1 of 3

০৩৯. প্রকাশ্য দাওয়াত

এরপর লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। অতঃপর মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তাঁর বাণী উচ্চকণ্ঠে প্রচার করার নির্দেশ দেন এবং আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। নবুওয়াত লাভের পর ইসলামের প্রকাশ্য প্রচার শুরু হবার আগে গোপন প্রবার কাজ তিন বছর ধরে চলে। তখন আল্লাহ এই নির্দেশ দেন,“হে নবী,এখন আপনি উচ্চকণ্ঠে প্রচার শুরু করুন এবং মুশরিকদের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবে না।” তিনি আরো বলেন, “হে নবী, আপনি আপনার নিকট-আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন আর আপনার অনুসারী মু’মিনদের প্রতি অনুকম্পাশীল ও সদয় থাকুন। আর বলুন : আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ নামায পড়ার সময় দুর্গম গিরিগুহায় চলে যেতেন এবং লোকজনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়তেন। একদিন সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের এবটি ক্ষুদ্র দল মক্কার কোন এক পর্বত গুহায় নামায পড়ছেন, এমন সময় মক্কার মুশরিকদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা মুমিনদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসক এই সময় একটা মরা উটের চোয়ালের হাড় দিয়ে প্রচ- জোরে আঘাত হেনে মুশরিকদের একজনের মাথা ফাটিয়ে দেন। ইসলামের জন্য এটাই ছিল রক্তপাতের প্রথম ঘটনা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক প্রকাশ্য দাওয়াত দিলেও যতক্ষণ তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করেননি ততক্ষণ তারা তাঁর থেকে দূরে যায়নি কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখরও হননি। কিন্তু যখন তিনি তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করলেন তখনই তারা তাঁর আন্দোলনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক জিনিস বলে মনে করলো। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে ক্ষেপে উঠলো এবং তাঁর বিরুদ্ধতা ও শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। তবে স্বল্পসংখ্যক লোক যারা তখনো আত্মপ্রকাশ করেননি- ইসলামের খাতিরে এই শত্রুতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর চাচা আবু তালিব পুর্ণ সহানুভূতি ও অনুকম্পা দেখাতে থাকেন। তিনি কুরাইশদের আক্রমণের মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে থাকলেন এবং তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজ অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু কুরাইশরা যখন দেখলো, সম্পর্কচ্ছেদ ও দেব-দেবীর সমলোচনার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রবল আপত্তিকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিন্দুমাত্র পরোয়া করছেন না, অধিকন্তু তাঁর চাচা তাঁকে আশ্রয় দিয়ে চলছেন, কোন মতেই তাঁকে কুরাইশদের হাতে সমর্পণ করছে না; তখন একদিন কুরাইশদের গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সদলবলে আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললো, “হে আবু তালিব আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমতাবস্থায় হয় আপনি তকে এসব থেকে বিরত রাখুন নতুবা তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দিন।” আবু তালিব তাদেরকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদায় করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকলেন ও তাঁর প্রচার-প্রসারের কাজ অব্যাহত রাখলেন। ফলে কুরাইশদের বিদ্বেষ ও আক্রোশ দিন দিন বেড়ে যেতে লাগলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠলো এবং পরস্পরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিতে আরম্ভ করলো।

তাই পুনরায় তারা আবু তালিবের কাছে উপস্থি হয়ে বললো, হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও মুরুব্বী। আমারা আপনাকে গণ্যমান্য ও শ্রদ্ধেয় মনে করি।

আমরা বলেছিলাম, আপনার ভাতিজাকে নিষেধ করুন কিন্তু আপনি তা করলেন না। আল্লাহর কসম, এভাবে আর চলতে দিতে পারি না। সে আমাদের সমলোচনা দেব-দেবীর নিন্দা ও আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাওরানোর যে ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে তা আমরা আর সহ্য করতে পারি না। এখন হয় আপনি তাকে নিবৃত করবেন নচেৎ আমরা আপনাকে সহ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো এবং একপক্ষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আর থামবো না।”

আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ভাতিজা তোমার সম্প্রদায়ের লোকজন আমার কাছে এসে এইসব কথা বলেছে।” এই বলে তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ যা বলেছিলো তা তাঁকে বললেন। তারপর বললেন, “অবস্থা যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তখন তুমি নিজেকে ও আমাকে সামলে চলো। আমার ওপর আমার সাধ্যের বেশী কোন কিছু চাপিয়ে দিও না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, চাচা মত পাল্টে ফেলেছেন, কুরাইশদের মুকাবিলায় তাঁকে একাকী ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন এবং তাঁর সহায়তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “চাচা, আল্লাহর কসম করে বলছি, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এন দেয় এবং তার বিনেময়ে আমাকে এই কাজ ত্যাগ করতে বলে, তবুও আমি এটা ত্যাগ করবো না। আমি ততদিন পর্যন্ত এ কাজ করতে থাকবো, যতদিন না আল্লাহ তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন কিংবা এই কাজ করতে করতে আমি ধ্বংস হয়ে যাই।” এই কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো অতঃপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চলে যেতে উদ্যত হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে আবু তালিব তাঁকে ডেকে বললেন, “হে ভাতিজা, কাছে এসো।” তিনি কাছে গেলেন। আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, ঠিক আছে। তুমি যা বলতে চাও বলতে থাক। আমি কখনো কোন কারণে তোমাকে ওদের কাছে সর্পণ করবো না।”

কুরাইশরা যখন জানতে পারলো যে, আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননাকর অবস্থার মুখে একা ছেড়ে দিতে রাজি নন এবং তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ও শত্রুতা সত্ত্বেও তাঁকে তাহাদের হাতে তুলে না দিতেও অবিচল, তখন তারা উমারাহ ইবনে ওয়ালদি ইবনে মুগীরা নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে নিয়ে গেয়ে বললো, “হে আবু তালিব, এই যুবককে দেখুন, এর নাম উমারাহ ইবনে ওয়ালীদ কুরাইশ গোত্রে এর মত সাহসী, শক্তিমান ও সুদর্শন যুবক আর নেই। একে আপনি পুত্র হিসেকে গ্রহণ করুন। এর বুদ্ধিমত্তা ও সাহায্য-সহোযোগিতা দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পারবেন। আর আপনার ঐ ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনার পূর্বপুরুষের ধর্মের বিরোধিতা করছে, আপনার সম্প্রায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামি ঠাওরাচ্ছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, আমরা তাকে হত্যা করি। একজন মানুষের বিনিময়ে একজন মানুষ আপনি পেয়ে যাচ্ছেন।”

আবু তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার আমার ওপর চপিয়ে দিচ্ছ। আমি কি এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যে, তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে দেবে, আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করবো আর আমার সন্তান তোমাদের হেিত তুলে দেবো, তোমরা তাকে হত্যা করবে? খোদার কসম, জেনে রেখো, এটা কখনো হবে না।”

মুতয়িম ইবনে আদী বললো, “হে আবু তালিব, আপনার সম্প্রদায় আপনার কাছে ন্যয়সঙ্গত প্রস্তাবই দিয়েছে। আপনি নিজেও যা পছন্দ করেন না তা থেকে তারা আপনাকে অব্যাহতি দিতে চাচ্ছে। অথচ মনে হচ্ছে, আপনি তাদের কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন।” আবু তালিব মুতয়িমকে বললেন, “আল্লাহর কসম, তারা আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আসলে তুমি আমাকে অপমানিত করতে বদ্ধপরিকর। এজন্য গোটা সম্প্রদায়কে আমার বিরুদ্ধে লিলিয়ে দিতে চাচ্ছ। এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পার।”

এবার ব্যাপারটা সবার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিল। কুরাইশরা পরস্পরকে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে দিল এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠোর চাপ দিতে লাগলো একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতন থেকে নিরাপদ রইলেন। চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করলেন।

আবু তালিব যখন দেখলেন কুরাইশরা চরম হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে, তখন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করা ও তাঁর প্রতি যে কোন অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন। এই দুই গোত্রের সকলেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলো ও তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। একমাত্র আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত আবু লাহাব সমর্থন দিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *