1 of 2

১৮. শিবস্তব

অষ্টাদশ অধ্যায় – শিবস্তব

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–তখন, বৃষধ্বজ, দক্ষ-নন্দিনীর গুণাবলী গণনা করত, দুঃখাৰ্ত্ত হইয়া সামান্য মনুষ্যের ন্যায় বিলাপ করিতে লাগিলেন। ১

মহাদেব, বিলাপ করিতেছেন জানিয়া, কাম, রতি বসন্ত-সমভিব্যাহারে তাহার সমীপবর্তী হইলেন। ২

মহাদেব শোকাকুল হইলেও দুষ্ট রতিপতি, ভ্রষ্টচিত্ত রোরুদ্যমান সেই দেব দেবকে একেবারে পঞ্চশর প্রহার করিলেন। ৩

শিব, শোকোপহত-চিত্ত হইলেও কাম-বাণে আকূল হইয়া মিশ্র ভাব প্রাপ্তি বশতঃ শোক করিতেও লাগিলেন, মুগ্ধ হইতেও লাগিলেন। ৪

প্রভু শিব, তখন কখন ভূতলে পতিত হইতে লাগিলেন, কখন উঠিয়া দৌড়িতে থাকিলেন, কখন সেইখানেই ঘুরিতে লাগিলেন, কখন বা দাক্ষায়ণী দেবীকে স্মরণ করত নয়ন মুদ্রিত করিয়া রহিলেন, কখন বা তিনি ভূতলবিলুষ্ঠিত মৃত সতীকে রসভাবাবেশে অবস্থিত ভাবিয়া হাসিতে হাসিতে আলিঙ্গন করিতে লাগিলেন। ৫-৬

শঙ্কর, বারংবার “সতী সতী” নাম উচ্চারণপূর্বক “বৃথা মান ত্যাগ কর” বলিয়া গা ঠেলিতে লাগিলেন। ৭

সতীর গাত্র হস্তদ্বারা পরিষ্কার করিয়া শরীরের যথাস্থানে অবস্থিত অলঙ্কার গুলিকে উন্মোচনপূর্বক পুনরায় সেই সেই স্থানে পরাইয়া দিলেন। ৮

ভূতনাথ, এইরূপ করিতে থাকিলেও মৃত সতী যখন কিছুই বলিলেন না, তখন মহাদেব, শোকাবেগে অত্যন্ত রোদন করিতে লাগিলেন। ৯

রোদনপরায়ণ মহাদেবের নয়নজল পতিত হইতেছে দেখিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ অত্যন্ত চিন্তাকুল হইলেন।১০

শিবের নয়নজল যদি ভূতলে পতিত হয়, তাহা হইলে এই ভূমণ্ডল দগ্ধ করিয়া ফেলিবে; এখন এ বিষয়ে কি উপায় করা যায়, এইরূপ চিন্তাবিষ্ট দেবগণ হাহাকার করিতে লাগিলেন। ১১

অনন্তর, ব্ৰহ্মাদি দেবগণ বিবেচনা করিয়া মূঢ়ভাব প্রাপ্ত মহাদেবের নয়নজল নিবারণের জন্য শনিকে স্তব করিতে লাগিলেন। ১২

দেবতারা বলিলেন,–হে ত্রিলোকানুগ্রহ-কারক মহাভাগ শনৈশ্চর। হে মূলশক্তি-সম্ভূত সূৰ্য-পুত্র। তোমাকে নমস্কার। ১৩

শূল, পাশ, শরাসন এবং বর–তোমার হস্তে বিরাজমান; তুমি ছায়া-গর্ভ সম্ভূত; তোমাকে নমস্কার। ১৪

হে নীল-জলদশ্যামল! হে দলিতঞ্জন-পুঞ্জ-সন্নিভ! তুমি সকল প্রাণীরই প্রাণ ধরণের হেতু; তোমাকে নমস্কার ১৫

হে গৃধ্রধ্বজ! তোমাকে নমস্কার; ভগবন! সুপ্রসন্ন হও; শিবের শোক সম্ভূত নয়নজল হইতে পৃথিবীকে রক্ষা কর। ১৬।

যেমন তুমি পূর্বে একশতবর্ষ-মেঘের জল গ্রহণ করিয়া অনাবৃষ্টি করিয়া ছিলে, সেইরূপ শিবের নয়নজলও গ্রহণ কর। ১৭

তুমি জল গ্রহণ করিতেছ দেখিয়া, পুষ্করাদি মেঘদল, ইন্দ্রের অনুমতিক্রমে সতত বৃষ্টি করিয়াছিল। ১৮

সেই সমস্ত বৃষ্টিজল তুমি আকাশেই বিনষ্ট করিয়াছিলে; সেইরূপ এখন শূলপাণির বাপ নাশ কর। ১৯

তুমি ভিন্ন শিবের নয়নজল নিবারণ করিতে পারে এমন কেহ নাই। ২০

সে অশ্রু পতিত হইলে দেবলোক, গন্ধৰ্ব্বলোক, ব্ৰহ্মলোক এবং পৰ্বত সহ পৃথিরী দগ্ধ করিবে; অতএব তুমি নিজ মায়াবলে ধারণ কর। ২১

মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–দেবগণ এইরূপ বলিতে থাকিলে, শনৈশ্চর, অনতি হৃষ্ট চিত্তে তাহাদিগকে বলিতে লাগিলেন। ২২

শনৈশ্চর বলিলেন,–হে সুরসত্তমগণ! আমি যথাশক্তি তোমাদিগের কাৰ্য্য করিব; কিন্তু মহাদেব, যাহাতে আমাকে জানিতে না পারেন, তাহা তোমাদিগকে করিতে হইবে। ২৩

আমি সমীপে থাকিয়া দুঃখশোকাকুল এই মহাদেবের নয়নজল ধারণ করিলে, তাহার কোপে নিশ্চয়ই আমার শরীর বিনষ্ট হইবে; এবিষয়ে সন্দেহ নাই। ২৪

আমি সমীপে থাকিয়া ভূতনাথের নয়নজল গ্রহণ করিব, কিন্তু তিনি যাহাতে আমাকে জানিতে না পারেন–তোমরা তাহা কর। ২৫

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর ব্রহ্মাদি দেবগণ সকলে, শঙ্করসমীপে গমন করিয়া যোগমায়াবলে তাহাকে সম্মোহিত করিলেন। ২৬

তখন, শনিও ভূতনাথের সমীপবর্তী হইয়া তাহার দুরাধর্ষ অশ্রুবৃষ্টি মায়াবলে গ্রহণ করিলেন। ২৭

যখন সূর্যপুত্র শনি তদীয় অশ্রু ধারণ করিতে সমর্থ হইলেন না, তখন তিনি জলধার নামক মহাগিরিতে তাহা নিক্ষেপ করিলেন। ২৮

জলধারগিরি, লোকালোক পৰ্বতের নিকটে, পুষ্কর দ্বীপের পশ্চাদ্ভাগে এবং জলসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত। ২৯

সেই গিরি সর্বতোভাবে সুমেরু-পৰ্বত-সদৃশ। শনৈশ্চর, শিবের বাষ্পবৃষ্টি ধারণে অসমর্থ হইয়া সেই পৰ্ব্বতে তাহা স্থাপন করেন। ৩০

গিরিবরও ঈশ্বরের সেই অশ্রু-জলরাশি ধারণে অসমর্থ হইলেন এবং তাহার তেজে গিরির মধ্যভাগ অবিলম্বে বিদীর্ণ হইল। ৩১

অনন্তর, সেই নয়নাম্বু, গিরিভেদ করিয়া জলসমুদ্রে প্রবিষ্ট হইল। সমুদ্রও সেই প্রখর জলরাশি ধারণে অসমর্থ হইলেন। অনন্তর তাহা সাগর-মধ্য ভেদ করিয়া সাগরের পূর্বকূলে সমাগত হইল। ৩২-৩৩

স্পর্শমাত্রে তাহা ভেদ করিয়া ফেলিল। সেই পুরদ্বীপ-মধ্য-গত অশ্রুজল বৈতরণী নদী হইয়া পূৰ্বসাগর-মুখে গমন করিল। ৩৪

সেই নয়নজল, জলধার গিরি ভেদ এবং সাগরসংসর্গ-বশতঃ কিঞ্চিৎ সৌম্যতা প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া পৃথিবী ভেদ করিতে পারে নাই। ৩৫

শিবের নয়ন-জল-সম্ভূতা সেই নদীর বিস্তার দুই যোজন, তাহা যম-পুর দ্বারে বর্তমান রহিয়াছে। অনন্তর শোক-বিমূঢ়-চিত্ত বৃষধ্বজ, সতীর শবদেহ স্কন্ধে করিয়া বিলাপ করত পূৰ্বাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ৩৬-৩৭

গমন-পরায়ণ মহাদেবের উন্মত্তের ন্যায় ভাব দেখিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ, সতীর শবদেহ বিচ্যুত করিবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। ৩৮

শিব-গাত্র-স্পর্শবশতঃ এই শবশরীর পচিয়া গলিয়াও পড়িবে না। তবে ইহা বিচ্যুত হইবে কিরূপে? ৩৯

ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু এবং শনি, ইহা চিন্তা করত, যোগমায়াবলে অদৃশ্য হইয়া সতীর শবদেহের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইলেন। ৪০

সেই দেবগণ, সতীর শব-শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া তাহা খণ্ড খণ্ড করত পুণ্যতীর্থ করিবার উদ্দেশে ভূতলের স্থানে স্থানে ফেলিয়া দিলেন। ৪১

প্রথমে পৃথিবীতে দেবীকূটনামক স্থানে সতীর পদযুগল নিপতিত হইল। জগন্মণ্ডলের হিতের জন্য উড্ডীয়ান-নামক স্থানে তাহার ঊরুযুগল পতিত হইল। ৪২।

কামপৰ্ব্বতের কামরূপে তাঁহার যোনিমণ্ডল পড়িল। সেই স্থানে পূর্ব ভাগে নাভিমণ্ডল পড়িল। সুবর্ণ-হার শোভিত স্তনযুগল জলন্ধরে পড়িল। স্কন্ধ ও গ্রীবা পূর্ণগিরিতে, আর মস্তক কামরূপের শেষভাগে পড়িল। ৪৩-৪৪

মহাদেব, সতীর শবদেহ লইয়া যতদূর গমন করিয়াছিলেন, পূৰ্বদেশের মধ্যে ততদূর পর্যন্তই যাজ্ঞিক দেশ বলিয়া কথিত। ৪৫

সতী-শরীরের অন্য অবয়বসকল দেবগণকর্তৃক তিল তিল খণ্ডিত হইয়া পবনবেগে আকাশগঙ্গাতে গমন করিল। ৪৬

হে দ্বিজগণ! তখন যেখানে যেখানে সতীর পদাদি অঙ্গ পতিত হইল, তথায় তথায় মহাদেব, সতী-স্নেহ-বশে বিমূঢ় হইয়া স্বয়ং লিঙ্গরূপে অবস্থিত হইলেন। ৪৭

ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শনি এবং অন্যান্য সকল দেবগণই প্রীতি সহকারে সতীর পাদাদি অঙ্গ পূজা করিলেন। ৪৮

দেবীকূটে সতীর পদযুগে অধিষ্ঠিত জগদম্বা মহাদেবী যোগনিদ্রা “মহাভাগা” নামে অভিহিত। উড্ডীয়ানে কাত্যায়নী, কামরূপে কামাখ্যা, পূর্ণগিরিতে পূর্ণেশ্বরী এবং জালন্ধরে “চণ্ডী” বলিয়া কথিত। ৪৯-১০

কামরূপের পূর্বভাগে অবয়বাধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম “দিক্কর-বাসিনী” আর শেষভাগে অঙ্গাধিষ্ঠাত্রী যোগনিদ্রার নাম “ললিতকান্তা”। ৫১

যেখানে সতীর মস্তক নিপতিত হয়, তথায় বৃষধ্বজ, তদীয় মস্তক দর্শনে অত্যন্ত শোকে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করত উপবিষ্ট হইলেন। ৫২

শিব তথায় উপবিষ্ট হইলে, ব্রহ্মাদি দেবগণ দূর হইতেই তাহাকে সান্তনা করত তদীয় নিকটে উপস্থিত হইলেন। ৫৩।

শিব দেবগণকে আসিতে দেখিয়া শোকে ও লজ্জাতে তথায় প্রস্তর হইয়া লিঙ্গমূর্তি হইলেন। ৫৪

মহেশ্বর, লিঙ্গরূপী হইলে, ব্ৰহ্মাদি দেবগণ, তথায় লিঙ্গরূপী জগৎ-প্রভু ত্রিলোচনকে স্তব করিতে লাগিলেন। ৫৫

দেবতারা বলিতে লাগিলেন,–তুমি মহাদেব, শিব, রুদ্র, উগ্র, স্থাণু, বৃষধ্বজ; তুমি শ্মশানবাসী, সৃষ্টিসংহারকারী পরাৎপর শঙ্কর। ৫৬

নীললোহিত ভর্গ; তুমি দেব! ভূত-ভাবন, অব্যয়, বরদ, গিরিশ; আমরা ভক্তিভাবে তোমাকে নমস্কার করি। ৫৭

যাহার মূল-প্রকৃতিসহ সংসার অনাদি; সেই যোগবেদ্য লিঙ্গরূপী ব্রহ্ম শান্তিময় শম্ভু শিবকে নমস্কার। ৫৮

তুমি জটাজুটধারী বিদ্যা-শক্তি সম্পন্ন গিরিশ; তুমি লিঙ্গরূপী ব্ৰহ্ম শান্তিময় শিব তোমাকে নমস্কার। ৫৯

তোমার অন্তরে জ্ঞানামৃত, তাহাতে তোমার দেহ এবং মন সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ; তুমি লিঙ্গরূপী ব্ৰহ্ম শান্তিময় শিব; তোমাকে নমস্কার। ৬০

জগতের আদি-মধ্য-অন্তস্বরূপ স্বভাবতঃ অনল-সদৃশ লিঙ্গরূপী ব্ৰহ্ম শান্তি ময় শিবকে নমস্কার। ৬১

“প্রলয়-পয়োধি-জলে” অবস্থিত, স্থিতিসংহারকারণ লিঙ্গরূপী ব্ৰহ্ম শান্তিময় শিবকে নমস্কার। ৬২

পরাৎপর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, লিঙ্গ রূপা ব্ৰহ্ম শান্তিময় পরমাত্মা শিবকে নমস্কার। ৬৩।

জ্বালাজাল-সংবৃতাঙ্গ, জ্বলন্ত অনলস্বরূপ লিঙ্গরূপী ব্ৰহ্ম শান্তিময় শিবকে নমস্কার। ৬৪

জ্ঞানদীপ বিধাতা প্রণব-বাচ্য পরম পদার্থকে নমস্কার। লিঙ্গরূপী ব্রহ্ম শান্তিময় শিবকে নমস্কার। ৬৫

দাক্ষায়ণীপতে। মৃড়! হে শৰ্ব্ব! হে মহেশ্বর! তোমাকে নমস্কার; হে ভগবন্! সৰ্ব্বভূতেশ! শিব! প্রসন্ন হও। ৬৬

হে লোকনাথ মহেশ্বর! তুমি শোকাকুল হইয়া বেড়াইলে, সকল দেবগণই ব্যাকুল হন, অতএব শোক পরিত্যাগ কর। ৬৭

হে ভূতনাথ! হে সৰ্ব্বকারণ-কারণ! তোমাকে নমস্কার; প্রসন্ন হও; আমাদিগের সকলকে রক্ষা কর; শোক ত্যাগ কর, তোমাকে নমস্কার। ৬৮

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–দেবগণ, জগৎপতি মহাদেবকে এইরূপ স্তব করিলে, সেই শোকাকুল দেব, নিজরূপ ধারণপূর্বক প্রাদুর্ভূত হইলেন। ৬৯

প্রাদুর্ভূত মহাদেবকে শোকে বিহ্বল এবং চৈতন্য-হীন দেখিয়া বিধি, সান্ত্বনা পূর্বক শোকনাশন বাক্য দ্বারা বৃষধ্বজের স্তব করিতে লাগিলেন। ৭০

হে হিরণ্যবাহো! তুমি ব্ৰহ্মা, তুমিই জগৎপতি বিষ্ণু। হে হর! একমাত্র তুমিই সৃষ্টিস্থিতি-সংহারের কারণ। ৭১

তুমিই অষ্টমূৰ্ত্তি দ্বারা চরাচর সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত করিয়া অবস্থিত। হে বিশ্বকৃৎ। তুমিই উৎপাদক, স্থাপক এবং নাশক। ৭২

হে মহাদেব! তোমাকে আরাধনা করিয়া রাগদ্বেষাদিবর্জিত সংসারবিমুখ তত্ত্বজ্ঞানী মুমুক্ষুগণ মুক্তি লাভ করে। ৭৩

হে মহেশ্বর! বায়ু, অগ্নি, জল এই সকল বস্তুদ্বারা বর্ধিত চন্দ্র-সূৰ্য-সমন্বিত নাড়ীত্রয়-মধ্যস্থিত পরমতত্ত্ব তোমারই বশবর্তী। ৭৪

জ্ঞান-সলিল-প্রবৃদ্ধ অষ্ট-শাখ প্রকৃতিতরুর সমীপসেব্য তপস্যাপত্র-পুঞ্জ সমাচ্ছাদিত সু-সূক্ষ্ম কোমল পুষ্প,–সতত তোমারই আয়ত্ত। ৭৫

মূলাধার চক্র হইতে আজ্ঞাচক্ৰ পৰ্যন্ত সমস্ত বায়ু অনাহত চক্রে রোধ করিয়া হৃৎপদ্মমধ্যে যে রজোস্তমোগুণাতীত প্রসন্ন তেজ অবলোকন কর, হে শিব! তুমিই তৎস্বরূপ। ৭৬

পরক-কুম্ভক-রেচক এই প্রাণায়াম-বলে সমস্ত ইন্দ্রিয় নিরোধপূর্বক যোগিগণ যে প্রপঞ্চাতীত পরম শুদ্ধ সমুজ্জ্বল তেজ অবলোকন করেন, তাহা তোমা হইতেই আগত। ৭৭

হে মহেশ! তত্ত্বজ্ঞানিগণের অন্বেষণীয় সাধ্যসাধন-রূপী গুণ-গণ-বর্জিত ইন্দ্রিয়রূপ চোরদিগের অনপহাৰ্য্য–অমূল্য ধন তোমারই আছে। ৭৮

সে ধন,–ক্রোধ, শোক, মান বা দম্ভবলে উপভোগ্য নহে; কিন্তু ক্রোধাদি ত্যাগ করিলেই তাহার বৃদ্ধি হয়। হে শঙ্কর! তুমি মায়া দ্বারা মোহিত হইয়াছ। তুমি হৃদয়-স্থিত পরম বস্তু বিস্মৃত হইয়াছ। ৭৯-৮১

এখন মায়াকে পৃথক ভাবিয়া আত্ম-সাহায্যেই আপনাকে ধৈৰ্যান্বিত কর। ৮২

হে মহেশ্বর। পূর্বে আমরাই জগতের জন্য মায়াকে স্তব করি, তিনিই তোমার ধ্যান-গত চিত্তকে বহু যত্নে নিজায়ত্ত করেন। ৮৩

শোক, ক্রোধ, মোহ, কাম, মন, পরাধীনতা, ঈর্ষা, মান, সন্দেহ, দয়া, অসূয়া এবং নিন্দা এই দ্বাদশপ্রকার চিত্ত-মল–ইহারা বুদ্ধিনাশের হেতু। ৮৪

এই সকল চিত্ত-মল-সেবন ভবাদৃশ লোকের অকৰ্তব্য; অতএব হে হর! শোক পরিত্যাগ কর। ৮৫

মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–শম্ভু, এইরূপ সান্ত্বভাবে স্তুত হইয়া আপনার কর্তব্য স্মরণ করিয়াও সতী বিরহে শোকে আপনার ধৈৰ্য্যসম্পাদন করিতে পারিলেন না। শিব অধোমুখে থাকিয়া ব্রহ্মার দিকে দৃষ্টিপাতপূর্বক ধীরে ধীরে বলিলেন, ব্ৰহ্মন। অতঃপর কি করিব বল। ৮৬-৮৭

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মহাদেব, ব্রহ্মাকে এই কথা বলিলে তিনি সকল দেবগণ সমভিব্যাহারে মহাদেবের শোক-নাশন বাক্য বলিতে লাগিলেন; মহাদেব! আপনি আপনাকে মনে করিয়া শোক পরিত্যাগ কর। ৮৮

তুমি শোকের পাত্র নহ; তোমার চিত্তে কিছুমাত্র শোক থাকিতে পারে না। ৮৯

দেবদেব! তুমি শোকান্বিত হইলে, দেবগণও ভীত হন। তোমার ক্রোধ, জগৎকে বিধ্বস্ত করিতে পারে এবং শোক সকলকেই শোকান্বিত করে। ৯০

শনি, যদি তোমার অশ্রুধারা গ্রহণ না করিতেন, তাহা হইলে পৃথিবী তোমার অশ্রুজলে আকুল হইয়া বিদীর্ণ হইত। তাহা গ্রহণ করাতে শনিও কৃষ্ণবর্ণ হইয়া পড়িয়াছেন। ৯১

মহাদেব। যেখানে দেবতা ও গন্ধৰ্ব্বগণ ঔৎসুক্য সহকারে সর্বদা ক্রীড়া করেন, যে পৰ্বত শ্রেষ্ঠ, পরিমাণে সুমেরুসদৃশ। ৯২

পুষ্করাবৰ্ত্তক প্রভৃতি মেঘগণ, যাহার পদ্ম নাল সদৃশ বিবরে প্রবিষ্ট হইয়া জলপান করে। ৯৩

মহামুনি অগস্ত্য জগতের হিতার্থ মন্দরগিরি হইতে সদা সৰ্ব্বদা যেখানে গিয়া তপস্যা করেন। ৯৪

প্রবাদ আছে–পূৰ্বে অগস্ত্য, যে পৰ্বতে থাকিয়া তপোবলে জল-সমুদ্রকে করতলে স্থাপনপূর্বক পান করিয়াছিলেন; শনৈশ্চর, তোমার অশ্রু জল বহনে অসমর্থ হইয়া সেই জলধারনামক পৰ্বতে নিক্ষেপ করেন, তাহাতে সেই পৰ্ব্বত বিদীর্ণ হইয়াছে। ৯৫-৯৬

শম্ভো! সেই নয়নজল, পৰ্বত ভেদ করিয়া সাগরে পতিত হয়; তৎক্ষণাৎ সাগর-গর্ভস্থ মীনাদি মরিয়া যাইল। তাহা আবার মৃত মীনাদি সঙ্কুল সেই সাগর ভেদ করিয়া সত্বর পূর্বতীরে আসিল। ৯৭-৯৮

সেই অশ্রুজলতেজে সমুদ্র বেলাও বিদীর্ণ হইল। তোমার অশ্রুজল, বেলা ভেদ করিয়া পৃথিবীর কিয়দংশ ভেদ করিয়া পূৰ্বসাগর-গামিনী বৈতরণী নদী রূপে পরিণত হইয়াছে। ৯৯

নৌকাদ্ৰোণী, রথ বা বিমান–কোন যান দ্বারাই সেই প্রতপ্ত-জলপূর্ণা অতি-ভীষণা নদী পার হওয়া যায় না। ১০০

পৃথিবী এখন মহাকষ্টে তাহাকে ধারণ করিতেছেন। সেই নদী উর্ধ্বগামী বাষ্প দ্বারা আকাশচারী প্রাণীদিগকে সর্বদাই অপসৃত করিতেছে। মহেশ্বর। ভয়ে সেই নদীর উপর দিয়া কোন দেবতাও গমনাগমন করিতে পারে না। ১০১-১০২

সেই নদী দুই যোজন বিস্তৃত, গভীর এবং জলপূর্ণ। উহা ত্রিভুবন, ভীত করত যমদ্বার বেষ্টন করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। ১০৩

তোমার নিশ্বাস-পবনজালে পৰ্বত, কানন, দ্বীপ এবং বৃক্ষসকল বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে, অধ্যাপি পূর্ববৎ অবস্থিত হয় নাই। ১০৪

বাধাহীন সনাতন ভবদীয় নিশ্বাস বায়ু, একেবারে সমস্ত জগৎ পীড়িত করিতেছে, আজও প্রশান্ত হইতেছে না। ১০৫

তুমি সতীর মৃতদেহ বহন করত ভ্রমণ করিতেছিলে, পৃথিবী তখন তোমার প্রতি-পদক্ষেপে বিশীর্ণ ও ব্যাকুল হয়, আজও সে-ব্যাকুলতা ত্যাগ করিতে পারিতেছে না। ১০৬

হে বৃষধ্বজ! তোমার ক্রোধ ও শোকে ব্যাকুল হয় নাই–এখন স্বর্গ মর্ত্য পাতালে এমন প্রাণী নাই। ১০৭

অতএব তুমি শোক ও ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া আমাদিগকে শান্তি প্রদান কর। আপনা হইতেই আপনাকে বুঝিয়া লও, আত্মসাহায্যেই আপনি ধৈৰ্য্য সম্পন্ন হও। ১০৮

আর দিব্য শতবর্ষ অতীত হইলে সেই সতীও ত্রেতাযুগের প্রথমে তোমার ভাৰ্য্যা হইবেন। ১৫৯

মার্কণ্ডেয় বলিলেন, চিন্তাপরায়ণ মৌনভাবে অধোমুখে উপবিষ্ট শিবকে ব্ৰহ্মা এই কথা বলিলে, তিনি অমিত-তেজা ব্রহ্মাকে বলিলেন,–ব্রহ্ম। আমি যত দিন সতীশোক-সাগর উত্তীর্ণ না হই, ততদিন আমার সহচর হইয়া শোকাপনোদন কর। ১১০-১১

বিধাতঃ! এই সময়ে আমি যেখানে যেখানে গমন করিব, তুমিও তথায় তথায় যাইয়া আমার শোক নাশ করিতে থাক। ১১২

মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–লোকনাথ ব্রহ্মা, মহাদেবকে “তথাস্তু” বলিয়া তাহার সহিত কৈলাস পর্বতে গমন করিতে ইচ্ছা করিলেন। ১১৩

ব্রহ্মার সহিত মহেশ্বরকে কৈলাস গমনে উদ্যোগী দেখিয়া নন্দিভৃঙ্গি প্রমুখ সমস্তগণ তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। ১১৪

অনন্তর, শারদ জলবৎ শুক্লবর্ণ পৰ্বতোপম বৃষ, গৈরিকসন্নিভ ব্রহ্মার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। ১১৫

বাসুকি প্রভৃতি অষ্টনাগ, সত্বর নানাস্থানে উঠিয়া শীঘ্র হরের মস্তক বাহু প্রভৃতি ভূষিত করিল। ১১৬

অনন্তর, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং সতীপতি মহাদেব নিখিল দেবগণ সমভিব্যাহারে হিমালয় পর্বতে গমন করিলেন। ১১৭

অনন্তর পর্বতরাজ হিমালয়, সচিবগণ সমভিব্যাহারে নিজ নগর ওষধি-প্রস্থ হইতে নির্গত হইয়া সেই সকল সুরশ্রেষ্ঠকে যথাবিধি অভ্যর্থনা করিলেন। ১১৮

অমাত্যগণ ও পৌরবর্গ সমভিব্যাহারে গিরিরাজ, পূজা করিলে সেই সুরবর সকল সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। ১১৯

অনন্তর, মহেশ্বর–সেই গিরিরাজনগর ওষধিপ্রন্থে সখীগণ-পরিবৃতা গৌতমতনয়া বিজয়াকে দেখিতে পাইলেন। ১২০

তখন বিজয়াও মহেশ্বরপ্রমুখ সমস্ত সুরশ্রেষ্ঠদিগকে প্রণাম করিয়া শিবের নিকটে মাতৃষ্বসা সতীর কথা জিজ্ঞাসা করত রোদন করিতে লাগিলেন। বলিতে লাগিলেন; মহাদেব! তোমার সতী কোথায়? তিনি বিনা তোমার শোভা হইতেছে না। পিতঃ! তুমি তাহাকে ভুলিয়া গেলেও আমার হৃদয় হইতে আর তিনি অপসৃত হইতেছেন না। ১২১-১২২

যখন, সতী, রোষ ভরে আমার সম্মুখে প্রাণত্যাগ করেন, আমি তখন হইতেই শোকশল্যে বিদ্ধ হইয়া আছি, কোনমতেই সুখলাভ করিতে পারিতেছি না। ১২৩

এই বলিয়া বিজয়া বসনাঞ্চলে বদন ঢাকিয়া অত্যন্ত রোদন করত ভূমিতে পতিত এবং মুর্চ্ছিত হইলেন। ১২৪

অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত। ১৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *