1 of 3

০৩৮. প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী

পুরুষদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনেন, তাঁর সাথে নামায আদায় করেন, এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওহী মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন তাঁরই চাচা আবু তালিবের পুত্র আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর।

হযরত আলীর (রা) ওপর আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ যে তাঁর কল্যাণ চেয়েছিলেন এবং সে জন্য তাঁর উপযোগী ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন, সেটা তাঁর ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায়। কুরাইশদের তখন ঘোর দুর্দিন। বহু সন্তানের পিতা হওয়ায় আবু তালিব নিদারুণ আর্থিক সংকটে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেক চাচা ছিলেন আব্বাস। তিনি ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে সচ্ছলতম ব্যক্তি। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আপনার ভাই আবু তালিব অধিক সন্তানের ভারে জর্জরিত। দেখতেই পাচ্ছেন মানুষ কি ভীষণ দুর্দশায় ভুগছে। আসুন, আমরা তাঁর সন্তান ভার লাঘব করি। তাঁর পুত্রদের মধ্য হ’তে একজনের দায়-দয়িত্ব আমি গ্রহণ করি আর অপর একজনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে দু’টি সন্তানের দায়-দায়িত্ব থেকে তাঁকে রেহাই দেয়া যাবে।”

আব্বাস বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই।”

অতঃপর তাঁরা উভয়ে গিয়ে আবু তালিবকে বললেন, “যতদিন দেশবাসী বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত হচ্ছে না ততদিনের জন্য আমর আপনার সন্তানদের ভার লাঘব করতে চাই।” আবু তালীব বললেন, “তোমরা আকীলকে আমার কাছে রেখে যাও। তারপর যাকে খুশী নিয়ে যাও।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আলীকে নিলেন এবং তাঁকে নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর আব্বস নিলেন জাফরকে এবং তাঁকে তিনি স্বীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। এরপর আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। তাই নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে আলী তাঁর ওপর ঈমান আনলেন ও তাঁকে নবী হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে তাঁর অনুসরন করতে লাগলেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, নামাযের সময় উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দুর্গম গিরি গুহায় চলে যেতেন, আর তাঁর সাথে আলীও যেতেন। কিন্তু এ কাজটি তাঁর পিতা, চাচা ও গোত্রের সকলের অগোচরে সঙ্গোপনে করতে থাকলেন।সেখানে তাঁরা দু’জনে গিয়ে নিভৃতে নামায পড়তেন এবং সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরতেন। এভাবেই তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন আবু তালিন তাঁদের দুজনকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, এটা আবার কোন দীন (ধর্ম) যার অনুসরণ তুমি করছো?” তিনি বললেন, “চাচা, এটা আল্লাহর দীন, তাঁর ফেরেশতাদের দীন, তাঁর নবী-রাসূলদের দীন। আর বিশেষতঃ আমাদের পিতা ইবরাহীমের দীন। আল্লাহ আমাকে রাসূল বনিয়েছেন এবং এই দীনসহ মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। হে চাচা, আমি যত লোককে এই দীনের শিক্ষা দিয়েছি এবং যত লোককে এই জীবন বিধান গ্রহনের আহ্বান জনিয়েছি তাদের সবলের চাইতে আপনি এই দাওয়াত পাওয়ার অধিক হকদার। আর যত লোক আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করেছে এবং আমাকে কাজে সহযোগিতা করেছে তাদের তুলনায় আপনারই বেশী কর্তব্য এ আহ্বানে সাড়া দেয়া ও সহযোগিতা করা।”

আবু তলিব বললেন, “ভাতিজা, আমি আমার পূর্বপুরুযদের ধর্ম ও রীতিনীতি বর্জন করতে পারি না। তবে আল্লাহর কসম, আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার এ তৎপরতার দরুন তোমাকে কোন অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না।”

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন যালিদ ইবনে হারিস্ ইবনে শুরাহবীল ইবনে কা’ব ইবনে আবদুল উযযা। ইতিপূর্বে খাদীজার ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম ইবনে হিযাম ইবনে খুয়াইলিদ সিরিয়া থেকে যায়িদ ইবনে হারিসাসহ বেশ কযেকজন ক্রীতদাষ নিয়ে আসেন। একদিন তার ফুফু খাদীজা তার কাছে এলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খাদীজার বিয়ে হয়ে গেছে। হাকীম বললেনম, “ফুফু, আপনি এই দাসগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একজনকে পছন্দ করুন। যে ছেলেটিকেই আপনি পছন্দ করবেন তাকেই আমি আপনাকে দিয়ে দেব।” তিনি যায়িদকে পছন্দ করে নিয়ে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার কাছে যায়িদকে দেখে তাকে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা কে উপহার হিসেবে তাকে দিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করলেন। এটা ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের ঘটনা।

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বাক্র ইবনে আবু কুহাফা। তাঁর আসল নাম আতীক। আর আবু কুহাফার প্রকৃত নাম ছিল উসমান। আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও তাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কুরাইশদের ও তাদের ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁর মত বিচক্ষণ জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান লোক। গোত্রের লোকেরা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পা-িত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। এ জন্য গোত্রের মধ্য থেকে যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতো ও তাঁর নিকট অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল, তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাঁর দাওয়াতে একে একে ইসলাম গ্রহণ করলেন উসমান এবনে আফফান, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। এই পাঁচজন এবং আবু বাক্র, আলূ ও যায়িদ-মোট আটজনই ছিলেন প্রথম মুসলিম। তাঁরাই প্রথম নামায কায়েম করেন ও ইসলামকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন।

এরপর আবু উবইদা ইবনুল জাররাহ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, [২২.আরকামের বাড়ী ছিল সাফা পাহাড়ের ওপর। এই বাড়ীতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হযরত উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশে পৌঁছার পূর্বে পর্যন্ত এভাবে গোপনে অবস্থান ও দাওয়াতের কাজ চলতে থাকে। চল্লিশজন পূর্ণ হবার পর তারা জনসমক্ষে আত্ন প্রকাশ করেন।]

উসমান ইবনে মাযউন এবং তাঁর দুই ভাই কুদামা ও আবুদল্লাহ, উবাইদা ইবনে হারেস, সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর ও তাঁর স্ত্রী উমার উবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা, আসমা বিনতে আবু বাক্র ও আয়িশা বিনতে আবু বাকর (আয়িশা তখন অল্পবয়স্কা বালিকা), খাব্বাব ইবনে আরাত, উমাইর ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মাসউদ ইবনে কারী, সালীত ইবনে আমর, আইয়াশ ইবনে আবু রাবীয়া ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সুলামা, খুনাইস ইবনে হুযাফা, আমের ইবনে রাবীয়া, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর ভ্রাতা আবু আহমদ, জাফর ইবনে আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, হাতেব ইবনে হারেস ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে মুজাল্লাল, তাঁর ভ্রাতা হুতাব ও তাঁর স্ত্রী ফুকাইহা বিনতে ইয়াসার, মা’মার ইবনে হারেস, সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউন, মুত্তালিব ইবনে আযহার ও তাঁর স্ত্রী রামলা বিনতে আবু আউফ, নাহহাম তথা নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ, আমের ইবনে ফুহাইরা, খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস ও তাঁর স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, হাতেব ইবনে আমর, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ইবনে রাবীয়া, ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ, বুকাইর ইবনে আবদে ইয়ালীলের পুত্র খালিদ, আমের, আকেল ও ইয়াস, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও সুহাইব ইবনে সিনান রুমী [২৩.সুহাইব জন্মগতভাবে আরব। তিনি শৈশবে রোমকদের হাতে বন্দী হন এবং তাদের মাঝেই দাস হিসেবে বড় হন। পরে কালব গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁকে ক্রয় করে এন মক্কায় বিক্রয় করে। আদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করেছেন। হাদেিস সাহাইব উসলাম গ্রহণকারী প্রথম রুমবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।] ইসলাম গ্রহণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *