4 of 11

১৭.০৯ কেশবের সঙ্গে কথা — ঈশ্বরের হাসপাতালে আত্মার চিকিৎসা

নবম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২৮শে নভেম্বর

কেশবের সঙ্গে কথা — ঈশ্বরের হাসপাতালে আত্মার চিকিৎসা

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি, সহাস্যে) — তোমার অসুখ হয়েছে কেন তার মানে আছে। শরীরের ভিতর দিয়ে অনেক ভাব চলে গেছে, তাই ওইরকম হয়েছে। যখন ভাব হয় তখন কিছু বোঝা যায় না, অনেকদিন পরে শরীরে আঘাত লাগে। আমি দেখেছি, বড় জাহাজ গঙ্গা দিয়ে চলে গেল, তখন কিছু টের পাওয়া গেল না; ও মা! খানিকক্ষণ পরে দেখি, কিনারার উপরে জল ধপাস ধপাস করছে; আর তোলপাড় করে দিচ্ছে। হয় তো কিনারার খানিকটা ভেঙে জলে পড়ল!

“কুঁড়েঘরে হাতি প্রবেশ করলে ঘর তোলপাড় করে ভেঙে চুরে দেয়। ভাবহস্তী দেহঘরে প্রবেশ করে, আর তোলপাড় করে।

“হয় কি জান? আগুন লাগলে কতক গুলো জিনিস পুড়িয়ে-টুড়িয়ে ফেলে, আর একটা হইহই কাণ্ড আরম্ভ করে দেয়। জ্ঞানাগ্নি প্রথমে কামক্রোধ এই সব রিপু নাশ করে, তারপর অহংবুদ্ধি নাশ করে। তারপর একটা তোলপাড় আরম্ভ করে!

“তুমি মনে কচ্ছো সব ফুরিয়ে গেল! কিন্তু যতক্ষণ রোগের কিছু বাকী থাকে, ততক্ষণ তিনি ছাড়বেন না। হাসপাতালে যদি তুমি নাম লেখাও, আর চলে আসবার জো নাই। যতক্ষণ রোগের একটু কসুর থাকে, ততক্ষণ ডাক্তার সাহেব চলে আসতে দেবে না। তুমি নাম লিখালে কেন!” (সকলের হাস্য)

কেশব হাসপাতালের কথা শুনিয়া বারবার হাসিতেছেন। হাসি সংবরণ করিতে পারিতেছেন না। থাকেন থাকেন, আবার হাসিতেছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।

[পূর্বকথা — ঠাকুরের পীড়া, রাম কবিরাজের চিকিৎসা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি) — হৃদু বলত, এমন ভাবও দেখি নাই! এমন রোগও দেখি নাই। তখন আমার খুব অসুখ। সরা সরা বাহ্যে যাচ্ছি। মাথায় যেন দুলাখ পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরীয় কথা রাতদিন চলছে। নাটগড়ের রাম কবিরাজ দেখতে এল। সে দেখে, আমি বসে বিচার করছি। তখন সে বললে, “একি পাগল। দুখানা হাড় নিয়ে, বিচার করছে!”

(কেশবের প্রতি) — “তাঁর ইচ্ছা। সকলই তোমার ইচ্ছা।

“সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।

“শিশির পাবে বলে মালী বসরাই গোলাপের গাছ শিকরসুদ্ধ তুলে দেয়। শিশির পেলে গাছ ভাল করে গজাবে। তাই বুঝি তোমার শিকড়সুদ্ধ তুলে দিচ্ছে। (ঠাকুরের ও কেশবের হাস্য) ফিরে ফিরতি বুঝি একটা বড় কাণ্ড হবে।”

[কেশবের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রন্দন ও সিদ্ধেশ্বরীকে ডাব-চিনি মানন ]

“তোমার অসুখ হলেই আমার প্রাণটা বড় ব্যাকুল হয়। আগের বারে তোমার যখন অসুখ হয়, রাত্রি শেষ প্রহরে আমি কাঁদতুম। বলতুম, মা! কেশবের যদি কিছু হয়, তবে কার সঙ্গে কথা কবো। তখন কলকাতায় এলে ডাব-চিনি সিদ্ধেশ্বরীকে দিয়েছিলুম। মার কাছে মেনেছিলুম যাতে অসুখ ভাল হয়।”

কেশবের উপর ঠাকুরের এই অকৃত্রিম ভালবাসা ও তাঁহার জন্য ব্যাকুলতা কথা সকলে অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এবার কিন্তু অত হয় নাই। ঠিক কথা বলব।

“কিন্তু দু-তিনদিন একটু হয়েছে।”

পূর্বদিকে যে দ্বার দিয়া কেশব বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়াছিলেন, সেই দ্বারের কাছে কেশবের পূজনীয়া জননী আসিয়াছেন।

সেই দ্বারদেশ হইতে উমানাথ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন, “মা আপনাকে প্রণাম করিতেছেন।”

ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন। উমানাথ বলিতেছেন, “মা বলছেন, কেশবের অসুখটি যাতে সারে।” ঠাকুর বলিতেছেন, “মা সুবচনী আনন্দময়ীকে ডাকো, তিনি দুঃখ দূর করবেন।”

কেশবকে বলিতেছেন —

“বাড়ির ভিতরে অত থেকো না। মেয়েছেলেদের মধ্যে থাকলে আরও ডুববে, ঈশ্বরীয় কথা হলে আরও ভাল থাকবে।”

গম্ভীরভাবে কথাগুলি বলিয়া আবার বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। কেশবকে বলছেন, “দেখি, তোমার হাত দেখি।” ছেলেমানুষের মতো হাত লইয়া যেন ওজন করিতেছেন। অবশেষে বলিতেছেন, “না, তোমার হাতহালকা আছে, খলদের হাত ভারী হয়।” (সকলের হাস্য)

উমানাথ দ্বারদেশ হইতে আবার বলিতেছেন, “মা বলছেন, কেশবকে আর্শীবাদ করুন।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীর স্বরে) — আমার কি সাধ্য! তিনিই আশীর্বাদ করবেন। ‘তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।’

“ঈশ্বর দুইবার হাসেন। একবার হাসেন যখন দুই ভাই জমি বখরা করে; আর দড়ি মেপে বলে, ‘এ-দিক্‌টা আমার, ও-দিক্‌টা তোমার’! ঈশ্বর এই ভেবে হাসেন, আমার জগৎ, তার খানিকটা মাটি নিয়ে করছে এ-দিক্‌টা আমার ও-দিক্‌টা তোমার!

“ঈশ্বর আর-একবার হাসেন। ছেলের অসুখ সঙ্কটাপন্ন। মা কাঁদছে। বৈদ্য এসে বলছে, ‘ভয় কি মা, আমি ভাল করব। ’বৈদ্য জানে না ঈশ্বর যদি মারেন, কার সাধ্য রক্ষা করে।” (সকলেই নিস্তব্ধ)

ঠিক এই সময় কেশব অনেকক্ষণ ধরিয়া কাশিতে লাগিলেন। সে কাশি আর থামিতেছে না। সে কাশির শব্দ শুনিয়া সকলেরই কষ্ট হইতেছে। অনেক্ষণ পরে ও অনেক কষ্টের পর কাশি একটু বন্ধ হইল। কেশব আর থাকিতে পারিতেছেন না। ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। কেশব প্রণাম করিয়া অনেক কষ্টে দেয়াল ধরিয়া সেই দ্বার দিয়া নিজের কামরায় পুনরায় গমন করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *