3 of 11

১৪.১০ বেলঘরের ভক্তসঙ্গে

দশম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১০ই জুন

বেলঘরের ভক্তসঙ্গে

বেলঘরে হইতে গোবিন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ভক্তেরা আসিয়াছেন। ঠাকুর যেদিন তাঁহার বাটীতে শুভাগমন করিয়াছিলেন, সেদিন গায়কের “জাগ জাগ জননি” এই গান শুনিয়া সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। গোবিন্দ সেই গায়কটিকেও আনিয়াছেন। ঠাকুর গায়ককে দেখিয়া আনন্দিত হইয়াছেন ও বলিতেছেন, তুমি কিছু গান কর। গায়ক গাইতেছেন:

১। দোষ কারু নয় গো মা,
আমি স্বখাত-সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।

২। ছুঁসনা রে শমন আমার জাত গিয়েছে।
যদি বলিস ওরে শমন জাত গেল কিসে,
কেলে সর্বনাশী আমায় সন্ন্যাসী করেছে।

[রাগিণী-মূলতান]

৩। জাগ জাগ জননী
মূলাধারে নিদ্রাগত কতদিন গত হল কুলকুণ্ডলিনী।
স্বকার্য সাধনে চল মা শির মধ্যে,
পরম শিব যথা সহস্রদল পদ্মে,
করি ষড়চক্র ভেদ ঘুচাও মনের খেদ, চৈতন্যরূপিণি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এই গানে ষড় চক্র ভেদের কথা আছে। ঈশ্বর বাহিরেও আছেন, অন্তরেও আছেন। তিনি ভিতরে থেকে মনের নানা অবস্থা করছেন। ষড় চক্র ভেদ হলে মায়ার রাজ্য ছাড়িয়ে জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে এক হয়ে যায়। এরই নাম ঈশ্বরদর্শন।

“মায়া দ্বার ছেড়ে না দিলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। রাম, লক্ষ্মণ আর সীতা একসঙ্গে যাচ্ছেন; সকলের আগে রাম, মধ্যে সীতা, পশ্চাতে লক্ষ্মণ। যেমন সীতা মাঝে মাঝে থাকাতে — লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পাচ্ছেন না, তেমনি মাঝে মায়া থাকাতে জীব ঈশ্বরকে দর্শন করতে পাচ্ছে না। (মণি মল্লিকের প্রতি) তবে ঈশ্বরের কৃপা হলে মায়া দ্বার ছেড়ে দেন। যেমন দ্বারওয়ানরা বলে, বাবু হুকুম করে দিন — ওকে দ্বার ছেড়ে দিচ্ছি।

“বেদান্ত মত আর পুরাণ মত। বেদান্তমতে বলে, ‘এই সংসার ধোঁকার টাটি’ অর্থাৎ জগৎ সব ভুল, স্বপ্নবৎ। কিন্তু পুরাণমত বা ভক্তিশাস্ত্রে বলে যে, ঈশ্বরই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়ে রয়েছেন। তাঁকে অন্তরে বাহিরে পূজা কর।

“যতক্ষণ ‘আমি’ বোধ তিনি রেখেছেন ততক্ষণ সবই আছে। আর স্বপ্নবৎ বলবার জো নাই। নিচে আগুন জ্বালা আছে, তাই হাঁড়ির ভিতরে ডাল, ভাত, আলু, পটোল সব টগ্‌বগ্‌ করছে। লাফাচ্ছে, আর যেন বলছে, ‘আমি আছি, আমি লাফাচ্ছি।’ শরীরটা যেন হাঁড়ি; মন বুদ্ধি — জল ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলি যেন — ডাল, ভাত, আলু পটোল। অহং যেন তাদের অভিমান, আমি টগ্‌বগ্‌ করছি! আর সচ্চিদানন্দ অগ্নি।

“তাই ভক্তিশাস্ত্রে, এই সংসারকেই ‘মজার কুটি’ বলেছে। রামপ্রসাদের গানে আছে ‘এই সংসার ধোঁকার টাটি’। তারই একজন জবাব দিয়েছিল, ‘এই সংসার মজার কুটি’। ‘কালীর ভক্ত জীবন্মুক্ত নিত্যানন্দময়।’ ভক্ত দেখে, যিনিই ঈশ্বর তিনিই মায়া হয়েছেন। তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। ইশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ এক দেখে। কোন কোন ভক্ত সমস্ত রামময় দেখে। রামই সব রয়েছেন। কেউ রাধাকৃষ্ণময় দেখে। কৃষ্ণই এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়ে রয়েছেন। সবুজ চশমা পরলে যেমন সব সবুজ দেখে।

“তবে ভক্তিমতে শক্তিবিশেষ। রামই সব হয়ে রয়েছেন, কিন্তু কোনখানে বেশি শক্তি, আর কোনখানে কম শক্তি। অবতারেতে তিনি একরকম প্রকাশ, আবার জীবেতে একরকম। অবতারেরও দেহবুদ্ধি আছে। শরীরধারণে মায়া। সীতার জন্য রাম কেঁদেছিলেন। তবে অবতার ইচ্ছা করে নিজের চোখে কাপড় বাঁধে। যেমন ছেলেরা কানামাছি খেলে। কিন্তু মা ডাকলেই খেলা থামায়। জীবের আলাদা কথা। যে-কাপড়ে চোখ বাঁধা সেই কাপড়ের পিঠে আটটা ইস্কুরূপ দিয়ে বাঁধা। অষ্টপাশ। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি, কুল, শীল, শোক, জুগুপ্সা (নিন্দা) — ওই অষ্টপাশ। গুরু না খুলে দিলে হয় না।”


মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে। [গীতা, ৭/১৪]
ঘৃণা, লজ্জা, ভয়ং, শঙ্কা (শো?) জুগুপ্সা, চেতী পঞ্চমী।
কুলং শীলং তথা জাতিরষ্টৌ পাশাঃ প্রকীর্তিতাঃ। কুলার্ণবতন্ত্র

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *