3 of 3

১৪৬. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও ইমার (রা)- এর বর্ণনা

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: [উমারের (রা) খিলাফতের শেষের দিকে আমি একদিন আবদুর রহমান ইবনে আওফের মিনাস্থ বাড়ীতে তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। আবদুর রহমান তখন উমারের (রা) কাছে ছিলেন। উমার তাঁর শেষ হজ্জ সমাপন করছিলেন। আবদুর রহমান (রা) উমারের (রা) কাছ থেকে ঘরে ফিরে দেখেন আমি তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। তৎকালে আমি তাঁকে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতাম। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) আমাকে বললেন, তুমি দেখলে অবাক হয়ে যেতে যে, একটি লোক আমীরুল মুমিনীন উমারের (রা) কাছে এস বলতে লাগলো, “হে আমীরুল মুমিনীন, অমুন ব্যক্তি সম্পর্কে কি আপনি কিছু বলবেন, যে বলেঃ উমার যদি মারা যেতেন তাহলে আমি অমুককে খলিফা নির্বাচন করতাম? আল্লাহর কসম, আবু বাকরের খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হওয়াটা ছিল নেহাৎ আকস্মিক ও অপ্রত্যশিত ঘটনা।” উমার (রা) এ কথা শুনে (একজন বিশেষ ব্যক্তিকে খলিফা করার পক্ষে ক্যানভাস করার প্রবণতা এবং প্রথম খলিফার নির্বাচনের অবমূল্যায়ন হতে দেখে) রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “আমি ইনশাআল্লাহ আজ বিকালেই জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবো এবং যারা মুসলমানদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিাকারকে বিকৃত ও বিনষ্ট করতে চাইছে, তাদের সম্পর্কে তাতেদরকে হুঁশিয়ার করে দেবো।” আবদুর রহমান (রা) বলেন, আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, এ কাজ করবেন না। কেননা হজ্জের সময় অনেক অজ্ঞ, অবুঝ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকও সমবেত হয়ে থাকে। আর আপনি যখনই জনসাধারনের মধ্যে দাঁড়াবেন তখন অজ্ঞ লোকেরা আপনার আশেপাশে থাকবে। আমার আশংকা হয়, আপনি যে কথা বলবেন অজ্ঞ লোকেরা তার ভুল অর্থ বুঝবে এবং চারদিক ছড়াবে। কাজেই মদীনায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করুন। কেননা মদীনাই রাসূলের কেন্দ্রভূমি। সেখানে আপনি গণ্যমান্য ও জ্ঞানী গুণী লোকদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পাবেন এবং যা বলতে চেয়েছেন তা সেখানে অবস্থানকালে বললে, সেখানকার বিচক্ষণ লোকেরা তা সঠিকভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে পারবে। কোন রকম কদর্থ করা বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকবে না।” উমার বললেন, “বেশ, তাই হবে। আমি মদীনায় গিয়ে প্রথম সুযোগেই এ কথা বলবো।”

ইবনে আব্বাস বলেন: আমরা যুলহিজ্জার শেষে মদীনায় পৌছলাম। আমি মিম্বারের কাছাকাছি সাঈদ ইবনে যায়িদকে পেয়ে তার গায়ে গায়ে ঘেষে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই উমারকে (রা) আসতে দেখলাম। তখন সাঈদ ইবনে যায়িদকে বললাম, “আজকে তিনি এমন একটি কথা বলবেন যা খলিফা হওয়ার পর আর কখনো বলেননি।” সাঈদ একথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, “এমন কি কথা বলতে পারেন যা কখনো বলেননি?” যা হোক, উমার গিয়ে মিম্বারে বসলেন মুয়াযযিনের আযান শেস হওয়া মাত্রই আল্লাহর প্রশংসান্তে নিম্নরূপ ভাষণ দান কররেন,

“আজ আমি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলবো যা আমার ভাগ্যে ছিল বলেই বলতে পারছি। হয়তো বা আমার মৃত্যু কাছাকাছি এসেই এটা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এর সঠিক মর্ম উলব্ধি করতে পারবে সে যেন অনর্থক আমি যা বলিনি, তা বলে না বেড়ায়। আল্লাহ মুহাম্মাদকে (সা) নবুওয়াত দান করেছিরেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেছিলেন। তার ভেতর ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা করাও সন্নিবেশিত হয়ের্ছি আমরা তা পড়েছি, শিখেছি ও অনুধাবন করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ শাস্তি কার্যকর করেছেন এবং তাঁর পরে আমরাও তা প্রয়োগ করেছি। আমার আশংকা হয় যে, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন হয়তো কেউ বলে বসবে, “আমরা আল্লাহর কিতাবে তো ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার শাস্তি কোথাও দেখতে পাই না।’ এভাবে আল্লাহর নাযিল করা একটা ফরয কাজ ত্যাগ করে লোক গুমরাহীতে লিপ্ত হবে। অথচ এই ‘রজম’ এর বিধান প্রত্যেক বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর জন্য আল্লাহ কিতাবে অকাট্যভাবে বিদ্যমান্ অবশ্য অপরাধটা সাক্ষী, কিংবা গর্ভসঞ্চার অথবা স্বীকারোক্তি দ্বার সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হওয়া চাই্ আমরা আল্লাহর কিতাবে এ বিধানও পড়েছি যে, নিজের পিতৃপরচয় বর্জন করো না। কেননা সেটা কুফরীর শামিল। সাবধান! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রশংসায় যেমন বাড়াবড়ি করা হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে তেমন অতিরঞ্জিত প্রশংসা করো না। আমাকে শুধু ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ বলে অভিহিত করো। আর একটা কথা বলছি, শোনো। আমি শুনেছি, অমুক ব্যক্তি নাকি বলেছে যে, উমার ইবনুল খাত্তাব মারা গেলে আমি অমুককে খলিফা মেনে নেব। তোমাদের কেউ যেন একথা বলে বিভ্রান্ত না করে যে, আবু বাকরের (রা) খিলাফত লাভ একটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল। ঘটনাটা আসলে সে রকমই ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তার সম্ভাব্য কুফল থেকে রক্ষা করেছেন। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমাদের মধ্যে আবু বাকরের মত উচ্চ মযার্দাসম্পন্ন ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আর কেউ নেই এবং ছিল না। সুতরাং যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করে কাউকে খলিফা মেনে নিয়ে বাইয়াত করবে, তার খিলাফত অচল এবং যে বাইয়াত করবে তার বাইয়াতও অবৈধ ও অগ্রাহ্য হবে। কেননা ও দু’ব্যক্তিকে হত্যার হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার আর কোন উপায় নেই।” [৯৯. এর তাৎপর্য এই যে, বাইয়াত তথা আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়ে কাউকে খলিফা, আমীর বা নেতা মেনে নেয়া একমাত্র পরামর্শ ও মতৈক্যের বৈধ হতে পারে। কিন্তু দুই ব্যক্তি যদি সমগ্র জামায়াত থেকে আলাদ হয়ে স্বেচ্ছাচারী পন্থায় একজন আর একজনের আনুগত্যের বাইয়াত করে তাহলে তা জামায়াতকে অগ্রাহ্য করা ওবিভক্ত করার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের বাইয়াত ঐ দুইজনের কারোই গ্রাহ্য হবে না। তারেদ ইভয়কে বর জামায়াত থেকে বহিস্কৃত করতে হবে, যে জামায়াত তাঁর সদস্যর ভেতর থেকে নেতা নির্বাচনে একমত। কেননা ঐ স্বৈরাচারী ব্যক্তিদ্বয়ের একজনকে যদি জামায়াত নেতা মেনে নেয় এবং বাইয়াত করে তাহলে যেহেতু তারা সমগ্র জামায়াতের মতামতকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে জামায়াতকে অপমানিত করেছে, তাই তাকে কে কখন হত্যা করে বসে বলা যায় না এবং কেউ তারেদ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে না। (লিসানুল আরব, [আরবী ***] অধ্যায় দ্রষ্টব্য মূল শব্দ [আরবী ***] এর অর্থ প্রসঙ্গে।)]

উমার (রা) বরেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর আমরা খবর পেলাম যে আনসারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বারে তাঁদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। আলী ইবনে আবু তালিব (রা), যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও তাঁদের সহচরগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাইলেন্ আর আবু বাকরের কাছে জমায়েত হলেন মুহাজিরগণ। আমি আবু বাকররেক (রা) বললাম, “আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আনসার ভাইদের কাছে চলুন।” তাদের কাছে যাওয়ার পথে তাদের দু’জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আমাদের দেখা হলো। তারা আনসারদের মনোভাব জানালেন। অতঃপর বললেন, “হে মুহাজিরগণ, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” আমরা বললাম, “আমরা এই আনসার ভাইদের কাছে যাচ্ছি।” তাঁরা বললেন, “তাঁদের কাছে আপনাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাদের যা করনীয় তা করুন।” আমি বললাম, “আমাদের যেতেই হবে।” অতঃপর আমরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, সমবেত আনসারগণের মাঝখানে এক ব্যক্তি কম্বল মুড়ি গিয়ে মুখ ঢেকে আছে। আমর বললাম, “তাঁর কি হয়েছে।” তাঁরস বললেন, “অসুখ।” আমরা সেখানে বসলে তাঁদের এক বক্তা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিকালাতের সাক্ষ্য দিয়ে এবং আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। বললেন, “আমরা আল্লাহর আনসার এবং ইসলামের বীর সেনানী। আর হে মুহাজিরগণ। আপনার আমাদেরই একটি দল। আপনাদের একটি শান্তশিষ্ট মরুচারী দল আামদের সাতে এসে ইতিমধ্যেই যোগদান করেছে।”

উমার (রা) বলেন: আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং তার ওপর জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে। আমি এর জবাবে চমৎকার একটা বক্তৃতা তৈরী করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বাক্রকে শোনাতে চাইলাম। আবু বাকরের (রা) মধ্যে এক ধরনের তেজস্বিতা ছিল যার জন্য তাঁকে আমি খুবই ভয় পেতাম এবং যথাসম্ভব তাঁর মনরক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। আবু বাক্র (রা) বললেন, “উমার। তুমি কিছু বলো ান।” আমি তার জিদ ধরে তাঁর রাগ বাড়াতে চাইলাম না। আমাদের চেয়ে ঢের বেশী শ্রদ্ধাভাজন ও জ্ঞানী ছিলেন আবু বাক্র (রা)। তিনি তাঁদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি অনেক সময় ধরে চিন্তা ভাবন করে যে বক্তৃতা তৈরী করেছিলাম – যাতে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম তাঁর উপস্থিত বক্তৃতায় তার একটা কথাও বাদ তো গেলইনা বরং তার চেয়েও ভাল কথা তিনি বললেন। তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিস গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছোল তা যথার্থ বলেছো। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থকালে আরবার ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতো না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরনের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য এই দুইজনের যেকোন একজনকে পছন্দ করি। তোমরা এঁদের মধ্যে যাঁকে পছন্দ করা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইয়াত কর।” এই বলে তিনি আমরা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। তাঁর এই শেষের কথাটি ছাড়া আর কোন কথা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছিল, শিরচ্ছেদের জন্য বধূভূমিতে এগিয়ে যাওয়া গুনাহর কাজ হলেও তা বোধ হয় আমার কাছে আবু বাক্র (রা) থাকতে মুসলমানদের আমীর হওয়ার চাইতে ঢের বেশী পছন্দনীয় হতো।

উমার (রা) বলেন: আবু বাকরের (রা) এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমারেদ পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) তরফ থেকে আর একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতন্ডা হলো এবং বেশ চড়া গলায় কথা কথাবার্তা হতে লাগলো। আমার আশংকা হলো যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটা বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়। আমি (সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে) তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বাক্র, আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইয়াত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইয়াত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইয়াত করলেন। এরপর আমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেদ একজন বললেন, “তোমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।”

যুহরী বলেছেন: উরওয়াহ ইবনে যুবাই (রা) আমাকে জানিয়েছেন যে, আবু বাক্র (রা), উমার (রা) ও অন্যান্য মুহাজিরগণ বনু সায়েদার চত্বরে যাওয়ার সময় যে দুজন আনসারীর সাক্ষাত পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন উয়াইম ইবনে সায়েদা এবং বনু আজলানের মুয়ান ইবনে আদী। বর্ণিত আছে যে, উয়াইম ইবনে সয়েদা সেই ভাগ্যবান সাহাবীগণের অন্যতম যাদের প্রশংসায় আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছিলেন-

[আরবী *******]

“সেখানে (মসজিদে কুবাতে) এমনসব লোক রয়েছে যার পবিত্রতা অর্জন পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতাকামী লোকদেরকে ভালবাসেন।” (তাওবাহ)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এই গোষ্ঠীর মধ্যে উয়াইম ইবনে সায়েদা চমৎকার মানুষ।”

মুয়ান ইবনে আদী (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল হয় সেদিন মুসলমানরা ব্যাপকভাবে কান্নাকাটি করেছিল এবং বলেছিল, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগেই আমাদের মরে যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর ইনতিকালের পর আমারেদ ঈমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা রয়েছে।” কিন্তু একমাত্র মুয়ান ইবনে আদী বলেছিলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে মরা পছন্দ করি না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যেমন তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, তেমনি তাঁর ইনতিকালের পরও আবার নতুন করে ঈমান আনার সুযোগ পেয়েছি।” পরে আবু বাকরের (রা) খিলাফতের আমলে ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলিমা কাযযাবের সাথে লড়তে গিয়ে তিনি শাহাদাত লাভ করেন।

যুহরী আনাস ইবনে মালিকের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে জানান: বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে খিলাফতের প্রাথমিক বাইয়াত গ্রহণের পরদিন আবু বাক্র (রা) মসজিদের মিম্বারে বসলেন। তিনি কিছু বলার আগে উমার (রা) আল্লাহর প্রশংসা করে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেন, “হে জনগণ, গতকাল আমি তোমাদেরকে যে কথা বলেছিলাম [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যাননি, তিনি মূসার (আ) মত সাময়িকভাবে অন্তর্ধান হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি] তা আমি কুরআন থেকে পাইনি এবং রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাকে তা বলেননি। আমার ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক পুরোপুরিভাবে গুছিয়ে দিয়ে সবার শেষে ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। আল্লাহর যে কিতাব দ্বারা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের মনোনীত লক্ষ্যে চারিত করেছেন সে কিতাব আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বহাল রেখেছেন। এই কিতাবকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যেদিকে চারিত করেছেন সেদিকে তোমাদের চালিত করবেন। আজ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম তাঁর কাছেই তোমাদের নেতৃত্ব সমর্পণ করেছেন। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সঙ্গী- সওর পর্বত গুহায় তাঁর একনিষ্ঠ সহচর। অতএব তোমরা তাঁর কাছে বাইয়াত করে তাঁকে খলিফা বা আমীর হিসাবে গ্রহণ কর।” তখন েেলাকেরা দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে বাইয়াত করলো। এটিই ছিল বনু সায়েদা চত্বরের বাইয়াতের পর সার্বজনীন বাইয়াত।

অতঃপর আবু বাক্র (রা) বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “হে জনমন্ডলী, আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ কির তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে শুধরে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো ততক্ষণ সে আমার কাছে শক্তিশলী। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ আম হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল। মনে রেখ কোন জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্চনা গঞ্জনা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার কথামত চলবে। কিন্তু যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবো তখন তোমাদের আনুগত্য আমার প্রাপ্য হবে না। তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান থেকো আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করুন।”

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: উমারের (রা) খিলাফতকালে আমি একবার তাঁর সাথে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। একখানা ছড়ি হাতে তিনি যাচ্ছিলেন নিজের কোন কাজে। তাঁর সাথে তখন আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি আপন মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন আর ছড়ি সগিয়ে নিজের পায়ের উপর আঘাত করছিলেন। সহসা আমার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে ইবনে আব্বাস, জানো, কি জন্য আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সময় ঐ কথা বলছিলাম?” আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, আমি তা জানি না। আপনিই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “আমি একটি আয়াত পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মাতের মধ্যে ততদিন থাকবেন যতদিন তাদের সর্বশেষ ক্রিয়াকলাপ দেখে তার ওপর সাক্ষ্য দিতে পারেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই আমি কথাটা বলেছিলাম। আয়াতটি এই:

[আরবী *******]

“এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাত বানিয়েছি যেন মানব জাতির জন্য তোমরা সাক্ষী হতে পারো। এবং রাসূল তোমারেদ জন্য সাক্ষী হতে পারেন।” (বাকারাহ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *