০৩. হস্তী যুদ্ধের ঘটনা

দ্বিতীয় ঘটনার সারমর্ম এই যে,আবিসিনয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর পক্ষে থেকে আবরাহা সাবাহ হাবশী ইয়েমেনের গভর্ণর জেনারেল ছিলো। আবরাহা লক্ষ্য করলো যে, আরবের লোকেরা কাবাঘরে হজ্ব পালনের জন্যে যাচ্ছে। আবরাহা লক্ষ্য করলো যে, আরবের লোকেরা কাবাঘরে হজ্ব পালনের জন্যে যাচ্ছে। এটা দেখে সে সনয়ায় একটি র্গীজা তৈরী করলো। সে চাচ্ছিলো যে, আরবের লোকেরা মক্কায় না গিয়ে সনয়ায় যাবে। এ খবর জানার পর বনু কেনানা গোত্রের একজন লোক আবরহার নির্মিত র্গীজার ভেতরে প্রবেশ করে র্গীজার মেহরাবে পায়খানা করে এলো। আবরাহা এ খবর পেয়ে ভীষন ক্রুদ্ধ হয়ে ষাট হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্য নিয়ে কাবাঘর ধ্বংস করতে অগ্রসর হলো। নিজের জন্যে সে একটি বিশাল হাতী ব্যবস্থা করলো। তার বাহিনীতে মোট নয় বা তেরোটি হাতী ছিলো। আবরাহা ইয়েমেন থেকে মোগাম্মাস নামক জায়গায় পোঁছে সৈন্যদের বিন্যস্ত করলো। মক্কায় প্রবেশের পর মোযদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী মোহাসসের প্রান্তরে পৌঁছুলে সব হাতী বসে পড়লো। অনেক চেষ্টার পরও কাবার দিকে যাওয়ার জন্যে হাতী উঠানো সম্ভব হলো না। চেষ্টা করলে হাতী উত্তর, দক্ষিণ বা পূর্ব দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। কিন্তু কাবার ঘরের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলেই বসে পড়তো। এ সময়ে আল্লাহ তায়ালা এক পাল চড়ুই পাখি প্রেরণ করলেন। পাখিরা মুখে ছোট ছোটপাথর বহর করছিলো। এসব পাথর তারা সৈন্য ওপর নিক্ষেপ করলো। এর মাধ্যমে আবরাহার সেনাদল ভূষির মতো নাস্তানাবুদ হয়ে গেলো। চড়ুই পাখিগুলো ছিলো আবাবিলের মতো। প্রতিটি পাখি তিনটি পাথর বহন করছিলো। একটি মুখে, অন্য দু’টি দুই পাখার নীচে। পাথরগুলো ছিলো মটরশুঁটির মত। যার গায়ে সে পাথর পড়তো, তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খসে পড়তে শুরু করতো এবং সে মরে যেতো। প্রত্যেকের গায়ে এ পাথর পড়েনি। কিন্তু সেনাদলের মধ্যে এমন আতষ্ক এবং বিভীষিকা সৃষ্টি হলো যে, এলোপাতাড়ি পালাতে শুরু করলো। এরপর তারা এখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলো। এদিকে আবরাহার ওপর আল্লাহ তায়ালা এমন গযম নাযিল করলেন যে, তার হাতের আঙ্গুল খসে পড়তে শুরু করলো। সনয়ায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো কলিজা ফেটে বাহিরে এসে মর্মান্তিভাবে মৃত্যুবরণ করলো।
আবরাহার এ হামলার সময় অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লো এবং পাহাড়ের গুহায় গিয়ে আত্নগোপন করলো। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আযাব অবর্তীণ হলে তারা নিশ্চিন্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে এলো।
উল্লেখিত ঘটনা অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার অভিমত অনুযায়ী রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পঞ্ঝাশ বা পঞ্ঝান্ন দিন আগে ঘটে। সেটি ছিলো মহররম মাস। ৫৭১ ঈসায়ী সালের ফেব্রুয়ারী শেষ বা মার্চের শুরুতে এ ঘটনা ঘটেছিলো। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী এবং তাঁর পবিত্র ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে এর ভূমিকাস্বরূপ এ ঘটনা ঘটেয়েছিলো। যেমন ৫৮৭ সালে বখতে নসর বায়তুল মাকদেস দখল করেছিলো। এর আগে ৭০ সালে রোমকরা বায়তুল মাকদেস অধিকার করেছিলো। পক্ষান্তরে কাবার ওপর খৃস্টনরা কখনোই আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। অথচ সে সময় ঈসায়ী বা খৃস্টনরা ছিলো আল্লাহ বিশ্বাসী মুসলমান এবং কাবার অধিকারীরা ছিলো পৌত্তলিক।
হস্তী যুদ্ধের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই অল্প সময়েই মধ্যেই তদনীন্তর উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিত রোম এবং পারস্যে এ খবর পৌঁছে গেয়েছিলো। কেননা মক্কার সাথে রোমকদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। অন্যদিকে রোমকদের ওপর পারসিকদের সব সময় নযর থাকতো। রোমক এবং তাদের শক্রদের যাবতীয় ঘটনা পারস্য বা পারসিকরা পর্যবেক্ষণ করতো। তাই দেখা যায় যে, আবরাহার পতনের পর পরই পারস্যবাসীরা ইয়েমেন দখল করে নেয়। এ সময়কার বিশ্বে পারস্য এবং রোম উন্নত সভ্য দেশ হিসাবে পরিচিত থাকায় বিশ্ব মানবের দৃষ্টি কাবার প্রতি নিবদ্ধ ছিলো। কাবাঘরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সস্পষ্ট প্রমাণ তারা প্রত্যক্ষ করলো। তারা বুঝতে পারল যে, এই ঘরকে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ঘর হিসাবে মনোনীত করেছেন। কাজেই মক্কার জনপদ থেকে নবুয়তের দাবীসহ কারো উথান অবশ্য সমাচীন। এদের বিরুদ্ধে মুসলামনদের বিপরাত মেরুতে অবস্থানকারী পৌত্তলিকদের আল্লাহ তায়ালা কেন সাহায্যে করেছিলেন, রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর্বিভাবের কথা চিন্তা করলে তা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না।
আবদুল মোত্তালেবের পুত্র ছিলো দশজন। তারা হলো: হারেস, যোবায়ের, আবু তালেব, আবদুল্লাহ, হামযা, আবু লাহাব, গাইদাক, মাকহুম, সাফার এবং আব্বাস। কেউ কেউ বলেছিলেন, এগারোজন। একজনের ছিলো কাছাম। কেউ বলেছেন তোরোজন। একজনের নাম ছিলো আবদুল কাবা, অন্যজন ছিলো হেজাল। যারা দশজন পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন তারা বলেন, মুকাওয়ামের আরেক নাম ছিলো আবদুল কাবা আর গাইদাকের আরেক নাম হেজাল। কাছাম নামে আবদুল মোত্তালেবের কোন পুত্র ছিলো না। আবদুল মোত্তালেবের কণ্যা ছিলো ছয়জন। তাদের নাম-উম্মুল হাকিম,(এর অন্য নাম বায়েজা), বাররা, আতেকা, সাফিয়া,আরোয়া ও উমাইয়া।
(তিন) আবদুল্লাহ ছিলেন রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা। আবদুল্লাহ মায়ের নাম ছিলো ফাতেমা। তিনি ছিলেন আমর ইবনে এমরান ইবনে মাখযুম ইবনে ইয়াকজা ইবনে মাররার কন্যা। আবদুল মোত্তালেবের সন্তানের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন সবচেয়ে সুদর্শন, সচ্চরিত্র এবং স্নেহভাজক। তাঁকে বলা হতো যবীহ বা যবাইকৃত। এরূপ বলার কারণ ছিলো এই যে, আবদুল মোত্তালেবের পুত্রদের সংখ্যা দশ হয়ে যাওয়ার পর এবং তারা নিজেদের রক্ষায় সমর্থ হওয়ার মতো বয়সে উন্নীত হওয়ার পর আবদুল মোত্তালেব তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানান। সবাই মেনে নেন। এরপর আবদুল মোত্তালেব ভাগ্য পরীক্ষার তীরের গায়ে তাদের সকলের নাম লিখলেন। লেখার পর হোবাল মূর্ত্তির তত্ত্বাবধায়কের হাতে দিলেন তত্ত্বাবধায়ক লটারি করারপর আবদুল্লাহ নাম উঠলো। আবদুল মোত্তালেব আবদুল্লাহর হাত ধরলেন, ছরি নিয়ে যবাই করতে কাবাঘরের পাশে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সকল কোরায়শ বিশেষত আবদুল্লাহর ভাই আবু তালেব বাধা দিলেন। আবদুল মোত্তালেব বললেন, তোমরা যদি বাধা দাও তবে আমি মানত পূর্ণ করব কিভাবে? তারা পরামর্শ দিলেন যে, আপনি কোন মহিলা সাধকের কাছে গিয়ে এর সমাধান চান। আবদুল মোত্তালেব এক মহিলা সাধকের কাছে গেলেন। সেই সাধক আবদুল্লাহ এবং দশটির উটের নাম লিখে লটারি করার পরামর্শ দিলেন। তবে বললেন, যদি আবদুল্লাহ নাম না উঠে তবে দশটি করে উট বাড়াতে থাকবেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ খুশি না হন। এরপর যতোটি উটের নাম লটারিতে উঠবে ততোটি যবাই করবেন। আবদুল মোত্তালেব ফিরে গিয়ে কোরা অর্থাৎ লটারি করতে শুরু করলেন। একশত উট হওয়ার পর আবদুল্লাহ নাম উঠলো। এরপর আবদুল মোত্তালেব একশত উট যবাই করে সেখানেই ফেলে রাখলেন। মানুষ এবং পশু কারো জন্যে তা নিতে বাধা ছিলো না। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত কোরায়শ এবং আরবদের মধ্যে রক্ত ঋণের পরিমাণ ছিলো দশটি উট। কিন্তু এরপর পরিমাণ বাড়িয়ে একশত উট করা হলো। ইসলামও এর পরিমাণ অব্যাহত রাখে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি দুইজন যবীহের সন্তান। একজন হযরত ইসমাইল (আ) অন্যজন আমার পিতা আবদুল্লাহ।
আবদুল মোত্তালেব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর বিয়ের জন্য আমেনাকে মনোনীত করেন। আমেনা ছিলেন ওয়াহাব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যোহরা ইবনে কেলাবের কন্যা। এরা বংশ মর্যাদায় কোরায়শদের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হতো। আমেনার পিতার বংশ মর্যাদা এবং আভিজাত্যে বনু যোহরা গোত্রের সর্দার ছিলেন। বিবি আমেনা বিয়ের পর পিত্রালয় থেকে বিদায় নয়ে স্বামীগৃহ আগমন করেন। কিছুদিন পর আবদুল মোত্তালেব খেজুর আনতে মদীনায় পাঠান। আবদুল্লাহ সেখানে ইন্তিকাল করেন।
কোন কোন সীরাত রচয়িতা লিখেছেন যে, আবদুল্লাহ ব্যবসায় উদ্দেশ্যে সিরিয়া গিয়েছিলেন। কোরায়শদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে মক্কায় ফিরে আসার সময় অসুস্থ হয়ে মদীনায় অবতরন করে সেখানে ইন্তিকাল করেন। নাবেহা যাআদীর বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিলো পঁচিশ বছর। অবশ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে রূল তখনো জন্মগ্রহণ করেননি। কারো কারো মতে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম তাঁর পিতার ইন্তিকালের দু’মাসে আগে হয়েছিলো।
স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর আমেনা বেদনা মথিত কন্ঠে আবৃত্তি করলেন, বাতহার যমীন হাশেমের বংশধর থেকে খালি হয়ে গেছে। মৃত্যু তাকে এক ডাক দিয়েছে এবং তিনি আমি হাযির বলেছেন। তিনি রাঙ্গ ও খুরুশের মধ্যবর্তী এক জায়গায় শায়িত রয়েছেন। মৃত্যু এখন ইবনে হাশেমের মতো কোন লোক রেখে যায়নি। সেই বিকালের কথা মনে পড়ে, যখন তাঁকে লোকেরা খাঁটিয়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। মৃত্যু যদি তাঁরও অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে, কিন্ত তাঁর কীর্তি মুছে দিতে পারবে না। তিনি বললেন বড় দাতা এবং দয়ালু।
মৃত্যুকালে তিনি যেসব জিনিস রেখে গিয়েছিলেন সেসব হচ্ছে পাঁচটি উট, এক পাল বকরি, একটি হাবশী দাসী। সেই দাসীর নাম ছিলো বরকত, কুনিয়াত ছিলো উম্মে আয়মন। তিনি রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুধ খাইয়েছিলেন।