০২. পাকিস্তানের তালেবানীকরণ: আদিপিতাদের স্বপ্ন পূরণ

অধ্যায়- ২
পাকিস্তানের তালেবানীকরণ: আদিপিতাদের স্বপ্ন পূরণ
লেখক: এম,এ খান

সমগ্র পাকিস্তানের তালেবানীকরণ যখন অব্যাহতভাবে চলছে তখন দেখা যাচ্ছে যে, তথাকথিত প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তারস্বরে বলে চলেছেন কীভাবে তালেবানরা আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ মত পাকিস্তানের আদিপিতাদের সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে চূরমার করছে। তাদের কথা শুনে মনে হয় যেন এই আদিপিতারা সত্যিই একটা পূর্ণাঙ্গ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন।

দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় নিজেদের সুবিধামত এখান সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃতি দিতে পারদর্শী বুদ্ধিজীবীরা প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্নাহ্ স্বপ্ন কেমন ছিল সেটা দেখাবার জন্য জিন্নাহ্র এই কথাটা অবশ্যই উদ্ধৃত করবে, “সময়ের পরিক্রমায় আপনারা দেখতে পাবেন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থে নাগরিক হিসাবে হিন্দুরা হিন্দু থাকবে না এবং মুসলমানরা মুসলমান থাকবে না; আমি কথাটা ধর্মীয় অর্থে বলছি না, কারণ সেটা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার।”

পাকিস্তান যে দ্রুত তালেবানীকরণের (বিশ্বজনীনভাবে ক্রমপ্রসারমান প্রবণতা) দিকে ধাবিত হয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতার মধ্যে প্রবেশ করছে, তাদের সেই আশঙ্কার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, এই সব তথাকথিত প্রগতিশীল উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী আসলে হয় অর্ধশিক্ষিত, নয় ডাহা মিথ্যাবাদী। এবং এদের পক্ষে কোন ক্রমেই অজ্ঞতা পূজারী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর লড়াই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই রকম লোকেরা যখন একটা জাতির প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তির কাণ্ডারী হয় তখন সেই জাতির পরিণতি কী হতে পারে পাকিস্তানের পিছন দিকে যাত্রা দেখেই সেটা চমৎকারভাবে বুঝা যায়।

বিশ্ব জুড়ে মুসলিম সমাজগুলি যখন সহিংস এবং অতীত বর্বরতায় প্রত্যাবর্তনকামী ইসলামপন্থীদের দিক থেকে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তখন আমরা যদি এই ভয়ানক বিপদ থেকে আসলেই উদ্ধার পেতে চাই তবে আমাদের দরকার হচ্ছে এমন একদল বুদ্ধিজীবীর যারা হবেন ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল এবং নির্মম সত্য ভাষণে হবেন দ্বিধাহীন। অসততা এবং মিথ্যা দিয়ে যেমন কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয় না তেমন অজ্ঞতাও কোন কাজে লাগে না। আমরা হয়ত তালেবানদের আদর্শ থেকে শিক্ষা নিতে পারি, যেই আদর্শ বা কর্মসূচী সম্পূর্ণরূপে কোরআন এবং সুন্নাহ (নবীর ঐতিহ্য)­-এর উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং তারা এই ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে সৎ এবং দ্বিধাহীন। তালেবানরা যেই মানুষদেরকে তাদের আদর্শে দীক্ষিত করতে চাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে তালেবানদের সাফল্য নজর কাড়ার মত।

ইতিপূর্বে জিন্নাহর তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত উক্তি যেটা উদ্ধৃত করেছিলাম সেটা ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চূড়ান্ত হয় এবং জিন্নাহ স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তার তখনকার একটি বক্তৃতা থেকে নেওয়া। এটা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোতুষ্টির জন্য প্রদান করা হয়েছিল। কারণ তখন তাদের স্বীকৃতি, সমর্থন এবং সাহায্য পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল। উক্ত কথার পরিবর্তে বরং জিন্নাহর ধর্মনিরপেক্ষতাকে দেখতে হবে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন পরিচালনা কালে তিনি যেসব বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং কর্মকাণ্ড করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কী চিন্তা ছিল সেটা বুঝার সুবিধার জন্য জিন্নাহর বিজ্ঞ পরামর্শদাতা মুহাম্মদ ইকবালের একটা বক্তৃতার কথা উল্লেখ করা যায়। উক্ত বক্তৃতাটি ইকবাল ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভায় সভাপতির ভাষণে প্রদান করেছিলেন, যার ভিতর ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সারবস্তু। ধর্ম নিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামী আদর্শের অসঙ্গতিকে এই বক্তৃতায় তুলে ধরা হয়েছে। ইকবালের ভয় ছিল যে, অখণ্ড ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়ে ইসলাম ব্যক্তিগত বিশ্বাসে পরিণত হবে ­ ধর্ম নিরপেক্ষ পাশ্চাত্যে যে জঘন্য ব্যাপারটা হয়েছে। তিনি বলেন,

“ধর্ম যে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার এ কথাটা কেবল ইউরোপীয়দের মুখেই শোভা পায়।… কোরআনে ব্যক্ত নবীর ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রকৃতি এ থেকে সম্পূর্ণরূপেই ভিন্ন।”

সুতরাং তিনি ভারতে মুসলিম সমাজ যে সমস্যাকে মোকাবিলা করছিল সেই সমস্যাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,

“সুতরাং ইসলাম যে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে তার সঙ্গে তার ধর্মীয় আদর্শ জীবন্তভাবে সংযুক্ত। একটির অস্বীকৃতি পরিণামে আর একটির অস্বীকৃতিতে পরিণত হবে। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত ভিত্তিক জাতিগত ধারায় রাষ্ট্র গঠনের অর্থ যদি হয় ইসলামী সংহতি থেকে বিচ্যুতি তবে সেটা একজন মুসলমানের নিকট হবে সম্পূর্ণরূপে অচিন্তনীয়। এটা এমন একটি বিষয় যেটা বর্তমান ভারতের মুসলমানদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে।”

এরপর ইকবাল তার বক্তব্যের জের টেনে “দ্বিজাতিতত্ত্ব”উপস্থাপন করেন।

“আমি পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমাìত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বালুচিস্তান সমন্বয়ে গঠিত একটি একক রাষ্ট্র দেখতে চাই।”

ইকবাল তার মৃত্যু (১৯৩৮) পর্যìত একটি পৃথক মুসলিম ভূমির জন্য এই প্রচারাভিযানকে জোরদার করেন। এবং এটাকে জিন্নাহর হাতে অর্পণ করেন। অগণিত মানুষের অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতি ও রক্তপাতের বিনিময়ে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লামা ইকবালের আরব্ধ কাজকে সম্পূর্ণতা দান করলেন জিন্নাহ।

অধিকন্তু “পাকিস্তান”শব্দের অর্থ হলো “পবিত্র ভূমি”। ইসলামে অমুসলমানরা হচ্ছে নোংরা, অপবিত্র (কোরআন ৯:২৮)। সুতরাং নোংরা, অপবিত্র অমুসলমানদের থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্নকৃত পবিত্র জনগোষ্ঠী হিসাবে কেবলমাত্র মুসলমানদের বাসভূমি হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সতর্কভাবে “পাকিস্তান”নামটি বেছে নেওয়া হল। আর এই বিশুদ্ধ ও জীবìতভাবে ইসলামী রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য “জিহাদ”অথবা “পবিত্র যুদ্ধ”হল জিন্নাহর হাতিয়ার। জিহাদের মধ্য দিয়ে বিধর্মীদেরকে পাইকারীভাবে হত্যা, বহিষ্কার, দাসত্বে নিক্ষেপ এবং জবরদস্তিমূলক ধর্মাìতরকরণ দ্বারা নবী মুহাম্মদ আরবে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, সেই দৃষ্টাìতকেই জিন্নাহ অনুসরণ করার চেষ্টা করলেন।

১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন র্যা লীর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য জিন্নাহর প্রচারাভিযানের যে সূত্রপাত হয় সেটি ছিল “জিহাদ”। যে দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সেই দিনটি ছিল রমযানের ১৮ তারিখ; এই দিনটিতে যুগান্তকারী বদর যুদ্ধে নবীর বিস্ময়কর বিজয় অর্জিত হয়। জিন্নাহর মুসলিম লীগের যে গোপন প্রচারপত্র মুসলমানদের মধ্যে বিলি করা হয় (মসজিদে ধর্মোপদেশের সময়েও পাঠ করা হয়) সেই প্রচারপত্রে বলা হয়,

“মুসলমানদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, রমযান হচ্ছে সেই মাস যে মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়। রমযান হচ্ছে সেই মাস, যে মাসে জিহাদের অনুমোদন দেওয়া হয়। রমযান হচ্ছে সেই মাস, যে মাসে বদর যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যেটা ছিল ইসলাম এবং ধর্মহীনতা (অর্থাৎ পৌত্তলিকতা, যা দিয়ে এখানে হিন্দু ধর্মকে বুঝানো হচ্ছে)-এর মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ, যে যুদ্ধে ৩১৩ জনের মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করে; আবার এই রমযান মাসেই পবিত্র নবী ১০,০০০ লোকের বাহিনী নিয়ে মক্কা জয় করেন এবং আরবে পরম সুখের রাজ্য এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম লীগ ভাগ্যবান যে, এই পবিত্র মাসে তারা তাদের সংগ্রাম শুরু করছে।

“আল্লাহর কৃপায় ভারতে আমরা দশ কোটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা হিন্দু এবং বৃটিশদের গোলামে পরিণত হয়েছি। আমরা এই পবিত্র মাসে আল্লাহর নামে জিহাদ শুরু করছি। প্রার্থনা করুন, আল্লাহ তুমি আমাদের শরীর ও মনে বলবান করো, আমাদের সকল প্রচেষ্টায় তুমি সাহায্য করো, কাফিরদের (কাফির অর্থাৎ আল্লাহর শত্রু যেমন, হিন্দুরা) উপর আমাদের জয়যুক্ত করো। আল্লাহর কৃপায় আমরা যেন ভারতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী রাজ্য গড়ে তুলতে পারি।”

তখন মুসলিম লীগ সরকার ছিল বাংলার ক্ষমতায়। তার নির্দেশে পুলিশের প্রশ্রয়ে কলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশনের মাধ্যমে সূচিত জিহাদ দ্বারা মুসলমানরা হিন্দু এবং শিখদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধংস, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালায়। দেড় দিনের ভয়ঙ্কর বর্বরতার শিকার হবার পর হিন্দু এবং শিখরা পাল্টা আঘাত হানে এবং মুসলমান দাঙ্গাকারীদেরকে সংখ্যা শক্তি দ্বারা পরাভূত ক’রে একইভাবে প্রতিশোধ নেয়। পাঁচ দিনের অব্যাহত সহিংসতা পাঁচ হাজার জীবনকে কেড়ে নেয় এবং যে কলকাতায় মুসলমানরা ছিল মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ সেখানে মুসলিম হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩%।

যে অঞ্চলগুলি পরে পাকিস্তানে পরিণত হয় ভারতের মুসলিম প্রধান সেই সব অঞ্চলে ডাইরেক্ট এ্যাকশনের পরবর্তী মাসগুলিতে প্রায়শ অনেক বেশী ভয়াবহতা এবং হিংস্রতা নিয়ে দাঙ্গা (ব্যতিক্রম হচ্ছে হিন্দু প্রধান বিহারের দাঙ্গা যা কলকাতা এবং নোয়াখালীর দাঙ্গার পর ঘটে)  ছড়িয়ে পড়ে। এইসব দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল ঐ এলাকাগুলি থেকে হিন্দু, শিখ এবং অন্য অমুসলিমদেরকে উচ্ছেদ করা। সেটা গণহত্যা দিয়ে হোক, বহিষ্কারকরণ দিয়ে হোক, জবরদস্তিভাবে ধর্মাìতরকরণ দিয়ে হোক এবং এমন কি অপহরণের মাধ্যমে দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেই হোক। নোয়াখালী দাঙ্গায় (অক্টোবর, ১৯৪৬) হিসাবকৃত চার লক্ষ হিন্দুর মধ্যে ৯৫ শতাংশকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়।

যখন মুসলমানরা এক অঞ্চলে অথবা অন্যত্র বিধর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে চলেছিল এবং যখন হিন্দু এবং শিখরা দেখলো যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়েছে তখন তারা ১৯৪৭ সালের আগস্টের প্রথম দিকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে, যেটা ছিল বর্তমান পাকিস্তানভুক্ত অঞ্চলে তাদের সমধর্মাবলম্বীদের উপর অব্যাহত এবং সাম্প্রতিক সময়ে বর্ধিত সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া।

জিন্নাহ যে জিহাদের আগুন প্রজ্বলিত করলেন তা তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হল। সেটা হল পাকিস্তান সৃষ্টি। যার জন্য মূল্য দিতে হল উভয় পক্ষে প্রায় ২০ লক্ষ পর্যìত জীবনকে। উভয় পক্ষের প্রাণহানির পরিমাণ প্রায় সমান। কয়েক মিলিয়ন হিন্দু এবং শিখকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হল, কয়েক লক্ষ হিন্দু এবং শিখ নারীকে ধর্ষণ করা হল এবং সমসংখ্যক নারীদেরকে মুসলিম গুণ্ডারা অপহরণ এবং বলপূর্বক বিবাহ করল।

প্রায় দুই কোটি মানুষ বাড়ীঘর এবং সহায়-সম্পত্তি ত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হল। কিন্তু নোংরা ও অপবিত্র বিশ্বাসহীনদের থেকে মুক্ত এবং মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র ভূমি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত জিন্নাহর অভিযান বিরাটভাবে সফল হলেও অমুসলিমদেরকে নিশ্চিহ্ন করার কাজটা তখনও কিছু সংখ্যক নাছোড়বান্দা হিন্দু এবং শিখের জন্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল। এই নাছোড়বান্দারা না ছাড়তে চায় তাদের বাপ-দাদার ভিটা, না ছাড়তে চায় তাদের ধর্ম। তবে আগে হোক পরে হোক পাকিস্তানকে বিশুদ্ধ করার কাজটা চলতে থাকল এবং প্রায় সম্পূর্ণ হল। বর্তমান পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালে হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে ছিল ১০ শতাংশ সেটা এখন সেখানে এক শতাংশেরও নীচে নেমে গেছে। ১৯৪৭ সালের পর প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ হিন্দু শুধু বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হল। এখানে হিন্দু জনসংখ্যা ২৫-৩০ শতাংশ থেকে বর্তমানে প্রায় ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।

যে তালেবানরা গোটা পাকিস্তানকে দ্রুত গতিতে গ্রাস করছে স্পষ্টতই তারা ইকবাল এবং জিন্নাহর স্বপ্ন পূরণে অগ্রসর হচ্ছে, যে স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানকে মুসলমানদের জন্য পবিত্র ভূমিতে পরিণত করা, যেখানে ইসলামী আইন হবে রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি।

ইসলামের প্রতি জিন্নাহর আনুগত্যের অভাব সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয় : যেমন, তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ ছিলেন, তিনি সামান্যই মুসলমান ছিলেন, যিনি শুকরের মাংস এবং মদ্য পান পছন্দ করতেন, ইত্যাদি। এটা সত্য হতে পারে। তিনি এমনকি সত্যিকার অর্থেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু সেটা কেবলমাত্র তার মনের ভিতরেই ছিল। তার মুসলিম লীগ পার্টি দ্বারা পরিচালিত সাধারণ মুসলমানরা, যারা তার আদর্শকে বাস্তবায়নের জন্য চরম বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তারা অতশত বুঝত না। তারা সেটুকুই শুধু বুঝত যেটুকু ইকবাল এবং জিন্নাহ স্পষ্টভাবে এবং জোরালোভাবে তাদেরকে বুঝাতেন। কোন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য “জিহাদ”পরিচালিত হয় না। দুইজন ভণ্ড মুসলমানের মনের ভিতরে কী ছিল না ছিল তা গুরুত্বহীন। যেই সাধারণ মুসলমানরা এই আদর্শকে এগিয়ে নিয়েছিল তাদেরকে কী বলা হয়েছিল এবং তাদের সামনে কোন আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছিল কেবলমাত্র সেটাকেই হিসাবে নিতে হবে।জিন্নাহ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সকল শাসক একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র লাভের পাওনা থেকে পাকিস্তানীদেরকে বঞ্চিত রেখে তাদেরকে দীর্ঘকাল বোকা বানিয়েছিলেন। তালেবানদেরকে ধন্যবাদ যে তারা পাকিস্তানীদের “স্বপ্ন রাষ্ট্র”প্রতিষ্ঠার প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে, যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কঠোর সংগ্রাম এবং বিপুলভাবে আত্মদান করেছিল। এই প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তান-এর চির-অকপট নেতা কাজী হোসেইন আহমদ-এর কথা সবচেয়ে শিক্ষণীয়,

“বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানীদের দীর্ঘকালের প্রাণের দাবী হচ্ছে পাকিস্তানের সম্পূর্ণরূপে ইসলামীকরণ। শুধু তাই নয়, তালেবানীকরণের ঘনায়মান বিপদকে মোকাবিলা করারও এটাই যথাযথ উপায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জনগণের প্রাণের এই দাবীকে অবদমিত করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই বিপদের আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে।”

বব মার্লের গানের কলির মতো করে বললে, “ . . .তুমি সব সময় সব মানুষকে বোকা বানাতে পারবে না”।

(নিবন্ধটি M. A. Khan-Gk Talibanization of Pakistan: Realizing the Dreams of Founding Fathers-এর বাংলায় ভাষান্তর। লেখক এমএ খান Islam Watch (www.islam-watch.org)-এর সম্পাদক এবং Islamic Jihad: A Ligacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery-এর লেখক। নিবন্ধটি লেখকের অনুমতিক্রমে ভাষান্তরিত এবং বঙ্গরাষ্ট্রে প্রকাশিত। ইতিপূর্বে এটির মূল ইংরাজী লেখা  Islam Watch-এ প্রকাশিত হয়।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *