র ঠাকুর হঠাৎ আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। হাতে সেই বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ভক্তেরা সকলেই অবাক্‌ — এই সমদর্শী মহাযোগীর অবস্থা নিরীক্ষণ করিতেছেন।

অনেকক্ষণ এইরূপে দাঁড়াইয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন। মহিমাচরণকে এইবার সেই হরিভক্তির শ্লোক আবৃত্তি করিতে বলিলেন। মহিমা নারদপঞ্চরাত্র হইতে আবৃত্তি করিতেছেন —

অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।
নান্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
বিরম বিরম ব্রহ্মন্‌ কিং তপস্যাসু বৎস।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্‌ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্‌।
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ৷৷

শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা! আহা!

[ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ড — তুমিই চিদানন্দ — নাহং নাহং ]

শ্লোকগুলির আবৃত্তি শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইতেছিলেন। কষ্টে ভাব সংবরণ করিলেন। এইবার যতিপঞ্চক পাঠ হইতেছে —

যস্যামিদং কল্পিতমিন্দ্রজালং, চরাচরং ভাতি মনোবিলাসম্‌।
সচ্চিৎসুখৈকং জগদাত্মরূপং, সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্‌ ৷৷

“সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্‌” — এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন, “যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”

এইবার পাঠ হইতেছে নির্বাণষট্‌কম্‌ —

ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ু —
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽ হং শিবোঽ হম্‌ ৷৷

যতবার মহিমাচরণ বলিতেছেন — চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্‌, ততবারই ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন —

“নাহং! নাহং — তুমি তুমি চিদানন্দ।”

মহিমাচরণ জীবন্মুক্তি গীতা থেকে কিছু পড়িয়া ষট্‌চক্রবর্ণনা পড়িতেছেন। তিনি নিজে কাশীতে যোগীর যোগাবস্থায় মৃত্যু দেখিয়াছিলেন, বলিলেন।

এইবার ভূচরী ও খেচরী মুদ্রার বর্ণনা করিতেছেন, ও সাম্ভবী বিদ্যার।

সাম্ভবী; — যেখানে সেখানে যায়, কোন উদ্দেশ্য নাই।

[পূর্বকথা — সাধুদের কাছে ঠাকুরের রামগীতাপাঠ শ্রবণ ]

মহিমা — রামগীতায় বেশ বেশ কথা আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) –তুমি রামগীতা রামগীতা কচ্ছো, — তবে তুমি ঘোর বেদান্তী! সাধুরা কত পড়ত এখানে।

মহিমাচরণ প্রণব শব্দ কিরূপ তাই পড়িতেছেন — “তৈলধারামবিচ্ছিন্নম্‌ দীর্ঘঘন্টানিনাদবৎ”! আবার সমাধির লক্ষণ বলিতেছেন —

“ঊর্ধ্বপূর্ণমধঃপূর্ণং মধ্যপূর্ণং যদাত্মকম্‌।
সর্বপূর্ণং স আত্মেতি সমাধিস্থস্য লক্ষণম্‌ ৷৷”

অধর, মহিমাচরণ ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *