০৭. হেজাযের নেতৃত্ব

হযরত ঈসমাইল (আ) থেকেই মক্কায় মানব বসতি গড়ে ওঠে। তিনি ১৩৭ বেঁচে ছিলেন। যতোদিন জীবিত ছিলেন ততোদিনই ছিলেন মক্কায় নেতা এবং কাবাঘরের মতোওয়াল্লী। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র নাবেত এবং কাইদার মক্কায় শাসনকার্য পরিচলনা করেন।
এই দুজনের মধ্যে কে আগে এবং কে পরে ক্ষমতাশীল ছিলেন- এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এদের পরে এদের নানা মাজাজ ইবনে জোরহামি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এমনি করে মক্কার শাসন ক্ষমতা জোরহামিদের হাতে চলে যায়। র্দীঘদিন এ ক্ষমতা তাদের কাছে থাকে। হযরত ঈসমাইল (আ) তাঁর পিতার সাথে কাবাঘর নির্মাণ করায় যদিও তাঁর বংশধরদের একটি সম্মানজনক অবস্থা ছিল, কিন্তু ক্ষমতা ও নেতৃত্বে পরবর্তী সময়ে তাদের কোনো অংশ ছিল না।
বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু হযরত ঈসমাইল (আ) এর বংশধররা অজ্ঞাত পরিচয় অবস্থা থেকে বাইরে আসতে পারননি। বখতে নসেরর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে বনু জোরহামের ক্ষমতা দূর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার রাজনৈতিক গগনে আদনানীদের রাজনৈতিক নক্ষত্র চমকাতে শুরু করে। এর প্রমাণ এই যে, ইরক নামে জায়গায় বখতে নসর আবরদের সাথে যে যুদ্ধ করেন, সেই যুদ্ধে আরব সেনাদলের অধিনায়কদের মধ্যে জোরহাম গোত্রের কেউ ছিলেন না।
যৃষ্টপূর্ব ৫৮৭ সালে বখতে নসরের দ্বিতীয় অভিযানের সময়ে বনু আদনান ইয়মেনে পালিয়ে যায়। সেই বনী ঈসরাইলের নবী ছিলেন হযরত ইয়ারমিয়াহ (আ)। তিনি আদনানের পুত্র মায়া’দকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ায় যান। বখতের নসেরর দাপট হ্রাস পাওয়ার পর মায়া’দ মক্কায় ফিরে আসেন। এ সময়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে, মক্কায় জোহামের গোত্রের জোরশাম নামে শুরু একজন লোর রয়েছেন। জোরশাম ছিলেন জোরহামার গোত্র। মায়া’দ তখন জোরশামের কন্যা মায়া’নার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার গর্ভ থেকে নাযার জন্মগ্রহণ করেন।
সে সময় মক্কায় জোরহামের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। দারিদ্রের নিষ্পষণে তারা ছিলো জর্জরিত। এর ফলে তারা কাবাঘর তওয়াফ করতে আসা লোকদের ওপর বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয় এমনকি কাবাঘরের অর্থ-সম্পদ আত্নসাৎ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। বনু আদনান বনু জোহামের এসব কাজে ভেতরে ভেতরে ছিলো দারুন অসন্তুষ্ট। ফলে বনু খোজায়া মাররাজ জাহরানে অভিযানের সময় আদনান বংশের লোকদের লোভকে কাজে লাগায়। বনু খোজায়া আদনান গোত্রের বনু বকর ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে কেনানাকে সঙ্গে নিয়ে বনু জোরহামের বিরুদ্ধে যুদ্থ ঘোষণা করে। যুদ্ধে বনু জোরহাম পরাজিত হয়ে মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। এ ঘটনা ঘটেছিলো খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
মক্কা ছেড়ে যাওয়ার সময় বনু জোরহাম যমযম কূপ ভরাট করে দেয়। এ সময় তারা যমযমে কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন নিক্ষপ করে তা প্রায় ভরাট করে ফেলে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আমর ইবনে হারেস মায়ায জোরহামি কাবাঘরের দুটি সোনার হরিণ এবং কাবার কোণে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদকে বের করে যমযম কুপে প্রোথিত করে। এরপর তারা জোরহাম গোত্রের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমনে চলে যায়। বনু জোরহাম মক্কা থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং ক্ষমতা হারানোর ব্যথা ভুলতে পারছিলো না। জোরহাম গোত্রের আমর নামক এক ব্যক্তি এ সম্পর্কে রচিত কবিতায় বলেছেন, আজুন থেকর সাফা পর্যন্ত মিত্র কেউ নেই, রাতের মহফিলে নেই গল্প বলার কেউ। নেই কেন, আমরা তো এখানের অধিবাসী, সময়ের আর্বতনে ভাঙ্গা কপাল, হায়রে, হায় আজ আমাদের করে দিয়েছে সর্বহারা!
হযরত ইসমাইল (আ) এর সময়কাল ছিলো খৃষ্টপূর্ব প্রায় দু’হাজার বছর আগে। এ হিসাবে অনুযায়ী মক্কায় জোরহাম গ্রোত্রের অস্তিত্ব ছিলো দুই হাজার একশত বছর। প্রায় দু’হাজার বছর তারা রাজত্ব করেছিলো।
বনু খোজায়া মক্কায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের পর বনু বকরকে বাদ দিয়ে শাসনকার্য পরিচলনা করতে থাকে। তবে মর্যাদা সম্পন্ন তিন পদে মোদারী গোত্রের লোকদের অধিষ্ঠিত করা হয়। পদ তিনটি নিম্নরূপঃ
(এক) হাজীদের আরাফাত থেকে মোযদালেফায় নিয়ে যাওয়া এবং ইয়াওমুন নাহারে হাজীদের মিনা থেকে রওয়ানা হওয়ার পরোয়ানা প্রদান। ১৩ই জিলহজ্জ হচ্ছে ইয়াওমুন নাহার, এইদিন হচ্ছে হজ্জে শেষদিন। এই মর্যাদা ইলিয়াস ইবনে মোদায়ের পরিবার বনু সাওম ইবনে মাররার অধিকারে ছিলো। এদেরকে সোফা বলা হতো। সোফার একজন লোক পাথর নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত ১৩ই জিলহ্জ্জ হাজীরা পাথর নিক্ষেপ করতে পারতেন না। হাজীদের পাথর নিক্ষেপ এবং মিনার রওয়ানা হওয়ার সময় সোফার লোকেরা মিনার একমাত্র পথ আকবার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাদের যাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন হাজী সে পথ অতিক্রম করতে পারত না। তাদের যাওয়ার পর অন্য লোকদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো। সোফাদের পর এই বিরল সম্মান বনু তামিমের একটি পরিবার বনু সা’দ ইবনে যায়েদ মানাত লাভ করে।
(দুই) ১০ই জিলহ্জ্জ সকালে মোযদালেফা থেকে মিনার যাওয়ার সম্মান বনু আদনানের অধিকারে ছিলো।
(তিন) হারাম মাসসমূহ এগিয়ে নেয়া এবং পিছিয়ে নেয়া। বনু কেনানহ গোত্রের একটি শাখা বনু তামিম ইবনে আদী এই মর্যাদার অধিকারী ছিলো।
মক্কার ওপর বনু খোজায়া গোত্রের আধিপত্য তিনশত বছর স্থায়ী ছিলো। এই সময় আদনানী গোত্রসমূহ মক্কা এবং হেজায থেকে বের হয়ে নজদ, ইরাকের বিভিন্ন এলাকা, বাহরাইন এবং অন্যত্র প্রসারিত হয়। মক্কার আশেপাশে কোরাইশদের কয়েকটি শাখা অবশিষ্ট থাকে। এরা ছিলো বেদুইন। এদের পৃথক পৃথক দল ছিলো এবং বনু কেনানায় এদের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পরিবার বসবাস করছিলো। মক্কার শাসন পরিচলনা কাবাঘরের রুক্ষণাবেক্ষণে এদের কোন ভূমিকা ছিলো না। এরপর কুসাই ইবনে কেলাবের আবির্ভাব ঘটে। কুসাই সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, সে মায়ের কোলে থাকতেই তার পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তার মা বনু ওজরা গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হন। স্বামীর গোত্র সিরিয়ায় থাকায় কুসাইয়ের মা সিরিয়ায় চলে যান। কুসাইকেও সঙ্গে নিয়ে যান। যবুক হওয়ার পর কুসাই মক্কা ফিরে আসেন। সে সময় মক্কার গভর্ণর ছিলেন হোলাইল ইবনে হাবশিয়া খোযায়ী। কুসাই হোলাইলের কন্যা হোবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। হোলাইন সে প্রস্তাব গ্রহণ করে হোবাকে বিবাহ দেন। হোলাইলের মৃত্যুর পর মক্কা ও কাবাঘরের ওপর আধিপত্যের বিষয় নিয়ে খোযায়ী এবং কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে জয়লাভ করে কুসাই মক্কয় শাসন ক্ষমতা এবং কাবাঘরের রক্ষণাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার লাভ করেন।
এ যুদ্ধের কারণ কি ছিলো? এ সম্পর্কে তিনটি বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রথমতঃ কুসাইয়ের বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য আসার পর কুসাইয়ের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এদিকে হোলাইয়ের মৃত্যু হলে কুসাই চিন্তা করলেন যে, বনু খোজোয়া এবং বনু বকরের পরিবর্তে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মক্কার শাসন পরিচলনার জন্যে আমি উপযুক্ত। তিনি একথাও চিন্তা করেছিলেন যে, কোরায়শরা নির্ভেজাল শুধু তাদেরই রয়েছে। এসব কথা চিন্তা করে কুসাই কোরায়শ এবং বনু খোযাআ গোত্রের কয়েকজন লোকের সাথে আলোচনা করেন। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বনু খোযায়া এবং বনু বকরকে মক্কা থেকে বের করে না দেয়ার কোন চযক্ত আছে কি? সবাই তার সাথে ঐক্যমত প্রকাশ এবং সমর্থন জানালো।
দ্বিতীয়তঃ মৃত্যুর সময়ের কুসাইয়ের শ্বশুর হোলাইল অসিয়ত করেছিলেন যে, কুসাই কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মক্কা শাসন করবেন।
তৃতীয়তঃ হোলাইল তার কন্যা হোবাকে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। আবু গিবশান খোযায়ীকে উকিল নিযুক্ত করা হয়।
হোবার প্রতিনিধি হিসাবে আবু গিবশান কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। হোলাইলের মৃত্যুর পর কুসাই এক মশক মদের বিনিময়ে আবু গিবশানের কাজ থেকে কাবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা ক্রয় করেন। কিন্তু খোযায়া গোত্র এ ক্রয়-বিক্রয় অনুমোদন করেনি। তারা কুসাইকে কাবাঘরের যেতে বাধা দেয়। এর ফলে কুসাই বনু খোযায়াদের মক্কা থেকে বের করে দেয়ার জন্যে কোরায়শ এবং বনু কেনানাদের একত্রিত করে। কুসায়ের ডাকে সবাই সাড়া দেয় এবং বনু খোযায়াদের মক্কা থেকে বের করে দেয়া হয়।
মোটকথা, কারণ যাই হোক না কেন ঘটনাধারা ছিলো এরূপ যে, হোলাইলের মৃত্যুর পর সোফা গোত্রের লোকেরা ইতিপূর্বে যা করতো তারা তাই করতে চাইলো। এ সময় কুসাই কোরায়শ এবং কেনানা গোত্রের লোকদের একত্রিত করেন। আকবার পথের ধারে সমবেত লোকদের কুসাই বললেন, তোমরা চেয়ে আমরা এ সম্মানের অধিক যোগ্য। একথার পর উভয় পক্ষে তুমুল সংর্ঘষ শুরু হয় এবং কুসাই সোফাদের কাজ থেকে মর্যদা ছিনিয়ে নেন। এ সময়ে বনু খোজায়া এবং বনু বকর গোত্রের লোকেরা কুসাইয়ের সাথে একাত্নতা প্রকাশ করার পরিবর্তে তার বিরোধিতা করে। এতে কুসাই তাদের হুমকি দেন। ফলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ বেধে যায় এবং বহু লোক মারা যায়। যুদ্ধের পর সন্ধির শর্ত অনুযারী কুসাই মক্কায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনবির্ন্যাস করেন। মক্কার বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরায়শদের ডেকে আনে তাদেরকে প্রশাসনের সাথে যুক্ত করে। এছাড়া তিনি প্রত্যেক কোরায়শ পরিবারের বসবাসের জন্যে নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করেন। মাসের হিসাব গগণাকারী, আলে সফওয়ানদের বনু্ আদওয়ান এবং বনু মাররা ইবনে আওফকে তাদের পদমর্যাদায় টিকিয়ে রাখেন। কুসাই মনে করতেন এটাও ধর্মের অংশ, এতে রদবদলের অধিকার কারো নেই।
কাবা ঘরের উভয় দিকে দারুন নোদওয়া প্রতিষ্ঠা করা কুসাইয়ের অন্যতম কীর্তি। এর দারোজা ছিলো মসজিদের দিকে। দারুন নোদওয়া ছিলো প্রক্রতপক্ষে কোরায়শদের সংসদ ভবন। কোরায়শদের সামাজিক জীবনে দারুন নোদওয়ার গুরুত্ব ও প্রভাব ছিলো অসামান্য। এই প্রতিষ্ঠান ছিলো কোরায়শদের ঐক্যের প্রতীক। সমাজের বহু জটিল সমস্যার সমাধান এখানে হতো।
কুসাই নিম্নোলিখিত মর্যাদার ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
(এক) দারুন নোদওয়ার সভাপতি। এখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ হতো। যুবক- যুবতীদের বিয়েও এখানে অনুষ্ঠিত হতো।
(দুই) লেওয়া,অর্থ্যাৎ যুদ্ধের পতাকা কুসাইয়ের হাতে বেঁধে রাখা হতো।
(তিন) হেজাবাত বা কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ। এর মানে হচ্ছে কাবাঘরের দরোজা কুসাই খুলতেন এবং কাবাঘরের যাবতীয় খেদমত এবং রক্ষণাবেক্ষণ তার তদারকিতেই সম্পন্ন হতো।
(চার) সেকায়া বা পানি পান করানো। কয়েকটি হাউযে হাজীদের জন্যে পানি ভরে রাখা হতো। এরপর সেই পানিতে খেজুর এবং কিসমিস মিশিয়ে তা মিঠা করা হতো। হজ্বযাত্রীরা মক্কায় এলে সেই পানি পান করতেন।
(পাঁচ) রেফায়া বা হাজীদের মেহমানদারী। এর অর্থ হচ্ছে হাজীদের মেহমানদারীর জন্যে খাবার তৈরী করা। এ উদ্দেশ্য কোরায়শদের ওপর নির্ধারিত পরিমান চাঁদা ধার্য করে দিতেন। সেই অর্থে হ্জ্জ মৌসুমে কুসাইয়ের কাছে মতা দিতে হতো। কুসাই জামাকৃত অর্থে হাজীদের জন্যে খাবার তৈরী করতেন। দরিদ্র ও নিঃস্ব হাজীদেরকে সেসব খাবার পরিবেশন করা হতো। যেসব হাজীর কাছে বাড়ী ফিরে যাওয়ার অর্থ সম্বল থাকতো না তাদের সাহয্যও করা হতো।
কুসাই উল্লেখিত সকল প্রকার পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। কুসাই-এর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ছিলো আবদুদ দার। দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিলো আবদে মান্নাফ। দ্বিতীয় পুত্র কুসাইয়ের জীবদ্দশাতেই নেতৃত্ব কর্তৃত্বের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। এ কারণে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুদ দারকে বলেছিলেন, ওরা যদিও তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমি তোমাকে তাদের সমমর্যাদার উন্নীত করবো। এরপর কুসাই সকল পদমর্যাদার ব্যাপারে আবদুদ দারকে উত্তরসূরী করে ওসিয়ত করে যান। অর্থ্যাৎ দারুন নোদওয়ার সভাপতি, কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ, যুদ্ধের পতাকা বহন, হাজীদের পানি পান এবং মেহমানদারী এ সব কিছুরই দায়িত্ব তিনি আবদুদ দারকে ন্যস্ত করেন। জীবদ্দশায় কুসাই-এর কোনো কথা এবং কাজের কেউ প্রতিবাদ করতো না। বরং সব কিছু সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতো। এ কারণে মৃত্যুর পরেও তার সব সিন্ধান্ত সবাই বিনা সমালোচনায় মেনে নিয়েছিলো। কুসাইয়ের সন্তানরা পিতার ওসিয়তের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করেন। আবদে মান্নাফের মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা চাচাতো ভাইদের উল্লেখিত বিষয়গুললোতে দরকষাকষি শুরু করে। চাচাতো ভাইদের একক পদমর্যাদার সমলোচনা করে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে। এর ফলে কুরায়শরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু একপর্যায়ে উভয় পক্ষ আপোস নিষ্পত্তির প্রসঙ্গ উন্থাপন করে এবং বিভিন্ন মর্যাদার নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এরপর হাজীদের পানি পান করানো এবং আতিথেয়তার দায়িত্ব বনু আবদে মান্নাফের ওপর ন্যস্ত করা হয়। দারুন নোদওয়ার নেতৃত্ব এবং কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আবদুদ দারের সন্তানদের হাতে থাকে। অর্জিত পদ মর্যাদার ব্যাপারে আবদে মান্নাফের সন্তানেরা কোরা অর্থ্যাৎ লটারির ব্যবস্থা করেন। কোরায় আবদে মান্নাফের পুত্র হাশেমের নাম ওঠে। এর ফলে হাশেম সারা জীবন হাজীদের পানি পান করানো এবং হাজীদের মেহমানদারীর দায়িত্ব পালন করেন। হাশেমের মৃত্যুর পর তার ভাই মোত্তালেব এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মোত্তালেবের পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল মোত্তালেবের ওপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাদা। আবদুল মোত্তালেবের পর তার সন্তানরা এই পবিত্র দায়িত্ব লাভ করেন। ইলামের আর্বভাবের পর আবদুল মোত্তালেবের পুত্র আব্বাস এ দায়িত্ব লাভ করেন।
এসব ছাড়া আরো কিছু পদমর্যাদা ছিল, যেসব কোরায়শরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এসব পদমর্যাদার মাধ্যমে কোরায়শরা একটি ছোটখাট সরকার গঠন করে রেখেছিলেন। সে সরকারের ব্যবস্থাপনা ছিল অনেকটা বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতির মতো। পদমর্যদার রূপরেখা ছিল নিম্নরূপ।
(এক) ঈসার, অর্থ্যাৎ ফালগিরি। ভাগ্য জানার জন্যে মূর্তিদের কাছে যে তীর রাখা হতো, সে তীরের রক্ষণাবেক্ষণ। এই মর্যাদা ছিল বনু জমহের কাছে।
(দুই) অর্থ ব্যবস্থাপনা, মূর্তিদের নৈকট্য লাভের জন্যে যেসব উপঢৌকন, নযরানা এবং কোরবানী পেশ করা হতো তার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া ঝগড়া-বিবাদের ফয়সালা করার দ্বায়িত্বও বনু সাহাম দেয়া হয়েছিলো।
(তিন) শূরা, এ সম্মান বনু আসাদের কাছে ছিলো।
(চার) আশনাক, ক্ষতিপূরণ এবং জরিমানার অর্থ আদায় ও বন্টন। বনু তাঈম গোত্র এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলো।
(পাঁচ) উকাব, জাতীয় পত্কা বহন বহন। এ দায়িত্ব বনু উমাহিয়া গোত্রের ওপর ন্যস্ত ছিলো।
(ছয়) কুব্বা, সাময়িক ছাউনির ব্যবস্থপনা এবং সৈন্যদের অধিনায়কত্ব। এ সম্মান বনু মাখযুমের অধিকার ছিল।
(সাত) সাফায়াত, সফর সম্পকিত বিষয় তত্ত্ববধান। এ দায়িত্ব বনু আদী গো্ত্র পালন করতো।