৫.১১ ঠাকুরের কলিকাতায় আগমন

পঞ্চম খণ্ড – একাদশ অধ্যায় : ঠাকুরের কলিকাতায় আগমন

পাণিহাটিতে যাইয়া গলায় বেদনা বৃদ্ধি ও বালক-স্বভাব ঠাকুরের আচরণ

পানিহাটি মহোৎসবে যোগদান করিয়া ঠাকুরের গলায় বেদনা বৃদ্ধি হইল। সেদিন মধ্যে মধ্যে বৃষ্টি হইয়াছিল। বৃষ্টিতে ভিজিয়া আর্দ্রপদে বহুক্ষণ ভাবাবেশে অতিবাহিত করিবার ফলেই রোগ বাড়িয়াছে বলিয়া ডাক্তার ভক্তগণকে বারম্বার অনুযোগ করিলেন এবং পুনরায় ঐরূপ অত্যাচার হইলে উহা কঠিন হইয়া দাঁড়াইবে বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিতেও ছাড়িলেন না। ভক্তগণ উহাতে এখন হইতে সতর্ক থাকিতে দৃঢ়সংকল্প করিলেন এবং বালক স্বভাব ঠাকুর ঐ দিবসের অত্যাচারের সমস্ত দোষ রামচন্দ্রপ্রমুখ কয়েকজন প্রবীণ ভক্তের উপর চাপাইয়া বলিলেন, “উহারা যদি একটু জোর করিয়া আমাকে নিষেধ করিত তাহা হইলে কি আমি পাণিহাটিতে যাইতে পারিতাম।” চিকিৎসা-ব্যবসায়ী না হইলেও রাম বাবু ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলে পড়িয়া ডাক্তারী পাশ করিয়া ছিলেন। বৈষ্ণব মতের প্রতি অনুরাগবশতঃ পাণিহাটির উৎসবে যাইবার জন্য তিনিই ঠাকুরকে বিশেষ উৎসাহিত করিয়াছিলেন, সুতরাং তিনিই এখন ঐ বিষয়ে সমধিক দোষভাগী বলিয়া বিবেচিত হইলেন। আমাদিগের জনৈক বন্ধু একদিন এই সময়ে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ঠাকুর গলদেশে প্রলেপ লাগাইয়া গৃহমধ্যে ছোট তক্তাখানির উপর চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। তিনি বলেন, “বালককে শাসন করিবার জন্য কোন কাৰ্য করিতে নিষেধ করিয়া একস্থানে আবদ্ধ রাখিলে সে যেমন বিষণ্ণ হইয়া থাকে, ঠাকুরের মুখে অবিকল সেই ভাব দেখিতে পাইলাম। প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হইয়াছে? তিনি তাহাতে গলার প্রলেপ দেখাইয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, “এই দ্যাখ না, ব্যথা বাড়িয়াছে, ডাক্তার বেশী কথা কহিতে নিষেধ করিয়াছে”। বলিলাম, তাই ত মশায়, শুনিলাম সেদিন আপনি পেণেটি গিয়াছিলেন, বোধ হয় সে জন্যই ব্যথাটা বাড়িয়াছে। তিনি তাহাতে বালকের ন্যায় অভিমানভরে বলিতে লাগিলেন, “হাঁ, দ্যাখ দেখি, এই উপরে জল নীচে জল, আকাশে বৃষ্টি পথে কাদা, আর রাম কিনা আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে সমস্ত দিন নাচিয়ে নিয়ে এলো! সে পাশকরা ডাক্তার, যদি ভাল করে বারণ করতো তা হলে কি আমি সেখানে যাই”। আমি বলিলাম, ‘তাই ত মশায়, রামের ভারি অন্যায়। যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, এখন কয়েকটা দিন একটু সাবধানে থাকুন, তাহা হইলেই সারিয়া যাইবে’। শুনিয়া তিনি খুশী হইলেন এবং বলিলেন, “তা বলে একেবারে কথা বন্ধ করে কি থাকা যায়? এই দ্যাখ দেখি—তুই কতদূর থেকে এলি, আর আমি তোর সঙ্গে একটিও কথা কইব না, তা কি হয়?” বলিলাম, ‘আপনাকে দেখিলেই আনন্দ হয়, কথা না-ই বা কহিলেন, আমাদের কোন কষ্ট হইবে না—ভাল হউন, আবার কত কথা শুনিব’। কিন্তু সেকথা শুনে কে? ডাক্তারের নিষেধ, নিজের কষ্ট প্রভৃতি সকল বিষয় ভুলিয়া তিনি পূর্বের ন্যায় আমার সহিত আলাপে প্রবৃত্ত হইলেন।”

গলায় ক্ষত হওয়া ও ডাক্তারের নিষেধ না মানিয়া ঠাকুরের সমীপাগত জনসাধারণকে পূর্ববৎ উপদেশ দান

ক্রমে আষাঢ় অতীত হইল। মাসাধিক চিকিৎসাধীন থাকিয়াও ঠাকুরের গলার বেদনার উপশম হইল না। অন্য সময়ে স্বল্প অনুভূত হইলেও একাদশী, পূর্ণিমা ও অমাবস্যা প্রভৃতি তিথিতে উহার বিশেষ বৃদ্ধি হইত। তখন কোনরূপ কঠিন খাদ্য গলায় ক্ষত হওয়া ও তরিতরকারি গলাধঃকরণ করা একপ্রকার অসাধ্য হইয়া উঠিত। সুতরাং দুধ ভাত ও সুজির পায়স মাত্র ভোজন করিয়া ঠাকুর ঐ সকল দিন অতিবাহিত করিতেন। ডাক্তারেরা পরীক্ষা পূৰ্ব্বক স্থির করিলেন, তাঁহার Clergyman’s sore-throat হইয়াছে অর্থাৎ লোককে দিবারাত্র ধর্মোপদেশ প্রদানে বাগযন্ত্রের অত্যধিক ব্যবহার হইয়া গলদেশে ক্ষত হইবার উপক্রম হইয়াছে; ধর্মপ্রচারকদিগের ঐরূপ ব্যাধি হইবার কথা চিকিৎসাশাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে। রোগনির্ণয় করিয়া ডাক্তারেরা ঔষধপথ্যাদির যেরূপ ব্যবস্থা করিলেন, ঠাকুর তাহা সম্যক্ মানিয়া চলিলেও দুইটি বিষয়ে উহার ব্যতিক্রম হইতে লাগিল। প্রগাঢ় ঈশ্বরপ্রেম এবং সংসারতপ্ত জনগণের প্রতি অপার করুণায় অবশ হইয়া তিনি সমাধি ও বাক্যসংযমের দিকে যথাযথ লক্ষ্য রাখিতে সমর্থ হইলেন না। কোনরূপ ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ উপস্থিত হইলেই তিনি দেহবুদ্ধি হারাইয়া পূর্বের ন্যায় সমাধিস্থ হইতে লাগিলেন এবং অজ্ঞানান্ধকারে নিপতিত, শোকে তাপে মুহ্যমান জনগণ পথের সন্ধান ও শান্তির প্রয়াসী হইয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইবামাত্র করুণায় আত্মহারা হইয়া তিনি পূর্বের মত তাহাদিগকে উপদেশাদিপ্রদানে কৃতার্থ করিতে লাগিলেন।

বহু ব্যক্তিকে ধর্মোপদেশ দানের অত্যধিক শ্রম ও মহাভাবে নিদ্রারাহিত্যাদি ব্যাধির কারণ

ঠাকুরের নিকটে এখন ধর্মপিপাসু ব্যক্তিসকলের আগমন বড় স্বল্প হইতেছিল না। পুরাতন ভক্তসকল ভিন্ন পাঁচ-সাত বা ততোধিক নূতন ব্যক্তিকে ধৰ্মলাভের আশয়ে দক্ষিণেশ্বরে তাহার দ্বারে এখন নিত্য উপস্থিত হইতে দেখা যাইত। ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে শ্ৰীযুত কেশবের দক্ষিণেশ্বরে আগমনের কিছুকাল পর হইতে প্রতিদিন ঐরূপ হইতেছিল। সুতরাং লোকশিক্ষা প্রদানের জন্য গত একাদশ বৎসরে ঠাকুরের নিয়মিতকালে স্নান, আহার এবং বিশ্রামের সত্য-সত্যই অনেক সময়ে ব্যাঘাত উপস্থিত হইতেছিল। তদুপরি মহাভাবের প্রেরণায় তাহার নিদ্রা স্বল্পই হইত। দক্ষিণেশ্বরে তাহার নিকটে অবস্থানকালে আমরা কত দিন দেখিয়াছি, রাত্রি প্রায় ১১টার সময় শয়ন করিবার অনতিকাল পরেই তিনি উঠিয়া ভাবাবেশে পদচারণ করিতেছেন–কখন পশ্চিমের, কখন উত্তরের দরজা খুলিয়া বাহিরে যাইতেছেন, আবার কখন বা শয্যাতে স্থির হইয়া শয়ন করিয়া থাকিলেও সম্পূর্ণ জাগ্রত রহিয়াছেন। ঐরূপে রাত্রের ভিতর তিন-চারি বার শয্যাত্যাগ করিলেও রাত্র ৪টা বাজিবামাত্র তিনি নিত্য উঠিয়া শ্রীভগবানের স্মরণ, মনন, নাম-গুণ-গান করিতে করিতে উষার আলোকের অপেক্ষা করিতেন এবং পরে আমাদিগকে ডাকিয়া তুলিতেন। অতএব দিবসে বহু ব্যক্তিকে উপদেশ দিবার অত্যধিক পরিশ্রমে এবং রাত্রের অনিদ্রায় তাঁহার শরীর যে এখন অবসন্ন হইবে, তাহাতে বিচিত্র কি!

ভাবাবেশ কালে জগন্মাতার সহিত কলহে ঠাকুরের শারীরিক অবসন্নতার কথা প্রকাশ

অত্যধিক পরিশ্রমে তাহার শরীর যে ক্ৰমে অবসন্ন হইতেছিল, ঠাকুর তদ্বিষয় আমাদিগের কাহাকে না বলিলেও উহার পরিচয় শ্রীশ্রীজগন্মাতার সহিত তাঁহার প্রেমের কলহে আমরা কখন কখন শুনিতে পাইতাম, কিন্তু সম্যক্ বুঝিতে পারিতাম না। পীড়িত হইবার কিছুকাল পূর্বে এক দিবস দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া আমাদিগের জনৈক দেখিয়াছিল, তিনি ভাবাবিষ্ট হইয়া ছোট তক্তাখানির উপর বসিয়া কাহাকে সম্বোধন করিয়া আপন মনে বলিতেছেন, “যত সব এঁদো লোককে এখানে আনবি, এক সের দুধে একেবারে পাঁচ সের জল, ফু দিয়ে জ্বাল ঠেলতে ঠেলতে আমার চোখ গেল, হাড় মাটি হল, অত করতে আমি পারব না, তোর সখ থাকে তুই করগে যা! ভাল লোক সব নিয়ে আয়, যাদের দুই-এক কথা বলে দিলেই (চৈতন্য) হবে।” অন্য এক দিবসে তিনি সমীপাগত ভক্তগণকে বলিয়াছিলেন, “মাকে আজ বলিতেছিলাম-বিজয়, গিরিশ, কেদার, রাম, মাষ্টার এই কয়জনকে একটু একটু শক্তি দে, যাতে নতুন কেহ আসিলে ইহাদের দ্বারা কতকটা তৈরী হইয়া আমার নিকটে আসে।” ঐরূপে লোকশিক্ষায় সহায়তাপ্রদানের বিষয়ে ভক্তিমতী জনৈকা স্ত্রীভক্তকে এক সময়ে বলিয়াছিলেন, “তুই জল ঢাল, আমি কাদা করি।” ধৰ্ম্মপিপাসুগণের জনতা দক্ষিণেশ্বরে প্রতিদিন বাড়িতেছে দেখিয়া তাহার গলদেশে প্রথম বেদনা অনুভবের কয়েক দিন পরে এক দিবস ভাবাবিষ্ট হইয়া তিনি শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে বলিয়াছিলেন, “এত লোক কি আনতে হয়? একেবারে ভিড় লাগিয়ে দিয়েছিস! লোকের ভিড়ে নাইবার খাবার সময় পাই না! একটা ত এই ফুটো ঢাক (নিজ শরীর লক্ষ্য করিয়া), রাতদিন এটাকে বাজালে আর কয়দিন টিকবে?”

দক্ষিণেশ্বরে কত ধর্মপিপাসু উপস্থিত হইয়াছিল তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য

বাস্তবিক, ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে কলিকাতার জনসাধারণের মধ্যে ঠাকুরের লোকোত্তর ভাব, প্রেম, সমাধি ও অমৃতময়ী বাণীর কথা মুখে মুখে এতদূর প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার পুণ্যদর্শনলাভের আশয়ে নিত্যই দলে দলে লোক দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইতেছিল এবং যাহারা একবার আসিতেছিল তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশই মোহিত হইয়া তদবধি পুনঃ পুনঃ আগমন করিতেছিল। কিন্তু ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে ঠাকুরের কণ্ঠপীড়া হইবার পূর্বে ঐরূপে কত লোক তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়াছিল তাহার পরিমাণ হওয়া সুকঠিন। কারণ, এক স্থানে একই দিনে তাহাদিগের সকলের একত্রিত হইবার সুযোগ কখনও উপস্থিত হয় নাই। ঐরূপ সুযোগ উপস্থিত না হওয়ায় একপ্রকার ভালই হইয়াছিল, নতুবা আমার পূজ্য দেশপূজ্য হইতেছেন, আমার প্রিয়তমকে সকলে ভালবাসিতেছে ভাবিয়া ঠাকুরের অন্তরঙ্গগণ তাহার ভক্তসংখ্যার বৃদ্ধিতে এতদিন যে আনন্দ অনুভব করিতে ছিলেন, তাহা ঐ সংখ্যার বাহুল্যদর্শনে বহু পূর্বে বিষাদ ও ভীতিতে পরিণত হইত; কারণ, তাহার নিজমুখে তাহারা বারম্বার শ্ৰবণ করিয়াছিলেন, “অধিক লোক যখন (আমাকে) দেবজ্ঞানে মনিবে, শ্রদ্ধা ভক্তি করিবে, তখনই ইহার (শরীরের) অন্তর্ধান হইবে।”

নিজদেহরক্ষার কালনিরূপণ সম্বন্ধে ঠাকুরের কথা

       তাঁহার দেহরক্ষা করিবার কালনিরূপণ সম্বন্ধে অনেক ইঙ্গিত ঠাকুর সময়ে সময়ে আমাদিগকে প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার প্রেমে অন্ধ আমরা সে সকল কথা তখন শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারি নাই। তাঁহার অলৌকিক কৃপা লাভে আমরা যেরূপ ধন্য হইয়াছি, আমাদিগের আত্মীয় বন্ধু ও পরিচিত সকলে তদ্রূপ কৃপা লাভে শান্তির অধিকারী হউক—এই বিষয়েই তখন সকলের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সুতরাং তাঁহার অদর্শনের কথা ভাবিবার অবসর কোথায়? কণ্ঠরোগ হইবার চারি-পাঁচ বৎসর পূর্বে ঠাকুর ঐবিষয়ে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীকে বলিয়াছিলেন, “যখন যাহার তাহার হস্তে ভোজন করিব, কলিকাতায় রাত্রিযাপন করিব এবং খাদ্যের অগ্রভাগ কাহাকেও প্রদান করিয়া অবশিষ্টাংশ স্বয়ং গ্রহণ করিব, তখন জানিবে দেহরক্ষা করিবার অধিক বিলম্ব নাই।” কণ্ঠরোগ হইবার কিছুকাল পূর্ব হইতে ঘটনাও বাস্তবিক ঐরূপ হইয়া আসিতেছিল। কলিকাতার নানা স্থানে নানা লোকের বাটীতে নিমন্ত্রিত হইয়া ঠাকুর অন্ন ভিন্ন অপর সকল ভোজ্যপদার্থ যাহার তাহার হস্তে ভোজন করিতেছিলেন–কলিকাতায় আগমনপূর্বক ঘটনাচক্রে শ্রীযুত বলরামের বাটীতে ইতিপূর্বে রাত্রিবাসও মধ্যে মধ্যে করিয়া গিয়াছিলেন এবং অজীর্ণ রোগে আক্রান্ত হইয়া নরেন্দ্রনাথ ইতিপূর্বে এক সময়ে দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার নিকটে পথ্যের বন্দোবস্ত হইবে না বলিয়া বহুদিবস না আসিলে, ঠাকুর একদিন তাহাকে প্রাতঃকালে আনাইয়া আপনার জন্য প্রস্তুত ঝোল-ভাতের অগ্রভাগ নরেন্দ্রনাথকে সকাল সকাল ভোজন করাইয়া অবশিষ্টাংশ স্বয়ং গ্রহণ করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী ঐ বিষয়ে আপত্তি করিয়া তাহার নিমিত্ত পুনরায় রন্ধন করিয়া দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, “নরেন্দ্রকে অগ্রভাগ প্রদানে মন সঙ্কুচিত হইতেছে না। উহাতে কোন দোষ হইবে না, তোমার পুনরায় বাঁধিবার প্রয়োজন নাই।” শ্ৰীমা বলিতেন, “ঠাকুর ঐরূপে বুঝাইলেও তাহার পূর্বকথা স্মরণ করিয়া আমার মন খারাপ হইয়া গিয়াছিল।”

ঠাকুরের শিবজ্ঞানে জীবসেবানুষ্ঠান

লোকশিক্ষাপ্রদানের অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর অবসন্ন হইলেও ঠাকুরের মনের উৎসাহ ঐবিষয়ে কখনও স্বল্প দেখা যায় নাই। অধিকারী ব্যক্তি উপস্থিত হইবামাত্র তিনি কেমন করিয়া প্রাণে প্রাণে উহা বুঝিতে পারিতেন এবং কোন্ এক দৈবশক্তির আবেশে আত্মহারা হইয়া তাহাকে উপদেশ প্রদান এবং স্পর্শাদি করিয়া তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ উন্মুক্ত করিয়া দিতেন। সে যে ভাবের ভাবুক তাহার মনে তখন সেই ভাব প্রবল হইয়া অন্য সকল ভাবকে কিছুক্ষণের জন্য প্রচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত এবং উক্ত ভাবে সিদ্ধিলাভ করিবার দিকে ঐ ব্যক্তি কতদূর যাইয়া আর অগ্রসর হইতে পারিতেছে না, তাহা দিব্যচক্ষে দেখিতে পাইয়া তিনি তাহার পথের বাধাসকল সরাইয়া তাহাকে উচ্চতর ভাবভূমিতে আরূঢ় করাইতেন। ঐরূপে দেহপাতের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিনি শিবজ্ঞানে জীবসেবার সর্বদা অনুষ্ঠান করিয়াছেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দান বলিয়া যাহা শাস্ত্রে বর্ণিত হইয়াছে, সেই অভয় পদবীর দিব্য জ্যোতিতে অভিষিক্ত করিয়া আবালবৃদ্ধ বনিতার জন্মজন্মাগত বাসনাপিপাসা চিরকালের মত মিটাইয়া দিয়াছেন!

লোকের মনের গূঢ়ভাব ও সংস্কারসমূহ ধরিবার ঠাকুরের ক্ষমতা

লোকের মনের নিগূঢ়ভাব ও সংস্কারসমূহ ধরিবার ক্ষমতা আমরা তাহাতে চিরকাল সমুজ্জ্বল দেখিয়াছি। শরীরের সুস্থতা বা অসুস্থতা তাঁহার মনকে যে কখন স্পর্শ করিত না, উহা তদ্বিষয়ের এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ বলিতে পারা যায়। কিন্তু অপরের অন্তরের রহস্য সম্পূর্ণরূপে জানিতে পারিলেও, নিজ অলৌকিক শক্তির পরিচয় দিবার জন্য তিনি উহা কখনও প্রকাশ করিতেন না। যখন যতটুকু প্রকাশ করিলে কাহারও যথার্থ কল্যাণ সাধিত হইত, তখন ততটুকু মাত্র প্রকাশপূর্বক তাহাকে উচ্চপথ দেখাইয়া দিতেন। অথবা কোন সৌভাগ্যবানের হৃদয়ে তাহার প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরের ভাব অচল অটল করিবার জন্য তাহার নিকটে পূর্বোক্ত শক্তির পরিচয় প্রদান করিতেন। পাঠকের বুঝিবার সুবিধা হইবে বলিয়া ঐ বিষয়ক সামান্য একটি দৃষ্টান্ত এখানে লিপিবদ্ধ করিতেছি—

ঠাকুরের কণ্ঠের বেদনাবৃদ্ধি হইয়াছে শুনিয়া ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের শ্রাবণের শেষে আমাদিগের সুপরিচিত জনৈকা তাহাকে দেখিতে যাইতেছিলেন। পল্লীবাসিনী অন্য এক রমণী ঐ কথা জানিতে পারিয়া তাহাকে বলিলেন, “ঠাকুরকে দিবার মত আজ বাটীতে দুধ ভিন্ন অন্য কিছু নাই যাহা তোর হাতে পাঠাই; এক ঘটি দুধ লইয়া যাইবি?” পূর্বোক্ত রমণী তাহাতে স্বীকৃত না হইয়া বলিলেন, “দক্ষিণেশ্বরে ভাল দুধের অভাব নাই, তাঁহার জন্য দুধ বরাদ্দও আছে জানি এবং উহা লইয়া যাওয়াও হাঙ্গাম, অতএব দুধ লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই।” দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিয়া তিনি দেখিলেন, গলার ব্যথার জন্য দুধ ভাত ভিন্ন কোনরূপ তরিতরকারি ঠাকুরের খাওয়া চলিতেছে না এবং কোন কারণে গয়লানী সেদিন নিত্য বরাদ্দ দুধ দিতে না পারায় শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী বিশেষ চিন্তিতা রহিয়াছেন। কলিকাতা হইতে দুধ না লইয়া আসায় তিনি তখন বিশেষ অনুতপ্ত হইলেন এবং পাড়ায় কোনস্থানে দুধ পাওয়া যায় কি না সন্ধান করিতে করিতে জানিতে পারিলেন, ঠাকুরবাটীর অনতিদূরে ‘পাড়ে গিন্নি’ নামে পরিচিত এক হিন্দুস্থানী রমণীর গাভী আছে এবং সে দুগ্ধ বিক্রয়ও করিয়া থাকে। তাহার বাটীতে উপস্থিত হইয়া জানিলেন, তাহার সকল দুগ্ধ বিক্রয় হইয়া গিয়াছে; কেবল দেড়পোয়া আন্দাজ উদ্বৃত্ত থাকায় সে উহা জ্বাল দিয়া রাখিয়াছে। বিশেষ প্রয়োজন বলায় সে ঐ দুগ্ধ তাহাকে বিক্রয় করিল এবং তিনি উহা লইয়া আসিলে ঠাকুর উহার সাহায্যেই সেদিন ভাত খাইলেন। আহারান্তে আচমন করিতে উঠিলে তিনি তাহার হাতে জল ঢালিয়া দিলেন। অনন্তর ঠাকুর তাহাকে সহসা একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, “ওগো, আমার গলাটায় বড় বেদনা হয়েছে, তুমি রোগ আরাম করিবার যে মন্ত্রটি জান তাহা উচ্চারণ করিয়া একবার হাত বুলাইয়া দাও তো।” রমণী ঐ কথা শুনিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর ঠাকুরের অভিপ্রায় মত তাহার গলদেশে হাত বুলাইয়া দিবার পরে শ্রীশ্রীমার নিকটে আসিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমি যে ঐ মন্ত্র জানি, উনি একথা কিরূপে জানিতে পারিলেন? ঘোষপাড়ার সম্প্রদায়ভুক্ত কোন রমণীর নিকটে আমি উহা সকাম কর্মসকল সাধনে বিশেষ সিদ্ধিদ জানিয়া বহুপূর্বে শিখিয়া লইয়া ছিলাম, পরে নিষ্কাম হইয়া ঈশ্বরকে ডাকাই জীবনের কর্তব্য জানিয়া উহা ত্যাগ করিয়াছি। জীবনের সকল কথাই ঠাকুরকে বলিয়াছি, কিন্তু কর্তাভজা মন্ত্রগ্রহণের কথা শুনিলে পাছে উনি ঘৃণা করেন ভাবিয়া ঐ বিষয় তাহার নিকটে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম—কেমন করিয়া উনি তাহা টের পাইলেন?” মাতাঠাকুরাণী তাহার ঐকথা শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ওগো, উনি সকল কথা জানিতে পারেন, অথচ মনমুখ এক করিয়া সদুদ্দেশ্যে যে যাহা করিয়াছে, তাহার নিমিত্ত তাহাকে কখন ঘৃণা করেন না; তোমার ভয় নাই; আমিও ইহার (ঠাকুরের) নিকটে আসিবার পূর্বে ঐ মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছিলাম, এখানে আসিয়া ঐকথা উহাকে বলায় উনি বলিয়াছিলেন, ‘মন্ত্র লইয়াছ তাহাতে ক্ষতি নাই, উহা এখন ইষ্টপাদপদ্মে সমর্পণ করিয়া দাও’।”

ব্যাধির বৃদ্ধিতে ঠাকুরের গলার ক্ষত হইতে রুধির নির্গত হওয়া ও ভক্তগণের তাঁহাকে কলিকাতায় আনয়নের পরামর্শ

শ্রাবণ যাইয়া ক্ৰমে ভাদ্রেরও কিছুদিন গত হইল, কিন্তু ঠাকুরের গলার বেদনা ক্রমে বৃদ্ধি ভিন্ন হ্রাস দেখা গেল না। ভক্তগণ ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছিলেন না, এমন সময়ে সহসা একদিন এক ঘটনার উদয় হইয়া তাহাদিগকে কলকাতায় কর্তব্যের পথ স্পষ্ট দেখাইয়া দিল। বাগবাজার বাসিনী জনৈকা রমণী সেদিন তাহার বাটীতে ভক্তগণকে সান্ধ্যভোজে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। ঠাকুরকে আনিবার তাঁহার বিশেষ আকিঞ্চন ছিল, কিন্তু তাহার শরীর অসুস্থ জানিয়া সেই আশা একপ্রকার ত্যাগ করিয়াছিলেন।

তথাপি যদি তিনি কোনরূপে কিছুক্ষণের জন্য একবার বেড়াইয়া যাইতে পারেন ভাবিয়া জনৈক ভক্তকে অনুরোধ করিয়া দক্ষিণেশ্বরে প্রেরণ করিয়াছিলেন। রাত্রি নয়টা হইলেও ঐ ব্যক্তি ফিরিয়া না আসায় আর বিলম্ব না করিয়া তিনি সমবেত ব্যক্তিদিগকে ভোজনে বসাইতেছেন, এমন সময়ে সেসংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিল– ঠাকুরের কণ্ঠতালুদেশ হইতে আজ রুধির নির্গত হইয়াছে, সেইজন্য আসিতে পারিলেন না। নরেন্দ্রনাথ, রাম, গিরিশ, দেবেন্দ্র, মাষ্টার (মহেন্দ্র) প্রভৃতি উপস্থিত সকলে বিশেষ চিন্তিত হইলেন এবং পরামর্শে স্থির হইল কলিকাতায় একখানি বাটী ভাড়া লইয়া অচিরে ঠাকুরকে আনয়নপূর্বক চিকিৎসা করাইতে হইবে। ভোজনকালে নরেন্দ্রনাথকে বিষণ্ন দেখিয়া জনৈক যুবক কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন, “যাহাকে লইয়া এত আনন্দ তিনি বুঝি এইবার সরিয়া যান—আমি ডাক্তারি গ্রন্থ পড়িয়া এবং ডাক্তার বন্ধুগণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছি, ঐরূপ কণ্ঠরোগ ক্রমে ‘ক্যান্সারে’ (Cancer) পরিণত হয়; অদ্য রক্তপড়ার কথা শুনিয়া রোগ উহাই বলিয়া সন্দেহ হইতেছে; ঐ রোগের ঔষধ এখনও আবিষ্কার হয় নাই।”

ঠাকুরের চিকিৎসার্থ কলিকাতায় আগমন ও বলরামের ভবনে অবস্থান

       পরদিবস ভক্তদিগের মধ্যে প্রবীণ কয়েকজন দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া ঠাকুরকে কলিকাতায় থাকিয়া চিকিৎসা করাইবার জন্য অনুরোধ করিলে তিনি সম্মত হইলেন। বাগবাজারে দুর্গা চরণ মুখাজি স্ট্রীটের ক্ষুদ্র একখানি বাটীর ছাদ হইতে গঙ্গাদর্শন হয় দেখিয়া ভক্তগণ উহা ভাড়া লইয়া অনতিকাল পরে তাহাকে কলিকাতায় লইয়া আসিলেন। কিন্তু ভাগীরথীতীরে কালীবাটীর প্রশস্ত উদ্যানের মুক্ত বায়ুতে থাকিতে অভ্যস্ত ঠাকুর ঐ স্বল্পপরিসর বাটীতে প্রবেশ করিয়াই ঐ স্থানে বাস করিতে পারিবেন না বলিয়া তৎক্ষণাৎ পদব্রজে রামকান্ত বসুর স্ট্রীটে বলরাম বসুর ভবনে চলিয়া আসিলেন। বলরাম তাঁহাকে সাদরে গ্রহণ করিলেন এবং মনোমত বাটী যতদিন না পাওয়া যায় ততদিন তাহার নিকটে থাকিতে অনুরোধ করায়, তিনি ঐস্থানে থাকিয়া যাইলেন।

প্রসিদ্ধ বৈদ্যগণকে আনয়ন করিয়া ঠাকুরের রোগ নিরূপণ ও শ্যামপুকুরের বাটী ভাড়া

বাটীর অনুসন্ধান হইতে লাগিল। বৃথা সময় নষ্ট করা বিধেয় নহে ভাবিয়া ভক্তগণ ইতিমধ্যে এক দিবস কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ বৈদ্যগণকে আনয়ন করিয়া ঠাকুরের ব্যাধিসম্বন্ধে মতামত গ্রহণ করিলেন। গঙ্গাপ্রসাদ, গোপীমোহন, দ্বারিকানাথ, নবগোপাল প্রভৃতি অনেকগুলি কবিরাজ সেদিন আহূত হইয়া ঠাকুরকে পরীক্ষা করিলেন এবং তাহার রোহিণী নামক দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধি হইয়াছে বলিয়া স্থির করিলেন। যাইবার কালে একান্তে জিজ্ঞাসিত হইয়া গঙ্গাপ্রসাদ জনৈক ভক্তকে বলিলেন, “ডাক্তারেরা যাহাকে ক্যান্সার বলে, রোহিণী তাহাই; শাস্ত্রে উহার চিকিৎসার বিধান থাকিলেও উহা অসাধ্য বলিয়া নির্ণীত হইয়াছে।” কবিরাজদিগের নিকটে বিশেষ কোন আশা না পাইয়া এবং অধিক ঔষধ ব্যবহার ঠাকুরের ধাতুতে কোনকালে সহে না জানিয়া, ভক্তগণ তাঁহার হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করানই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিলেন। সপ্তাহকালের মধ্যেই শ্যামপুকুর ষ্ট্রীটে অবস্থিত গোকুলচন্দ্র ভট্টাচার্যের বৈঠকখানাভবনটি ঠাকুরের থাকিবার জন্য ভাড়া লওয়া হইল এবং কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চিকিৎসাধীনে কিছুদিন তাহাকে রাখা সৰ্ববাদিসম্মত হইল।

ঠাকুরকে দেখিবার জন্য বলরাম ভবনে বহু ব্যক্তির জনতা

এদিকে চিকিৎসার্থ ঠাকুরের কলিকাতা আগমন শহরের সর্বত্র লোকমুখে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল এবং পরিচিত অপরিচিত বহু ব্যক্তি তাহার দর্শনমানসে যখন তখন দলে দলে উপস্থিত হইয়া বলরামের ভবনকে উৎসবস্থলের ন্যায় আনন্দময় করিয়া তুলিল। ডাক্তারের নিষেধ ও ভক্তগণের সকরুণ প্রার্থনায় সময়ে সময়ে নীরব থাকিলেও ঠাকুর যেরূপ উৎসাহে তাহাদিগের সহিত ধৰ্ম্মালাপে প্রবৃত্ত হইলেন, তাহাতে বোধ হইল তিনি যেন ঐ উদ্দেশ্যেই এখানে আগমন করিয়াছেন, যেন দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত যাওয়া যাহাদের পক্ষে সুগম নহে তাহাদিগকে ধৰ্ম্মালোকপ্রদানের জন্যই তিনি কিছুকালের জন্য তাহাদের দ্বারে উপস্থিত হইয়াছেন! প্রাতঃকাল হইতে ভোজন কাল পর্যন্ত এবং ভোজনান্তে ঘণ্টা দুই আন্দাজ বিশ্রামের পরেই রাত্রির আহার এবং শয়নকাল পর্যন্ত প্রতিদিন তিনি ঐ সপ্তাহকাল মধ্যে বহুলোকের ব্যক্তিগত জীবনের জটিল প্রশ্নসকল সমাধান করিয়া দিয়াছিলেন, নানাভাবে ঈশ্বরীয় কথার আলোচনায় বহু ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিক পথে আকৃষ্ট করিয়াছিলেন এবং ভজন সঙ্গীতাদি শ্রবণে গভীর সমাধিরাজ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বহু পিপাসুর প্রাণ শান্তি ও আনন্দের প্লাবনে পূর্ণ ও উচ্ছলিত করিয়াছিলেন। সকল দিবস সকল সময়ে উপস্থিত থাকিবার সৌভাগ্য আমাদিগের কাহারও ঘটে নাই, গৃহস্বামীকেও ঠাকুরের এবং ভক্তগণের সম্বন্ধে নানা বন্দোবস্ত করিতে অনেক সময়ে স্থানান্তরে ব্যস্ত থাকিতে হইত, সুতরাং ঐ সপ্তাহের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব বলিয়াই মনে হয়। অতএব কি ভাবে ঠাকুর, বলরামের ভবনে এই কয়দিন যাপন করিয়াছিলেন, তাহা পাঠককে বুঝাইবার জন্য নিয়ে একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ করিয়া আমরা নিরস্ত হইব।

বলরাম ভবনে একদিনের ঘটনা

আমরা তখন কলেজে পড়িতাম, সুতরাং সপ্তাহের মধ্যে দুই-একদিন মাত্র ঠাকুরকে দেখিতে আসিবার অবসর পাইতাম। একদিবস অপরাহ্নে ঐরূপে বলরামের ভবনে আসিয়া দেখি, দ্বিতলের বৃহৎ ঘরখানি লোকে পূর্ণ ও গিরিশচন্দ্র এবং কালীপদ(১) মহোৎসাহে গান ধরিয়াছেন–

         আমায় ধর নিতাই। 
         আমার প্রাণ যেন আজ করে রে কেমন।

গৃহমধ্যে কোনরূপে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘরের পশ্চিম প্রান্তে পূর্বমুখে উপবিষ্ট থাকিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছেন। তাঁহার মুখে প্রসন্নতা ও আনন্দের অপূৰ্ব হাসি, দক্ষিণ চরণ উত্থিত ও প্রসারিত এবং সম্মুখে উপবেশন করিয়া এক ব্যক্তি পরম প্রেমের সহিত ঐ চরণখানি অতি সন্তর্পণে বক্ষে ধারণ করিয়া রহিয়াছে। ঠাকুরের পদপ্রান্তে যে ঐরূপে উপবিষ্ট রহিয়াছে, তাহার চক্ষু নিমীলিত এবং মুখ ও বক্ষ নয়নধারায় সিক্ত হইতেছে। গৃহ নিস্তব্ধ এবং একটা দিব্যাবেশে জম্ জম্ করিতেছে। গান চলিতে লাগিল

আমার প্রাণ যেন আজ করে রে কেমন, 
                আমায় ধর নিতাই।
        (নিতাই) জীবকে হরিনাম বিলাতে
        উঠল যে ঢেউ প্রেমনদীতে 
        সেই তরঙ্গে এখন আমি ভাসিয়ে যাই। 
        (নিতাই) খত লিখেছি আপন হাতে 
        অষ্ট সখী সাক্ষী তাতে 
        (এখন) কি দিয়ে শুধিব আমি প্রেমের মহাজন। 
        (আমার) সঞ্চিত ধন ফুরাইল 
        তবু ঋণের শোধ না হ’ল,
        প্রেমের দায়ে এখন আমি বিকাইয়ে যাই।

গীত সাঙ্গ হইলে কতক্ষণ পরে ঠাকুর অর্ধবাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া সম্মুখস্থ ব্যক্তিকে বলিলেন, “বল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-বল শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য- বল শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য।” ঐরূপে উপর্য্যুপরি তিন বার তাহাকে ঐ নাম উচ্চারণ করাইবার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর পুনরায় প্রকৃতিস্থ হইয়া অন্যের সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিয়া পরে আমরা জানিতে পারিয়াছিলাম, ঐ ব্যক্তির নাম নৃত্যগোপাল গোস্বামী, ঢাকার কোন কলেজে তিনি অধ্যয়ন করাইয়া থাকেন, ঠাকুরের পীড়ার কথা শুনিয়া তাহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। গোস্বামী যেমন ভক্তিমান্, দেখিতেও তেমনি সুপুরুষ ছিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *