ইবনে ইসহাক বলেনঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়িশা থেকে উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ, তাঁর থেকে মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম যুহরী এবং তাঁর থেকে ইয়াকুব ইবনে উতবা আমাকে জানিয়েচেন যে, আয়িশা (রা) বলেছেন, “(অন্যান্য স্ত্রীদের কাছ থেকে আমার ঘরে পরিচর্যঅর জন্য অবস্থানের অনুমতি লাভের পর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবারভূক্ত দুই ব্যীক্ত ফযল ইবলে আব্বাস (রা) ও অন্য একজনের কাঁধে ভর করে মাথায় পট্রি বাঁধা অবস্থায় পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মতে অপর ব্যক্তিটি ছিলেন আলী ইবনে আবু তালিব (রা)।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যন্ত্রণা বেড়ে গেল এবং তিনি কাতর হয়ে বললেন, “বিভিন্ন কুয়া থেকে সাত মশক পানি এনে আমার মাথায় ঢাল যাতে আমি জনগণের কাছে গিয়ে অঙ্গীকার আদায় করে আসতে পারি।” আমরা তাঁকে হাফসা বিনতে (রা) একটি বড় কাপড় ধোয় পাত্রের কাছে বসিয়ে তার মাথায় প্রচুর পরিমাণে পানি ঢাললাম। অবশেষে তিনি বললেন,
“যথেষ্ট হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে।”
যুহরী বলেন: আইয়ুব ইবনে বাশীর আমাকে জানিয়েছেন যে, মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বেরিয়ে এসে মসজিদের মিম্বারে বসলেন। অতঃপর তিনি মুখ খুলেই সর্বপ্রথম উহুদ যুদ্ধের শহীদদের জন্য রহমত কামনা করলেন ও তাঁদের জন্য ক্ষমা চাইলেন। তাঁদের জন্য রহমত কামনা করে তিিন অনেক দোয়া করলেন। অতঃপর বললেন, “এক বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়ার সম্পদ ও আল্লাহর নিকট যে নিয়ামত রয়েছে তার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে বললেন। সেই বান্দা আল্লাহর কাছে যে নিয়ামত রয়েছে তা-ই বেছে নিল।” এ কথার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন আবু বাক্র সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বুঝেছিলেন যে, এই বান্দা খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কেউ নন। তাই তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের নিজেদেরকে আর আমাদের সন্তান সন্ততিকে বরং আপনার জানের বদলায় কুরবানী করে দিই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু বাক্র একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ কর।” অতঃপর বললেন, “মসজিদের এই উন্মুক্ত দরজাগুলো বন্ধ করে দাও। তবে আবু বাক্রের ঘরের সাথে সংলগ্ন দরাজা বন্ধ করো না। কেননা আমার সহচর্যে যত লোক এসেছে তার মধ্যে আবু বাক্রকেই আমি সর্বাধিক নির্ভযোগ্য সহযোগী পেয়েছি।”
আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সাথে একথাও বলেছিলেন, “আল্লাহর বান্দাদের ভেতর থেকে কাউকে যদি আমি নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতাম তাহলে আবু বাক্রকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু যদিদিন আমরা আল্লাহর কাছে সম্মিলিত না হই ততদিন শুধু সাহচর্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঈমানই আমাদের পারস্পরিক বন্ধনের যোগসূত্র হয়ে থাকবে।”
উরওয়া ইবনে যুবাইর প্রমুখ বিজ্ঞ ব্যক্তির সূত্র উল্লেখ করে আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে যুবাইর জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রোগাবস্থায় থাকা সত্ত্বেও উসামা (রা) বাহিনী প্রেরণে বিলম্ব হওয়ায় অস্থিরতা প্রকাশ করেন। ওদিকে কেউ কেউ প্রবীণ মুহাজির ও আনসারগণ থাকতে অল্পবয়স্ক তরুণ উসামা অধিনায়ক মনোনীত হওয়ায় মৃদু আপত্তি প্রকাশ করছিলেন। একথা জেনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় মিম্বারে এসে বসলেন। আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনগন, উসামার বাহিনী তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে যদি তোমাদের মধ্যে কথা উঠে থাকে তবে এ ধরনের কথা তোমরা তার পিতার অধিনায়কত্ব নিয়েও তুলেছিল। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, উসামা এ কাজের যোগ্য আর তাঁর পিতাও এ কাজের যোগ্য ছিল।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে এলেন। মুসলমানগণ উসামার বাহিনী প্রেরণের আয়োজন করতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগযন্ত্রণাও প্রবল হতে লাগলো। উসামা বাহিনী নিয়ে যখন মদীনা থেকে এক ফারসাখ দূরে অবস্থিত ন্মিনভূমিতে পৌছেছেন, সেখানে তাঁর সেনাবাহিনীও পৌছেছে এবং অন্যান্য মুসলমানগণও তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে, ঠিক তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা কি দাঁড়ায় দেখার জন্য। যুহরী বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে মালিক আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন তাঁর ভাষণে উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দোয়া এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে যা কিছু বলেছিলেন তার সাথে এ কথাও বলেছিলেন, “হে মুহাজিরগণ, তোমরা আনাসারদের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য রেখ। অন্যান্য লোকদের তো ক্রমেই আর্থিক সচ্ছলতা এসে থাকে। কিনউত আনসারদের বর্তমান অবস্থার আলোকে সে অবকাশ নেই। তারা আমার গোপনীয়তার সংরক্ষক ও আশ্রয়দাতা ছিল। সুতরাং ভাল ব্যবহারের বদলায় তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। আর তাদের থেকে কোন মন্দ ব্যবহার পেলে মাফ করে দিও।”
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে বাড়ীর মধ্যে প্রবশে করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন।
এই সময় উম্মে সালামা ও মাইমুনা (রা) সহ তাঁর কতিপয় স্ত্রী এবং আসমা বিনতে উমাইস সহ মুসলমানদের কতিপয় স্ত্রীলোক তাঁর কাছে জমায়েত হলেন। তাঁর কাছে তাঁর চাচা আব্বাস (রা) আগেই উপস্থিত ছিলেন।
সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘লাদুদ’ নমাক ওষুধ খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। আর আব্বাস (রা) বললেন, “আমি তাঁকে অবশ্যই ‘লাদুদ’ খাওয়াবো।” শেষ পর্যন্ত তাঁকে লাদুদ খাওয়ানো হলো এবং তিনি সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে এ জিনিস কে খাইয়েছে?” সবাই বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার চাচা খাইয়েছেন।” তিনি বললেন, এটা হাবশার দিক থেকে আগত কিছু সংখ্যক মহিলার আনীত এক ধরনের ওষুধ। তোমরা কেন এটা প্রয়োগ করলে?” আব্বাস (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আশংকা করেছিলাম যে, আপনি ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হয়েছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঐ রোগে আল্লাহ আমাকে কখনো আক্রান্ত করবেন না। আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে আমার চাচা ছাড়া আর কেউ এই ‘লাদুদ’ থেকে অব্যাহতি পাবে না।” মাইমুনা (রা) কে রোযা অবস্থায় লাদুদ সেবন করতে হয়েছিল। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা তাঁর পরিবার-পরিজনকে ঐ ভুল কর্মের জন্য শাস্তি দোবর ব্যবস্থা করেছিলেন।
উসামা ইবনে যায়িদ (রা) বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়লে আমি এবং আমার সহগামী বাহিনী ও মুসলমানগণ মদীনায় ফিরে গেলাম এবং পরে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে, তিনি আকাশের দিকে হাত তুলতে লাগলেন এবং হাত নামিয়ে আমার গায়ে রাখতে লাগলেন। এতে বুঝলাম যে, তিনি আমার জন্য দোয় করছেন।
আয়িশা (রা) বলেনঃ
রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ মুহুর্তে উপস্থিত হলে তাঁর শেষ যে কথাটা উচ্চারিত হতে শুনেছি তা ছিল এই: “বরং জানাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু, তাঁকে আমি চাই।” আমি তা শুনে মনে মনে বললাম: তিনি আমাদেরকে অগ্রাধিকার দেন না। এই সময় আমি বুঝতে পারলাম তিনি যে বলতেন “কোন নবীকে জীবন ও মৃত্যুর ইখতিয়ার না দিয়ে মৃত্যু দেয়া হয়নি, “-তার। মনোনীত সেই প্রয়তম বস্তুই তাঁর এই উক্তিতে বিঘোষিত হয়েছে-“বরং জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু তাঁকে আমি চাই।”