১.৩ কামারপুকুরে ধর্মের সংসার

প্রথম খণ্ড – তৃতীয় অধ্যায়: কামারপুকুরে ধর্মের সংসার

কামারপুকুরে আসিয়া ক্ষুদিরামের বানপ্রস্থের ন্যায় জীবনযাপন করিবার কারণ

প্রায় দশ বৎসরের পুত্র রামকুমার ও চারি বৎসরের কন্যা কাত্যায়নীকে সঙ্গে লইয়া সস্ত্রীক ক্ষুদিরাম যেদিন কামারপুকুরে আসিয়া পর্ণকুটিরে বাস করিলেন, তাঁহাদিগের সেদিনকার মনোভাব বলিবার নহে। ঈর্ষাদ্বেষপূর্ণ সংসার সেদিন তাঁহাদিগের নিকট অন্ধতমসাবৃত বিকট শ্মশানতুল্য; স্নেহ, ভালবাসা, দয়া, ন্যায়পরতা প্রভৃতি সদ্গুণনিচয় তথায় মধ্যে মধ্যে ক্ষীণালোক বিস্তার করিয়া হৃদয়ে সুখাশার উদয় করিলেও, পরক্ষণেই উহা কোথায় বিলীন হয় এবং যে অন্ধকার সেই অন্ধকারই সেখানে বিরাজ করিতে থাকে। পূর্বাবস্থার সহিত বর্তমান অবস্থার তুলনা করিয়া ঐরূপ নানাকথা যে তাঁহাদের মনে এখন উদিত হইয়াছিল, একথা বেশ বুঝিতে পারা যায়। কারণ দুঃখ-দুর্দিনে পড়িয়াই মানব সংসারের অসারতা ও অনিত্যতা সম্যক্ উপলব্ধি করে। অতএব শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের প্রাণে এখন যে বৈরাগ্যের উদয় হইবে, ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। আবার, পূর্বোক্ত অযাচিত ও অপ্রত্যাশিতভাবে আশ্রয়লাভের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার ধর্মপ্রাণ অন্তর যে এখন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও নির্ভরতায় পূর্ণ হইয়াছিল, একথা বলিতে হইবে না। সুতরাং ৺রঘুবীরের হস্তে পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণপূর্বক পুনরায় সংসারের উন্নতিসাধনে উদাসীন হইয়া তিনি যে এখন শ্রীভগবানের সেবাপূজাতে দিন কাটাইতে থাকিবেন, ইহাতে আশ্চর্যের কি আছে? বাস্তবিক সংসারে থাকিলেও তিনি এখন হইতে অসংসারী হইয়া প্রাচীন কালের বানপ্রস্থসকলের ন্যায় দিনযাপন করিতে লাগিলেন।

অদ্ভুত উপায়ে ক্ষুদিরামের ৺রঘুবীরশিলা-লাভ

এই সময়ের একটি ঘটনায় শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের ধর্মবিশ্বাস অধিকতর গভীর ভাব ধারণ করিয়াছিল। কার্যবশতঃ একদিন তাঁহাকে গ্রামান্তরে যাইতে হইয়াছিল। তথা হইতে ফিরিবার কালে তিনি শ্রান্ত হইয়া পথিমধ্যে বৃক্ষতলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। জনশূন্য বিস্তীর্ণ প্রান্তর তাঁহার চিন্তাভারাক্রান্ত মনে শান্তি প্রদান করিল এবং নির্মল বায়ু ধীরে প্রবাহিত হইয়া তাঁহার শরীর স্নিগ্ধ করিতে লাগিল। তাঁহার শয়নেচ্ছা বলবতী হইল এবং শয়ন করিতে না করিতে তিনি নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি স্বপ্নাবেশে দেখিতে লাগিলেন, তাঁহার অভীষ্টদেব নবদূর্বাদল-শ্যাম-তনু ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যেন দিব্য বালকবেশে তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছেন এবং স্থানবিশেষ নির্দেশ করিয়া বলিতেছেন, “আমি এখানে অনেকদিন অযত্নে অনাহারে আছি, আমাকে তোমার বাটীতে লইয়া চল, তোমার সেবাগ্রহণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইয়াছে।” ঐ কথা শুনিয়া ক্ষুদিরাম একেবারে বিহ্বল হইয়া পড়িলেন এবং তাঁহাকে বারংবার প্রণামপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “প্রভু, আমি ভক্তিহীন ও নিতান্ত দরিদ্র, আমার গৃহে আপনার যোগ্য সেবা কখনই সম্ভবে না, অধিকন্তু সেবাপরাধী হইয়া আমাকে নিরয়গামী হইতে হইবে, অতএব ঐরূপ অন্যায় অনুরোধ কেন করিতেছেন?” বালক-বেশী শ্রীরামচন্দ্র তাহাতে প্রসন্নমুখে তাঁহাকে অভয় প্রদানপূর্বক বলিলেন, “ভয় নাই, আমি তোমার ত্রুটি কখনও গ্রহণ করিব না, আমাকে লইয়া চল।” ক্ষুদিরাম শ্রীভগবানের ঐরূপ অযাচিত কৃপায় আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না, প্রাণের আবেগে ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। এমন সময়ে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল।

জাগরিত হইয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ভাবিতে লাগিলেন – এ কি অদ্ভুত স্বপ্ন! হায়, হায়, কখনও কি তাঁহার সত্য সত্য ঐরূপ সৌভাগ্যের উদয় হইবে? ঐরূপ ভাবিতে ভাবিতে সহসা তাঁহার দৃষ্টি নিকটবর্তী ধান্যক্ষেত্রে পতিত হইল এবং বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, ঐ স্থানটিই তিনি স্বপ্নে দর্শন করিয়াছিলেন। কৌতূহলপরবশ হইয়া তিনি তখন গাত্রোত্থান করিলেন এবং ঐ স্থানে পৌঁছিবামাত্র দেখিতে পাইলেন, একটি সুন্দর শালগ্রামশিলার উপরে এক ভুজঙ্গ ফণা বিস্তার করিয়া রহিয়াছে! তখন শিলা হস্তগত করিতে তাঁহার মনে প্রবল বাসনা উপস্থিত হইল এবং তিনি দ্রুতপদে ঐ স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ভুজঙ্গ অন্তর্হিত হইয়াছে এবং তাহার বিবরমুখে শালগ্রামটি পড়িয়া রহিয়াছে। স্বপ্ন অলীক নহে ভাবিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের হৃদয় তখন বিষম উৎসাহে পূর্ণ হইল এবং আপনাকে দেবাদিষ্টজ্ঞানে তিনি ভুজঙ্গদংশনের ভয় না রাখিয়া ‘জয় রঘুবীর’ বলিয়া চীৎকারপূর্বক শিলা গ্রহণ করিলেন। অনন্তর শাস্ত্রজ্ঞ ক্ষুদিরাম শিলার লক্ষণসকল নিরীক্ষণ করিয়া বুঝিলেন, বাস্তবিকই উহা ‘রঘুবীর’ নামক শিলা। তখন আনন্দে ও বিস্ময়ে অধীর হইয়া তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং যথাশাস্ত্র সংস্কার-কার্য সম্পন্ন করিয়া উহাকে নিজ গৃহদেবতারূপে প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিত্য পূজা করিতে লাগিলেন। ৺রঘুবীরকে ঐরূপ অদ্ভুত উপায়ে পাইবার পূর্বে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম নিজ অভীষ্টদেব শ্রীরামচন্দ্রের পূজা ভিন্ন, ঘট প্রতিষ্ঠাপূর্বক ৺শীতলাদেবীকে নিত্য পূজা করিতেছিলেন।

সাংসারিক কষ্টের মধ্যে ক্ষুদিরামের অবিচলতা ও ঈশ্বরনির্ভরতা। লক্ষ্মীজলায় ধান্যক্ষেত্র

একের পর এক করিয়া দুর্দিন চলিয়া যাইতে লাগিল, ক্ষুদিরামও সর্বপ্রকার দুঃখকষ্টে উদাসীন থাকিয়া একমাত্র ধর্মকে দৃঢ়ভাবে আশ্রয়পূর্বক হৃষ্টচিত্তে কাল কাটাইতে লাগিলেন। সংসারে কোন কোনদিন এককালে অন্নাভাব হইয়াছে, পতিপ্রাণা চন্দ্রাদেবী ব্যাকুলহৃদয়ে ঐ কথা স্বামীকে নিবেদন করিয়াছেন; শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম কিন্তু তাহাতেও বিচলিত না হইয়া তাঁহাকে আশ্বাস প্রদানপূর্বক বলিয়াছেন, “ভয় কি, যদি ৺রঘুবীর উপবাসী থাকেন, তাহা হইলে আমরাও তাঁহার সহিত উপবাসী থাকিব।” সরলপ্রাণা চন্দ্রাদেবী তাহাতে স্বামীর ন্যায় ৺রঘুবীরের উপর একান্ত নির্ভর করিয়া গৃহকর্মে নিরতা হইয়াছেন – আহার্যের সংস্থানও সেদিন কোনরূপে হইয়া গিয়াছে।

ঐরূপ একান্ত অন্নাভাব কিন্তু শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামকে অধিক দিন ভোগ করিতে হয় নাই। তাঁহার বন্ধু শ্রীযুক্ত সুখলাল গোস্বামী তাঁহাকে লক্ষ্মীজলা নামক স্থানে যে এক বিঘা দশ ছটাক ধান্য-জমি প্রদান করিয়াছিলেন, ৺রঘুবীরের প্রসাদে তাহাতে এখন হইতে এত ধান্য হইতে লাগিল যে, উহাতে তাঁহার ক্ষুদ্র সংসারের অভাব সংবৎসরের জন্য নিবারিত হওয়া ভিন্ন কিছু কিছু উদ্বৃত্ত হইয়া অতিথি-অভ্যাগতের সেবাও চলিয়া যাইতে লাগিল। কৃষাণদিগকে পারিশ্রমিক দিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম উক্ত জমিতে চাষ করাইতেন এবং ক্ষেত্র কর্ষিত হইয়া বপনকাল উপস্থিত হইলে ৺রঘুবীরের নাম গ্রহণপূর্বক স্বয়ং কয়েক গুচ্ছ ধান উহাতে প্রথমে রোপণ করিতেন, পরে কৃষকদিগকে ঐ কাজ নিষ্পন্ন করিতে বলিতেন।

ক্ষুদিরামের ঈশ্বরভক্তির বৃদ্ধি ও দিব্যদর্শনলাভ। প্রতিবেশিগণের তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা

দিন, মাস অতীত হইয়া ক্রমে দুই-তিন বৎসর কাটিয়া গেল এবং ৺রঘুবীরের মুখ চাহিয়া প্রায় আকাশবৃত্তি অবলম্বন করিয়া থাকিলেও শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের সংসারে মোটা অন্নবস্ত্রের অভাব হইল না। কিন্তু ঐ দুই-তিন বৎসরের কঠোর শিক্ষাপ্রভাবে তাঁহার হৃদয়ে এখন যে শান্তি, সন্তোষ ও ঈশ্বরনির্ভরতা নিরন্তর প্রবাহিত থাকিল, তাহা স্বল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে। অন্তর্মুখ অবস্থায় থাকা তাঁহার মনের স্বভাব হইয়া উঠিল এবং উহার প্রভাবে তাঁহার জীবনে নানা দিব্যদর্শন সময়ে সময়ে উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রতিদিন প্রাতে ও সায়ংকালে সন্ধ্যা করিতে বসিয়া যখন তিনি ৺গায়ত্রীদেবীর ধ্যানাবৃত্তিপূর্বক তচ্চিন্তায় মগ্ন হইতেন, তখন তাঁহার বক্ষঃস্থল রক্তবর্ণ হইয়া উঠিত এবং মুদ্রিত নয়ন অবিরল প্রেমাশ্রুবর্ষণ করিত। প্রত্যুষে যখন তিনি সাজিহস্তে ফুল তুলিতে যাইতেন, তখন দেখিতেন তাঁহার আরাধ্যা ৺শীতলাদেবী যেন অষ্টমবর্ষীয়া কন্যারূপিণী হইয়া রক্তবস্ত্র ও নানা অলঙ্কার ধারণপূর্বক হাসিতে হাসিতে তাঁহার সঙ্গে যাইতেছেন এবং পুষ্পিত বৃক্ষের শাখাসকল নত করিয়া ধরিয়া তাঁহাকে ফুল তুলিতে সহায়তা করিতেছেন! ঐ সকল দিব্যদর্শনে তাঁহার অন্তর এখন সর্বদা উল্লাসে পূর্ণ হইয়া থাকিত এবং তাঁহার অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস ও ভক্তি বদনে প্রকাশিত হইয়া তাঁহাকে এক অপূর্ব দিব্যাবেশে নিরন্তর পরিবৃত করিয়া রাখিত। তাঁহার সৌম্য শান্ত মুখদর্শনে গ্রামবাসীরা উহা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়া তাঁহাকে ক্রমে ঋষির ন্যায় ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিতে লাগিল। তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিলে তাহারা বৃথালাপ পরিত্যাগপূর্বক সসম্ভ্রমে উত্থান ও সম্ভাষণ করিত; তাঁহার স্নানকালে সেই পুষ্করিণীতে অবগাহন করিতে তাহারা সঙ্কোচ বোধ করিয়া সসম্ভ্রমে অপেক্ষা করিত; তাঁহার আশীর্বাণী নিশ্চিত ফলদান করিবে ভাবিয়া তাহারা বিপদে সম্পদে উহার প্রত্যাশী হইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইত।

শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীকে প্রতিবেশিগণ যে চক্ষে দেখিত

স্নেহ ও সরলতার মূর্তি শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীও নিজ দয়া ও ভালবাসায় তাহাদিগকে মুগ্ধ করিয়া তাহাদিগের মাতৃভক্তির যথার্থই অধিকারিণী হইলেন। কারণ সম্পদ বা আপৎকালে তাঁহার ন্যায় হৃদয়ের সহানুভূতি তাহারা আর কোথাও পাইত না। দরিদ্রেরা জানিত, শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীর নিকট তাহারা যখনই উপস্থিত হইবে, তখন সুদ্ধ যে এক মুঠা খাইতে পাইবে, তাহা নহে; কিন্তু উহার সহিত এত অকৃত্রিম যত্ন ও ভালবাসা পাইবে যে, তাহাদিগের অন্তর পরম পরিতৃপ্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিবে। ভিক্ষুক সাধুরা জানিত, এ বাটীর দ্বার তাহাদিগের নিমিত্ত সর্বদা উন্মুক্ত আছে। প্রতিবেশী বালক-বালিকারা জানিত, চন্দ্রাদেবীর নিকটে তাহারা যে-বিষয়ের জন্যই আবদার করুক না কেন, তাহা কোন না কোন উপায়ে পূর্ণ হইবেই হইবে। ঐরূপে প্রতিবেশীদিগের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের পর্ণকুটিরে যখন-তখন আসিয়া উপস্থিত হইত এবং দুঃখদারিদ্র্য বিদ্যমান থাকিলেও উহা এক অপূর্ব শান্তির আলোকে নিরন্তর উদ্ভাসিত হইয়া থাকিত।

ক্ষুদিরামের ভগিনী শ্রীমতী রামশীলার কথা

আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি, শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের রামশীলা নাম্নী এক ভগিনী এবং নিধিরাম ও কানাইরাম বা রামকানাই নামক দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। দেরেপুরের জমিদারের সহিত বিবাদ উপস্থিত হইয়া যখন তিনি সর্বস্বান্ত হইলেন তখন তাঁহার উক্ত ভগিনীর বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ বৎসর এবং ভ্রাতৃদ্বয়ের ত্রিশ ও পঁচিশ বৎসর হইবে। তাঁহারা সকলেই তখন বিবাহ করিয়া সংসারে প্রবেশ করিয়াছেন। কামারপুকুরের প্রায় ছয় ক্রোশ পশ্চিমে অবস্থিত ছিলিমপুরে ৺ভাগবত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত শ্রীমতী রামশীলার বিবাহ হইয়াছিল এবং রামচাঁদ নামক এক পুত্র ও হেমাঙ্গিনী নাম্নী এক কন্যা জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। উক্ত বিপদের সময় রামচাঁদের বয়স আন্দাজ একুশ বৎসর এবং হেমাঙ্গিনীর ষোল বৎসর ছিল। শ্রীযুক্ত রামচাঁদ তখন মেদিনীপুরে মোক্তারি করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। শ্রীমতী হেমাঙ্গিনীর দেরেপুরে মাতুলালয়েই জন্ম হইয়াছিল এবং ভ্রাতা অপেক্ষাও তিনি মাতুলদিগের অধিকতর স্নেহলাভ করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ইঁহাকে কন্যানির্বিশেষে পালন করিয়া বিবাহকাল উপস্থিত হইলে কামারপুকুরের প্রায় আড়াই ক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শিহড় গ্রামের শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে স্বয়ং সম্প্রদান করিয়াছিলেন। যৌবনে পদার্পণ করিয়া তিনি ক্রমে রাঘব, রামরতন, হৃদয়রাম ও রাজারাম নামে চারি পুত্রের জননী হইয়াছিলেন।

ক্ষুদিরামের ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা

শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের নিধিরাম নামক ভ্রাতার কোন সন্তান হইয়াছিল কি না, তাহা আমরা জানিতে পারি নাই; কিন্তু সর্বকনিষ্ঠ কানাইরামের রামতারক ওরফে হলধারী এবং কালিদাস নামে দুই পুত্র হইয়াছিল। কানাইরাম ভক্তিমান ও ভাবুক ছিলেন। এক সময়ে কোন স্থানে ইনি যাত্রা শুনিতে গিয়াছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের বনগমনের অভিনয় হইতেছিল। উহা শুনিতে শুনিতে তিনি এমন তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন যে, কৈকেয়ীর শ্রীরামচন্দ্রকে বনে পাঠাইবার মন্ত্রণাচেষ্টাদিকে সত্য জ্ঞান করিয়া ঐ ভূমিকার অভিনেতাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। সে যাহা হউক, পৈতৃক সম্পত্তি হারাইবার পরে নিধিরাম ও কানাইরাম দেরেপুর পরিত্যাগ করিয়া সম্ভবতঃ যে যে গ্রামে তাঁহাদিগের শ্বশুরালয় ছিল, সেই সেই গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন।

ক্ষুদিরামের ভাগিনেয় রামচাঁদ

শ্রীমতী রামশীলার পুত্র শ্রীযুক্ত রামচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেদিনীপুরে মোক্তারি করিবার কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। ব্যবসায়সূত্রে ইনি ক্রমে মেদিনীপুরে বাস করিয়া বেশ দুই পয়সা উপার্জন করিতে লাগিলেন। তখন মাতুলদিগের দুরবস্থার কথা স্মরণ করিয়া ইনি শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামকে মাসিক পনর টাকা এবং নিধিরাম ও কানাইরামের প্রত্যেককে মাসিক দশ টাকা করিয়া সাহায্য করিতে লাগিলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ভাগিনেয়ের কিছুকাল সংবাদ না পাইলেই চিন্তিত হইয়া মেদিনীপুরে উপস্থিত হইতেন এবং দুই-চারিদিন তাঁহার আলয়ে কাটাইয়া কামারপুকুরে প্রত্যাবর্তন করিতেন। একবার ঐরূপে মেদিনীপুর আগমনকালে তাঁহার সম্বন্ধে একটি বিশেষ ঘটনা আমরা শ্রবণ করিয়াছি। ঘটনাটি শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের আন্তরিক দেবভক্তির পরিচায়ক বলিয়া আমরা উহার এখানে উল্লেখ করিলাম।

ক্ষুদিরামের দেবভক্তির পরিচায়ক ঘটনা

কামারপুকুরের প্রায় চল্লিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে মেদিনীপুর অবস্থিত। রামচাঁদ ও তাঁহার পরিবারবর্গের কুশল-সংবাদ অনেক দিন না পাওয়ায় চিন্তিত হইয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম একদিন ঐ স্থানে যাইবার জন্য বাটী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তখন মাঘ বা ফাল্গুন মাস হইবে। বিল্ববৃক্ষের পত্রসকল এই সময় ঝরিয়া পড়ে এবং যতদিন না নবপত্রোদ্গম হয়, ততদিন লোকের ৺শিবপূজা করিবার বিশেষ কষ্ট হয়। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ঐ কষ্ট কিছুদিন পূর্ব হইতে বিশেষভাবে উপলব্ধি করিতেছিলেন।

অতি প্রত্যুষে বহির্গত হইয়া তিনি প্রায় দশ ঘটিকা পর্যন্ত অবিশ্রান্ত পথ চলিয়া একটি গ্রামে পৌঁছিলেন এবং তথাকার বিল্ববৃক্ষসকল নবীন পত্রাভরণে ভূষিত দেখিয়া তাঁহার প্রাণ উল্লসিত হইয়া উঠিল। তখন মেদিনীপুর যাইবার কথা এককালে বিস্মৃত হইয়া তিনি গ্রাম হইতে একটি নূতন ঝুড়ি ও একখানি গামছা ক্রয় করিয়া নিকটস্থ পুষ্করিণীর জলে বেশ করিয়া ধৌত করিলেন। পরে নবীন বিল্বপত্রে ঝুড়িটি পূর্ণ করিয়া ভিজা গামছাখানি উহার উপর চাপা দিয়া অপরাহ্ণ প্রায় তিন ঘটিকার সময় কামারপুকুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাটী পৌঁছিয়াই শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম স্নানসমাপনপূর্বক ঐ পত্রসকল লইয়া মহানন্দে ৺মহাদেব ও ৺শীতলামাতার বহুক্ষণ পর্যন্ত পূজা করিলেন; পরে স্বয়ং আহারে বসিলেন। শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী তখন অবসর লাভ করিয়া তাঁহাকে মেদিনীপুর না যাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন এবং আদ্যোপান্ত সকল কথা শ্রবণ করিয়া বিল্বপত্রে দেবার্চনা করিবার লোভে এতটা পথ অতিবাহন করিয়াছেন জানিয়া যারপরনাই বিস্মিতা হইলেন। পরদিন প্রত্যুষে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম পুনরায় মেদিনীপুর যাত্রা করিলেন।

রামকুমার ও কাত্যায়নীর বিবাহ

এক, দুই করিয়া ক্রমে কামারপুকুরে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের ছয় বৎসর অতিবাহিত হইল। তাঁহার পুত্র রামকুমার এখন ষোড়শ বর্ষে এবং কন্যা কাত্যায়নী একাদশ বর্ষে পদার্পণ করিল। কন্যা বিবাহযোগ্যা হইয়াছে দেখিয়া তিনি এখন পাত্রের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন এবং কামারপুকুরের উত্তরে এক ক্রোশ দূরে অবস্থিত আনুড় গ্রামের শ্রীযুক্ত কেনারাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে কন্যা সম্প্রদানপূর্বক কেনারামের ভগিনীর সহিত নিজ পুত্র রামকুমারের উদ্বাহকার্য সম্পন্ন করিলেন। রামকুমার নিকটস্থ গ্রামের চতুষ্পাঠীতে ইতিপূর্বে ব্যাকরণ ও সাহিত্যপাঠ সমাপ্ত করিয়া এখন স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছিলেন।

সুখলাল গোস্বামীর মৃত্যু ইত্যাদি

ক্রমে আরও তিন-চারি বৎসর অতিক্রান্ত হইল। ৺রঘুবীরের প্রসাদে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের সংসারে এখন পূর্বাপেক্ষা অনেক সুবন্দোবস্ত হইয়াছে এবং তিনিও নিশ্চিন্তমনে শ্রীভগবানের আরাধনায় নিযুক্ত আছেন। ঘটনার মধ্যে ঐ চারি বৎসরে শ্রীযুক্ত রামকুমার স্মৃতি-অধ্যয়ন সমাপ্ত করিয়া সংসারের আর্থিক উন্নতিকল্পে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের পরম বন্ধু সুখলাল গোস্বামী উহার কোন সময়ে দেহরক্ষা করিয়াছিলেন। হিতৈষী বন্ধু শ্রীযুক্ত সুখলালের মৃত্যুতে যে তিনি বিশেষ ব্যথিত হইয়াছিলেন, একথা বলা বাহুল্য।

ক্ষুদিরামের ৺সেতুবন্ধতীর্থদর্শন ও রামেশ্বর নামক পুত্রের জন্ম

রামকুমার মানুষ হইয়া সংসারের ভার গ্রহণ করিয়াছেন দেখিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম নিশ্চিন্ত হইয়া এখন অন্য বিষয়ে মন দিবার অবসর লাভ করিলেন। তীর্থ-দর্শনের জন্য তাঁহার অন্তর এখন ব্যাকুল হইয়া উঠিল। অনন্তর সম্ভবতঃ সন ১২৩০ সালে তিনি পদব্রজে ৺সেতুবন্ধরামেশ্বরদর্শনে গমন করিলেন এবং দাক্ষিণাত্য প্রদেশের তীর্থসকল পর্যটন করিয়া প্রায় এক বৎসর পরে বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন। ৺সেতুবন্ধ হইতে এই সময়ে তিনি একটি বাণলিঙ্গ কামারপুকুরে আনয়নপূর্বক নিত্য পূজা করিতে থাকেন। ৺রামেশ্বর নামক ঐ বাণলিঙ্গটিকে এখনও কামারপুকুরে ৺রঘুবীর-শিলার ও ৺শীতলাদেবীর ঘটের পার্শ্বে দেখিতে পাওয়া যায়। সে যাহা হউক, শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী বহুকাল পরে পুনরায় এই সময়ে গর্ভধারণ করিয়া সন ১২৩২ সালে এক পুত্র প্রসব করিয়াছিলেন। ৺রামেশ্বর তীর্থ হইতে প্রত্যাগমন করিয়া এই পুত্র লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ইহার নাম রামেশ্বর রাখিয়াছিলেন।

রামকুমারের দৈবী শক্তি

এই ঘটনার পরে প্রায় আট বৎসর কাল পর্যন্ত কামারপুকুরের এই দরিদ্র সংসারে জীবন-প্রবাহ প্রায় সমভাবেই বহিয়াছিল। শ্রীযুক্ত রামকুমার স্মৃতির বিধান দিয়া এবং শান্তি-স্বস্ত্যয়নাদি কর্ম করিয়া এখন উপার্জন করিতেছিলেন; সুতরাং সংসারে এখন আর পূর্বের ন্যায় কষ্ট ছিল না। শান্তি-স্বস্ত্যয়নাদি কর্মে রামকুমার বিশেষ পটু হইয়াছিলেন। শুনা যায়, তিনি ঐ বিষয়ে দৈবী শক্তি লাভ করিয়াছিলেন। শাস্ত্র-অধ্যয়নের ফলে তিনি ইতিপূর্বে আদ্যাশক্তির উপাসনায় বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়াছিলেন এবং উপযুক্ত গুরুর নিকট ৺দেবীমন্ত্রও গ্রহণ করিয়াছিলেন। অভীষ্টদেবীকে নিত্য পূজা করিবার কালে একদিন তাঁহার অপূর্ব দর্শনলাভ হয় এবং তিনি অনুভব করিতে থাকেন যেন ৺দেবী নিজ অঙ্গুলি দ্বারা তাঁহার জিহ্বাগ্রে জ্যোতিষশাস্ত্রে সিদ্ধিলাভের জন্য কোন মন্ত্রবর্ণ লিখিয়া দিতেছেন। তদবধি রোগী ব্যক্তিকে দেখিলেই তিনি বুঝিতে পারিতেন, সে আরোগ্যলাভ করিবে কি-না এবং ঐ ক্ষমতাপ্রভাবে তিনি এখন যে রোগীর সম্বন্ধে যাহা বলিতে লাগিলেন, তাহাই ফলিয়া যাইতে লাগিল। ঐরূপে ভবিষ্যদ্বক্তা বলিয়া তাঁহার এইকালে এতদঞ্চলে সামান্য প্রসিদ্ধিলাভ হইয়াছিল। শুনা যায়, তিনি এই সময়ে কঠিন পীড়াগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখিয়া তাহার নিমিত্ত স্বস্ত্যয়নে নিযুক্ত হইতেন এবং জোর করিয়া বলিতেন, এই স্বস্ত্যয়ন-বেদীতে যে শস্য ছড়াইতেছি, তাহাতে কলার উদ্গম হইলেই এই ব্যক্তি আরোগ্যলাভ করিবে। ফলেও বাস্তবিক তাহাই হইত। তাঁহার পূর্বোক্ত ক্ষমতার উদাহরণস্বরূপে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত শিবরাম চট্টোপাধ্যায় আমাদিগের নিকটে নিম্নলিখিত ঘটনাটি উল্লেখ করিয়াছিলেন।

ঐ শক্তির পরিচায়ক ঘটনাবিশেষ

কার্যোপলক্ষে রামকুমার কলিকাতায় আগমন করিয়া একদিন গঙ্গায় স্নান করিতেছিলেন। কোন ধনী ব্যক্তি ঐ সময়ে সপরিবারে তথায় স্নান করিতে আসিলেন এবং উক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর স্নানের জন্য শিবিকা গঙ্গাগর্ভে লইয়া যাওয়া হইলে, উহার মধ্যে বসিয়াই ঐ যুবতী স্নানসমাপন করিতে থাকিলেন। পল্লীগ্রামবাসী রামকুমার স্নানকালে স্ত্রীলোকদিগের ঐরূপে আবরুরক্ষা কখন নয়নগোচর করেন নাই। সুতরাং বিস্মিত হইয়া উহা দেখিতে দেখিতে শিবিকামধ্যে অবস্থিত যুবতীর মুখকমল ক্ষণেকের নিমিত্ত দেখিতে পাইলেন এবং পূর্বোল্লিখিত দৈবীশক্তিপ্রভাবে তাঁহার মৃত্যুর কথা জানিতে পারিয়া আক্ষেপ করিয়া বলিয়া ফেলিলেন – “আহা! আজ যাহাকে এত আদবকায়দায় স্নান করাইতেছে, কাল তাহাকে সর্বজনসমক্ষে গঙ্গায় বিসর্জন দিবে!” ধনী ব্যক্তি ঐ কথা শুনিতে পাইয়া ঐ বাক্য পরীক্ষা করিবার জন্য শ্রীযুক্ত রামকুমারকে নিজালয়ে সাগ্রহে আহ্বান করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় ছিল, ঘটনা সত্য না হইলে রামকুমারকে বিশেষরূপে অপমানিত করিবেন। যুবতী সম্পূর্ণ সুস্থ থাকায় ঐরূপ ঘটনা হইবার কোন লক্ষণও বাস্তবিক তখন দেখা যায় নাই; কিন্তু ফলে শ্রীযুক্ত রামকুমার যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই হইয়াছিল এবং ঐ ব্যক্তিও তাঁহাকে মান্যের সহিত বিদায়দান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

ঐ শক্তির পরিচায়ক রামকুমারের স্ত্রীর সম্বন্ধীয় ঘটনা

নিজ স্ত্রী-ভাগ্য দর্শন করিয়াও শ্রীযুক্ত রামকুমার এক সময়ে বিষম ফল নির্ণয় করিয়াছিলেন এবং ঘটনাও কিছুকাল পরে ঐরূপ হইয়াছিল। আমরা শুনিয়াছি, তাঁহার স্ত্রী বিশেষ সুলক্ষণসম্পন্না ছিলেন। সম্ভবতঃ সন ১২২৬ সালে শ্রীযুক্ত রামকুমার পাণিগ্রহণ করিয়া যেদিন তাঁহার সপ্তমবর্ষীয়া পত্নীকে কামারপুকুরে আনয়ন করিয়াছিলেন, সেইদিন হইতে তাঁহার ভাগ্যচক্র উন্নতির পথে আরোহণ করিয়াছিল। তাঁহার পিতার দরিদ্র সংসারেও সেইদিন হইতে ঐরূপ পরিবর্তন উপস্থিত হইয়াছিল। কারণ শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের মেদিনীপুরনিবাসী ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত রামচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাসিক সাহায্য ঐ সময় হইতে আসিতে আরম্ভ হয়। স্ত্রী বা পুরুষ কোন ব্যক্তির সংসারে প্রথম প্রবেশকালে ঐরূপ শুভফল উপস্থিত হইলে হিন্দুপরিবারে সকলে তাহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চক্ষে দেখিয়া থাকে, একথা বলিতে হইবে না। বিশেষতঃ, রামকুমারের বালিকা পত্নী তখন আবার এই দরিদ্র সংসারে একমাত্র পুত্রবধূ। সুতরাং বালিকা যে সকলের বিশেষ আদরের পাত্রী হইবে, ইহাতে আশ্চর্যের কিছুই নাই। আমরা শুনিয়াছি, ঐরূপ অতিমাত্রায় আদরযত্ন পাইয়া তাহার নানা সদ্গুণের সহিত অভিমান ও অনাশ্রবতারূপ দোষদ্বয় প্রশ্রয় পাইয়াছিল। ঐ দোষ সকলের চক্ষে পড়িলেও কেহ কিছু বলিতে বা সংশোধনের চেষ্টা করিতে সাহসী হইত না। কারণ, সকলে ভাবিত সামান্য দোষ থাকিলেও তাহার আগমনকাল হইতেই কি সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হয় নাই? সে যাহা হউক, কিছুকাল পরে শ্রীযুক্ত রামকুমার তাঁহার প্রাপ্তযৌবনা স্ত্রীকে দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “সুলক্ষণা হইলেও গর্ভধারণ করিলেই ইহার মৃত্যু হইবে!” পরে বহুকাল গত হইলেও যখন পত্নীর গর্ভ হইল না, তখন তিনি তাঁহাকে বন্ধ্যা ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সকালে তাঁহার পত্নী প্রথম ও শেষবার গর্ভবতী হইয়া সন ১২৫৫ সালে ছত্রিশ বৎসরে এক পরম রূপবান পুত্র-প্রসবান্তে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। এই পুত্রের নাম অক্ষয় রাখা হইয়াছিল। উহা অনেক পরের ঘটনা হইলেও সুবিধার জন্য পাঠককে এখানেই বলিয়া রাখিলাম।

ক্ষুদিরামের পরিবারস্থ সকলের বিশেষত্ব

শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের ধর্মের সংসারে স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই একটা বিশেষত্ব ছিল। অনুধাবন করিলে স্পষ্ট বুঝা যায়, তাঁহাদিগের প্রত্যেকের অন্তর্গত ঐ বিশেষত্ব আধ্যাত্মিক রাজ্যের সূক্ষ্ম শক্তিসকলের অধিকার হইতে সর্বথা সমুদ্ভূত হইত। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ও তাঁহার পত্নীর ভিতর ঐরূপ বিশেষত্ব অসাধারণভাবে প্রকাশিত ছিল বলিয়াই বোধ হয় উহা তাঁহাদিগের সন্তানসন্ততিসকলে অনুগত হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের সম্বন্ধে উক্ত-বিষয়ক অনেক কথা আমরা ইতিপূর্বে পাঠককে বলিয়াছি। শ্রীমতী চন্দ্রমণি সম্বন্ধে এখন ঐরূপ একটি বিষয়ের উল্লেখ অযোগ্য হইবে না। ঘটনাটিতে স্পষ্ট বুঝা যাইবে, স্বামীর ন্যায় শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীতেও দিব্যদর্শনশক্তি সময়ে সময়ে প্রকাশিত থাকিত। ঘটনাটি রামকুমারের বিবাহের কিছু পূর্বে ঘটিয়াছিল। পঞ্চদশবর্ষীয় রামকুমার তখন চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন ভিন্ন যজমানবাটীসকলে পূজা করিয়া সংসারে যথাসাধ্য সাহায্য করিত।

চন্দ্রাদেবীর দিব্যদর্শন-সম্বন্ধীয় ঘটনা

আশ্বিন মাসে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিনে রামকুমার ভূরসুবো নামক গ্রামে যজমানগৃহে উক্ত পূজা করিতে গিয়াছিল। অর্ধরাত্রি অতীত হইলেও পুত্র গৃহে ফিরিতেছে না দেখিয়া শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী বিশেষ উৎকণ্ঠিতা হইলেন এবং গৃহের বাহিরে আসিয়া পথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ ঐরূপে কাটিবার পরে তিনি দেখিতে পাইলেন, প্রান্তরপথ অতিবাহিত করিয়া ভূরসুবোর দিক হইতে কে একজন কামারপুকুরে আগমন করিতেছে। পুত্র আসিতেছে ভাবিয়া তিনি উৎসাহে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু আগন্তুক ব্যক্তি নিকটবর্তী হইলে দেখিলেন সে রামকুমার নহে, এক পরমা সুন্দরী রমণী নানালঙ্কারে ভূষিতা হইয়া একাকিনী চলিয়া আসিতেছেন। পুত্রের অমঙ্গলাশঙ্কায় শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী তখন বিশেষ আকুলিতা, সুতরাং ভদ্রবংশীয়া যুবতী রমণীকে গভীর রজনীতে ঐরূপে পথ অতিবাহন করিতে দেখিয়াও বিস্মিতা হইলেন না। সরলভাবে তাঁহার নিকটে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?” রমণী উত্তর করিলেন, “ভূরসুবো হইতে।” শ্রীমতী চন্দ্রা তখন ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার পুত্র রামকুমারের সঙ্গে কি তোমার দেখা হইয়াছিল? সে কি ফিরিতেছে?” অপরিচিতা রমণী তাঁহার পুত্রকে চিনিবেন কিরূপে, একথা তাঁহার মনে একবারও উদিত হইল না। রমণী তাঁহাকে সান্ত্বনা প্রদানপূর্বক বলিলেন, “হাঁ, তোমার পুত্র যে বাটীতে পূজা করিতে গিয়াছে, আমি সেই বাটী হইতেই এখন আসিতেছি। ভয় নাই, তোমার পুত্র এখনই ফিরিবে।” শ্রীমতী চন্দ্রা এতক্ষণে আশ্বস্তা হইয়া অন্য বিষয় ভাবিবার অবসর পাইলেন এবং রমণীর অসামান্য রূপ, বহুমূল্য পরিচ্ছদ ও নূতন ধরণের অলঙ্কারসকল দেখিয়া এবং মধুর বচন শুনিয়া বলিলেন, “মা, তোমার বয়স অল্প; এত গহনা-গাঁটি পরিয়া এত রাত্রে কোথা যাইতেছ? তোমার কানে ও কি গহনা?” রমণী ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, “উহার নাম কুণ্ডল, আমাকে এখনও অনেক দূরে যাইতে হইবে।” শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী তখন তাঁহাকে বিপন্না ভাবিয়া সস্নেহে বলিলেন, “চল না, আমাদের ঘরে আজ রাত্রের মত বিশ্রাম করিয়া কাল যেখানে যাইবার, যাইবে এখন।” রমণী বলিলেন, “না মা, আমাকে এখনি যাইতে হইবে; তোমাদের বাড়ীতে আমি অন্য সময়ে আসিব।” রমণী ঐরূপ বলিয়া তাঁহার নিকট বিদায়গ্রহণ করিলেন এবং শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীর বাটীর পার্শ্বেই লাহাবাবুদের অনেকগুলি ধান্যের মরাই ছিল, তদভিমুখে চলিয়া যাইলেন। রাস্তা না ধরিয়া লাহাবাবুদের বাটীর দিকে তাঁহাকে যাইতে দেখিয়া চন্দ্রাদেবী বিস্মিতা হইলেন এবং রমণী পথ ভুলিয়াছে ভাবিয়া ঐ স্থানে উপস্থিত হইয়া চারিদিকে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও তাঁহাকে আর দেখিতে পাইলেন না। তখন রমণীর বাক্যসকল স্মরণ করিতে করিতে সহসা তাঁহার প্রাণে উদয় হইল স্বয়ং লক্ষ্মীদেবীকে দর্শন করিলাম নাকি? অনন্তর কম্পিতহৃদয়ে স্বামীর পার্শ্বে গমনপূর্বক তাঁহাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম সমস্ত শ্রবণ করিয়া ‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীই তোমাকে কৃপা করিয়া দর্শন দিয়াছেন’ বলিয়া তাঁহাকে আশ্বস্তা করিলেন। রামকুমারও কিছুক্ষণ পরে বাটীতে ফিরিয়া জননীর নিকট ঐ কথা শুনিয়া যারপরনাই বিস্মিত হইলেন।

ক্ষুদিরামের ৺গয়াতীর্থে গমন

ক্রমে সন ১২৪১ সাল সমাগত হইল। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের জীবনে এই সময়ে একটি বিশেষ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল। তীর্থদর্শনে তাঁহার অভিলাষ পুনরায় প্রবল ভাব ধারণ করায়, পিতৃপুরুষদিগের উদ্ধারকল্পে তিনি এখন গয়া যাইতে সঙ্কল্প করিলেন। ষাট বৎসরে পদার্পণ করিলেও তিনি পদব্রজে ঐ ধামে গমন করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হইলেন না। তাঁহার ভাগিনেয়ী শ্রীমতী হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র শ্রীযুক্ত হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায় তাঁহার গয়াধাম যাওয়ার কারণ সম্বন্ধে একটি অদ্ভুত ঘটনা আমাদিগের নিকটে উল্লেখ করিয়াছিলেন।

ক্ষুদিরামের গয়া গমন সম্বন্ধে হৃদয়রাম কথিত ঘটনা

নিজ দুহিতা শ্রীমতী কাত্যায়নী দেবীর বিশেষ পীড়ার সংবাদ পাইয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম এই সময়ে একদিন আনুর গ্রামে তাঁহাকে দেখিতে উপস্থিত হইয়াছিলেন। শ্রীমতী কাত্যায়নীর বয়স তখন আন্দাজ পঁচিশ বৎসর হইবে। পীড়িতা কন্যার হাবভাব ও কথাবার্তায় তাঁহার নিশ্চয় ধারণা হইল, তাঁহার শরীরে কোন ভূতযোনির আবেশ হইয়াছে। তখন সমাহিতচিত্তে শ্রীভগবানকে স্মরণ করিয়া তিনি কন্যা-শরীরে প্রবিষ্ট জীবের উদ্দেশে বলিলেন, “তুমি দেবতা বা উপদেবতা যাহাই হও, কেন আমার কন্যাকে এরূপ কষ্ট দিতেছ? অবিলম্বে ইহার শরীর ছাড়িয়া অন্যত্র গমন কর।” তাঁহার ঐ কথা শ্রবণ করিয়া উক্ত জীব ভীত ও সঙ্কুচিত হইয়া শ্রীমতী কাত্যায়নীর শরীরাবলম্বনে উত্তর করিল, “গয়ায় পিণ্ডদানে প্রতিশ্রুত হইয়া যদি আপনি আমার বর্তমান কষ্টের অবসান করেন, তাহা হইলে আমি আপনার দুহিতার শরীর এখনি ছাড়িতে স্বীকৃত হইতেছি। আপনি যখনি ঐ উদ্দেশ্যে গৃহ হইতে বাহির হইবেন, তখন হইতে ইহার আর কোন অসুস্থতা থাকিবে না, একথা আমি আপনার নিকটে অঙ্গীকার করিতেছি।” অনন্তর শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম ঐ জীবের দুঃখে দুঃখিত হইয়া বলিলেন, “আমি যত শীঘ্র পারি ৺গয়াধামে গমনপূর্বক তোমার অভিলাষ সম্পাদন করিব এবং পিণ্ডদানের পরে তুমি যে নিশ্চয় উদ্ধার হইলে, ঐ সম্বন্ধে কোনরূপ নিদর্শন পাইলে বিশেষ সুখী হইব।” তখন প্রেত বলিল, “ঐ বিষয়ের নিশ্চিত প্রমাণস্বরূপে সম্মুখস্থ নিম্ব-বৃক্ষের বৃহত্তম ডালটি আমি ভাঙ্গিয়া যাইব, জানিবেন।” হৃদয়রাম বলিলেন, উক্ত ঘটনাই শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামকে ৺গয়াধামে যাত্রা করিতে প্রোৎসাহিত করিয়াছিল এবং উহার কিছুকাল পরে উক্ত বৃক্ষের ডালটি সহসা ভাঙ্গিয়া যাওয়ায়, সকলে ঐ প্রেতের উদ্ধার হইবার কথা নিঃসংশয়ে জানিতে পারিয়াছিল। শ্রীমতী কাত্যায়নী দেবীও তদবধি সম্পূর্ণরূপে নীরোগ হইয়াছিলেন। হৃদয়রাম-কথিত পূর্বোক্ত ঘটনাটি কতদূর সত্য বলিতে পারি না, কিন্তু শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম যে এই সময়ে ৺গয়াদর্শনে গমন করিয়াছিলেন, একথায় কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

য়াধামে ক্ষুদিরামের দেবস্বপ্ন

সন ১২৪১ সালের শীতের কোন সময়ে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম বারাণসী1 ও ৺গয়াধামদর্শন করিতে গমন করিয়াছিলেন। প্রথমোক্ত স্থানে ৺বিশ্বনাথকে দর্শন করিয়া যখন তিনি গয়াক্ষেত্রে পৌঁছিলেন, তখন চৈত্রমাস পড়িয়াছে। মধুমাসে ঐ ক্ষেত্রে পিণ্ডপ্রদানে পিতৃপুরুষসকলের অক্ষয় পরিতৃপ্তি হয় জানিয়াই বোধ হয় তিনি ঐ মাসে গয়ায় আগমন করিয়াছিলেন। প্রায় এক মাসকাল তথায় অবস্থানপূর্বক তিনি যথাবিহিত ক্ষেত্রকার্যসকলের অনুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে ৺গদাধরের শ্রীপাদপদ্মে পিণ্ডপ্রদান করিলেন। ঐরূপে যথাশাস্ত্র পিতৃকার্য সম্পন্ন করিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের বিশ্বাসী হৃদয়ে ঐ দিন যে কতদূর তৃপ্তি ও শান্তি উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা বলিবার নহে। পিতৃঋণ যথাসাধ্য পরিশোধ করিয়া তিনি যেন আজ নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন এবং শ্রীভগবান তাঁহার ন্যায় অযোগ্য ব্যক্তিকে ঐ কার্য সমাধা করিতে শক্তি প্রদান করিয়াছেন ভাবিয়া তাঁহার কৃতজ্ঞ অন্তর অভূতপূর্ব দীনতা ও প্রেমে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। দিবাভাগে তো কথাই নাই, রাত্রিকালে নিদ্রার সময়েও ঐ শান্তি ও উল্লাস তাঁহাকে ত্যাগ করে নাই। কিছুক্ষণ নিদ্রা যাইতে না যাইতে তিনি স্বপ্নে দেখিতে লাগিলেন, তিনি যেন শ্রীমন্দিরে ৺গদাধরের শ্রীপাদপদ্মসম্মুখে পুনরায় পিতৃপুরুষসকলের উদ্দেশ্যে পিণ্ডপ্রদান করিতেছেন এবং তাঁহারা যেন দিব্য জ্যোতির্ময় শরীরে উহা সানন্দে গ্রহণপূর্বক তাঁহাকে আশীর্বাদ করিতেছেন! বহুকাল পরে তাঁহাদিগের দর্শনলাভ করিয়া তিনি যেন আত্মসংবরণ করিতে পারিতেছেন না; ভক্তিগদ্গদচিত্তে রোদন করিতে করিতে তাঁহাদিগের পাদস্পর্শ করিয়া প্রণাম করিতেছেন। পরক্ষণেই আবার দেখিতে লাগিলেন, যেন অদৃষ্টপূর্ব দিব্য জ্যোতিতে মন্দির পূর্ণ হইয়াছে এবং পিতৃপুরুষগণ সসম্ভ্রমে, সংযতভাবে দুই পার্শ্বে করজোড়ে দণ্ডায়মান থাকিয়া মন্দিরমধ্যে বিচিত্র সিংহাসনে সুখাসীন এক অদ্ভুত পুরুষের উপাসনা করিতেছেন। দেখিলেন, নবদূর্বাদল-শ্যাম জ্যোতিৰ্মণ্ডিততনু ঐ পুরুষ স্নিগ্ধপ্রসন্নদৃষ্টিতে তাঁহার দিকে অবলোকনপূর্বক হাস্যমুখে তাঁহাকে নিকটে যাইবার জন্য ইঙ্গিত করিতেছেন! যন্ত্রের ন্যায় পরিচালিত হইয়া তিনি যেন তখন তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং ভক্তিবিহ্বলচিত্তে দণ্ডবৎ প্রণামপূর্বক হৃদয়ের আবেগে কতপ্রকার স্তুতি ও বন্দনা করিতে লাগিলেন। দেখিলেন, ঐ দিব্য পুরুষ যেন তাহাতে পরিতুষ্ট হইয়া বীণানিস্যন্দি মধুর স্বরে তাঁহাকে বলিতে লাগিলেন, “ক্ষুদিরাম, তোমার ভক্তিতে পরম প্রসন্ন হইয়াছি, পুত্ররূপে তোমার গৃহে অবতীর্ণ হইয়া আমি তোমার সেবা গ্রহণ করিব!” স্বপ্নেরও অতীত ঐ কথা শুনিয়া তাঁহার যেন আনন্দের অবধি রহিল না, কিন্তু পরক্ষণেই চিরদরিদ্র তিনি তাঁহাকে কি খাইতে দিবেন, কোথায় রাখিবেন ইত্যাদি ভাবিয়া গভীর বিষাদে পূর্ণ হইয়া রোদন করিতে করিতে তাঁহাকে বলিলেন, “না, না প্রভু, আমার ঐরূপ সৌভাগ্যের প্রয়োজন নাই; কৃপা করিয়া আপনি যে আমাকে দর্শনদানে কৃতার্থ করিলেন এবং ঐরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট; সত্য সত্য পুত্র হইলে দরিদ্র আমি আপনার কি সেবা করিতে পারিব!” এই অমানব পুরুষ যেন তখন তাঁহার ঐরূপ করুণ বচন শুনিয়া অধিকতর প্রসন্ন হইলেন এবং বলিলেন, “ভয় নাই, ক্ষুদিরাম, তুমি যাহা প্রদান করিবে তাহাই আমি তৃপ্তির সহিত গ্রহণ করিব; আমার অভিলাষ পূরণ করিতে আপত্তি করিও না।” শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম এই কথা শুনিয়া যেন আর কিছুই বলিতে পারিলেন না; আনন্দ, দুঃখ প্রভৃতি পরস্পরবিপরীত ভাবসমূহ তাঁহার অন্তরে যুগপৎ প্রবাহিত হইয়া তাঁহাকে এককালে স্তম্ভিত ও জ্ঞানশূন্য করিল। এমন সময়ে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল।


1. কেহ কেহ বলেন, শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম বহুপূর্বে এক সময়ে দেরেপুর হইতে তীর্থগমনপূর্বক শ্রীবৃন্দাবন, ৺অযোধ্যা, ও ৺বারাণসী দর্শন করিয়া আসিয়াছিলেন এবং উহার কিছুকাল পরে তাঁহার পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করিলে তিনি ঐ তীর্থযাত্রার কথা স্মরণ করিয়া তাঁহাদিগের রামকুমার ও কাত্যায়নী নামকরণ করিয়াছিলেন। শেষবারে তিনি কেবলমাত্র ৺গয়াধামদর্শন করিয়াই বাটী ফিরিয়াছিলেন।

কামারপুকুরে প্রত্যাগমন

নিদ্রাভঙ্গ হইলে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম কোথায় রহিয়াছেন, তাহা অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুঝিতে পারিলেন না। পূর্বোক্ত স্বপ্নের বাস্তবতা তাঁহাকে এককালে অভিভূত করিয়া রাখিল। পরে ধীরে ধীরে তাঁহার যখন স্থূল জগতের জ্ঞান উপস্থিত হইল, তখন শয্যাত্যাগ করিয়া তিনি ঐ অদ্ভুত স্বপ্ন স্মরণ করিয়া নানা কথা ভাবিতে লাগিলেন। পরিণামে তাঁহার বিশ্বাসপ্রবণ হৃদয় স্থিরনিশ্চয় করিল, দেবস্বপ্ন কখনও বৃথা হয় না – নিশ্চয় কোন মহাপুরুষ তাঁহার গৃহে শীঘ্রই জন্মপরিগ্রহ করিবেন – বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয় তাঁহাকে পুনরায় পুত্রমুখ অবলোকন করিতে হইবে। অনন্তর ঐ অদ্ভুত স্বপ্নের সাফল্য পরীক্ষা না করিয়া কাহারও নিকট তদ্বিবরণ প্রকাশ করিবেন না, এইরূপ সঙ্কল্প তিনি মনে মনে স্থির করিলেন এবং কয়েক দিন পরে ৺গয়াধাম হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া সন ১২৪২ সালের বৈশাখে কামারপুকুরে উপস্থিত হইলেন।


Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *