4 of 11

২০.০৪ সাধনকালে বেলতলায় ধ্যান ১৮৫৯-৬১ — কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৫ই জানুয়ারি

সাধনকালে বেলতলায় ধ্যান ১৮৫৯-৬১ — কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ
[শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি গমন — রঘুবীরের জমি রেজিস্ট্রি — ১৮৭৮-৮০ 
]

ঠাকুরের মধ্যাহ্ন সেবা হইয়াছে। বেলা প্রায় ১টা। শনিবার, ৫ই জানুয়ারি। মণির আজ প্রভুসঙ্গে ত্রয়োবিংশতি দিবস।

মণি আহারান্তে নবতে ছিলেন — হঠাৎ শুনিলেন, কে তাহার নাম ধরিয়া তিন-চারবার ডাকিলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, ঠাকুরের ঘরের উত্তরের লম্বা বারান্দা হইতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাহাকে ডাকিতেছেন। মণি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।

দক্ষিণের বারান্দায় ঠাকুর মণির সহিত বসিয়া কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমরা কিরকম ধ্যান কর? আমি বেলতলায় স্পষ্ট নানা রূপ দর্শন করতাম। একদিন দেখলাম সামনে টাকা, শাল, একসরা সন্দেশ, দুজন মেয়েমানুস। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম, মন! তুই এ-সব কিছু চাস? — সন্দেশ দেখলাম গু! মেয়েদের মধ্যে একজনের ফাঁদি নথ। তাদের ভিতর বাহির সব দেখতে পাচ্ছি — নাড়ীভুঁড়ি, মল-মূত্র, হাড়-মাংস, রক্ত। মন কিছুই চাইলে না।

“তাঁর পাদপদ্মেতেই মন রহিল। নিক্তির নিচের কাঁটা আর উপরের কাঁটা — মন সেই নিচের কাঁটা। পাছে উপরের কাঁটা (ঈশ্বর) থেকে মন বিমুখ হয় সদাই আতঙ্ক। একজন আবার শূল হাতে সদাই কাছে এসে বসে থাকত; ভয় দেখালে, নিচের কাঁটা উপরের কাঁটা থেকে তফাত হলেই এর বাড়ি মারব।

“কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না হলে হবে না। আমি তিন ত্যাগ করেছিলাম — জমিন, জরু, টাকা।রঘুবীরের নামের জমি ও-দেশে রেজিস্ট্রি করতে গিছলাম। আমায় সই করতে বললে। আমি সই করলুম না। ‘আমার জমি’ বলে তো বোধ নাই। কেশব সেনের গুরু বলে খুব আদর করেছিল। আম এনে দিলে। তা বাড়ি নিয়ে যাবার জো নাই। সন্ন্যাসীর সঞ্চয় করতে নাই।

“ত্যাগ না হলে কেমন করে তাঁকে লাভ করা যাবে! যদি একটা জিনিসের পর আর একটা জিনিস থাকে, তাহলে প্রথম জিনিসটাকে না সরালে, কেমন করে একটা জিনিস পাবে?

“নিষ্কাম হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। তবে সকাম ভজন করতে করতে নিষ্কাম হয়। ধ্রুব রাজ্যের জন্য তপস্যা করেছিলেন, কিন্তু ভগবানকে পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যদি কাচ কুড়ুতে এসে কেউ কাঞ্চন পায়, তা ছাড়বে কেন’?”

[দয়া, দানাদি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — চৈতন্যদেবের দান ]

“সত্ত্বগুণ এলে তবে তাঁকে লাভ করা যায়।

“দানাদি কর্ম সংসারী লোকের প্রায় সকামই হয় — সে ভাল না। তবে নিষ্কাম করলে ভাল। কিন্তু নিষ্কাম করা বড় কঠিন।

“সাক্ষাৎকার হলে ঈশ্বরের কাছে কি প্রার্থনা করবে যে ‘আমি কতকগুলো পুকুর, রাস্তা, ঘাট, ডিস্পেনসারি, হাসপাতাল — এই সব করব, ঠাকুর আমায় বর দাও। তাঁর সাক্ষাৎকার হলে ও-সব বাসনা একপাশে পড়ে থাকে।

“তবে দয়ার কাজ — দানাদি কাজ — কি কিছু করবে না?

“তা নয়। সামনে দুঃখ কষ্ট দেখলে টাকা থাকলে দেওয়া উচিত। জ্ঞানী বলে, ‘দে রে দে রে, এরে কিছু দে।’ তা না হলে, ‘আমি কি করতে পারি, — ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা’ এইরূপ বোধ হয়।

“মহাপুরুষেরা জীবের দুঃখে কাতর হয়ে ভগবানের পথ দেখিয়ে দেন। শঙ্করাচার্য জীবশিক্ষার জন্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।

“অন্নদানের চেয়ে জ্ঞানদান, ভক্তিদান আরও বড়। চৈতন্যদেব তাই আচণ্ডালে ভক্তি বিলিয়েছিলেন। দেহের সুখ-দুঃখ তো আছেই। এখানে আম খেতে এসেছ, আম খেয়ে যাও। জ্ঞান-ভক্তির প্রয়োজন। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু।”

[স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) কি আছে, ঠাকুরের সিদ্ধান্ত ]

“তিনি সব কচ্ছেন। যদি বল তাহলে লোকে পাপ করতে পারে। তা নয় — যার ঠিক বোধ হয়েছে ‘ঈশ্বর কর্তা আমি অকর্তা’ তার আর বেতালে পা পড়ে না।

“ইংলিশম্যান-রা যাকে স্বাধীন ইচ্ছা (Free will) বলে, সেই স্বাধীন ইচ্ছাবোধ তিনিই দিয়ে রাখেন।

“যারা তাঁকে লাভ করে নাই, তাদের ভিতর ওই স্বাধীন ইচ্ছাবোধ না দিলে পাপের বৃদ্ধি হত। নিজের দোষে পাপ কচ্ছি, এ-বোধ যদি তিনি না দিতেন, তাহলে পাপের আরও বৃদ্ধি হত।

“যারা তাঁকে লাভ করেছে, তারা জানে দেখতেই ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ — বস্তুতঃ তিনিই যন্ত্রী, আমি যন্ত্র। তিনি ইঞ্জিনিয়ার, আমি গাড়ি।”

 


 ভিক্ষুঃ সৌবর্ণাদীনাং নৈব পরিগ্রহেৎ
যস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন দৃষ্টং চ স ব্রহ্মহা ভবেৎ।
যস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন স্পৃষ্টং চেৎ পৌল্কসো ভবেৎ।
যস্মদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন গ্রাহ্যং চ স আত্মহা ভবেৎ।
তস্মাদভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন ন দৃষ্টঞ্চ স্পৃষ্টঞ্চ ন গ্রাহ্যঞ্চ।                     [পরমহংসোপনিষদ্‌]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *