1 of 11

০৬.০১ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘সমাধিমন্দিরে’

শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের সহিত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নৌকাবিহার,
আনন্দ ও কথোপকথন

প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘সমাধিমন্দিরে’

আজ কোজাগর লক্ষ্মীপূজা। শুক্রবার ২৭শে অক্টোবর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বসিয়া আছেন। বিজয় (গোস্বামী) ও হরলালের সহিত কথাবার্তা কহিতেছেন। একজন আসিয়া বলিলেন, কেশব সেন জাহাজে করিয়া ঘাটে উপস্থিত। কেশবের শিষ্যেরা প্রণাম করিয়া বলিলেন, “মহাশয়, জাহাজ এসেছে, আপনাকে যেতে হবে, চলুন একটু বেড়িয়ে আসবেন; কেশববাবু জাহাজে আছেন, আমাদের পাঠালেন।”

বেলা ৪টা বাজিয়া গিয়াছে। ঠাকুর নৌকা করিয়া জাহাজে উঠিয়াছেন। সঙ্গে বিজয়। নৌকায় উঠিয়াই বাহ্যশূন্য! সমাধিস্থ!

মাস্টার জাহাজে দাঁড়াইয়া সেই সমাধি-চিত্র দেখিতেছেন! তিনি বেলা তিনটার সময় কেশবের জাহাজে চড়িয়া কলিকাতা হইতে আসিয়াছেন। বড় সাধ, দেখিবেন ঠাকুর ও কেশবের মিলন ও তাঁহাদের আনন্দ, শুনিবেন তাঁহাদের কথাবার্তা। কেশব তাঁহার সাধুচরিত্র ও বক্তৃতাবলে মাস্টারের ন্যায় অনেক বঙ্গীয় যুবকের মন হরণ করিয়াছেন। অনেকেই তাঁহাকে পরম আত্মীয়বোধে হৃদয়ের ভালবাসা দিয়াছেন। কেশব ইংরেজী পড়া লোক, ইংরেজী দর্শন সাহিত্য পড়িয়াছেন। তিনি আবার দেবদেবীপূজাকে অনেকবার পৌত্তলিকতা বলিয়াছেন। এইরূপ লোক শ্রীরামকৃষ্ণকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন, আবার মাঝে দর্শন করিতে আসেন; এটি বিস্ময়কর ব্যাপার বটে। তাঁহাদের মনের মিল কোন্‌খানে বা কেমন করিয়া হইল — এ-রহস্য ভেদ করিতে মাস্টারাদি অনেকেই কৌতূহলাক্রান্ত হইয়াছেন। ঠাকুর নিরাকারবাদী বটেন, কিন্তু আবার সাকারবাদী। ব্রহ্মের চিন্তা করেন, আবার দেবদেবী-প্রতিমার সম্মুখে ফুল-চন্দন দিয়া পূজা ও প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নৃত্যগীত করেন। খাট-বিছানায় বসেন, লালপেড়ে কাপড়, জামা, মোজা, জুতা পরেন। কিন্তু সংসার করেন না। ভাব সমস্ত সন্ন্যাসীর; তাই লোকে পরমহংস বলে। এদিকে কেশব নিরাকারবাদী, স্ত্রী-পুত্র লইয়া সংসার করেন, ইংরেজীতে লেকচার দেন, সংবাদপত্রে লেখেন, বিষয়কর্ম করেন।

সমবেত কেশব-প্রমুখ ব্রাহ্মভক্তগণ জাহাজ হইতে ঠাকুরবাড়ির শোভা সন্দর্শন করিতেছেন। জাহাজের পূর্বদিকে অনতিদূরে বাঁধা ঘাট ও ঠাকুরবাড়ির চাঁদনি। আরোহীদের বামপার্শ্বে চাঁদনির উত্তরে দ্বাদশ শিবমন্দিরের ক্রমান্বয়ে ছয় মন্দির, দক্ষিণপার্শ্বেও ছয় শিবমন্দির। শরতের নীল আকাশ চিত্রপটে ভবতারিণীর মন্দিরের চূড়া ও উত্তরদিকে পঞ্চবটী ও ঝাউগাছের মাথাগুলি দেখা যাইতেছে। বকুলতলার নিকট একটি ও কালীবাড়ির দক্ষিণ-প্রান্তভাগে আর একটি নহবতখানা। দুই নহবতখানার মধ্যবর্তী উদ্যানপথ, ধারে ধারে সারি সারি পুষ্পবৃক্ষ। শরতের নীলাকাশের নীলিমা জাহ্নবীজলে প্রতিভাসিত হইতেছে। বহির্জগতে কোমলভাব, ব্রাহ্মভক্তদের হৃদয়মধ্যে কোমলভাব। ঊর্ধ্বে সুন্দর সুনীল অনন্ত আকাশ, সম্মুখে সুন্দর ঠাকুরবাড়ি, নিম্নে পবিত্রসলিলা গঙ্গা, যাঁহার তীরে আর্য ঋষিগণ ভগবানের চিন্তা করিয়াছেন। আবার আসিতেছেন একটি মহাপুরুষ, সাক্ষাৎ সনাতন ধর্ম। এরূপ দর্শন মানুষের কপালে সর্বদা ঘটে না। এরূপ স্থলে, সমাধিস্থ মহাপুরুষে কাহার ভক্তির না উদ্রেক হয়, কোন্‌ পাষাণহৃদয় না বিগলিত হয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *