১.৪ চন্দ্রাদেবীর বিচিত্র অনুভব

প্রথম খণ্ড – চতুর্থ অধ্যায়: চন্দ্রাদেবীর বিচিত্র অনুভব

অবতারপুরুষের আবির্ভাবকালে তাঁহার জনক-জননীর দিব্য অনুভবাদি সম্বন্ধে শাস্ত্রকথা

জগৎপাবন মহাপুরুষসকলের জন্মপরিগ্রহ করিবার কালে তাঁহাদিগের জনক-জননীর জীবনে অসাধারণ আধ্যাত্মিক অনুভব ও দর্শনসমূহ উপস্থিত হইবার কথা পৃথিবীস্থ সকল জাতির ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ, মায়াদেবীতনয় বুদ্ধ, মেরীনন্দন ঈশা, শ্রীভগবান শঙ্কর, মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভৃতি যে-সকল মহামহিম পুরুষপ্রবর মানবমনের ভক্তিশ্রদ্ধাপূত পূজার্ঘ্য অদ্যাবধি প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত হইতেছেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের জনক-জননীর সম্বন্ধেই ঐরূপ কথা শাস্ত্রনিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রমাণস্বরূপে নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা এখানে স্মরণ করিলেই যথেষ্ট হইবে –

যজ্ঞাবশিষ্ট পাত্রাবশেষ বা চরু ভোজন করিয়া ভগবান শ্রীরামচন্দ্রপ্রমুখ ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের জননীগণের গর্ভধারণের কথা কেবলমাত্র রামায়ণপ্রসিদ্ধ নহে, কিন্তু ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্বে ও পরে তাঁহারা যে বহুবার উক্ত ভ্রাতৃচতুষ্টয়কে জগৎপাতা শ্রীভগবান বিষ্ণুর অংশসম্ভূত ও দিব্যশক্তিসম্পন্ন বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, একথাও উহাতে লিপিবদ্ধ আছে।

শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণের জনক-জননী তাঁহার গর্ভপ্রবেশকালে এবং ভূমিষ্ঠ হইবার অব্যবহিত পরে তাঁহাকে ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন মূর্তিমান ঈশ্বররূপে অনুভব করিয়াছিলেন; তদ্ভিন্ন তাঁহার জন্মগ্রহণের পরক্ষণ হইতে প্রতিদিন তাঁহাদিগের জীবনে নানা অদ্ভুত উপলব্ধির কথা শ্রীমদ্ভাগবতাদি পুরাণসকলে লিপিবদ্ধ আছে।

শ্রীভগবান বুদ্ধদেবের গর্ভপ্রবেশকালে শ্রীমতী মায়াদেবী দর্শন করিয়াছিলেন, জ্যোতির্ময় শ্বেত হস্তীর আকার ধারণপূর্বক কোন পুরুষপ্রবর যেন তাঁহার উদরে প্রবেশ করিতেছেন এবং তাঁহার সৌভাগ্যদর্শনে ইন্দ্রপ্রমুখ যাবতীয় দেবগণ যেন তাঁহাকে বন্দনা করিতেছেন।

শ্রীভগবান ঈশার জন্মগ্রহণকালে তজ্জননী শ্রীমতী মেরী অনুভব করিয়াছিলেন, নিজ স্বামী শ্রীযুত যোষেফের সহিত সঙ্গতা হইবার পূর্বেই যেন তাঁহার গর্ভ উপস্থিত হইয়াছে – অননুভূতপূর্ব দিব্য আবেশে আবিষ্ট ও তন্ময় হইয়াই তাঁহার গর্ভলক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে।

শ্রীভগবান শঙ্করের জননী অনুভব করিয়াছিলেন, দেবাদিদেব মহাদেবের দিব্যদর্শন ও বরলাভেই তাঁহার গর্ভধারণ হইয়াছে।

শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের জননী শ্রীমতী শচীদেবীর জীবনেও পূর্বোক্ত প্রকার নানা দিব্য অনুভব উপস্থিত হইবার কথা ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ প্রমুখ গ্রন্থসকলে লিপিবদ্ধ আছে।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি যাবতীয় ধর্ম ঈশ্বরের সপ্রেম উপাসনাকে মুক্তিলাভের সুগম পথ বলিয়া মানবের নিকট নির্দেশ করিয়াছে; তাহাদিগের সকলেই ঐরূপে ঐ বিষয়ে একমত হওয়ায় নিরপেক্ষ বিচারকের মনে স্বতই প্রশ্নের উদয় হয়, উহার ভিতর বাস্তবিক কোন সত্য প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে কি-না এবং মহাপুরুষগণের জীবনেতিহাসে বর্ণিত ঐসকল আখ্যায়িকার ভিতর কতটা গ্রহণ এবং কতটা বা ত্যাগ করা বিধেয়।

ঐ শাস্ত্রকথার যুক্তিনির্দেশ

যুক্তি অন্যপক্ষে মানবকে ইঙ্গিত করিয়া থাকে যে, কথাটার ভিতর কিছু সত্য থাকিলেও থাকিতে পারে। কারণ, বর্তমান যুগের বিজ্ঞান যখন উচ্চপ্রকৃতিসম্পন্ন পিতামাতারই উদার চরিত্রবান পুত্রোৎপাদনের সামর্থ্য স্বীকার করিয়া থাকে, তখন শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ ও ঈশাদির ন্যায় মহাপুরুষগণের জনক-জননী যে বিশেষ সদ্গুণসম্পন্ন ছিলেন, একথা গ্রহণ করিতে হয়। তৎসঙ্গে ইহাও স্বীকার করিতে হয় যে, ঐ সকল পুরুষোত্তমকে জন্মপ্রদানকালে তাঁহাদিগের মন সাধারণ মানবাপেক্ষা অনেক উচ্চ ভূমিতে অবস্থান করিয়াছিল এবং ঐরূপে উচ্চ ভূমিতে অবস্থানের জন্যই তাঁহারা ঐ কালে অসাধারণ দর্শন ও অনুভবাদির অধিকারী হইয়াছিলেন।

সহজে বিশ্বাসগম্য না হইলেও ঐসকল কথা মিথ্যা বলিয়া ত্যাজ্য নহে

কিন্তু পুরাণেতিহাস ঐ বিষয়ক নানা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিলেও এবং যুক্তি ঐকথা ঐরূপে সমর্থন করিলেও, মানবমন উহাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী হইতে পারে না। কারণ, উহা সর্বোপরি নিজ প্রত্যক্ষের উপরেই বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সেজন্য আত্মা, ঈশ্বর, মুক্তি, পরকাল প্রভৃতি বিষয়সকলেও অপরোক্ষানুভূতির পূর্বে কখনও নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিতে পারে না। ঐরূপ হইলেও কিন্তু নিরপেক্ষ বিচার-বুদ্ধি অসাধারণ বা অলৌকিক বলিয়াই কোন বিষয়কে ত্যাজ্য মনে করে না – কিন্তু স্বয়ং সাক্ষিস্বরূপ থাকিয়া স্থিরভাবে তদ্বিষয়ে স্বপক্ষ ও বিপক্ষ প্রমাণসকল সংগ্রহে অগ্রসর হয় এবং উপযুক্ত কালে তদ্বিষয় মিথ্যা বলিয়া ত্যাগ অথবা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়া থাকে।

সে যাহা হউক, যে মহাপুরুষের জীবনেতিহাস আমরা লিখিতে বসিয়াছি, তাঁহার জন্মকালে তাঁহার জনক-জননীর জীবনেও নানা দিব্যদর্শন ও অনুভবসমূহ উপস্থিত হইয়াছিল, একথা আমরা অতি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি। সুতরাং সেই সকল কথা লিপিবদ্ধ করা ভিন্ন আমাদিগের গত্যন্তর নাই। পূর্ব অধ্যায়ে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের সম্বন্ধে ঐরূপ কয়েকটি কথা পাঠককে বলিয়াছি। বর্তমান অধ্যায়ে শ্রীমতী চন্দ্রমণি সম্বন্ধে ঐরূপ সকল কথা আমরা এখানে লিপিবদ্ধ করিলাম।

গয়া হইতে ফিরিয়া ক্ষুদিরামের চন্দ্রাদেবীর ভাব-পরিবর্তন দর্শন

আমরা ইতিপূর্বে বলিয়াছি, ৺গয়াধামে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম যে অদ্ভুত স্বপ্ন দর্শন করিয়াছিলেন, গৃহে ফিরিয়া তাহার কথা কাহাকেও না বলিয়া তিনি নীরবে উহার ফলাফল লক্ষ্য করিয়াছিলেন। ঐ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে যাইয়া শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীর স্বভাবের অদ্ভুত পরিবর্তন প্রথমেই তাঁহার নয়নে পতিত হইয়াছিল। তিনি দেখিয়াছিলেন, মানবী চন্দ্রা এখন যেন সত্য সত্যই দেবীত্ব পদবীতে আরূঢ়া হইয়াছেন! কোথা হইতে একটা সর্বজনীন প্রেম আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়া সংসারের বাসনাময় কোলাহল হইতে তাঁহাকে যেন অনেক উচ্চে তুলিয়া রাখিয়াছে। আপনার সংসারের চিন্তা অপেক্ষা শ্রীমতী চন্দ্রার মনে এখন অভাবগ্রস্ত প্রতিবেশিসকলের সংসারের চিন্তাই প্রবল হইয়াছে। নিজ সংসারের কর্তব্যপালন করিতে করিতে তিনি দশবার ছুটিয়া যাইয়া তাহাদিগের তত্ত্বাবধান করিয়া আসেন এবং আহার্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুসকলের ভিতর যাহার যে বস্তুর অভাব দেখেন, আপন সংসার হইতে লুকাইয়া লইয়া যাইয়া তিনি তৎক্ষণাৎ ঐসকল তাহাদিগকে প্রদান করিয়া থাকেন। আবার ৺রঘুবীরের সেবা সারিয়া স্বামীপুত্রাদিকে ভোজন করাইয়া বেলা তৃতীয় প্রহরে স্বয়ং ভোজনে বসিবার পূর্বে শ্রীমতী চন্দ্রা পুনরায় তাহাদিগের প্রত্যেকের বাটীতে যাইয়া সংবাদ লইয়া আসেন, তাহাদিগের সকলের ভোজন হইয়াছে কি-না। যদি কোন দিন দেখিতে পান যে, কোন কারণে কাহারও আহার জুটে নাই, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে সাদরে বাটীতে আনয়নপূর্বক নিজের অন্ন ধরিয়া দিয়া স্বয়ং হৃষ্টচিত্তে সামান্য জলযোগমাত্র করিয়া দিন কাটাইয়া দেন।

চন্দ্রাদেবীর অপত্যস্নেহের প্রসারদর্শন

শ্রীমতী চন্দ্রা প্রতিবেশী বালকবালিকাগণকে চিরকাল অপত্যনির্বিশেষে ভালবাসিতেন। ক্ষুদিরাম দেখিলেন, তাঁহার সেই অপত্যস্নেহ এখন যেন দেবতাসকলের উপরও প্রসারিত হইয়াছে। কুলদেবতা ৺রঘুবীরকে তিনি এখন আপন পুত্রগণের অন্যতমরূপে সত্য সত্যই দর্শন করিতেছেন এবং ৺শীতলাদেবীর ও ৺রামেশ্বর বাণলিঙ্গটিও যেন তাঁহার হৃদয়ে ঐরূপ স্থান অধিকার করিয়াছে। ঐসকল দেবতার সেবাপূজাকালে ইতিপূর্বে তাঁহার অন্তর শ্রদ্ধাপূর্ণ ভয়ে সর্বদা পূর্ণ থাকিত; ভালবাসা আসিয়া সেই ভয়কে যেন এখন কোথায় অন্তর্হিত করিয়াছে। দেবতাগণের নিকটে তাঁহার এখন আর ভয় নাই, সঙ্কোচ নাই, লুকাইবার এবং চাহিবার যেন কিছুই নাই! আছে কেবল তৎস্থলে আপনার হইতে আপনার বলিয়া তাঁহাদিগকে জ্ঞান করা, তাঁহাদিগকে সুখী করিবার জন্য সর্বস্বপ্রদানের ইচ্ছা এবং তাঁহাদিগের সহিত চিরসম্বন্ধ হওয়ার অনন্ত উল্লাস।

তদ্দর্শনে ক্ষুদিরামের চিন্তা ও সঙ্কল্প

ক্ষুদিরাম বুঝিলেন, ঐরূপ নিঃসঙ্কোচ দেবভক্তি ও নির্ভর-প্রসূত উল্লাসই সরলহৃদয়া চন্দ্রাকে এখন অধিকতর উদারস্বভাবা করিয়াছে। উহাদিগের প্রভাবেই তিনি এখন কাহাকেও অবিশ্বাস করিতে বা পর ভাবিতে পারিতেছেন না। কিন্তু স্বার্থপর পৃথিবীর লোক তাঁহার এই অপূর্ব উদারতার কথা কি কখনও যথাযথভাবে গ্রহণ করিবে? – কখনই না। তাঁহাকে অল্পবুদ্ধি বা ‘পাগল’ বলিবে, অথবা কঠোরতর ভাষায় তাঁহাকে নির্দেশ করিবে। ঐরূপ ভাবিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিবার অবসর খুঁজিতে লাগিলেন।

চন্দ্রাদেবীর দেব-স্বপ্ন

ঐরূপ অবসর আসিতে বিলম্বও হইল না। সরলপ্রাণা চন্দ্রা স্বামীর নিকট নিজ চিন্তাটি পর্যন্ত কখনও গোপন করিতে পারিতেন না। বয়স্যাদিগের নিকটেই তিনি অনেক সময় মনের সকল কথা বলিয়া ফেলিতেন, তা পৃথিবীর সকলের অপেক্ষা যাঁহার সহিত তাঁহার নিকট সম্বন্ধ ঈশ্বর স্থাপন করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার নিকট ঐসকল গোপন করিবেন কিরূপে? অতএব ৺গয়াদর্শন করিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম বাটী ফিরিলেই কয়েকদিন ধরিয়া চন্দ্রাদেবী তাঁহাকে তাঁহার অনুপস্থিতকালে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, দেখিয়াছিলেন, অথবা অনুভব করিয়াছিলেন – সেই সমস্ত কথা সুবিধা পাইলেই যখন তখন বলিতে লাগিলেন। ঐরূপ অবসরে একদিন বলিলেন, “দেখ, তুমি যখন ৺গয়া গিয়াছিলে, তখন একদিন রাত্রিকালে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। দেখিলাম, যেন এক জ্যোতির্ময় দেবতা আমার শয্যাধিকার করিয়া শয়ন করিয়া আছেন। প্রথমে ভাবিয়াছিলাম তুমি, কিন্তু পরে বুঝিয়াছিলাম কোন মানবের ঐরূপ রূপ হওয়া সম্ভবপর নহে। সে যাহা হউক, ঐরূপ দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখনও মনে হইতে লাগিল তিনি যেন শয্যায় রহিয়াছেন। পরক্ষণে মনে হইল, মানুষের নিকট দেবতা আবার কোন্ কালে ঐরূপে আসিয়া থাকেন? তখন মনে হইল, তবে বুঝি কোন দুষ্ট লোক কোন মন্দ অভিসন্ধিতে ঘরে ঢুকিয়াছে এবং তাহার পদশব্দাদির জন্য আমি ঐরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছি। ঐকথা মনে হইয়াই বিষম ভয় হইল। তাড়াতাড়ি উঠিয়া প্রদীপ জ্বালিলাম; দেখিলাম, কেহ কোথাও নাই, গৃহদ্বার যেমন অর্গলবদ্ধ তেমনি রহিয়াছে। তত্রাচ ভয়ে সে রাত্রে আর নিদ্রা যাইতে পারিলাম না। ভাবিলাম, কেহ হয়তো কৌশলে অর্গল খুলিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল এবং আমাকে জাগরিতা হইতে দেখিয়াই পলাইয়া পুনরায় কৌশলে অর্গলবদ্ধ করিয়া গিয়াছে। প্রভাত হইতে না হইতে ধনী কামারনী ও ধর্মদাস লাহার কন্যা প্রসন্নকে ডাকাইলাম এবং তাহাদিগকে সকল কথা বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমরা কি বুঝ বল দেখি, সত্য সত্যই কি কোন লোক আমার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল? আমার সহিত পল্লীর কাহারও বিরোধ নাই, কেবল মধু যুগীর সহিত সেদিন সামান্য কথা লইয়া কিছু বচসা হইয়াছিল – সেই কি আড়ি করিয়া ঐরূপে গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল?’ তখন তাহারা দুইজনে হাসিতে হাসিতে আমাকে অনেক তিরস্কার করিল। বলিল, ‘মর মাগী, বুড়ো হয়ে তুই কি পাগল হলি নাকি যে, স্বপ্ন দেখে এইরূপে ঢলাচ্ছিস্! অপর লোক একথা শুনলে বলবে কি বল্ দেখি? তোর নামে একেবারে অপবাদ রটিয়ে দেবে। ফের যদি ওকথা কাউকে বলবি তো মজা দেখতে পাবি!’ তাহারা ঐরূপ বলাতে ভাবিলাম, তবে স্বপ্নই দেখিয়াছিলাম। আর ভাবিলাম একথা আর কাউকে বলিব না, কিন্তু তুমি ফিরিয়া আসিলে তোমাকে বলিব।

শিবমন্দিরে চন্দ্রাদেবীর দিব্য দর্শন ও অনুভব

“আর একদিন যুগীদের শিবমন্দিরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ধনীর সহিত কথা কহিতেছি, এমন সময় দেখিতে পাইলাম, ৺মহাদেবের শ্রীঅঙ্গ হইতে দিব্যজ্যোতি নির্গত হইয়া মন্দির পূর্ণ করিয়াছে এবং বায়ুর ন্যায় তরঙ্গাকারে উহা আমার দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। আশ্চর্য হইয়া ধনীকে ঐ কথা বলিতে যাইতেছি, এমন সময় সহসা উহা নিকটে আসিয়া আমাকে যেন ছাইয়া ফেলিল এবং আমার ভিতরে প্রবল বেগে প্রবেশ করিতে লাগিল। ভয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিতা হইয়া এককালে মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গেলাম। পরে ধনীর শুশ্রূষায় চৈতন্য হইলে তাহাকে সকল কথা বলিলাম। সে শুনিয়া প্রথমে অবাক হইল, পরে বলিল, ‘তোমার বায়ুরোগ হইয়াছে।’ আমার কিন্তু তদবধি মনে হইতেছে ঐ জ্যোতি যেন আমার উদরে প্রবিষ্ট হইয়া রহিয়াছে এবং আমার যেন গর্ভসঞ্চারের উপক্রম হইয়াছে! ঐ কথাও ধনী এবং প্রসন্নকে বলিয়াছিলাম। তাহারা শুনিয়া আমাকে ‘নির্বোধ’ ‘পাগল’ ইত্যাদি কত কি বলিয়া তিরস্কার করিল এবং মনের ভ্রম হইতে অথবা বায়ুগুল্ম নামক ব্যাধি হইতে ঐরূপ অনুভব হইতেছে, এইরূপ নানা কথা বুঝাইয়া ঐ অনুভবের কথা কাহাকেও বলিতে নিষেধ করিল। তোমাকে ভিন্ন ঐ কথা আর কাহাকেও বলিব না নিশ্চয় করিয়া তদবধি এতদিন চুপ করিয়া আছি। আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? ঐরূপ দর্শন কি আমার দেবতার কৃপায় হইয়াছে, অথবা বায়ুরোগে হইয়াছে? এখনও আমার কিন্তু মনে হয়, আমার যেন গর্ভসঞ্চার হইয়াছে।”

ঐসকল কথা কাহাকেও না বলিতে চন্দ্রাদেবীকে ক্ষুদিরামের সতর্ক করা

শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ৺গয়ায় নিজ স্বপ্নের কথা স্মরণ করিতে করিতে শ্রীমতী চন্দ্রার সকল কথা শুনিলেন এবং উহা রোগজনিত নাও হইতে পারে, এই কথা বলিয়া তাঁহাকে নানাভাবে বুঝাইয়া বলিলেন, “এখন হইতে ঐরূপ দর্শন ও অনুভবের কথা আমাকে ভিন্ন আর কাহাকেও বলিও না; শ্রীশ্রীরঘুবীর কৃপা করিয়া যাহাই দেখান তাহা কল্যাণের জন্য, এই কথা মনে করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিবে। ৺গয়াধামে অবস্থানকালে, শ্রীশ্রীগদাধর আমাকেও অলৌকিক উপায়ে জানাইয়াছেন, আমাদিগকে পুনরায় পুত্রমুখ দর্শন করিতে হইবে।” শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী দেবপ্রতিম স্বামীর ঐরূপ কথা শুনিয়া আশ্বস্তা হইলেন এবং তাঁহার আজ্ঞানুবর্তিনী হইয়া এখন হইতে পূর্ণভাবে শ্রীশ্রীরঘুবীরের মুখাপেক্ষিণী হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। দিনের পর দিন আসিয়া ব্রাহ্মণদম্পতির পূর্বোক্ত কথোপকথনের পরে ক্রমে তিন চারি মাস অতীত হইল। তখন সকলে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিল, পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে ক্ষুদিরাম-গৃহিণী শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী সত্য সত্যই পুনরায় অন্তর্বত্নী হইয়াছেন। গর্ভধারণ করিবার কালে রমণীর রূপলাবণ্য সর্বত্র বর্ধিত হইতে দেখা যায়। চন্দ্রাদেবীরও তাহাই হইয়াছিল। ধনীপ্রমুখ তাঁহার প্রতিবাসিনীগণ বলিত, এইবার গর্ভধারণ করিয়া তিনি যেন অন্যান্য বার অপেক্ষা অধিক রূপলাবণ্যশালিনী হইয়াছেন। তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ আবার উহা দেখিয়া জল্পনা করিত, ‘বুড়ো বয়সে গর্ভবতী হইয়া মাগীর এত রূপ! বোধ হয় ব্রাহ্মণী এবার প্রসবকালে মৃত্যুমুখে পতিতা হইবে।’

চন্দ্রাদেবীর পুনরায় গর্ভধারণ ও ঐকালে তাঁহার দিব্য-দর্শনসমূহ

সে যাহা হউক, গর্ভবতী হইয়া শ্রীমতী চন্দ্রার দিব্যদর্শন ও অনুভবসকল দিন দিন বর্ধিত হইয়াছিল। শুনা যায়, এই সময়ে তিনি প্রায় নিত্যই দেবদেবীসকলের দর্শনলাভ করিতেন; কখন বা অনুভব করিতেন, তাঁহাদিগের শ্রীঅঙ্গনিঃসৃত পুণ্যগন্ধে গৃহ পূর্ণ হইয়াছে; কখন বা দৈববাণী শ্রবণ করিয়া বিস্মিতা হইতেন। আবার শুনা যায়, সকল দেব-দেবীর উপরেই তাঁহার মাতৃস্নেহ যেন এইকালে উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছিল; শুনা যায়, এইকালে তিনি প্রায় প্রতিদিন ঐসকল দর্শন ও অনুভবের কথা নিজ স্বামীর নিকটে বলিয়া কেন তাঁহার ঐরূপ হইতেছে, তদ্বিষয়ে প্রশ্ন করিতেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম তাহাতে তাঁহাকে নানাভাবে বুঝাইয়া ঐসকলের জন্য শঙ্কিতা হইতে নিষেধ করিতেন। ঐ কালের একদিনের ঘটনা আমরা যেরূপ শুনিয়াছি, এখানে বিবৃত করিতেছি। শ্রীমতী চন্দ্রা তাঁহার স্বামীর নিকটে সেদিন ভয়চকিতা হইয়া এইরূপ নিবেদন করিয়াছিলেন, দেব, শিবমন্দিরের সম্মুখে জ্যোতিদর্শনের দিন হইতে মধ্যে মধ্যে কত যে দেব-দেবীর দর্শন পাইয়া থাকি, তাহার ইয়ত্তা নাই। তাঁহাদিগের অনেকের মূর্তি আমি ইতিপূর্বে কখনও ছবিতেও দেখি নাই। আজ দেখি, হাঁসের উপর চড়িয়া একজন আসিয়া উপস্থিত। দেখিয়া ভয় হইল; আবার রৌদ্রের তাপে তাহার মুখখানি রক্তবর্ণ হইয়াছে দেখিয়া মন কেমন করিতে লাগিল। তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, ‘ওরে বাপ্ হাঁসেচড়া ঠাকুর রৌদ্রে তোর মুখখানি যে শুকাইয়া গিয়াছে; ঘরে আমানি পান্তা আছে, দুটি খাইয়া ঠাণ্ডা হইয়া যা!’ সে ঐ কথা শুনিয়া হাসিয়া যেন হাওয়ায় মিলাইয়া গেল! আর দেখিতে পাইলাম না। ঐরূপ কত মূর্তি দেখি! পূজা বা ধ্যান করিয়া নহে – সহজ অবস্থায় যখন তখন দেখিয়া থাকি। কখন কখন আবার দেখিতে পাই, তাহারা যেন মানুষের মত হইয়া সম্মুখে আসিতে আসিতে বায়ুতে মিলাইয়া গেল। কেন ঐরূপ সব দেখিতে পাই, বল দেখি? আমার কি কোন রোগ হইল? সময়ে সময়ে ভাবি আমাকে গোসাঁইয়ে1 পাইল না কি? শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম তখন তাঁহাকে ৺গয়ায় দৃষ্ট নিজ স্বপ্নের কথা বলিয়া বুঝাইতে লাগিলেন যে, অশেষ সৌভাগ্যের ফলে তিনি এবার পুরুষোত্তমকে গর্ভে ধারণ করিয়াছেন এবং তাঁহার পুণ্যসংস্পর্শেই তাঁহার ঐরূপ দিব্য দর্শনসমূহ উপস্থিত হইতেছে। স্বামীর উপর অসীম বিশ্বাসশালিনী চন্দ্রার হৃদয় তাঁহার ঐসকল কথা শুনিয়া দিব্য ভক্তিতে পূর্ণ হইল এবং নবীন বলে বলশালিনী হইয়া তিনি নিশ্চিন্তা হইলেন।

ঐরূপে দিনের পর দিন যাইতে লাগিল এবং শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ও তাঁহার পূতস্বভাবা গৃহিণী শ্রীশ্রীরঘুবীরের একান্ত শরণাগত থাকিয়া যাঁহার শুভাগমনে তাঁহাদিগের জীবন ঐশী ভক্তিতে পূর্ণ হইয়াছে, সেই মহাপুরুষ-পুত্রের মুখদর্শন-আশায় কাল কাটাইতে লাগিলেন।


1. শ্রীযুক্ত সুখলাল গোস্বামীর মৃত্যুর পরে নানা দৈব উৎপাত উপস্থিত হওয়ায় পল্লীবাসিগণের মনে ধারণা হইয়াছিল যে, উক্ত গোস্বামী বা তদ্বংশীয় কোন ব্যক্তি মরিয়া প্রেত হইয়া গোস্বামীদিগের বাটীর সম্মুখে যে বৃহৎ বকুল গাছ ছিল, তাহাতে অবস্থান করিতেন। বিশ্বাসপ্রভাবেই লোকে সময়ে কাহারও কোনরূপ দিব্যদর্শন উপস্থিত হইলে বলিত, ‘উহাকে গোসাঁইয়ে পাইয়াছে।সরলহৃদয়া চন্দ্রাদেবী সেইজন্যই এই সময়ে ঐরূপ বলিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *