০৩. ওহী নাযিলের সময় তাঁর বয়স

প্রিয় নবী কি মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন, এ ব্যাপরে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ সীরাত রচয়িতর মতে প্রিয় রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রবিউল আউয়াল মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছিলেন রমযান মাসে, আবার কেউ কেউ বলেছেন রজব মাসে। আমার বিবেচনায় রমযান মাসে ওহী নাযিল হওয়া অর্থাৎ নবুয়ত লাভ করার কথাই ঠিক। কেননা কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রমযান মাসেই কোরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন,
শবে কদরে কোরআন নাযিল করা হয়েছে। শবে কদর তো রমযান মাসেই হয়ে থাকে। তিনি আরো বলেছেন,আমি একটি বরকতময় রাতে কোরআন নাযিল করেছি এবং আমি লোকদের আযাবের আশষ্কা সম্পর্কে অবহিত করি। রমযানের কোরআন নাযিল হওয়ার পক্ষে এ যুক্তিও রয়েছে যে, রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেরার গুহায় রমযানে ধ্যান করতেন। হযরত জিবরাইল (আ) হেরার গুহায়তেই এসেছিলেন।
যারা রমযান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে রমযানের কতো তারিখে কোরআন নাযিল হয়েছিলো, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন সাত, আবার কেউ বলেন আঠারো তারিখ। আল্লামা হাযরামি লিখেছেন, সতেই তারিখই নির্ভুল। আমি এ ব্যাপারে ২১শে রমযান তারিখকে প্রাধান্য দিয়েছি। অথচ অন্য কেউই ২১ শে রমযান কোরআন নাযিলের শুরু বলে উল্লেখ করেননি। আমার যুক্তি হচ্ছে, অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার মতে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর্বিভাব ঘটেছিলো সোমবার দিনে। হযরত কাদাতা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসেও এর প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রিয় রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবান সম্পর্কে জিজ্ঞসা করা হলে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এ দিন আমাকে নবু্‌য়ত দেয়া হয়েছে। সেই বছর রমযান মাস সোমবাব পড়েছিলো ৭,১৪,২১ এবং ৮ তারিখে। সহীহ বর্ণনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শবে কদর রমযান মাসের বিজোড় রাতে হয়ে থাকে এবং বিজোড় রাতেই আবর্তিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, শবে কদরে কোরআন নাযিল হয়েছে। যে বছর তিনি নবুয়ত পেয়েছেন, সে বছরের সোমবারসমূহ পর্যালোচনা করে এ সিন্ধান্ত পোঁছা যায় যে, তিনি একুশে সোমবার জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তারিখে নবুয়ত লাভ করেন।
আসুন, হযরত আয়েশা (রা) এর যবানীতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনা যাক। কোরআন নাযিল ছিলো এক আলৌকিক আলোক শিখায় সকল গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকার তিরোহিত হয়ে গিয়েছিলো। ইতিহাসে গতিধারা এই ঘটনায় বদলে গিয়েছিলো।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, প্রিয় রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ওহী নাযিলের সূচনা স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিলো। তিনি যে স্বপ্ন শুভ্র সকালের মতো প্রকাশ পেতো। এরপর তিনি নির্জতারপ্রিয় হয়ে যান। তিনি হেরা গুহায় এবাদাত বন্দেগীতে। কাটাতে থাকেন এবং এ সময় একাধারে কয়েকদিন ঘরে ফিরতেন না। পানাহার সামগ্রী শেষ হয়ে গেলে সেসব নেয়ার জন্যে পুনরায় বাড়িতে ফিরতেন। এমনি করে এক পর্যায়ে হযরত জিবরাইল (আ) তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, পড়ো। তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। ফেরেশতা তাঁকে বুকে জুড়িয়ে চাপ দিলেন। তিনি বলেন, আমার সব শক্তি যেন নিংড়ে নেয়া হলো। এরপর তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো। তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। পুনরায় ফেরেশতা আমাকে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন।
এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো। তৃতীয়বার তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, “ইকরা বে-ইসমে রাব্বিকাল্লাযি খালাক। অর্থাৎ পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।
এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী ঘরে এলেন। তাঁর বুক ধুকধুক করছিলো। স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলেদকে বললেন, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। বিবি খাদিজা প্রিয় নবীকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। তার ভয় কেটে গেলো।
এরপর বিবি খাদিজাকে সব কথা খুলে বলে প্রিয় রসূল বললেন, আমার কী হয়েছে, নিজের জীবনের আমি আশষ্কা করছি। বিবি খাদিজা তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্নীয় স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করেন, মেহমানদারী করেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সহয়তা করেন।
বিবি খাদিজা এর পর প্রিয় নবী রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আপন চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযযার কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা আইয়ামে জাহেলিয়তে ঈসায়ী ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় লিখতে জানতেন। যতোটা আল্লাহ তায়ালা তওফীক দিতেন, হিব্রু ভাষায় তোতটা ইঞ্জিল তিনি লিখতেন। সে সময় তিনি ছিলেন বয়সের ভারে ন্যজ এবং দৃষ্টিহীন। বিবি খাদিজা বললেন, ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনন। ওয়ারাকা বললেন, ভাতিজা তুমি কি দেখেছো?
রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা যা দেখেছেন তাঁকে খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, তিনি সেই দূত, যিনি হযরত মূসা (আ) এর কাছে এসেছিলেন। হায়, যদিআমি সেই সময় বেঁচে থাকতাম, যখন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবাক হয়ে বললেন, তুমি আমার কওম আমাকে সত্যি সত্যিই বের করে দেবে? ওয়ারাকা বললেন, হাঁ, তুমি যে ধরণের বাণী লাভ করেছো, এ ধরণেরই বাণী যখনই কেউ পেয়েছে, তার সাথেই শক্রতা করা হয়েছে। যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে অব্যশই তোমাকে সাহায্য করবো। এর কিছুকাল পরই ইয়ারাকা ইন্তিকাল করেন। এরপর হঠাৎ ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যায়।
তারাবী এবং ইবনে হিশামের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ওহী নাযিল বন্ধ হওয়ার সময়েও তিনি হেরার গুহায় আরো কিছুকাল অবস্থান করে নির্ধারণ মেয়াদ পূর্ণ করেন। পরে মক্কায় ফিরে আলোকপাত করা হয়েছে। সে বর্ণনা নিম্নরূপ।
ওহী আসার পরের মানসিক অবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর মখলুকের মধ্যে করি এবং পাগল ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত। প্রচন্ড ঘৃণার কারণে এদের প্রতি চোখ তুলে তাকাতেও আমার ইচ্ছা হতো না। ওহী আসার পর আমি মনে মনে বললাম, কোরায়শরা আমাকে কবি বা পাগল বলবে না তো? এরূপ চিন্তার পর আমি পাহাড়চূড়ায় উঠে ঝাপ দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তা করলাম। একদিন এক পাহাড়ে উঠলামও। পাহাড়ে মাঝামাঝি ওঠার পর হঠাৎ আসমান থেকে আওয়ায এলো, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহ রসূল। আমি জিবরাঈল। প্রিয় রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এই আওয়ায শোনার পর আকাশের প্রতি তাকালাম। দেখলাম জিবরাঈল মানুষের আকৃতি ধরে দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বলেছেন, হে মোহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসূল, আমি জিবরাঈল বলছি। রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি থমকে দাঁড়িয়ে সেখানে জিবরাঈলকে দেখতে লাগলাম। যে ইচ্ছা করে এসেছিলাম সে ইচ্ছা কথা ভুলে গেলাম। আমি তখন সামনেও যেতে পাচ্ছিলাম না, পেছনেও না। আকাশের যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, সেদিকেই জিবরাঈলকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যে খাদিজা আমার খোঁজে লোক পাঠালেন। আমাকে খুঁজে না পেয়ে তারা মক্কায় ফিরে এলো।
জিবরাঈল চলে যাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। খাদিজার উরুর পাশে হেলাল দিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, আবুল কাশেম, আপনি কথায় গিয়েছিলেন? আপনার খোঁজে আমি একজন লোক পাঠিয়েছি, সে মক্কায় গিয়ে খুঁজে এসেছে, কিন্তু আপনাকে পায়নি। আমি তখন যা কিছু দেখেছি, খাদিজাকে বললাম। তিনি বললেন, হে আমার চাচাতো ভাই, আপনি খুশি হোন এবং দৃঢ়পদ থাকুন, আমার আশা, আপনি এই উম্মতের নবী হবেন। এরপর তিনি ওয়ারেকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। তাঁকে সব কথা শোনালেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে ওয়ারাকার প্রাণ রয়েছে, তাঁর কাছে সেই ফেরেশতা এসেছেন, যিনি হযরত মূসা (আ) এর কাছে এসেছিলেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম এই উম্মতের নবী। তাঁকে বলবে, তিনি যেন দৃঢ়পদ থাকেন।
এরপর হযরত খাদিজা ফিরে এসে রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওয়ারাকার কথা শোনালেন, প্রিয় নবী হেরা গুহায় তাঁর অবস্থানের মেয়াদ পূর্ণ করে মক্কায় আসেন। এ সময় ওয়ারাকা ইবনে নওফেল তাঁর সাথে দেখা করে সব কথা বিস্তারিত শোনার পর বললেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার রয়েছে, আপনি হচ্ছেন এই উম্মতের নবী। আপনার কাছে সেই বড় ফেরেশতা এসেছেন, যিনি হযরত মূসা (আ) এর কাছে এসেছিলেন।