2 of 11

১২.০২ ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে অমাবস্যায় ভক্তসঙ্গে — রাখালের প্রতি গোপালভাব

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৯ই মার্চ

ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে অমাবস্যায় ভক্তসঙ্গে — রাখালের প্রতি গোপালভাব

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি দুই-একটি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। আজ শুক্রবার (২৬শে ফাল্গুন), ৯ই মার্চ, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, মাঘের অমাবস্যা, সকাল, বেলা ৮টা-৯টা হইবে।

অমাবস্যার দিন, ঠাকুরের সর্বদাই জগন্মাতার উদ্দীপন হইতেছে। তিনি বলিতেছেন, ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। মা তাঁর মহামায়ায় মুগ্ধ করে রেখেছেন। মানুষের ভিতরে দেখ, বদ্ধজীবই বেশি। এত কষ্ট-দুঃখ পায়, তবু সেই ‘কামিনী-কাঞ্চনে’ আসক্তি। কাঁটা ঘাস খেয়ে উটের মুখে দরদর করে রক্ত পড়ে, তবু আবার কাঁটা ঘাস খায়। প্রসববেদনার সময় মেয়েরা বলে, ওগো, আর স্বামীর কাছে যাব না; আবার ভুলে যায়।

“দেখ, তাঁকে কেউ খোঁজে না। আনারসগাছের ফল ছেড়ে লোকে তার পাতা খায়।”

ভক্ত — আজ্ঞা, সংসারে তিনি কেন রেখে দেন?

[সংসার কেন? নিষ্কামকর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধির জন্য]

শ্রীরামকৃষ্ণ — সংসার কর্মক্ষেত্র, কর্ম করতে করতে তবে জ্ঞান হয়। গুরু বলেছেন, এই সব কর্ম করো, আর এই সব কর্ম করো না। আবার তিনি নিষ্কামকর্মের উপদেশ দেন। কর্ম করতে করতে মনের ময়লা কেটে যায়। ভাল ডাক্তারের হাতে পড়লে ঔষধ খেতে খেতে যেমন রোগ সেরে যায়।

“কেন তিনি সংসার থেকে ছাড়েন না? রোগ সারবে, তবে ছাড়বেন। কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করতে ইচ্ছা যখন চলে যাবে, তখন ছাড়বেন। হাসপাতালে নাম লেখালে পালিয়ে আসবার জো নাই। রোগের কসুর থাকলে ডাক্তার সাহেব ছাড়বে না।”

ঠাকুর আজকাল যশোদার ন্যায় বাৎসল্যরসে সর্বদা আপ্লুত হইয়া থাকেন, তাই রাখালকে কাছে সঙ্গে রাখিয়াছেন। ঠাকুরের রাখালের সম্বন্ধে গোপালভাব। যেমন মার কোলের কাছে ছোট ছেলে গিয়া বসে, রাখালও ঠাকুরের কোলের উপর ভর দিয়া বসিতেন। যেন মাই খাচ্ছেন।

[শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তসঙ্গে গঙ্গায় বানদর্শন]

ঠাকুর এইভাবে বসিয়া আছেন, এমন সময় একজন আসিয়া সংবাদ দিল যে, বান আসিতেছে। ঠাকুর, রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি সকলে বান দেখিবার জন্য পঞ্চবটী অভিমুখে দৌড়াইতে লাগিলেন। পঞ্চবটীমূলে আসিয়া সকলে বান দেখিতেছেন। বেলা প্রায় ১০৷৷টা হইবে। একখানা নৌকার অবস্থা দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “দেখ, দেখ, ওই নৌকাখানার অবস্থা বা কি হয়।”

এইবার ঠাকুর পঞ্চবটীর রাস্তার উপরে মাস্টার, রাখাল প্রভৃতির সহিত বসিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আচ্ছা, বান কি রকম করে হয়?

মাস্টার মাটিতে আঁক কাটিয়া পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, মাধ্যাকর্ষণ, জোয়ার, ভাটা; পূর্ণিমা, অমাবস্যা, গ্রহণ ইত্যাদি বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছেন।

[শ্রীরামকৃষ্ণ বাল্যকালে ও পাঠশালায় –The Yogi is beyond all finite relations of number, quantity, cause, effect.]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — ওই যা! বুঝতে পারছি না; মাথা ঘুরে আসছে! টনটন করছে! আচ্ছা, এত দূরের কথা কেমন করে জানলে?

“দেখ, আমি ছেলেবেলায় চিত্র আঁকতে বেশ পারতুম, কিন্তু শুভঙ্করী আঁক ধাঁধা লাগত! গণনা অঙ্ক পারলাম না।”

এইবার ঠাকুর নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছেন। দেওয়ালে টাঙানো যশোদার ছবি দেখিয়া বলিতেছেন, ”ছবি ভাল হয় নাই, ঠিক যেন মেলেনীমাসী করেছে।“

[শ্রীঅধর সেনের প্রথম দর্শন ও বলির কথা]

মধ্যাহ্ন-সেবার পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। অধর ও অন্যান্য ভক্তরা ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিলেন। অধর সেন এই প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করিতেছেন। অধরের বাড়ি কলিকাতা বেনেটোলায়। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বয়স ২৯।৩০।

[অবস্থা ও অহিংসা]

অধর (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — মহাশয়, আমার একটি জিজ্ঞাস্য আছে; বলিদান করা কি ভাল? এতে তো জীবহিংসা করা হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিশেষ বিশেষ অবস্থায় শাস্ত্রে আছে, বলি দেওয়া যেতে পারে। ‘বিধিবাদীয়’ বলিতে দোষ নাই। যেমন অষ্টমীতে একটি পাঁঠা। কিন্তু সকল অবস্থাতে হয় না। আমার এখন এমন অবস্থা, দাঁড়িয়ে বলি দেখতে পারি না। মার প্রসাদী মাংস, এ-অবস্থায় খেতে পারি না। তাই আঙুলে করে একটু ছুঁয়ে মাথায় ফোঁটা কাটি; পাছে মা রাগ করেন।

“আবার এমন অবস্থা হয় যে, দেখি সর্বভূতে ঈশ্বর, পিঁপড়েতেও তিনি। এ-অবস্থায় হঠাৎ কোন প্রাণী মরলে এই সান্ত্বনা হয় যে, তার দেহমাত্র বিনাশ হল। আত্মার জন্ম মৃত্যু নাই।”

[অধরকে উপদেশ — “বেশি বিচার করো না”]

“বেশি বিচার করা ভাল নয়, মার পাদপদ্মে ভক্তি থাকলেই হল। বেশি বিচার করতে গেলে সব গুলিয়ে যায়। এ-দেশে পুকুরের জল উপর উপর খাও, বেশ পরিষ্কার জল পাবে। বেশি নিচে হাত দিয়ে নাড়লে জল ঘুলিয়ে যায়। তাই তাঁর কাছে ভক্তি প্রার্থনা কর। ধ্রুবর ভক্তি সকাম। রাজ্যলাভের জন্য তপস্যা করেছিলেন। প্রহ্লাদের কিন্তু নিষ্কাম অহেতুকী ভক্তি।”

ভক্ত — ঈশ্বরকে কিরূপে লাভ হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই ভক্তির দ্বারা। তবে তাঁর কাছে জোর করতে হয়। দেখা দিবিনি, গলায় ছুরি দেব — এর নাম ভক্তির তমঃ।

ভক্ত — ঈশ্বরকে কি দেখা যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, অবশ্য দেখা যায়। নিরাকার, সাকার — দুই দেখা যায়। সাকার চিন্ময়রূপ দর্শন হয়। আবার সাকার মানুষ তাতেও তিনি প্রতক্ষ্য। অবতারকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা। ঈশ্বরই যুগে যুগে মানুষরূপে অবতীর্ণ হন!


 কর্মণ্যেবাধিকারাস্তে মা ফলেষু কদাচন ৷৷               [গীতা, ২।৪৭]

 ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।                              [গীতা, ২।২০]

 ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে                   [গীতা, ৪।৮]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *