2 of 11

১১.০১ গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে

বেলঘরে গ্রামে গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে

প্রথম পরিচ্ছেদ

গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে

১৮৮৩, ১৮ই ফেব্রুয়ারি

শ্রীরামকৃষ্ণ বেলঘরে শ্রীযুক্ত গোবিন্দ মুখুজ্জের বাটীতে শুভাগমন করিয়াছেন। আজ রবিবার, (৭ই ফাল্গুন) ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, মাঘ শুক্লা দ্বাদশী, পুষ্যানক্ষত্র। নরেন্দ্র, রাম প্রভৃতি ভক্তরা আসিয়াছেন, প্রতিবেশিগণ আসিয়াছেন। ৭/৮টার সময় প্রথমেই ঠাকুর নরেন্দ্রাদিসঙ্গে সংকীর্তনে নৃত্য করিয়াছিলেন।

[বেলঘরেবাসিকে উপদেশ — কেন প্রণাম — কেন ভক্তিযোগ ]

কীর্তনান্তে সকলেই উপবেশন করিলেন। অনেকেই ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন। ঠাকুর মাঝে মাঝে বলিতেছেন, “ঈশ্বরকে প্রণাম কর।” আবার বলিতেছেন, “তিনিই সব হয়ে রয়েছেন, তবে এক-এক জায়গায় বেশি প্রকাশ, যেমন সাধুতে। যদি বল, দুষ্ট লোক তো আছে, বাঘ সিংহও আছে; তা বাঘনারায়ণকে আলিঙ্গন করার দরকার নাই, দূর থেকে প্রণাম করে চলে যেতে হয়। আবার দেখ জল, কোন জল খাওয়া যায়, কোন জলে পূজা করা যায়, কোন জলে নাওয়া যায়। আবার কোন জলে কেবল আচান-শোচান হয়।”

প্রতিবেশী — আজ্ঞা, বেদান্তমত কিরূপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — বেদান্তবাদীরা বলে ‘সোঽহম্‌’ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; আমিও মিথ্যা। কেবল সেই পরব্রহ্মই আছেন।

“কিন্তু আমি তো যায় না; তাই আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর সন্তান, আমি তাঁর ভক্ত — এ-অভিমান খুব ভাল।

“কলিযুগে ভক্তিযোগই ভাল। ভক্তি দ্বারাও তাঁকে পাওয়া যায়। দেহবুদ্ধি থাকলেই বিষয়বুদ্ধি। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ — এই সকল বিষয়। বিষয়বুদ্ধি যাওয়া বড় কঠিন। বিষয়বুদ্ধি থাকতে ‘সোঽহম্‌’ হয় না।

“ত্যাগীদের বিষয়বুদ্ধি কম, সংসারীরা সর্বদাই বিষয়চিন্তা নিয়ে থাকে, তাই সংসারীর পক্ষে ‘দাসোঽহম্‌’।”

[বেলঘরেবাসী ও পাপবাদ ]

প্রতিবেশী — আমরা পাপী, আমাদের কি হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর নামগুণকীর্তন করলে দেহের সব পাপ পালিয়ে যায়। দেহবৃক্ষে পাপপাখি; তাঁর নামকীর্তন যেন হাততালি দেওয়া। হাততালি দিলে যেমন বৃক্ষের উপরের পাখি সব পালায়, তেমনি সব পাপ তাঁর নামগুণকীর্তনে চলে যায়।

“আবার দেখ, মেঠো পুকুরের জল সূর্যের তাপে আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। তেমনি তাঁর নামগুণকীর্তনে পাপ-পুষ্করিণীর জল আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়।

“রোজ অভ্যাস করতে হয়। সার্কাসে দেখে এলাম ঘোড়া দৌড়ুচ্ছে তার উপর বিবি একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত অভ্যাসে ওইটি হয়েছে।

“আর তাঁকে দেখবার জন্য অন্ততঃ একবার করে কাঁদ।

“এই দুটি উপায় — অভ্যাস আর অনুরাগ, অর্থাৎ তাঁকে দেখবার জন্য ব্যাকুলতা।”

[বেলঘরেবাসীর ষট্‌চক্রের গান ও শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ]

বৈঠকখানাবাড়ির দোতলা ঘরের বারান্দায় ঠাকুর ভক্তসঙ্গে প্রসাদ পাইতেছেন; বেলা ১টা হইয়াছে। সেবা সমাপ্ত হইতে না হইতে নিচের প্রাঙ্গণে একটি ভক্ত গান ধরিলেন:

জাগ জাগ জননি,
মূলাধারে নিদ্রাগত কতদিন গত হল কুলকুণ্ডলিনী।

ঠাকুর গান শুনিয়া সমাধিস্থ। শরীর সমস্ত স্থির, হাতটি প্রসাদপাত্রের উপর যেরূপ ছিল, চিত্রর্পিতের ন্যায় রহিল। খাওয়া আর হইল না। অনেকক্ষণ পরে ভাবের কিঞ্চিৎ উপশম হইলে বলিতেছেন, “আমি নিচে যাব, আমি নিচে যাব।”

একজন ভক্ত তাঁহাকে অতি সন্তর্পনে নিচে লইয়া যাইতেছেন।

প্রাঙ্গণেই সকালে নামসংকীর্তন ও প্রেমানন্দে ঠাকুরের নৃত্য হইয়াছিল। এখনও সতরঞ্চি ও আসন পাতা রহিয়াছে। ঠাকুর এখনও ভাববিষ্ট; গায়কের কাছে আসিয়া বসিলেন। গায়ক এতক্ষণে গান থামাইয়াছিলেন। ঠাকুর অতি দীনভাবে বলিতেছেন, “বাবু, আর-একবার মায়ের নাম শুনব।”

গায়ক আবার গান গাহিতেছেন:

জাগ জাগ জননি,
মূলাধারে নিদ্রাগত কতদিন গত হল কুলকুণ্ডলিনী।
স্বকার্যসাধনে চল মা শিরোমধ্যে, পরম শিব যথা সহস্রদলপদ্মে,
করি ষট্‌চক্র ভেদ (মাগো) ঘুচাও মনের খেদ, চৈতন্যরূপিণি।

গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট।


 অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।                                    [গীতা, ১২/৫]
 …মামেকং শরণং ব্রজ, অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি।           [গীতা, ১৮/৬৬]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *