০৬. উইল – ষষ্ঠ অধ্যায়

উইল – ষষ্ঠ অধ্যায়

হিন্দু আইনে উইলের ন্যায় কোনও ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ মৃত্যুর পর সম্পত্তির কি হইবে তাহা কেহ ভাবিতেন না, এবং সেজন্য কেহ উইলও করিতেন না। যাহাদের পুত্র থাকিত তাহাদের কিছু ভাবিবার প্রয়োজন হইত না, যাহাঁদের পুত্ৰ না হইত তাহার দত্তকগ্রহণ করিয়া সম্পত্তির ব্যবস্থা করিয়া যাইতেন। যাহার: আত্মীয় স্বজনকে কিছু দিয়া যাইতে ইচ্ছা করিতেন, তাহার। জীবিত থাকিতে দান করিতেন, অথবা মৃত্যুশয্যায় দান করিয়া যাইতেন।

ইংরাজগণের আগমনের পর এই দেশে উইল প্রচলিত হয়, এবং তাঁহাদের নিকট হইতেই এদেশীয় লোক উইল করিতে শিক্ষা করে। কলিকাতা প্রভৃতি বড় বড় স্থানের ধনী ব্যক্তিগণ সম্পত্তি সম্বন্ধে কোনও ব্যবস্থা করিতে হইলে ইংরাজ আইনজ্ঞগণের পরামর্শ লইতেন এবং তাহাদের নিকট হইতে উইলের কথা শুনিয়া সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেন। এইরূপে সহরের মধ্যে উইল খুব প্রচলিত হইল, এবং পরে মহরের লোকের দেখাদেখি মফঃস্বলের লোকেরাও উইল করিতে শিখিল। ১৭৫৮ সালে উমিচাঁদ এদেশে সৰ্ব্বপ্রথম উইল করেন।

কে কোন সম্পত্তি উইল করিতে পারেন

দান সম্বন্ধে আইনের যে বিধানগুলি আছে, উইল সম্বন্ধেও তাহার অনেকগুলি প্রযোজ্য হয়। ষে ব্যক্তি যে সম্পত্তি দান করিতে পারেন, তিনি তাহা উইল করিয়াও দিয়া যাইতে পারেন। পুত্রগণকে বঞ্চিত করিয়া পিতা তাহার সম্পত্তি যে কোনও ব্যক্তিকে দান করিয়া বাইতে পারেন, উইল করিয়াও দিয়া যাইতে পারেন। এজমালী সম্পত্তির কোনও এক মালিক তাহার নিজ অংশ দান করিয়া যাইতে পারেন, উইল করিয়াও দিয়া যাইতে পারেন। স্ত্রীলোক তাহার স্ত্রীধন সম্পত্তি দান করিতে পারেন, উইল করিয়াও দিয়া যাইতে পারেন। স্ত্রীলোক যে সম্পত্তি জীবনস্বত্বে পাইয়া থাকেন, তাহা তিনি দান করিতেও পারেন না, উইল করিতেও পারেন না।

উইলকর্তার ক্ষমতা

দান এবং উইলে প্রভেদ এই যে, দানকার্য্য দ্বারা সম্পত্তি তৎক্ষণাৎ হস্তান্তরিত হইয়া যায়, কিন্তু উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুর পব তবে উইল কাৰ্য্যকর হয়। আর একটী প্রভেদ এই যে, উইলকৰ্ত্তা উইল প্রত্যাহার করিতে পারেন, কিন্তু দান সহজে প্রত্যাহার করা চলে না।

দাতা যেমন তাঁহার সম্পত্তি জীবনস্বত্বে বা নির্ব্যুঢ়স্বত্বে দান করিতে পারেন, উইলকর্তাও সেইরূপ উইল করিয়া তাহার সম্পত্তি জীবনস্বত্বে বা নির্ব্যূঢ়স্বত্বে দিয়া যাইতে পারেন। দাতা যেমন এই সৰ্ত্তে দান করিতে পারেন যে গ্রহীতা দাতাকে ভরণপোষণ করিবে বা দাতার গৃহদেবতার পূজা নিৰ্বাহ করবে, উইলকৰ্ত্তাও সেইরূপ আদেশ দিয়া যাইতে পারেন যে, যাহাকে তিনি সম্পত্তি দিতেছেন সে তাঁহার কন্যাকে ভরণপোষণ করিবে, বা তাহার ঋণ পরিশোধ করিবে।

উইলকর্তা যখনই কোনও সর্তে উইল করিয়া যাইবেন, তখনই তাহার এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক যে ঐ সর্বগুলি যেন হিন্দু আইনবিরুদ্ধ না হয়। শ্ৰীযুক্ত প্রসন্নকুমার ঠাকুর এই মৰ্ম্মে তাঁহার উইল করিয়া গিয়াছিলেন—“আমার একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্ৰীষ্টানধৰ্ম্ম গ্রহণ করিয়াছে, আমি তাহাকে ত্যজ্যপুত্র করিলাম; সে এই উইল অনুসারে কিছুই পাইবে না। আমার সম্পত্তি নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ পাইবে যথা—যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর জীবনস্বত্বে পাইবে, তাহার পর যতীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবনস্বত্বে; তাহার পর যতীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবনস্বত্বে; তাহার পর যতীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের অন্য পুরুষ ওয়ারিসগণ জীবনস্বত্বে; তাঙ্গর পর যতীন্দ্রমোহনের অন্য পুত্ৰগণ জীবনস্বত্বে; তাহার পর যতীন্দ্রমোহনের অন্য পুত্ৰগণের পুরুষ ওয়ারিসগণ জীবনস্বত্বে; তাহার পর সৌরীন্দ্রমোহন জীবনস্বত্বে; তাহার পর সৌরীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবনস্বত্বে; তাহার পর সৌরীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের জ্যেষ্ঠপুত্র জীবনস্বত্বে; তাহার পর সৌরীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্রের অন্ত পুরুষ ওয়ারিসগণ জীবনস্বত্বে; ত{হার পর সৌরীন্দ্রমোহনের অন্য পুত্ৰগণ জীবনস্বত্বে; তাহার পর সৌরীন্দ্রমোহনের অন্য পুত্ৰগণের পুরুষ ওয়ারিসগণ জীবনস্বত্বে; তাহার পর ললিতমোহন জীবনস্বত্বে” ইত্যাদি। আরও ঐ উইলে স্পষ্ট বিধান ছিল যে কোনও স্ত্রীলোক ঐ সম্পত্তি পাইবে না, এমন কি স্ত্রীলোকের বংশের ওয়ারিস (যথা দৌহিত্র, ভাগিনেয়) পাইবে না। এই উইল লইয়া যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিরুদ্ধে জ্ঞানেন্দ্রমোহন নালিস করিলেন; মোকদম প্রিভিকৌ{সল পৰ্য্যন্ত গেল; এবং হিন্দুগণের উইল সম্বন্ধে যতকিছু প্রশ্ন উঠিত পারে তাহা সমস্তই এই মোকদ্দমায় আলোচিত হইঘাছিল। যাহা হউক, প্রিভিকৌন্সিল স্থির করিলেন যে যতীন্দ্রমোহনকে জীবনস্বত্বে দান করার সত্ত্বট সিদ্ধ, এতদ্ভিন্ন এই উইলের বাকী সৰ্বগুলি হিন্দু-আইনবিরুদ্ধ; হিন্দু-আইন অনুসারে পিতার মৃত্যুর পর পিতার সম্পত্তি সকল পুত্ৰই একসঙ্গে পাইল থাকেন। কিন্তু এ স্থলে উইলে ব্যবস্থা করা হইয়াছে যে যতীন্দ্রমোহনের পর শুধু যতীন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ, পুত্রই পাইবে; তদভাবে এই জ্যেষ্ঠ পুত্রের শুধু জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ পাইবে ইত্যাদি; এ প্রকার ব্যবস্থা হিন্দু-আইনসম্মত নহে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর উত্তরাধিকার সম্বন্ধে হিন্দু আইনের বিধান উলটাইয়া দিয়া যেন নিজের ইচ্ছামত নূতন বিধান করিতে গিয়াছেন। সুতরাং তাহা সিদ্ধ হইবে না; অতএব যতীন্দ্রমোহন ঐ সম্পত্তি জীবনস্বত্বে পাইবেন, উইলের এই পৰ্য্যন্ত ব্যবস্থা সিদ্ধ থাকিবে, তাহার পরবর্তী ব্যবস্থাগুলি সমস্তই অসিদ্ধ হইবে। তাহার পর, হিন্দু আইন অমুসারে স্ত্রীলোকগণ (যথা পত্নী, কন্যা) এবং স্ত্রীলোকের বংশীয় ব্যক্তিগণ (যথা দৌহিত্র, ভাগিনেয়) উত্তরাধিকারী হইয়া থাকেন; কিন্তু এই উইলে তাহাও নিষেধ করা হইয়াছে; এরূপ নিষেধও হিন্দু-আইন-বিরুদ্ধ। (যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বঃ জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, ১৮ উইক্‌লি রিপোর্টার ৩৫৯)।

আরও একটী মোকদ্দমায় এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছিল। দুই ভ্রাতা এই মর্শ্বে একট দলিল সম্পাদন করিয়াছিলেন যে, তাহাদের মৃত্যুর পর সম্পত্তির একজনের বংশের পুরুষ ওয়ারিসগণ পর পর ভোগ করিবে; সেই বংশে যদি কোনও কালে পুরুষ ওয়ারিস আর না থাকে, তাহা হইলে অপর ব্যক্তির বংশের পুরুষ ওয়ারিসগণ পাইবে; এবং যতক্ষণ এই দুই বংশে পুরুষ ওয়ারিস থাকিবে, ততক্ষণ কোনও স্ত্রীলোক ঐ সম্পত্তিতে অধিকারিণী হইতে পরিবে না। প্রিভিকৌন্সিল স্থির করিলেন যে এই ব্যবস্থা আইন-বিরুদ্ধ। হিন্দু আইনে স্ত্রীলোকগণ ওয়ারিস হইতে পারেন; স্থতরাং তাহারা কোন কালেই ওয়ারিস হইবে না, এইমৰ্ম্মে ব্যবস্থা করিয়া দলিলকর্তাগণ হিন্দু আইনের উত্তরাধিকারের নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া নিজেরা একটী নূতন নিয়ম করিতে বসিয়াছেন; এইরূপ বিধান বে-আইনী ও অসিদ্ধ (পূর্ণশশী বঃ কালৗধন, ৩৮ কলিকাতা ৬০৩)।

সুতরাং উইলের কোনও সর্ভ দ্বারা যদি কোনও আইনের বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করা হয়, তাহা হইলে উহা অসিদ্ধ হইবে। ইহার আরও একটী দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতেছে। কোন ব্যক্তি উইল করিয়া তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার তিন পুত্রকে দিয়া গিয়াছিলেন; ঐ উইলে এইরূপ সৰ্ব ছিল যে যদি ঐ তিন পুত্রের মধ্যে একজন নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন, তাহা হইলে তাহার অংশ তাহার বিধবা পত্নী পাইবেন না, অপর ভ্রাতাগণ পাইবেন। ফলেও তাহা হইল। উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুর পর তিন পুত্র সম্পত্তি ভোগ করিতে করিতে দ্বিতীয় পুত্র নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা পত্নীকে রাখিয়া পরলোক গমন করিলেন। তখন অপর ভ্রাতাগণ উইল অনুসারে মৃত ভ্রাতার অংশ দাবী করিলেন। এদিকে বিধবা পত্নীও স্বামীর অংশ দাবী করিলেন; দুই পক্ষে মোকদম হুইল এবং মোকদম প্রিভিকৌন্সিল পর্য্যন্ত গড়াইল। প্রিভিকৌন্সিল স্থির করিলেন ষে, বিধবা পত্নীই মৃত ব্যক্তির অংশ পাইবেন, তাহার ভ্রাতাগণ পাইবেন না; ঐ উইলের সত্ত্ব অসিদ্ধ, কারণ হিন্দু আইন অনুসারে ভ্রাতা অপেক্ষা পত্নীই অগ্রগণ্য উত্তরাধিকারী, এবং উইলকর্তী পত্নীর পরিবর্তে ভ্রাতাকে সম্পত্তি দিবার আদেশ দিয়৷ উত্তরাধিকার সম্বন্ধে হিন্দু আইনের বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। নরেন্দ্র ব: কমলবাসিনী, ২৩ কলিকাতা ৫৬৩)।

সেইজন্য, কোনও উইল করিবার সময়ে উইলকৰ্ত্তার খুব সাবধান হওয়া উচিত, যাহাতে উইলট বিশেষ জটিল হইয়া না দাড়ায়। উইলের সৰ্বগুলি যত সরল হইবে ততই নিরাপদ। উইলের সর্তগুলি জটিল হইলেই হয়তো আইনের কোনও না কোনও বিধানের উপর হস্তক্ষেপ করা হইবে, আর উইলট অসিদ্ধ হইয়া যাইবে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর নিজে একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন; এবং বহু আইনজ্ঞ বিচক্ষণ ব্যক্তির পরামর্শ লইয়া উইল করিয়াছিলেন, কিন্তু উইলট এমন জটিল করিয়া ফেলিলেন যে জটিলতা দোষেই উহা ব্যর্থ হইয়া গেল; এমন কি, যে উদ্দেশ্যে তিনি উইল করিয়াছিলেন, প্রকৃতপক্ষে সেই উদ্দেশ্যই বিফল হইয়া গিয়াছিল।

দান সম্বন্ধে যেমন নিয়ম আছে যে, যে ব্যক্তি বৰ্ত্তমান আছেন তাহাকেই দান করিতে পারা যায়, য়ে ব্যক্তি জন্মায় নাই তাহাকে দান করা যায় না, উইল সম্বন্ধেও সেই নিয়ম। যে ব্যক্তি উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালে বর্তমান আছেন তিনিই উইল অনুসারে সম্পত্তি পাইবেন; যে ব্যক্তি সে সময়ে জন্মায় নাই সে পাইবে না।

প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উইলেও এই প্রশ্ন উঠিয়াছিল। প্রসন্নকুমার ঠাকুর যখন পরলোকগমন করিলেন তখন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কোনও পুত্র ছিল না। অথচ এদিকে উইলে লেখা রহিয়াছে যে যতীন্দ্রমোহনের জীবনস্বত্ব শেষ হইয়া গেলে তাহার জ্যেষ্ঠপুত্র পাইবে। সুতরাং উইন্সের ঐ সর্ত্ত নিষ্ফল; এবং প্রসন্নকুমারের মৃত্যুর পরে যদি যতীন্দ্রমোহনের কোন পুত্র জন্মিত তাহা হইলেও সে উইল অনুসারে কিছুই পাইত না। (১৮ উইক্‌লি রিপোর্টার ৩৫৯)। সেইরূপ, যদি কোনও ব্যক্তি এই মৰ্ম্মে উইল করেন যে”আমার ভ্রাতু-পুত্রগণকে আমার সম্পত্তি উইল করিয়া দিয়া গেলাম” তাহা হইলে উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালে যে সকল ভ্রাতু-পুত্র বর্তমান আছে তাহারাই পাইবে, তাহার মৃত্যুর পর যে সকল ভ্রাতু-পুত্র জন্মিবে তাহারা কিছুই পাইবে না (ভগবতী বঃ কালীচরণ, ৩২ কলিকাতা ৯৯২; ৩৮ কলি: ৪৬৮, গ্রি; কৌ:; রামলাল ব: কানাইলাল, ১২ কলিঃ ৬৬৩)।

এইস্থলে আরও একটী নিয়ম জানিয়া রাখা কৰ্ত্তব্য যে উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালের অবস্থা ধরিয়াই উইল কাৰ্য্যকর হয়, উইল যে সময়ে সম্পাদিত হয় সে সময়কার অবস্থা দেখিয় উইলের বিচার হয় না। দান ও উইলে এইটী বিশেষ প্রভেদ। এক ব্যক্তি এই মৰ্ম্মে উইল করেন যে”আমার সম্পত্তি আমার সমস্ত ভ্রাতুষ্পপুত্ৰগণ পাইবে।” উইলকৰ্ত্তা যে সময়ে উইল করিলেন সে সময়ে তাহার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র জীবিত, কিন্তু তিনি যে সময়ে পরলোকগমন করিলেন সে সময়ে আরও তিনজন ভ্রাতুষ্পপুত্র জন্মিয়াছে, এস্থলে পাচজন ভ্রাতুষ্পুত্রই পাইবেন, শুধু দুইজন পাইবেন না; অর্থাৎ উইল সম্পাদনের সময়কার ঘটনা ধরিয়া উইলের বিচার হইবেন, উইল কৰ্ত্তার মৃত্যুর সময়কার অবস্থাই ধরা হইবে। কিন্তু যদি উইল না হইয়া দানপত্র সম্পাদিত হইত, তাহা হইলে শুধু দুইজন ভ্রাতুপুত্র পাইতেন, দানপত্র সম্পাদিত হওয়ার পর যাহার জন্মগ্রহণ করিত তাহারী কিছুই পাইত না। অথবা যদি এইরূপ হইত যে, যে সময়ে ঐ ব্যক্তি উইল করিয়াছিলেন সে সময়ে কোনও ভ্রাতুষ্পুত্রই জন্মগ্রহণ করে নাই, কিন্তু তাহার মৃত্যুর সময়ে পাচজন জন্মিয়াছে, তাহা হইলেও উইল অসিদ্ধ হইয়া যাইত না, এবং ঐ পাঁচজন ভ্রাতু-পুত্ৰ পাইতেন; কিন্তু উইল না হইয়া দানপত্র হইলে উহা অসিদ্ধ হইত। যদি এইরূপ হয় যে, ঐ ব্যক্তি যে সময়ে ঐ উইল কবিয়াছিলেন সে সময়ে তাহার দুই ভ্রাতু-পুত্র জীবিত ছিল, কিন্তু উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুর পূর্বেই একজন পরলোকগমন করেন, তাহা হইলে উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুর সময়ে যে ভ্রাতুম্পুত্র জীবিত আছেন তিনিই সমস্ত সম্পত্তি পাইবেন, মৃত ভ্রাতুপুত্রের ওয়ারিস কিছুই পাইবেন না। কিন্তু এস্থলে যদি উইল না হইয়া দানপত্র হইত, তাহা হইলে দুষ্ট ভ্রাতুষ্পপুত্ৰই পাইতেন; এবং তাহার পর একজনের মুতু্য হইলে তাহার অংশ অবশ্যই তাঁহার ওয়ারিসে বৰ্ত্তিত।

উইলকৰ্ত্তা যদি উইলে তাহার উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করিতে চাহেন, তাহা হইলে সেই সঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লেখা উচিত যে কে ঐ সম্পত্তি নির্ব্যূঢ় স্বত্বে পাইবে; এমন কি, তিনি উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করিতেছেন এ কথা তিনি স্পষ্ট লিখুন বা না লিখুন, কে সম্পত্তি নির্ব্যূঢ় স্বত্বে পাইবে তাহা লেখা চাই; তাহা যদি না লেখা থাকে তাহা হইলে ঐ উত্তরাধিকারীই ঐ সম্পত্তি পাইবেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উইলেও ঠিক তাহাই ঘটয়াছিল, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মৃত্যুর পর কে ঐ সম্পত্তি পাইবে সে সম্বন্ধে উইলে যাহা লিখিত আছে তাহা তো হিন্দু-আইনবিরুদ্ধ; কিন্তু যতীন্দ্রমোহনের জীবনস্বত্ব শেষ হইয়া যাওয়ার পর কে ঐ সম্পত্তি নির্ব্যূঢ় স্বত্বে পাইবে তাহা তো স্থির করা চাই। প্রিভি কৌন্সিল স্থির করিলেন যে কে ঐ সম্পত্তি নির্ব্যূঢ় স্বত্বে পাইবে তাহা যখন উইলে লেখা নাই, তখন যতীন্দ্রমোহনের মৃত্যুর পর উইলকৰ্ত্তার আইনমত উত্তরাধিকারী ঐ সম্পত্তি পাইবেন। এমন কি, জ্ঞানেন্দ্রমোহন যদি সে সময়ে জীবিত থাকেন তো তিনিই পাইবেন। যদিও প্রসন্নকুমার তাহাকে ত্যজ্যপুত্র করিয়াছেন তথাপি তিনি সম্পত্তি পাইতে ক্ষমতাপন্ন হইবেন, কারণ নিজের উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করিতে হইলে সম্পত্তি অপর কোনও বাক্তিকে নির্ব্যূঢ় স্বত্বে দেওয়া চাই।” অর্থাৎ প্রসন্নকুমার ঠাকুর যাহা নিবারণ করিতে চাহিয়াছিলেন, উইলের দোষে তাহাই ঘটিল, এবং তাহার উইল করিবার উদ্দেশুই ব্যর্থ হইল। ফলে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সকলেই জানেন। অবশেষে সেই জ্ঞানেশ্রমোহনেরই দৌহিত্র ঐ সম্পত্তি পাইয়াছিলেন।

পূৰ্ব্বে লিখিত হইয়াছে যে, ষে ব্যক্তি উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালে জন্মগ্রহণ করে নাই, তাহাকে কোনও সম্পত্তি উইল করিয়া দেওয়া যায় না। কিন্তু যদি কেহ এই মৰ্ম্মে উইল করেন”আমার মৃত্যুর পর একটী বিগ্ৰহ স্থাপন করা হইবে, এবং ঐ বিগ্রহ সেবার জন্য আমি এই সম্পত্তি দান করিলাম” তাহা হইলে ঐ উইল কি সিদ্ধ হইবে? ১৯০৯ সালের পূৰ্ব্বের সমস্ত মোকদ্দমায় স্থির হইয়াছিল যে ঐ রূপ দান অসিদ্ধ, কারণ ইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালে যে দেবমূৰ্ত্তি বৰ্ত্তমান নাই তাহাকে কোনও সম্পত্তি দেওয়া যায় না (উপেন্দ্রলাল বঃ হেমচন্দ্র, ২৫ কলিকাতা ৪০৪)। কিন্তু ১৯০৯ সালে একটী মোকদ্দমায় ঐ নিষ্পত্তি রহিত হইয়া ইহা স্থির হইয়াছে যে”মানুষের সম্বন্ধে এই নিয়ম আছে বটে যে, ষে মকুন্তু উইলকৰ্ত্তার মৃত্যুকালে জন্মগ্রহণ করে নাই, তাহাতে সম্পত্তি দেওয়া যায় না; কিন্তু কোনও মন্দিরের দেব-দেবী মূৰ্ত্তি তো মানুষ নহৈ যে তাহাদের সম্বন্ধেও এই নিয়মটা প্রয়োগ করিতে হইবে। সুতরাং উইলকর্তা যদি তাহার মৃত্যুর পর এক বিগ্রহ স্থাপনের আদেশ দিয়া উইলদ্বারা ঐ বিগ্রহকে সম্পত্তি দিয়া যান তাহা হইলেও উহা সিদ্ধ হইবে। (ভূপতিনাথ স্মৃতিতীর্থ বঃ রামলাল, ৩৭ কলিকাতা ১২৮ ফুলবেঞ্চ)।

স্ত্রীলোককে দান

স্ত্রীলোককে কোনও সম্পত্তি উইল করিয়া দিয়া গেলে সাধারণতঃ এইরূপ অছুমান হয় যে তিনি উহা জীবনস্বত্বে পাইবেন (প্রবোধ বঃ হরিশ, ৯ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস, ৩০৯)। তবে যদি উইলে স্পষ্ট ভাষায় লেখা থাকে ম্বে তিনি সম্পূর্ণরূপে ‘মালিক’ হইলেন এবং দান বিক্রয়াদি করিবার ক্ষমতাও তাঁহার রহিল তাহা হইলে অবশ্য তিনি উহ। নির্ব্যূঢ়স্বত্বে পাইবেন। সেইজন্য, স্ত্রীলোককে কোনও সম্পত্তি নির্ব্যূঢ় স্বত্বে দিতে ইচ্ছা করিলে উইলে সেই কথা স্পষ্ট করিয়া লেখা উচিত, নহিলে ভবিষ্ণুতে অনেক গোলযোগ হইবার সম্ভাবনা। হাইকোর্ট এইরূপ স্থির করিয়াছেন যে, কোন স্ত্রীলোককে যদি এই মৰ্ম্মে উইল করিয়া সম্পত্তি দেওয়া যায় যে তিনি উহার ‘মালিক’ হইবেন (২৪ কলিকাতা ৪০৬; ২৭ কলিঃ ৬৪৯; ২৮ কলি: উইক্‌লি নোটস, ৫৪১ প্রি: কৌ:) অথবা যদি লেখা থাকে যে তিনি পুত্র-পৌত্রাদিক্ৰমে ভোগ করিবেন (৭ মাদ্রাজ ৩৮৭), তাহা হইলে স্ত্রীলোক নির্ব্যূঢ় স্বত্বেই পাইয়া থাকেন।

অন্যান্য কথা

কোনও হিন্দু বাচনিকভাবে উইল করিতে পারে না; উইল করিতে হইলেই তাহা লিখিত হওয়া আবশ্যক, এবং তাঁহাতে অন্যূন দুইজন সাক্ষী থাক চাই। ৪/৫ জন ভদ্রলোক সাক্ষী রাখাই কৰ্ত্তব্য। এদেশে প্রায় মৃত্যুর কিছু পূৰ্ব্বে পীড়িত অবস্থায় লোকে উইল করে। এরূপ অবস্থায় উইল হয় বলিয়াই নানারূপ আপত্তি উপস্থিত হয়। পীড়িত অবস্থায় উইল হইলে যাঁহারা উইলকৰ্ত্তার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু এবং তাঁহাকে সৰ্ব্বদা দেখিতে আসেন তাহাদিগকে সাক্ষী রাখা কৰ্ত্তব্য; যে চিকিৎসক সেই সময়ে উইলকৰ্ত্তার পীড়ার চিকিৎসা করেন, তাহাকেও সাক্ষী রাখা উচিত।

উইল ষ্ট্যাম্প কাগজে লিখিতে হয় না, সাদ। কাগজেই লিখিলে চলে। উহা রেজিষ্টারী না করিলেও সিদ্ধ হয়, কিন্তু তথাপি রেজিষ্টারী করিয়া রাখা খুবই উচিত; কারণ যদি বহুবৎসর পরে প্রোবেট লইতে হয়, এবং ঐ উইল সম্বন্ধে কেহ আপত্তি উত্থাপন করে তখন উহা অনেক সময়ে প্রমাণ করা উঠিন হয়। সেইজন্য রেজিষ্টারী কয়িয়া রাখা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। উইল করিয়াও পরে উইলকৰ্ত্তা উইলের লিখিত সম্পত্তি হস্তাস্তর করিতে পারেন। তাঁহার মৃত্যুকালে যে সম্পত্তি থাকিবে তৎসম্বন্ধেই উইল কাৰ্য্যকর হইবে। যদি সে সময়ে কোনও সম্পত্তি না থাকে, তাহা হইলে উইল ব্যর্থ হইবে।

উইলকর্ত্তা যদি উইলে সম্পত্তিগুলির নাম ও বর্ণনা নির্দিষ্ট করিয়া লিখিয়া থাকেন, তাহা হইলে উইল সম্পাদনের পর তিনি যদি নূতন কিছু সম্পত্তি অর্জন করেন, তৎসম্বন্ধে ঐ উইল প্রযোজ্য হইবে না, কেবলমাত্র ঐ নির্দিষ্ট সম্পত্তিগুলি সম্বন্ধে উইলটা খাটিবে (১৬ ইণ্ডিয়ান কেসেস ৫৪৩)!

উত্তরাধিকার বিষয়ক ১৯২৫ সালের ৩১ আইনের কতকগুলি ধারায় উইল সম্পাদন সম্বন্ধে অনেকগুলি প্রয়োজনীয় কথা লিখিত হইয়াছে। এই নিয়মগুলি হিন্দুগণের প্রতি প্রয়োজ্য হয়। সেইগুলি নিয়ে উদ্ধৃত হইল :–

কে উইল করিতে পারেন

৫৯ ধারা। সাবালক ও প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিমাত্রই উইল করিতে পারেন। স্ত্রীলোক তাহার স্ত্রীধনু সম্পত্তি উইল করিতে পারেন। বধির, মূক ও অন্ধ ব্যক্তিও উইল করিতে পারেন, তবে তাহারা যে উইল করিতেছেন, ইহা তাহাদের বুঝা চাই। যে ব্যক্তি মধ্যে মধ্যে পাগল হন, তিনি যে সময়ে প্রকৃতিস্থ থাকেন সেই সময়ে উইল করিতে পারেন।

উইল করিবার সময়ে উইলকৰ্ত্তার জ্ঞান থাকা উচিত। অত্যন্ত মাতাল অবস্থায় উইল হইতে পারে না; সেইরূপ, অত্যন্ত পীড়ায় অজ্ঞান হইলে উইল হইতে পারে না। তবে কেহ পীড়িত এবং দুৰ্ব্বল হইলেও তাহার সম্পত্তি সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করা কৰ্ত্তব্য তাহা বিবেচনা করিবার ক্ষমতা যদি তাহার থাকে, তাহা হইলে তিনি উইল করিতে পারেন।

৬১ ধারা। স্বাধীন ইচ্ছায় উইল না করিলে তাহা সিদ্ধ হইবে না। উইলকৰ্ত্তাকে প্রতারিত করিয়া বা পীড়ন করিয়া বা অন্য কোনও প্রকারে তাহার স্বাধীন ইচ্ছ লোপ করিয়া যে উইল করান হয় তাহা অসিদ্ধ। যথা, কোন ব্যক্তিকে মিথ্যা করিয়া বলা হইল যে তাহার পুত্র মরিয়া গিয়াছে; ঐ ব্যক্তি তাহা শুনিয়া নিজের পুত্র মরিয়া গিয়াছে বিশ্বাস করিয়া উইল দ্বারা অপর ব্যক্তিকে সম্পত্তি দিলেন; ঐ উইল অসিদ্ধ। আনন্দ বলরামকে বলিলেন”তোমার সম্পত্তি যদি আমার নামে উইল করিয়া না দাও, তাহা হইলে আমি তোমাকে হত্যা করিব, কিংবা তোমার ঘর জালাইয়া দিব, কিংবা তোমাকে কোনও ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত করাইব।” বলরাম ভয়ে আনন্দের নামে উইল করিলেন। ঐ উইল অসিদ্ধ হইবে।

উইল পরিবর্তন ও রহিত করণ

৬২ ধারা। উইলকৰ্ত্তা যে কোন সময়ে উইল পরিবর্তন বা রহিত করিতে পারেন।

উইল সম্পাদন

৬৩ ধারা। উইলকর্ত্তা স্বয়ং উইলে স্বাক্ষর করিবেন বা (লেখাপড় না জানিলে) বুদ্ধাঙ্গুলির টিপ বা ঢেড়াসহি দিবেন; কিংবা তাঁহার আদেশমত তাঁহার সম্মুখে অন্য কেহ তাহার নাম দস্তখত করিবেন। যথা, কোনও ব্যক্তি হাতে পক্ষাঘাতবশত: লিখিতে অক্ষম; এরূপ অবস্থায় তাহার আদেশমত ও তাঁহার সম্মুখে অপর কেহ তাহার নাম স্বাক্ষর করিলেও চলিবে।

উইলের মাথায় বা নীচে স্বাক্ষর করাই কৰ্ত্তব্য। একাধিক কাগজে উইল লিখিত হইলে প্রত্যেক কাগজের মাথায় বা নীচে উইলকর্তার ও সাক্ষীগণের স্বাক্ষর থাকা উচিত।

উইলে অন্ততঃ দুইজন সাক্ষী থাকা আবশ্যক। প্রত্যেক সাক্ষী উইলকৰ্ত্তার সম্মুখে স্বাক্ষর করবেন।

৬৮ ধারা। উইলে যাহাকে একজিকিউটার নিযুক্ত করা হয় বা কোন সম্পত্তি দান করা যায়, তিনিও ঐ উইলে সাক্ষী থাকিতে পারেন।

উইল প্রত্যাহার

৭০ ধারা। নিম্নলিখিতরূপে উইল প্রত্যাহার করিতে হয়; যথা— প্রথম উইলখানি রহিত করিবার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় একখানি উইল যথারীতি সম্পাদন, এবং দ্বিতীয় উইলে উক্ত রহিতকরণের কথা লিখন, অথবা প্রথম উইলথানি ছিড়িয়া বা পোড়াইয়ী বা অন্য কোন প্রকারে নষ্ট করণ। শুধু বাচনিক ভাবে “অমুক তারিখের উইলখানি আমি রহিত করিলাম” এইরূপ বলিলে প্রত্যাহার করা হয় না।

উইল পরিবর্তন

৭১ ধারা। উইল সম্পাদনের পর যদি ঐ উইলে কোনও অতিরিক্ত কথা লেখা যায়, বা কোনও কথা পরিবর্ত্তন করা বা কাটিয়া দেওয়া হয় তাহা হইলে সেই স্থলে উইলকর্ত্তা ও সাক্ষীগণের স্বাক্ষর থাকা আবশ্যক, নচেৎ তাহা সিদ্ধ হইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *