মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস যখন চল্লিশ বছর হলো, আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণাস্বরূপ এবং গেটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁরা নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদরেকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সেই অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।
আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন, “আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের সমই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।”
আবদুল মালিক ইবনে উবাইদুল্লাহ বর্ণনা বলেনঃ
আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও মার্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুওয়াতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!” ( হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি সালাম)। এ কথা শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশে-পাশে ডানে-বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিছুদিন কেটে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শুন্তে ও দেখতে থাকলেন। অতঃপর রমযান মাসে তিনি যখন হেরা গুহায় [২০. মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের গুহার নাম হেরা।] অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে পরম সম্মান ও মর্যাদার বাণী বহন করে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এলেন।
উবাইদ ইবনে ‘উমাইর থেকে বর্ণিত আছে যে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এক মাস হেরা গুহায় কাটাতেন। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও এই একইভাবে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে নিভৃত তপস্যায় মগ্ন হতো। প্রতি বছর একটা মাস তিনি এভাবে নির্জনে ইবাদাত করে কাটাতেন। উক্ত মাসে তাঁর কাছে যত দরিদ্র লোকই থাকতো তাদেরকে তিনি খাবার দিতেন। এক মাসের এই নির্জনবাস সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার আগে সর্বপ্রথম কা’বা শরীফে প্রবেশ করে সাতবার বা ততোধিক বার তাওয়াফ করতেন এবং একাজ করার পরই কেবল বাড়ীতে ফিরে আসতেন। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক তাঁকে পরম সম্মানে ভূষিত করার মাসটি অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির বছরের রমযান মাস সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি হেরায় অবস্থানের জন্য রওয়ানা হলেন। অবশেষে সেই মহান রাতটি এলো, যে রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রিসালাত দিয়ে গৌরবান্বিত করলেন। এই সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম তাঁর কাছে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এই অবস্থায় জিবরীল একখ- রেশমী কাপড় নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখ-ে কিছু লেখা ছিল। জিবরীল আমাকে বললেন, “পড়ুন”! আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।”
তখন তিনি আমাকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, আমি ভাবলাম, মরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন!” আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।” তিনি পুনরায় আমাকে সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এবারও চাপের প্রচ-তায় আমার মৃত্যুর আশংকা হলো। আবার তিনি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, “পড়ৃন”! আমি বললাম, “কি পড়বো?” তিনি বললেন, “ইকরা বিসমি রাব্বিকা….। অর্থাৎ পড়ুন আপনার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন, আর আপনার প্রভু সদাশয় অতি। তিনিই কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সেইসব জিনিস শিক্ষ দিয়েছেন যা সে জানতো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এই পর্যন্ত পড়িয়েই জিবরীল থামলে এবং তারপর চলে গেলেন। এরপর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হলো যেন আমি আমার মানসপটে কিছু লিখে নিয়েছি এরপর আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম “ হে মুহাম্মাদ, আপনি আল্লাহর রাসুর এবং আমি জিবরীল।” আমি ওপরে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম. জিবরীল একজন মানুষের আকৃতিত আকাশের দূর দিগন্তে ডানা দু’খানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মাদ আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরীল।” আমি স্তব্ধ হযে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এইরূপ নিশ্চলভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পিছনে সরতে বা সামনে এগুতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। এই সময় খাদীজা আমাকে খুঁজতে লোক পাঠালো। মক্কার উঁচু এলাকায় পৌঁছে তারা আবার খাদীজার কাছে ফিরে গেল। অথচ আমি তখনো ঐ একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর জিবরীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে চললাম। খদীজার কাছে উপনীত হয়ে তার কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম। সে বললো, “হে আবুল কাসিম, আপনি কোথায় ছিলেন? আমি আপনার খোঁজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কার উচ্চভূমিতে আপনাকে খুজে ফিরে এসছে।” আমি যা কিছু দেখেছিলাম সবকিছু খাদীজাকে খুলে বললাম। খাদীজা বললো, “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলেছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
অতঃপর খাদীজা কাপড়-চোপড়ে আবৃত হয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদীজার চাচাতো ভাই। তিনি খ্রস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপ-িত ছিলেন। বিশেষতঃ তাওরাত ও ইনজীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা ও শোনা সমস্ত য়টনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে ওয়ারাকা বলে উছলেন, “কুদ্দূসুন কদ্দূসুন! মহা পবিত্র ফেরেশতা! মহা পবিত্র ফেরেশতা!! আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মাদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন। বস্তুতঃ মুহাম্মাদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। [২১.সুহাইলী বলেনঃ ঈসা (আ) সময়ের ব্যবধানের দিক দিয়ে নিকটতর নবী হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারাকা তার পরিবর্তে মূসার নামোল্লেখ করলেন এই যে, ওয়ারাকা তখন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর খৃস্টানদের মতে হযরত ঈসা (আ) নবী নন। বরং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হয়রত ঈসা (আ) আল্লাহ তায়ালার তিনটি সত্তার একটি যা ঈসার সত্তায় একাকার হয়ে গিয়েছে। খৃস্টানদের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।]তাঁকে বলো, তিনি যেন অবিচল থাকেন।”
খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গিলেন এবং ওয়ারাকা যা বলেছেন তা তাঁকে জানালেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেরা গুহায় মাসব্যাপী ইবাদাত শেষ হলে তিনি মক্কায় ফিরে যথারীতি কা’বার তাওয়াফ করতে শুরু করলেন। এই সময় ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, তুমি যা দেখেছো ও শুনেছো- বলতো।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সমস্ত ঘটনা কললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, “নিশ্চিত জেনো, তুমি এ যুগের মানব জাতির নবী। সেই মহাদূতই তোমার কাছে এসেছিলেন যিনি মূসার কাছেও আসতেন। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমাকে দেশান্তরিত করা হবে এবং তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন জীবিত থাকি তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” অতঃপর ওয়ারাকা তাঁর কাছে মাথা এগিয়ে নিয়ে এলেন এবং তাঁর কপালে চুমু খেলেন। তাওয়াফ সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ী ফিরে গেলেন।