3 of 11

১৬.০৯ সমাধিমন্দিরে

নবম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২২শে জুলাই

সমাধিমন্দিরে

শ্রীরামকৃষ্ণ অহর্নিশ সমাধিস্থ! দিনরাত কোথা দিয়া যাইতেছে। কেবল ভক্তদের সঙ্গে এক-একবার ঈশ্বরীয় কথা কীর্তন করেন। তিনটা-চারিটার সময় মাস্টার দেখিলেন, ঠাকুর ছোট তক্তপোশে বসিয়া আছেন, ভাবাবিষ্ট। কিয়ৎক্ষণ পরে মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।

মার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে একবার বলিলেন, “মা, ওকে এক কলা দিলি কেন?” ঠাকুর খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। আবার বলিতেছেন, “মা, বুঝেছি, এক কলাতেই যথেষ্ট হবে। এক কলাতেই তোর কাজ হবে, জীবশিক্ষা হবে।”

ঠাকুর কি সাঙ্গোপাঙ্গদের ভিতর এইরূপে শক্তিসঞ্চার করিতেছেন? এসব কি আয়োজন হইতেছে যে, পরে তাঁহারা জীবশিক্ষা দিবেন? মাস্টার ছাড়া ঘরে রাখালও বসিয়া আছেন। ঠাকুর এখনও আবিষ্ট। রাখালকে বলিতেছেন, “তুই রাগ করেছিলি? তোকে রাগালুম কেন, এর মানে আছে। ঔষধ ঠিক পড়বে বলে। পিলে মুখ তুললে পর মনসার পাতা-টাতে দিতে হয়।”

কিয়ৎক্ষণ পরে বলিতেছেন, “হাজরাকে দেখলাম শুষ্ক কাঠ! তবে এখানে থাকে কেন? তার মানে আছে, জটিলে-কুটিলে থাকলে লীলা পোষ্টাই হয়।”

(মাস্টারের প্রতি) — ঈশ্বরীয় রূপ মানতে হয়। জগদ্ধাত্রীরূপের মানে জানো? যিনি জগৎকে ধারন করে আছেন। তিনি না ধরলে, তিনি না পালন করলে জগৎ পড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। মনকরীকে যে বশ করতে পারে, তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।

রাখাল — “মন-মত্ত-করী!”

শ্রীরামকৃষ্ণ — সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রয়েছে।

সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতেছে। সন্ধ্যা সমাগমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে ঠাকুরদের নাম করিতেছেন। ঘরে ধূনা দেওয়া হইল। ঠাকুর বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ছোট তক্তপোশটির উপর বসিয়া আছেন। মার চিন্তা করিতেছেন। বেলঘরের শ্রীযুক্ত গোবিন্দ মুখুজ্জে ও তাহার বন্ধুগণ আসিয়া প্রণাম করিয়া মেঝেতে বসিলেন। মাস্টারও বসিয়া আছেন। রাখালও বসিয়া আছেন।

বাহিরে চাঁদ উঠিয়াছে। জগৎ নিঃশব্দে হাসিতেছে। ঘরের ভিতর সকলে নিঃশব্দে বসিয়া ঠাকুরের শান্তমূর্তি দেখিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। কিয়ৎক্ষণ পরে কথা কহিলেন। এখনও ভাবাবস্থা।

[শ্যামারূপ — পুরুষ-প্রকৃতি — যোগমায়া — শিবকালী ও রাধাকৃষ্ণরূপের ব্যাখ্যা — উত্তম ভক্ত — বিচারপথ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ) — বল, তোমাদের যা সংশয়। আমি সব বলছি।

গোবিন্দ ও অন্যান্য ভক্তেরা ভাবিতে লাগিলেন।

গোবিন্দ — আজ্ঞা, শ্যামা এরূপটি হল কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে দূর বলে। কাছে গেলে কোন রঙই নাই। দীঘির জল দূর থেকে কালো দেখায়, কাছে গিয়ে হাতে করে তোল, কোন রঙ নাই। আকাশ দূর থেকে যেন নীলবর্ণ। কাছের আকাশ দেখ, কোন রঙ নাই। ঈশ্বরের যত কাছে যাবে ততই ধারণা হবে, তাঁর নাম, রূপ নাই। পেছিয়ে একটু দূরে এলে আবার “আমার শ্যামা মা!” যেন ঘাসফুলের রঙ। শ্যামা পুরুষ না প্রকৃতি? একজন ভক্ত পূজা করেছিল। একজন দর্শন করতে এসে দেখে ঠাকুরের গলায় পৈতে! সে বললে, তুমি মার গলায় পৈতে পরিয়েছ! ভক্তটি বললে, “ভাই, তুমিই মাকে চিনেছ। আমি এখনও চিনতে পারি নাই তিনি পুরুষ কি প্রকৃতি। তাই পৈতে পরিয়েছি!”

“যিনি শ্যামা, তিনিই ব্রহ্ম। যাঁরই রূপ, তিনিই অরূপ। যিনি সগুণ, তিনিই নির্গুণ। ব্রহ্ম শক্তি — শক্তি ব্রহ্ম. অভেদ। সচ্চিদানন্দময় আর সচ্চিদানন্দময়ী।”

গোবিন্দ — যোগমায়া কেন বলে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — যোগমায়া অর্থাৎ পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। যা কিছু দেখছ সবই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। শিবকালীর মূর্তি, শিবের উপর কালী দাঁড়িয়া আছেন। শিব শব হয়ে পড়ে আছেন। কালী শিবের দিকে চেয়ে আছেন। এই সমস্তই পুরুষ-প্রকৃতির যোগ। পুরুষ নিষ্ক্রিয়, তাই শিব শব হয়ে আছেন। পুরুষের যোগে প্রকৃতি সমস্ত কাজ করছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন!

“রাধাকৃষ্ণ-যুগলমূর্তিরও মানে ওই। ওই যোগের জন্য বঙ্কিমভাব। সেই যোগ দেখাবার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের নাকে মুক্তা, শ্রীমতীর নাকে নীল পাথর। শ্রীমতীর গৌর বরণ মুক্তার ন্যায় উজ্জ্বল। শ্রীকৃষ্ণের শ্যামবর্ণ, তাই শ্রীমতীর নীল পাথর। আবার শ্রীকৃষ্ণ পীতবসন ও শ্রীমতী নীলবসন পরেছেন।

“উত্তম ভক্ত কে? যে ব্রহ্মজ্ঞানের পর দেখে, তিনিই জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। প্রথমে ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করে ছাদে পৌঁছিতে হয়। তারপর সে দেখে, ছাদও যে জিনিসে তৈয়ারি — ইট, চুন, সুড়কি — সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারি। তখন দেখে, ব্রহ্মই জীবজগৎ সমস্ত হয়েছেন।

“শুধু বিচার! থু! থু! — কাজ নাই।

(ঠাকুর মুখামৃত ফেলিলেন।)

“কেন বিচার করে শুষ্ক হয়ে থাকব? যতক্ষণ ‘আমি তুমি’ আছে, ততক্ষণ যেন তাঁর পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে।”

(গোবিন্দের প্রতি) — কখনও বলি — তুমিই আমি, আমিই তুমি। আবার কখনও ‘তুমিই তুমি’ হয়ে যায়। তখন ‘আমি’ খুঁজে পাই না।

“শক্তিরই অবতার। এক মতে রাম ও কৃষ্ণ চিদানন্দসাগরের দুটি ঢেউ।

“অদ্বৈতজ্ঞানের পর চৈতন্যলাভ হয়। তখন দেখে, সর্বভূতে চৈতন্যরূপে তিনি আছেন। চৈতন্যলাভের পর আনন্দ। অদ্বৈত, চৈতন্য, নিত্যানন্দ।”

[ঈশ্বরের রূপ আছে — ভোগবাসনা গেলে ব্যাকুলতা ]

(মাস্টারের প্রতি) — আর তোমায় বলছি, রূপ, ঈশ্বরীয় রূপ অবিশ্বাস করো না। রূপ আছে বিশ্বাস কর! তারপর যে রূপটি ভালবাস সেই রূপ ধ্যান করো।

(গোবিন্দের প্রতি) — কি জানো, যতক্ষণ ভোগবাসনা, ততক্ষণ ঈশ্বরকে জানতে বা দর্শন করতে প্রাণ ব্যাকুল হয় না। ছেলে খেলা নিয়ে ভুলে থাকে। সন্দেশ দিয়ে ভুলোও খানিক সন্দেশ খাবে। যখন খেলাও ভাল লাগে না, সন্দেশও ভাল লাগে না, তখন বলে, ‘মা যাব!’ আর সন্দেশ চায় না। যাকে চেনে না, কোনও কালে দেখে নাই, সে যদি বলে, আয় মার কাছে নিয়ে যাই — তারই সঙ্গে যাবে। যে কোলে করে নিয়ে যায় তারই সঙ্গে যাবে।

“সংসারের ভোগ হয়ে গেলে ইশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়। কি করে তাঁকে পাব — কেবল এই চিন্তা হয়। যে যা বলে তাই শুনে।”

মাস্টার (স্বগত) — ভোগবাসনা গেলে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *