1 of 2

০২. ওহী প্ৰাপ্তিকালে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স এবং ওহী নাযিলের তারিখ

ওহী প্ৰাপ্তিকালে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স এবং ওহী নাযিলের তারিখ

ইমাম আহমদ আমির শা’বীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন চল্লিশ বছর বয়সে। তার নিকট নবুওয়াত আনয়ন তথা ওহী আনয়নে তিন বছর যাবত ফেরেশতা ইসরাফীল (আঃ) সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বিভিন্ন বাণী ও বস্তু সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। তখন কুরআন নাযিল হয়নি। তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত জিবরাঈল (আঃ) ওহী নাযিলের সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে ২০ বছরে পূর্ণ কুরআন মজীদ নাযিল হয়। ১০ বছর মক্কায় এবং দশ বছর মদীনায়।। ৬৩ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ইনতিকাল হয়। শা’বী পর্যন্ত এটি একটি বিশুদ্ধ সনদ। এত দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চল্লিশ বছর বয়সের পর পরবতী ৩ বছর ইসরাফীল (আ) তাঁর সাথে ছিলেন। এরপরই জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট এসেছেন।

শায়খ শিহাবুদ্দীন আবু শামা বলেছেন, হযরত আইশা (রা)-এর হাদীছ এই বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, এমনও হতে পারে যে, প্রথমাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা) স্বপ্ন দেখতেন। তারপর হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার মেয়াদে ইসরাফীল (আঃ) তাঁর নিকট আসতেন। তিনি দ্রুত বাক্য বলে দিয়ে চলে যেতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট অবস্থান করতেন না। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রশিক্ষণ ও ক্রমান্বয়ে তাকে পরবতী পরিস্থিতির জন্যে উপযোগী করে তোলার উদ্দেশ্যে এরপর জিবরাঈল (আ) তিনি এমনটি করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে তিনবার চেপে ধরার পর যা শেখানোর তা শেখালেন। হাদীছ সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও জিবরাঈল (আ.)-এর মাঝে যা অনুষ্ঠিত হয়েছে। হযরত আইশা (রা) তা বর্ণনা করেছেন। ইসরাফীল (আ.)-এর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেননি। অথবা এমনও হতে পারে যে, হযরত ইসরাফীল (আ.)-এর সম্পৃক্ততার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না।

ইমাম আহমদ (র) বলেন, ইয়াহইয়া ইবন আব্বাস (রা) সূত্র বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ওহী নাযিল হয় তাঁর তেতাল্লিশ বছর বয়সে। এরপর তিনি মক্কায় অবস্থান করেন। দশ বছর আর মদীনায় অবস্থান করেন। দশ বছর। তেষট্টি বছর বয়সে তার ইনতিকাল

হয়। ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ এবং সাঈদ ইবন মুসায়্যাব থেকেও অনুরূপ বৰ্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমদ (র) ভিন্ন সনদে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন এবং তার প্রতি কুরআন নাযিল হল তার চল্লিশ বছর বয়সে। এরপর তিনি মক্কায় অবস্থান করেন তের বছর আর মদীনায় দশ বছর। তেষট্টি বছর বয়সে তার ইনতিকাল হয়। ইমাম আহমদ (র) ভিন্ন সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় পনের বছর এ ভাবে অবস্থান করেছেন যে, প্রতিবছর তিনি একটি জ্যোতি দেখতেন ও অদৃশ্য শব্দ শুনতেন আর আট বছর তার প্রতি ওহী নাযিল হতো। তিনি মদীনায় অবস্থান করেছেন। দশ বছর।

আবু শামা (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর নবুওয়াত লাভের পূর্বে আশ্চর্য ও বিস্ময়কর বিষয়াদি দেখতেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত অনুরূপ একটি ঘটনা নিম্নরূপ জাবির ইবন সামুরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন–

মক্কায় অবস্থিত একটি পাথরকে আমি চিনি। আমার নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেও সেটি আমাকে সালাম দিত। ওই পাথরটি আমি এখনও চিনতে পারবো।

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) নির্জনতা পসন্দ করতেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের সাহচর্য থেকে দূরে থাকতে চাইতেন। এজন্যে যে, তিনি দেখতেন, তারা মূর্তিপূজা এবং প্রতিমাকে সিজদা করা ইত্যাদি স্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে। তার প্রতি আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নাযিলের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, ততই নির্জনতা ও একাকীত্বের আগ্রহ তার মধ্যে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক জনৈক আলিমের বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রত্যেক বছরই এক মাস করে হেরা গুহায় কাটাতেন এবং সেখানে ইবাদত করতেন। জাহিলী যুগে কুরায়শের যে কেউ ওই বিশেষ ইবাদত করতো, সে তার কাছে আগত সকল মিসকীনকে খাদ্য দান করত। অবশেষে তার ওই বিশেষ ইবাদত সমাপ্ত হলে বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ না করে সে ঘরে ফিরত না। ওয়াহাব ইবন কায়সান আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কুরায়শ বংশের উপাসনাকারী লোকদের এ নিয়ম ছিল যে, উপাসনার জন্যে তারা হেরা পর্বতে গিয়ে অবস্থান করত। এ জন্যে আবু তালিব তাঁর বিখ্যাত কাসীদায় বলেছেন :

শপথ ছাওর পর্বতের আর যিনি ছাবীর পর্বতকে যথাস্থানে স্থাপন করেছিল তারা। শপথ হেরা পর্বতে আরোহণকারীর এবং সেখান থেকে অবতরণকারীর।

উক্ত পংক্তিটির এটিই বিশুদ্ধ পাঠ। সুহায়লী আবু শামা ও শায়খ হাফিয আবুল হাজ্জাজ মিযয়ী (র) প্রমুখও তাই বলেছেন। কোন কোন বর্ণনাকারী ভুল করে এরূপ বলেছেন —

এটি বিশুদ্ধতার পরিপন্থী ও ত্রুটিপূর্ণ। আল্লাহই ভাল জানেন।

হেরা (০°1>) শব্দটি দীর্ঘ স্বরে এবং হ্রাস স্বরে উভয় প্রকারে পাঠ করা যায়।

হেরা একটি পর্বতের নাম। এটি মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে উচ্চভূমিতে অবস্থিত। মিনার

পথে যাত্রীর এটি বামদিকে থাকে। তার একটি সুউচ্চ শৃঙ্গ কা’বা গৃহের দিকে ঝুকে রয়েছে।

ওই অংশেই গুহাটি অবস্থিত। এ প্রসংগে রুবা ইবন আজাজ কী চমৎকারই না বলেছেন :

فلاً ورب الأمنات القطن – ورب ركن من حراء منحتى নিরাপদ ও নিরুদ্বিগ্ন কবুতরগুলোর প্রতিপালকের শপথ এবং হেরা পর্বতের মস্তকাবনত বঁকে থাকা অংশের প্রতিপালকের শপথ।

হাদীছে উল্লিখিত ৩১%, এ শব্দটিকে “……. তথা ইবাদতে লিপ্ত থাকা বলে ব্যাখ্যা করাটা হল অর্থগত ব্যাখ্যা। বস্তৃত ১…. … শব্দের ধাতুগত অর্থ হল পাপের মধ্যে প্রবেশ করা। এটি বলেছেন ভাষাবিদ সুহায়লী। তবে আরবী ভাষায় আমি গুটি কতক শব্দ দেখেছি যেগুলোর অর্থ হল তার ধাতুগত অর্থ থেকে বেরিয়ে আসা। যেমন এ., অর্থ পাপ থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। م>)}& Tg|5 SId}ه آ۹)।| 5 آیه اع تقر 3 تن جنسی ، تهجید، تأثم ، تحرج، تحوب NN বেরিয়ে আসা বুঝানো হয়েছে।

আবু শামা এসব নজীর উল্লেখ করেছেন। হাদীসে বর্ণিত ও…. … এর ব্যাখ্যায় ৫,৭৭ বলা সম্পর্কে ইবন আরাবী (র)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন : মূলত ওই শব্দটি ‘…. … বলে আমি মনে করি না। বরং শব্দটি ৩-৪%,। হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর দীন-ই-হানীফ তথা সঠিক ধর্মমতের সাথে শব্দটি সম্পর্কিত। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা) হেরা গুহায় হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর দীন-ই-হানীফ অনুযায়ী ইবাদত করবেন। ইবন হিশাম বলেন,

……. … শব্দটি মূলত ঐ দুর্গ, % ছিল। আরবগণ ফা (আঃ) বর্ণকে ছা (এম.) বর্ণে পরিবর্তিত করে থাকে। যেমন করে এ. কে বলে–যেমন রূবা বলেন :

لوکان آحجاری مع الا جداف — হায় পাথরগুলো যদি কবরগুলোর সাথে থাকত। এখানে — ১২। দ্বারা ৩১,1, 1 বুঝানো হয়েছে।

আবু উবায়দা বলেন, আরবগণ :–এর স্থলে ঐ বলে থাকে। আমি বলি, ওই সূত্রেই কোন কোন তাফসীরকার বলেন যে,–64, অর্থ–(অর্থ রসুন)।

নবুওয়াত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কোন নির্দিষ্ট শরীআতের অনুসরণে ইবাদত করতেন কিনা সে সম্পর্কে আলিমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কোন শরীআত অনুসরণ করলে তা কোনটি?

কেউ বলেছেন, তিনি নূহ (আ.)-এর শরীআতের অনুসরণ করতেন। কেউ বলেছেন, ইবরাহীম (আ:)-এর শরীআত মেনে চলতেন। এটি অবশ্য অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ও বলিষ্ঠ

অভিমত। কেউ মূসা (আ:)-এর, আবার কেউ ঈসা (আ:)-এর শরীআত তিনি অনুসরণ করতেন বলে মত প্ৰকাশ করেছেন। আবার কেউ বলেছেন, তার বিবেক-বিবেচনায় যে কাজ তার নিকট শরীআতসম্মত প্রমাণিত হয়েছে তিনি তাই পালন করতেন। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্যে উসূলে ফিকহ বিষয়ক গ্রন্থাদি দেখা যেতে পারে।

তিনি তখন হেরা গুহায় ছিলেন। অর্থাৎ পূর্ব অবগতি ব্যতিরেকে হঠাৎ ও আকস্মিক সত্য তাঁর নিকট এসেছে। যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেন :

و ما كنت ترجوا أن يلقى اليك الكتاب الأرخمة من ربك আপনি আশা করেননি যে, আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এটি তো একমাত্র আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহ (২৮ : ৮৬)।

কিতাব নাযিলের সূচনা হয়েছিল সূরা আলাকের প্রথম দিকের আয়াতগুলো নাযিলের মাধ্যমে। সেগুলো হল :

— পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহা মহিমান্বিত। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না (৯৬ : ১-৫)। এটুকুই হল কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত অংশ। তাফসীর গ্রন্থে আমরা তা প্রমাণ করেছি। “সোমবার” বিষয়ক আলোচনায়ও তা আলোচিত হবে। এ বিষয়ে সহীহ মুসলিমে উল্লিখিত

আছে যে, আবু কাতাদা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, উত্তরে তিনি বলেন :

— সেটি এমন একটি দিন যে, ওই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং ওই দিনটিতে আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়েছে।

হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন, “তোমাদের নবী মুহাম্মদ (সা) জন্মগ্রহণ করেছেন সোমবারে এবং তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছেন সোমবারে। উবায়দ ইবন উমায়র, আবু জাফর— বাকির এবং আরও বহু আলিম এরূপ বলেছেন যে, সোমবারেই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই।

ওহী নাযিলের মাস সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন যে, রবীউল আউয়াল মাসে প্রথম ওহী

নাযিল হয়েছে যেমন ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবন আব্বাস ও জাবির (রা) থেকে বৰ্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) জন্মগ্রহণ করেছেন রবীউল আউয়ালের ১২ তারিখ সোমবারে। ওই

তারিখেই তিনি নবুওয়াত লাভ করেছেন এবং ওই তারিখেই তিনি মি’রাজে গিয়েছেন। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি সর্বপ্রথম ওহী নাযিল করা হয়। উবায়দ ইবন উমােয়র মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ও অন্যান্য অনেকেই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দলীল পেশ করেছিল। ইবন ইসহাক (র) এ বিষয়ে দলীল পেশ করেছেন আল্লাহ তা’আলার এই বাণী দিয়ে —

— রামাযান মাসই সেই মাস যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের

তবে কেউ কেউ বলেছেন, রামাযানের প্রথম দশ দিনের মধ্যে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়েছে। ওয়াকিদী আবু জাফর বাকির থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ওহী নাযিলের সূচনা হয় রামাযানের সতের তারিখ সোমবারে। কেউ কেউ বলেছেন, রমযানের চব্বিশ তারিখে। ইমাম আহমদ (র) বলেন, আবু সাঈদ-ওয়াছিলা ইবন আসকা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, ইবরাহীম (আ:)-এর সহীফাগুলো নাযিল হয়েছে রমযানের পহেলা তারিখে। তাওরাত নাযিল হয়েছে রামাযানের ছয় তারিখে। ইনজীল নাযিল হয়েছে রামাযানের তের তারিখে এবং কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযানের ২৪ তারিখে। ইবন মারদাওয়াহ তার তাফসীর গ্রন্থে জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) থেকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উক্তি রূপে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ জন্যে একদল সাহাবী ও তাবিঈ এ অভিমত পেশ করেছেন যে, লায়লাতুল কদর হল রমযানের ২৪তম রাত্রি।

জিবরাঈল (আ) প্রিয়নবী (সা)-কে বললেন, “পাঠ করুন”। তিনি বললেন, আমি পাঠ করতে পারি না। তাঁর বক্তব্য মূলত: নেতিবাচক। অর্থাৎ আমি ভাল করে পাঠ করতে পারি না। ইমাম নববী (র) এবং তাঁর পূর্বে শায়খ আবু শামা এই ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যারা বলে, উক্ত বক্তব্য প্রশ্নবোধক অর্থাৎ আমি কী পড়বো? তাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ইতিবাচক বক্তব্যে অতিরিক্ত “বা (-)” ব্যবহৃত হয় না। আবু নুআয়মের উদ্ধৃত মু’তামির ইবন সুলায়মানের হাদীছটি প্রথমোক্ত অভিমতকে সমর্থন করে। মু’তামির ইবন সুলায়মান তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, “ভয়ে ও শংকায় কম্পমান হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমি তো কখনও কোন কিতাব পাঠ করিনি এবং আমি ভালভাবে পাঠ করতে জানি না। আমি লিখিও না। আমি পড়িও না। এরপর জিবরাঈল (আঃ) তাকে ধরলেন এবং সজোরে তাকে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, “পাঠ করুন”। উত্তরে মুহাম্মাদ (সা) বললেন, আমি তো এমন কিছু দেখছি না। যা পাঠ করব। আমি তো পড়ি না, আর আমি লিখিও না।,

বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় আছে, তিনি আমাকে সজোরে চেপে ধরলেন, আবার কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি আমার গলা চেপে ধরলেন–

আবু সুলায়মান খাত্তাবী বলেন, তিনি এরূপ করেছেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্যে তার আচার আচরণ পরিশীলিত করে দেয়ার জন্যে যাতে নবুওয়াতের কঠিন দায়িত্ব

পালনে তিনি উপযোগী হয়ে উঠেন। এজন্যে মাঝে মাঝে তিনি প্ৰচণ্ড তাপে উত্তপ্ত ব্যক্তির ন্যায় হয়ে উঠতেন এবং ঘর্মাসিক্ত হয়ে উঠতেন। অন্য এক ভাষ্যকার বলেছেন, একাধিক কারণে জিবরাঈল (আ) এরূপ করেছেন। তার একটি এই যে, দৈহিকভাবে প্ৰচণ্ড কষ্ট ভোগের পর তার প্রতি যা নাযিল করা হবে তার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে তিনি যেন সচেতন হয়ে উঠেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :

— আমি আপনার প্রতি অবিলম্বে অবতীর্ণ করব গুরুভার বাণী (৭৩ : ৫)। এ জন্যেই যখন ওহী আসতো, তখন তার মুখমণ্ডল লাল হয়ে যেত, উট শাবকের ন্যায় তিনি হাঁপাতেন এবং প্ৰচণ্ড শীতের দিনেও তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতো।

—নাযিলকৃত আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) খাদীজার নিকট আসলেন। তখন তাঁর হৃদয় दीoछिल।

কোন কোন বর্ণনায় ১৬৫৯-এর স্থলে ১১৩১-এ শব্দ এসেছে। ১৩১-এ শব্দটি ১০৩U.–এর বহুবচন। আবু উবায়দা বলেন, ১,১), হল কাঁধ ও ঘাড়ের মধ্যবতী গোশতের টুকরা। অন্যরা বলেন, ১১, হচ্ছে সেই শিরাগুলি যেগুলো ভীতিবিহবলতার সময় দপ দপ করতে থাকে।

এর অর্থ হল ঘাড় ও কষ্ঠার মধ্যবর্তী অংশ। কেউ কেউ বলেন, স্তনমূল। আর কেউ বলেন, স্তনদ্বয়ের গোশত। এ ছাড়াও এর আরো বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন এ1,,,,,, —তোমরা আমাকে কম্বলে ঢেকে দাও, কম্বলে ঢেকে দাও। ভয় কেটে যাওয়ার পর তিনি খাদীজা (রা)-কে বলেছিলেন “আমার কী হল? আমি কিসের সম্মুখীন হলাম? ইতোপূর্বেকার সকল ঘটনা তিনি খাদীজা (রা)-কে খুলে বললেন। তিনি এও বললেন যে, আমি আমার জীবনহানির আশংকা করেছিলাম। তা এ জন্যে যে, তিনি এমন একটি ঘটনার মুখোমুখি হলেন ইতোপূর্বে কখনাে যা ঘটেনি এবং যা তিনি কখনো ধারণাও করেননি। এ জন্যে হযরত খাদীজা (রা) তাকে বলেছিলেন, আপনি সুসংবাদ নিন, কখনো আল্লাহ। আপনাকে অপমানিত করবেন না। আবার কেউ বলেছেন যে, তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ। আপনাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবেন না। হযরত খাদীজা (রা) তাকে এ নিশ্চিত আশ্বাসবাণী দিতে পেরেছিলেন এ জন্যে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চরিত্রে যে অনিন্দ্যসুন্দর ও অনুপম গুণাবলী আল্লাহ্ তা’আলা দিয়েছিলেন, তা হযরত খাদীজা (রা) জানতেন এবং তিনি জানতেন যে, এমন সদগুণাবলীসম্পন্ন লোককে আল্লাহ্ তা’আলা দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত করেন না, আখিরাতেও নয়। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কতিপয় সুমহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, নিঃসন্দেহে আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখেন। সদা সত্য কথা বলেন। বস্তৃত সত্যবাদিতায় দোস্ত-দুশমন সকলের নিকট রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সুখ্যাতি ছিল।

হযরত খাদীজা (রা) আরো বলেন, “আপনি অন্যের বোঝা বহন করেন। অর্থাৎ পরিবারের ভরণ-পোষণে হিমশিম খাওয়া লোককে এমন দান-খয়রাত করেন, যা দ্বারা পরিবারের ভরণপোষণের কষ্ট থেকে সে মুক্তি পায়। আপনি নিঃস্ব লোকদেরও উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ সৎকর্মে আপনি এগিয়ে যান এবং নিঃস্ব অভাবগ্ৰস্তাদেরকে দান করার বেলায়ও আপনি অগ্রণী থাকেন।

হাদীছে আছে, তারপর হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে তাঁর (রা) চাচাত ভাই ওয়ারোকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন অতি বৃদ্ধ। তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছিল। ইতোপূর্বে যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়লের আলোচনার সাথে তাঁর সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং মক্কা ছেড়ে সিরিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। ওয়ারাকা। ইবন নাওফিল, যােয়দ ইবন আমর, উছমান ইবন হুওয়ায়রিছ এবং উবায়দুল্লাহ ইবন জাহাশ। তাঁরা সবাই তখন খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, তখনকার পরিস্থিতিতে অন্যান্য ধর্মের তুলনায় খৃস্টধর্মকেই তারা সত্যের অধিকতর কাছাকাছি বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়াল তাদের সাথে যোগ দেননি। কারণ, তিনি খৃস্টধর্মে বানােয়াট তথ্যের অনুপ্রবেশ, সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ, সত্য-বিকৃতি, অসত্য সংযোজন ও ভুল ব্যাখ্যা প্রভৃতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর স্বচ্ছ বিবেক ওই ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।

অন্যদিকে পাদ্রী ও ধর্মযাজকগণ সত্য নবীর আবির্ভাব ও তাঁর আগমন আসন্ন বলে তাকে অবহিত করেছিলেন। ফলে, ওই সত্য নবীর অন্বেষণে তিনি ফিরে আসেন এবং তার স্বচ্ছ বিবেক ও একত্ববাদে অবিচল থাকেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেই মৃত্যু তাকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেয়।

ওয়ারোকা ইবন নাওফিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নবুওয়াত প্ৰাপ্তির যুগ পেয়েছিলেন। সঠিক নবীর নিদর্শনসমূহ তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যেমন ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করে এসেছি। তাতে ওয়ারাকা বুঝে নিয়েছিলেন যে, ইনি সঠিক ও সত্য নবী। এ জন্যে ওহী সম্পর্কে সংঘটিত ঘটনার বিবরণ শুনে ওয়ারোকা বললেন,’:’,”.’-‘, ‘. —পবিত্র, পবিত্ৰ! ইনি তো সেই মাহাত্ম্যপূর্ণ সংবাদবাহক, যিনি মূসা (আ:)-এর নিকট এসেছিলেন। ঈসা। (আ) মূসা (আ:)-এর পরে আসা সত্ত্বেও ওয়ারোকা তার উল্লেখ করেননি এজন্যে যে, হযরত ঈসা। (আ:)-এর শরীআত ছিল মূসা (আ:)-এর শরীআতের সম্পূরক। আলিমগণের বিশুদ্ধ অভিমত এই যে, তাঁর শরীআত হযরত মূসা (আ:)-এর শরীআতের কতক বিধি-বিধান রহিত করেছে। যেমন হযরত ঈসা (আ:)-এর বক্তব্য কুরআন শরীকে উদ্ধৃত হয়েছে।

— এবং আমি এসেছি তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতক বৈধ করে দেয়ার জন্যে

ওয়ারাকা। ইবন নাওফিলের উপরোক্ত মন্তব্য নাখলা প্ৰান্তরে উপস্থিত জিনদের বক্তব্যের অনুরূপ। তারা বলেছিল?

— হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসা (আ:)-এর পরে। এটি পূর্ববতী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে (৪৬ : ৩০) {

এরপর ওয়ারোকা বললেন, Z’: 7, 8 351 364.1, অর্থাৎ হায়! আমি যদি তখন যুবক হতাম, ঈমান দ্বারা কল্যাণকর জ্ঞান দ্বারা এবং সৎকর্ম দ্বারা শক্তিমান হতাম! হায়! আমি যদি তখন জীবিত থাকতাম যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে। অর্থাৎ তাহলে আমি আপনার সাথে বেরিয়ে যেতাম এবং আপনাকে সাহায্য করতাম।

তখনই রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওরা কি সত্যিই আমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে? ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, প্রিয়নবী বিস্মিত হয়ে এ প্রশ্ন করেছিলেন এ জন্যে যে, জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও কষ্টকর। উত্তরে ওয়ারাকা বলেছিলেন হ্যা, তাই। আপনি যা নিয়ে এসেছেন ইতোপূর্বে অনুরূপ আহবান নিয়ে যিনিই এসেছেন তার প্রতিই শক্ৰতা পোষণ করা হয়েছে। আপনার ওই সময়ে যদি আমি জীবিত থাকতাম, তবে প্ৰচণ্ড ও কার্যকরভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতাম।

অর্থাৎ এ ঘটনার অল্প কয়েক দিন পরেই ওয়ারাক ইবন নাওফিলের মৃত্যু হয়। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত বৰ্ষিত হোক। কারণ, ওয়ারাকার মুখ থেকে যা

কিছু বের হয়েছে তা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আনীত বিষয়ের সত্যায়ন এবং তাঁর আনীত ওহীর প্রতি ঈমান আনয়ন। এটি ভবিষ্যতের জন্য তাঁর একটি উপযুক্ত নিয়্যতের বহিঃপ্রকাশ।

ইমাম আহমদ—আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত খাদীজা (রা) একদা ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আমি তো তাকে স্বপ্নে দেখেছি। আমি তাঁর পরিধানে সাদা পোশাক দেখেছি। আমি মনে করি যে, তিনি যদি জাহান্নামের অধিবাসী হতেন, তবে তার পরিধানে সাদা পোশাক থাকত না। এ হাদীসের সনদ উত্তম। তবে আল্লামা যুহরী এবং হিশাম হাদীছটি উরওয়া থেকে মুরসালরূপে অৰ্থাৎ সাহাবীর উক্তিরূপে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।

হাফিয আবু ইয়ালা জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে ওয়ারাকা। ইবন নাওফিল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন, আমি তাকে দেখেছি। আমি তাঁর পরিধানে সাধা কাপড় দেখেছি। আমি তাকে দেখেছি জান্নাতে। তাঁর পরিধানে সূক্ষ্ম রেশমী পোশাক। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে যায়দ ইবন আমর ইবন নুফায়াল সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা

একাকী পুনরুখিত হবেন। তাঁকে আবু তালিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি

তলদেশ থেকে টেনে এনে অপেক্ষাকৃত অগভীর স্থানে রেখেছি। তাঁকে হযরত খাদীজা (রা) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। কারণ, ইসলামের ফরয বিষয়াদি এবং কুরআনের বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হওয়ার পূর্বে তিনি ইনতিকাল করেছিলেন : উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)

—জান্নাতের মধ্যে একটি ঝর্ণার পাশে জান্নাতী মুক্তায় নির্মিত গৃহের মধ্যে আমি তাকে দেখেছি। সেখানে না আছে কোন শোরগোল আর না আছে কোন দুঃখ-কষ্ট! এ হাদীছের সনদ উত্তম। সহীহ হাদীছ গ্রন্থসমূহে এটির সমর্থনে অন্যান্য বর্ণনা রয়েছে

হাফিযী আবু বকর বাযযার হযরত আইশা (রা)-এর বরাতে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ১ —তোমরা ওয়ারাকার দুর্নাম…..করো না। কারণ, আমি দেখেছি তাঁর জন্যে একটি কিংবা দু’টি জান্নতি রয়েছে! ইবন আসাকির আইশা (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এটি একটি উত্তম সনদ। হাদীছটি মুরসাল রূপে ও বর্ণিত হয়েছে এবং তা মুরসাল হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

হাফিস বায়হাকী আবু নুআয়ম তাদের নিজ নিজ দালাইলুন নবুওয়াত গ্রন্থে ইউনুস ইবন বুকােয়র সূত্রে আমর ইবন শুরাহবীল (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত খাদীজা (রা)-কে বলেছিলেন, আমি যখন একাকী থাকি, তখন আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। আল্লাহর কসম! আমি আশঙ্কা করছি যে, এর মাধ্যমে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। খাদীজা (রা) বললেন, আল্লাহ হিফাযত করুন, মহান আল্লাহ। আপনার সাথে তেমন আচরণ করবেন না। আল্লাহর কসম, আপনি তো আমানত পরিশোধ করেন, আত্মীয়তা রক্ষা করেন, সত্য কথা বলেন। এরপর আবু বকর (রা) সেখানে আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

হযরত খাদীজা (রাঃ) আবু বকরকে এ সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, হে আতীক!* আপনি একটু মুহাম্মদ (সা)-কে নিয়ে ওয়ারাকা। এর নিকট যান। রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত হওয়ার পর হযরত আবু বকর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হাত ধরে বললেন, চলুন আমরা ওয়ারাকা-এর নিকট যাই। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাকে আবার এসব জানালো কে? তিনি উত্তর দিলেন, খাদীজা (রা)। তারপর তাঁরা দু’জনে ওয়ারাকা–এর নিকট গেলেন এবং পূর্বোল্লিখিত ঘটনা তাকে জানাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি যখন একাকী ও নির্জনে থাকি তখন আমার পেছন থেকে আমাকে ডাকার শব্দ শুনি যেন কে বলছে, হে মুহাম্মাদ, হে মুহাম্মাদ! এ ডাক শুনে আমি ভয়ে ওখান থেকে চলে যাই। ওয়ারাকা বললেন, আপনি আর আমন করবেন। না। ওই আগন্তুক আপনার নিকট আসলে আপনি স্থির থাকবেন এবং সে কী বলে, তা শুনবেন। এরপর আমার নিকট এসে তা আমাকে জানাবেন।

১. হযরত আবু বকর (রা)-কে এ নামে ডাকা হতো।–সম্পাদকদ্বয়

এরপর একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা) একাকী ছিলেন। তখন ওই আগন্তুক তাকে ডেকে বললেন, হে মুহাম্মাদ (সা) বলুন,

দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই প্রাপ্য। যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। কর্মফল দিবসের মালিক। আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি। শুধু আপনারই সাহায্য কামনা করি। আমাদেরকে সরল পথ দেখান। তাদের পথ— যাদেরকে আপনি অনুগ্রহ দান করেছেন। যারা ক্ৰোধে নিপতিত নয়, পথভ্রষ্টও নয়। আরও বলুন 21।| 8।| 41।|১। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই।

এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওয়ারাকা-এর নিকট আসলেন এবং ওই ঘটনা তাকে জানালেন। ওয়ারোকা তাকে বললেন, আপনি সুসংবাদ আর সুসংবাদ গ্ৰহণ করুন। আমি সুনিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তো সেই মহান নবী মারিয়াম পুত্র ঈসা যার আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং আপনি মূসা (আঃ)-এর নিকট মাহাত্ম্যপূর্ণ সংবাদ বহনকারী ফেরেশতার মুখোমুখি হয়েছেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি প্রেরিত নবী এবং অচিরেই আপনি জিহাদের জন্যে আদিষ্ট হবেন। আমি যদি ওই সময়ে জীবিত থাকি তবে অবশ্যই আপনার সাখী। হয়ে আমি জিহাদ করব। তারপর ওয়ারাক ইবন নাওফিলের মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন?

“আমি ওই জ্ঞানী ব্যক্তিকে জান্নাতে দেখেছি। তখন তার পরনে ছিল রেশমী বস্ত্ৰ। কারণ, তিনি আমার প্রতি ঈমান এনেছেন এবং আমাকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। এখানে তিনি

ওয়ারাকার কথা বুঝিয়েছেন। এটি বায়হাকী (র)-এর উদ্ধৃত পাঠ। বর্ণনাটি মুরসাল পর্যায়ের এবং এটি একটি বিরল বর্ণনা।

যেহেতু এতে প্রথম নাযিলকৃত আয়াতসমূহরুপে সূরা ফাতিহার উল্লেখ রয়েছে। ইতোপূর্বে আমরা ওয়ারাকার কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করেছি যা তার ঈমান আনয়ন ও ঈমানের উপর তার দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করে। হযরত খাদীজা (রা)-এর ক্রীতদাস মায়সারার সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আচরণ এবং প্রচণ্ড গরমের দিনে ভর দুপুরে তার উপর মেঘমালার ছায়া প্ৰদান ইত্যাদি বিষয়ে হযরত খাদীজা (রা) যখন ওয়ারাকাকে অবগত করেন, তখন ওয়ারাক ওই কবিতা আবৃত্তি করেন। তার কতকাংশ এরূপ :

— আমি পুনঃ পুনঃ বলে আসছিলাম যে, সেই বিষয়ের কথা যে বিষয়ে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত

আমার অশ্রুপাত ঘটেছিল।

খাদীজার মুখ থেকে আমি তার সম্পর্কে বর্ণনার পর বর্ণনা শুনেছি। যে খাদীজা! তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় আমার প্রতীক্ষাকাল অনেক দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে।

তোমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি আশা করছি যে, মক্কাভূমিতে তাঁর আবির্ভাব দেখতে পাবো।

আমি একথা বলছি অভিজ্ঞ খৃস্টান ধর্মযাজকের বক্তব্য সম্পর্কে তুমি যে আমাকে অবগত করিয়েছ তার ভিত্তিতে। ওই যাজকের কথার ব্যতিক্রম হোক তা আমি কামনা করি না।

খৃস্টান যাজক তো বলেছেন যে, অবিলম্বে মুহাম্মদ (সা) সম্প্রদায়ের নেতা হবেন এবং যারা তার বিরোধিতা করবে। তিনি তাদের যুক্তি খণ্ড করবেন।

তিনি দেশে দেশে আলোর জ্যোতি ছড়াবেন। ওই আলো দিয়ে তিনি সত্যাচুৰ্য্যত জগতবাসীকে সোজাপথে আনবেন।

যে ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে লড়বে, সে ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে। আর যে তার সাথে মিত্ৰতা করবে, সে সাফল্যমণ্ডিত হবে।

হায়! তোমাদের ওই পরিস্থিতিতে আমি যদি উপস্থিত থাকতাম এবং আমিই সর্বপ্রথম তাঁর দলভুক্ত হতাম, তবে কতই না উত্তম হত!

হায়! কুরায়শগণ যা অপসন্দ করছে তাই যদি বাস্তবায়িত হত। হায়! তাদের এই ভ্ৰান্ত অবস্থানের কারণে তারা যদি হাহুতাশ ও আহাজারি করত!

তারা সবাই যা অপসন্দ করছে আরাশের মালিকের নিকট তার বাস্তবায়নই অধিকতর কাম্য। উন্নতি লাভের পর তাদের অবনতির অতল গহবরে তারা তলিয়ে যাবে।

১. সীরাতে ইবন হিশাম গ্রন্থে আছে।

৩. ত্রে ১ ও প্রবেশ করা 8. …”,–উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করা।

যদি তারা জীবিত থাকে এবং আমিও জীবিত থাকি, তবে এমন ঘটনা হতে দেখব যার প্রেক্ষিতে কাফিরগণ ব্যর্থতা ও হতাশায় আর্তচিৎকার করবে।

অন্য এক কাসীদায় তিনি বলেছেন :

– মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বহু সত্য সংবাদ আমাকে জানানো হয়েছে। কল্যাণকামী ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেও তাঁর সম্পর্কে ওই সকল সংবাদ জানানো হয়।

ওই সংবাদ এই যে, আবদুল্লাহর পুত্র আহমদ রাসূল রূপে প্রেরিত হবেন সমগ্ৰ জগতবাসীর প্ৰতি।

তাঁর সম্পর্কে আমার বিশ্বাস এই যে, অতি সত্বর তিনি সত্যবাদী রাসূল রূপে প্রেরিত হবেন। যেমন রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছিলেন আল্লাহর দু’জন বান্দা— হযরত হ্রদ ও সালিহ (আ:)।

এবং যেমন প্রেরিত হয়েছিলেন। হযরত মূসা ও ইবরাহীম (আ:)। অবশেষে দেখা যাবে তাঁর জন্যে জ্যোতি ও সত্যের উজ্জ্বল প্ৰকাশ।

তাঁর জীবনকালেই লুয়াই ইবন গালিব বংশের লোকজন তার অনুসরণ করবে। তাদের যুবক বৃদ্ধ সকল সন্ত্রান্ত লোকই তাঁর আনুগত্য করবে।

মানবজাতি যখন তার নবুওয়াতের যুগ পাবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকি, তবে আমি হাসিমুখে ও সানন্দে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করব।

আর যদি তা না হয় অর্থাৎ আমি যদি তখন জীবিত না থাকি, তবে হে খাদীজা! তুমি জেনে নাও, তোমার বসবাসের এই জগত থেকে আমি আরও প্রশস্ত ও বিস্তৃত জগতে যাত্রা করব।

ইবন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে ইউনুস ইবন বুকােয়র বলেছেন যে, ওয়ারোকা বলেছেন :

সীরাতে হালবিয়া গ্রন্থে আছে

আমাদের নিকট ব্যক্ত করা তোমার কথাগুলো যদি সত্য হয়, তবে হে খাদীজা! তুমি জেনে নাও যে, আহমদ নিশ্চয়ই রাসূল রূপে প্রেরিত।

তার নিকট ফেরেশতা জিবরাঈল ও মীকাঈল আসবেন। তাদের সাথে থাকবে। আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী। ওই ওহী তাঁর বক্ষ সম্প্রসারিত করে দিবে।

يفوز به من فاز فيها بتوبة – ويشفى به العانى الغريز المضل যারা সফলকাম হবার তারা তাওবার মাধ্যমে এবং এই ওহীর অনুসরণে এ দুনিয়ায় সফলকাম হবে। পক্ষান্তরে দুর্ভােগা, প্ৰতারিত ও পথভ্ৰষ্ট লোক হবে বিফল ও ব্যৰ্থ।

فريقان منهم فرقة فى جناته – وأخرى بأحواز الجحيم شعل সকল মানুষ দু’দলে বিভক্ত হবে। তাদের একদলের বাসস্থান হবে জান্নাত। আর অপর দল জাহান্নামের গর্তগুলোর মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাবে।

اذا ما دعوا بالويل فيها تتا بعث – مقامع فی هاماتهم ثم تشغل জাহান্নামের মধ্যে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যখনই তারা হাহুতাশ করবে, তখনই অনবরত

হাতুড়ির আঘাত পড়তে থাকবে তাদের মাথার খুলিতে। এরপর তারা জুলতে থাকবে আগুনের

মধ্যে।

فسبحان من يهوى الرياح بأمره – ومن هو فى الأيام ماشاء يفعل ، অতএব পবিত্রতা ও মহিমা সেই প্রভুর আপনি নির্দেশে যিনি বায়ু পরিচালনা করেন এবং যিনি যে কোন সময়ে যা ইচ্ছা তা করতে পারেন।

و من عرشهٔ فوق السالمؤت گلها–و آقضاؤهٔ فی خلقم لا تبیل এবং পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য সেই প্রভুর যার আরশ রয়েছে সকল আকাশের উপরে। সৃষ্টি জগতে তার ফায়সালা পরিবর্তন করা যায় না।

ওয়ারাক আরও বলেছেন :

يا للرجال وصرف الذهر والقدر – وما يشيى قضاه اللّة من غير হায় মানব সমাজ, যুগের পরিবর্তন এবং তাকদীর ও নির্ধারিত বিষয়। আল্লাহ যা ফায়সালা করে দেন তা পরিবর্তনকারী কেউ নেই।

حتى خديجة تدعونى لأخيرها – أمرا آرأة سيأتى النّاس من أخر. খাদীজা (রা) আমাকে অনুরোধ করেছে যেন আমি তাকে এমন একটি বিষয়ে অবহিত করি যা অচিরেই মানুষের নিকট আবির্ভূত হবে বলে আমি মনে করি।

و خبر تنی بامر قد سمغت به–فیها مخصی من قدیم الد هر و العصر

যে আমাকে এমন একটি বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে সুদূর অতীত থেকে এবং সুপ্রাচীনকাল থেকে যা সম্পর্কে আমি শুনে আসছি।

بان أحمد يأتيه فيخبرة – جبريل أنك مبعوث الى البشر আর তা হলো এই যে, আহমদের নিকট আগমন করবেন ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এবং তিনি তাঁকে জানিয়ে দিবেন যে, “আপনি মানব জাতির প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”

فقاً تا علی الذی ترجین يذ جزه–للن الالهٔ فرچى الخير و انتظرى আমি বললাম, তুমি যা আশা করছ তোমার মা’বুদ তোমার সে আশা পূরণ করে দিবেন। সুতরাং তুমি কল্যাণের আশায় থাক এবং অপেক্ষা কর।

و آرسلیه الینا کی ناسائلهٔ–من آمرم مایری فی النوم و الساهر তুমি তাকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও তাকে উপলক্ষ করে ঘটে যাওয়া বিষয় সম্পর্কে * আমি তাকে জিজ্ঞেস করব এবং নিদ্ৰিত বা সজাগ অবস্থায় তিনি যা প্ৰত্যক্ষ করেন তা আমি

জেনে নিব।

فقال حين أتانا منطقا عجبا – يقف منه أعالى الجلد والشغر তিনি যখন আমার নিকট আসলেন, তখন তিনি বিস্ময়কর ঘটনা বললেন, যা শুনে চর্মের উপরিভাগ ও লোমগুলো কেঁপে উঠে। p

ازی رایت آمین اللّه واجهنی–فی صورةاگملت من آغظم الصدور

মুখােমুখি দাঁড়িয়েছিলেন এমন এক জ্যোতির্ময় আকৃতি নিয়ে, যা আকৃতিতে ছিল সর্ববৃহৎ।

তারপর তিনি নিয়মিত আসতে থাকেন। আশপাশে থাকা বৃক্ষরাজির সালাম আমাকে ভীতিগ্ৰস্ত করে তোলে।

فقلّت ظبى وما أذرى أيُصدّقنى – آن سوف يبعث يتلو منزل السور আমি বললাম, তিনি আমাকে সত্যবাদী বলবে, কিনা তা আমি জানি না। বস্তৃত, আমি ধারণা করছি যে, অবিলম্বে তিনি রাসূলরাপে প্রেরিত হবেন এবং আল্লাহর নাযিলকৃত সূরাসমূহ পাঠ করবেন।

وسوف يبليك ان أعلنت دعوتهم – من الجهاد بلا من ولا كدر আপনি যখন তাদেরকে প্রকাশ্য দাওয়াত দিবেন, তখন অবিলম্বে আল্লাহ তা’আলা জিহাদ দ্বারা আপনাকে পরীক্ষা করবেন। এই জিহাদ অনুগ্রহ প্ৰকাশও নয়। আর তাতে কোন অলসতাও চলবে না।

হাফিয বায়হাকী তাঁর দালাইল গ্রন্থে এভাবেই কবিতাগুলো উল্লেখ করেছেন। তবে এগুলো ওয়ারাকার রচিত কি-না সে বিষয়ে আমার সন্দেহে রয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল মালিক জনৈক আলিমের বরাতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে যখন আল্লাহ তা’আলা সম্মান ও মর্যাদা দান এবং তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণের সূচনা করার ইচ্ছা করলেন, তখন তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলে লোকালয় থেকে অনেক দূরে চলে যেতেন।

তখন তিনি বস্ত্ৰ উন্মোচন করে প্রয়োজন সেরে নিতেন। এ উপলক্ষ্যে তিনি মক্কার পাহাড়ী পথ-প্ৰান্তরের দিকে চলে যেতেন। তিনি যে পাথর ও বৃক্ষের পাশ দিয়েই যেতেন সেটি তাঁর উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বলত আসসালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি তাঁর ডানে-বায়ে ও পেছনে তাকাতেন। কিন্তু বৃক্ষ ও পাথর ব্যতীত কিছুই দেখতে পেতেন না। এভাবেই তাঁর দেখা ও শোনা চলতে থাকে। যতদিন না। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মর্যাদা ও সম্মানের বার্তা নিয়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। তখন তিনি হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন। তখন ছিল রমযান মাস।

ইবন ইসহাক বলেন, যুবােয়র পরিবারের আযাদকৃত দাস ওয়াহাব ইবন কায়সান বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ ইবন যুবােয়র (রা)-কে বলতে শুনেছি, তিনি উবায়দ ইবন উমােয়র ইবন কাতাদা লায়হীকে বলছিলেন, হে উবায়দ! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির সূচনা সম্পর্কে এবং তার নিকট হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর আগমন সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বিবরণ শুনান তো! বর্ণনাকারী বলেন, তখন উবায়দা বলতে শুরু করেন। আমিও অবশ্য সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আবদুল্লাহ ইবন যুবােয়র এবং সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সকলের উদ্দেশ্যে উবায়দ বলেন, বছরে একমাস করে রাসূলুল্লাহ (সা) হেরা গুহায় নির্জািনবাস করতেন। সেখানে তিনি ইবাদতে নিয়োজিত থাকতেন। এটি অবশ্য জাহিলী যুগে কুরায়শদের একটি প্রিয় ইবাদত-রীতি ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) প্রতিবছর ওই মাসে হেরা গুহায় ইবাদতে নিয়োজিত থাকতেন।

এ সময়ে যে সকল ফকীর-মিসকীন তার নিকট আসত। তিনি তাদেরকে খাদ্য দান করতেন। মাসব্যাপী অবস্থান শেষ হলে ঘরে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সর্বপ্রথম তিনি কা’বা শরীফে উপস্থিত হতেন এবং সাতবার কিংবা আল্লাহর যা ইচ্ছা সে পরিমাণ তাওয়াফ করতেন। তারপর ঘরে ফিরে আসতেন। এরপর যে মাসে নবুওয়াত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলায় তাকে সম্মানিত করতে চাইলেন ওই মাসটি এলো। ওই মাসটি ছিল রমযান মাস। তখন তিনি সপরিবার হেরা গুহায় গেলেন। তারপর যখন সে রাতটি এল যে রাতে রিসালাত প্ৰদান করে। আল্লাহ তা’আলা তাকে সম্মানিত করলেন এবং তার মাধ্যমে সমগ্র বান্দাকে রহমত দান করলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, তিনি আমার নিকট আসলেন। আমি তখন নিদ্রামগ্ন। তিনি রেশমী একটি চাদরে রক্ষিত একটি কিতাব নিয়ে এলেন। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, পাঠ করুন! আমি বললাম, আমি পড়তে পারি না। তিনি আমাকে সজোরে চেপে ধরলেন, আমি আশঙ্কা করছিলাম যে, তাতে আমার মৃত্যু হবে। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন পাঠ করুন। আমি বললাম, আমি পড়তে পারি না। তখন তিনি আমাকে আবার সজোরে চেপে ধরলেন। আমি আশঙ্কা করছিলাম যে তাতে আমার মৃত্যু হবে। এরপর আমাকে

ছেড়ে দিয়ে বললেন, পাঠ করুন। আমি বললাম। আমি পড়তে পারি না। তিনি আমাকে আবার সজোরে চেপে ধরলেন। আমি আশঙ্কা করছিলাম, যে তাতে আমার মৃত্যু হবে। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পাঠ করুন। আমি বললাম, আমি কী পাঠ করবো? আমি এরূপ বলেছি। এজন্যে যে, তিনি যেন আমার সাথে সে আচরণ করেন যা ইতোপূর্বে তিনি আমার সাথে করেছিলো। এবার তিনি বললেন :

পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে।— যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তজমাট থেকে। পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালক তো মহা-মহিমান্বিত। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (৯৬ : ১-৫)

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, এরপর আমি তা পাঠ করি। এরপর তিনি থেমে যান এবং আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। এমতাবস্থায় যে, আমার অন্তরে যেন কিতাব লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপর আমি পথে বের হই। আমি যখন পাহাড়ের মধ্যস্থানে উপস্থিত হলাম, তখন আকাশ থেকে আগত একটি শব্দ শুনতে পাই। :

একজন বলছে, হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি জিবরাঈল। আমি মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি জিবরাঈল (আঃ)-কে। একজন পুরুষের আকৃতিতে তাঁর পদদ্বয় জোড় করে দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি বলছেন, হে মুহাম্মদ (সা:)! আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি জিবরাঈল। আমি তার দিকে তাকিয়ে ঠােয় দাঁড়িয়ে থাকি। সামনেও যেতে পারছিলাম না, পেছনেও নয়।–

তাঁর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি আকাশের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে তাকাই। কিন্তু সবদিকে শুধু তাই দেখি যা পূর্বে দেখেছি। তারপর আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনেও অগ্রসর হতে পারছিলাম না, পিছুও হটতে পারছিলাম না। ততক্ষণে খাদীজা আমার খোজে লোক পাঠিয়ে দেন। তাঁরা মক্কা পর্যন্ত গিয়ে আমাকে খুঁজেছে এবং সেখান থেকে ফিরে এসেছে অথচ আমি তখনও স্বস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছিলাম।

এরপর জিবরাঈল (আঃ) আমার নিকট থেকে চলে যান। আর আমিও আমার পরিবারের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা শুরু করি। আমি আসি খাদীজার নিকট। আমি তার কাছাকাছি বসি। তিনি বললেন, আবুল কাসিম! আপনি কোথায় ছিলেন? আল্লাহর কসম, আমি তো আপনার খোজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কা পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু আপনাকে না পেয়ে তারা ফিরে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, এরপর আমি যা দেখেছি তা খাদীজাকে জানাই। আমার বর্ণনা শুনে তিনি বলেন, চাচাত ভাই, আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন এবং স্থির থাকুন। খাদীজার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর কসম করে বলছি, আমি সুনিশ্চিতভাবে আশাবাদী যে, আপনি এই উম্মতের নবী

১. সম্ভবত প্রতিবারে চাপেই যে তাঁর বক্ষ প্রসারিত হচ্ছিল, তা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন।

হবেন। এরপর তিনি উঠে দাঁড়ান এবং কাপড়-চোপড় পরে আমাকে নিয়ে ওয়ারাকা। ইবন নাওফিলের নিকট যান। রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজার নিকট যা যা বলেছিলেন খাদীজা (রা) তার সবই ওয়ারাকাকে জানান। তখন ওয়ারাকা বলেন, পবিত্র, পবিত্র, ওয়ারাকার প্রাণ যার হাতে তাঁর কসম হে খাদীজা, তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে তাঁর নিকট যিনি এসেছেন তিনি হলেন প্রধান মাহাত্ম্যপূর্ণ সংবাদবাহক। তিনি মূসা (আ:)-এর নিকট আসতেন। আর ইনি নিশ্চয়ই এই উম্মতের নবী। আর তুমি তাকে বলে দাও, তিনি যেন স্থির থাকেন, ধৈর্য ধারণ করেন। খাদীজা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট ফিরে এলেন এবং ওয়ারাকার বক্তব্য তাকে জানালেন।

হেরা গুহায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্জনবাস শেষ হওয়ার পর তিনি সেখান থেকে ফিরে আসলেন এবং গৃহে প্রবেশের পূর্বে যথারীতি কা’বা শরীফের তাওয়াফ করতে গেলেন। এ সময় তার সাথে ওয়ারাক ইবন নাওফিলের সাক্ষাত হয়। তখন তার সাথে তার যে বাক্যালাপ হয় তা পূর্বেই উক্ত হয়েছে। তবে এ বর্ণনায় এতটুকু অতিরিক্ত রয়েছে যে, তারপর ওয়ারোকা তার মাথাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর খুব নিকটে নিয়ে আসেন এবং রাসূলের মাথার অগ্রভাগে চুম্বন করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।

উবায়দ ইবন উমােয়র সূত্রে বর্ণিত। পরবতীকালে সজাগ অবস্থায় যা ঘটেছিল এটা ছিল তারই পূর্বাভাস। যেমন পূর্বোল্লিখিত হযরত আইশা (রা)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যে স্বপ্ন দেখতেন। পরে সেটি প্রভাত আলোর ন্যায় বাস্তব রূপ লাভ করত। অথবা এমন হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ স্বপ্নটি দেখেছিলেন সজাগ অবস্থায় জিবরাঈল (আ.)-এর সাক্ষাতের ঠিক পরবর্তী রাতের ভোর বেলায়। অথবা এমনও হতে পারে যে, সাক্ষাতের দীর্ঘদিন পর এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লাহই ভাল জানেন। }_

মূসা ইবন উকবা (র) সাঈদ ইবন মুসায়্যাবের বরাতে বলেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সর্বপ্রথম দেখা স্বপ্ন সম্পর্কে আমাদের নিকট যে তথ্য পৌছেছে তা এইঃ আল্লাহ তা’আলা তাকে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি এটিকে গুরুতর স্বপ্নরূপে গ্রহণ করেন। তাঁর সহধর্মিণী খাদীজা (রা)-কে তিনি তা জানান। এ স্বপ্নকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা থেকে আল্লাহ তা’আলা খাদীজাকে রক্ষা করেন এবং এটি সত্য বলে গ্রহণ করার মত মনের প্রসারিতা তাকে দান করেন। তিনি তাঁকে বলেন, আপনি সুসংবাদ নিন। আল্লাহ। আপনাকে কল্যাণই দান করবেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) খাদীজার (রা) নিকট থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি পুনরায় খাদীজার নিকট গিয়ে বললেন যে, তিনি দেখেছেন তার পেট চিরে ফেলা হয়েছে এবং সেটি ধৌত ও পরিচ্ছন্ন করে ইতোপূর্বে যেমন ছিল তেমন ভাবে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। বর্ণনা শুনে হযরত খাদীজা (রা) বললেন, আল্লাহর কসম! এটি তো কল্যাণকর। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এরপর জিবরাঈল (আ.) প্রকাশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মুখোমুখি হলেন। তখন তিনি মক্কায় উঁচু এলাকায় অবস্থান করছিলেন। জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে একটি আকর্ষণীয় ও সুসজ্জিত আসনে বসালেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এভাবে বলেছেন : আমাকে একটি

মখমলের মণিমুক্তাখচিত বিছানায় বসানো হল। জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে রিসালাতের সুসংবাদ দিলেন। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা) প্রশান্তি লাভ করলেন।

তখন জিবরাঈল (আঃ) বললেন, “পাঠ করুন”। তিনি বললেন, কেমন করে পাঠ করব? জিবরাঈল (আঃ) বললেন :

পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে— যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক তো মহান। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না (৯৬ : ১-৫)। সাঈদ ইবন মুসায়্যাব বলেন, কেউ কেউ মনে করেন যে, সূরা মুদ্দাছুছিরই সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরা। আল্লাহই ভাল জানেন।

বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ প্রদত্ত রিসালাত গ্ৰহণ করলেন এবং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে জিবরাঈল (আঃ) যা আনলেন, তিনি তার অনুসরণ করলেন। সেখান থেকে তিনি যখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন পথিমধ্যে সকল গাছ ও পাথর তাকে সালাম করছিল। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে এবং যা দেখেছেন তা নিশ্চয়ই অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ এই প্রত্যয় নিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন। হযরত খাদীজার (রা) নিকট গিয়ে বললেন, আমি যে স্বপ্নে যা দেখেছি বলে তোমাকে বলেছিলাম, তিনি আসলে জিবরাঈল (আঃ)। এবার তিনি প্রকাশ্যে আমার নিকট উপস্থিত হয়েছেন। আমার প্রতিপালক তাকে আমার নিকট প্রেরণ করেছেন। জিবরাঈল (আ.) যে বাণী নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁর নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) যা শুনেছেন তাও খাদীজার নিকট ব্যক্ত করলেন। খাদীজা (রা) বললেন, আপনি সুসংবাদ নিন। আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনার কল্যাণই করবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে যা এসেছে আপনি তা গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই তা সত্য। আর আপনি সুসংবাদ নিন যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রেরিত সত্য রাসূল। এরপর খাদীজা (রা) সেখান থেকে উঠে যান এবং উতবা ইবন রাবী আর এক খৃস্টান ক্রীতদাসের নিকট উপস্থিত হন। তার নাম ছিল আদাস। তিনি ছিলেন নিনেভার অধিবাসী। খাদীজা (রা) বললেন, হে আদাস! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, তুমি আমাকে সত্য তথ্য দাও। বলো, জিবরাঈল সম্পর্কে তুমি কি কিছু জােন? আদাস বললেন, পবিত্ৰ! পবিত্র! এই মূর্তিপূজারীদের দেশে আবার জিবরাঈল (আ.)-এর আলোচনা। খাদীজা (রা) বললেন, জিবরাঈল (আ) সম্পর্কে তোমার যা জানা আছে তা আমাকে বল! তিনি বললেন, তিনি তো আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর নবীগণের মধ্যে বিশ্বস্ত মাধ্যম। তিনি মূসা (আ:) ও ঈসা (আ:)-এর ‘৯ নিকটও এসেছেন। হযরত খাদীজা (রা) সেখান থেকে ফিরে এলেন। এবার গেলেন ওয়ারাকা

ইবন নাওফিলের নিকট।

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সকল ঘটনা এবং জিবরাঈল (আঃ) তাকে যা দিয়ে গেছেন তার সবই তিনি ওয়ারাকাকে জানালেন। ওয়ারাকা বললেন, ভাতিজী! আমি সঠিক জানি না, তবে সম্ভবত

(፩ –

তোমার স্বামী সেই প্ৰতীক্ষিত নবী কিতাবীরা যার অপেক্ষায় রয়েছে এবং যার সম্পর্কে তারা, তাওরাত ও ইনজীল কিতাবে বিবরণ পেয়েছে। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমার স্বামী যদি সেই শেষ নবী হয়ে থাকেন এবং তিনি যদি তা প্ৰকাশ্যে ঘোষণা করেন এবং আমি তখন জীবিত থাকি, তবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আনুগত্যে এবং তাঁর সাহায্য-সহযোগিতাদানে আমি আল্লাহর পথে বিপদাপদ সহ্য করব। এরপর ওয়ারাকার মৃত্যু হয়। আল্লাহ তাঁর প্রতি দয়া করুন।

যুহরী বলেন, হযরত খাদীজা (রা)-ই সর্বপ্রথম আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছেন এবং তার রাসূলকে সত্য বলে গ্রহণ করেছেন। আমরা যে বর্ণনা উল্লেখ করেছি তা উল্লেখ করার পর হাফিয বায়হাকী ১ মন্তব্য করেছেন যে, এই বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বক্ষ বিদারণের যে বিবরণ এসেছে তা দ্বারা হালীমা-এর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় শৈশবে তাঁর বক্ষ বিদারণের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অথবা এও হতে পরে যে, দ্বিতীয় বার কোন এক সময়ে তাঁর বক্ষ বিদারণ করা হয়েছিল এবং তৃতীয় বার বক্ষ বিদারণ করা হয়েছিল মি’রাজের রাতে আসমানে আরোহণের সময়। আল্লাহই ভাল জানেন।

প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, সুলায়মান বলেছেন, আমাদের নিকট এ বর্ণনা পৌছেছে যে, কা’বা। পুনঃনির্মাণের ৫০ বছরের মাথায় আল্লাহ্ তা’আলা মুহাম্মদ (সা)-কে রাসূল রূপে দায়িত্ব প্রদান করেছেন। নবী করীম (সা)-এর নবুওয়াত ও মর্যাদাপ্ৰাপ্তির সর্বপ্রথম পর্যায় হল তাঁর স্বপ্ন দর্শন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) স্বপ্ন দেখতেন। এরপর সেটি তার সহধর্মিণী খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদকে জানাতেন। খাদীজা বলতেন, আপনি সুসংবাদ নিন। আল্লাহর কসম তিনি আপনাকে কল্যাণই দান করবেন।

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) হেরা গুহায় অবস্থান করছিলেন। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের ংস্পর্শ ত্যাগ করে তিনি এখানে আসতেন। তখন জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর খুবই নিকটে এলেন। তাঁকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ভীষণ ভয় পেলেন। জিবরাঈল (আ) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বক্ষে এবং পেছন দিক থেকে দু’কাঁধের মাঝখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! এর ত্রুটিগুলো মোচন করে দিন। বক্ষ প্রসারিত করে দিন। অন্তর পবিত্র করে দিন। মুহাম্মাদ (সা)। আপনি সুসংবাদ নিন, নিশ্চয়ই আপনি এ উম্মতের নবী, আপনি পাঠ করুন! আল্লাহর নবী বললেন, তখন তিনি ভয়ে কাপছিলেন— আমি তো কখনো কিতাব পাঠ করিনি। আমি ভালভাবে পাঠ করতে পারি না। আমি পড়িও না, লিখিও না। জিবরাঈল (আ) তাকে সজোরে চেপে ধরলেন, তারপর ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, পাঠ করুন!” রাসূলুল্লাহ (সা) পূর্বের ন্যায় উত্তর দিলেন। এরপর তিনি একটি মখমলী বিছানায় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বসালেন। তিনি ওই বিছানায় মণিমুক্তা ও ইয়াকৃত খচিত দেখতে পান। এবার বলেন :

১. এখান থেকে শুরু করে “বায়হাকী বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবন হাফিয আমাদের নিকট হাদীছ বর্ণনা করেছেন।”

পর্যন্ত এ গ্রন্থের মিসরে মুদ্ৰিত কপিতে উল্লেখ নেই।

পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে— যিনি সৃষ্টি করেছেন ……..। আয়াতগুলো পাঠ করলেন। এরপর জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হে মুহাম্মাদ (সা), আপনি ভয় পাবেন না, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। জিবরাঈল (আ) চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, হায়! আমি এখন কি করব? আমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে এ ঘটনা কিভাবে বলব? ভয়ে ভয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এবার জিবরাঈল (আঃ) নিজ আকৃতিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এক মহান অভিজ্ঞতা লাভ করলেন যাতে তাঁর বক্ষ ভরপুর হয়ে গেল। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, হে মুহাম্মাদ (সা:)! পাবেন না, আমি জিবরাঈল আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্ৰতিনিধি। জিবরাঈল হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবী-রাসূলের প্রতি যোগাযোগ-মাধ্যম। আপনাকে আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা ও সম্মান বিষয়ে আপনি নিশ্চিত বিশ্বাসী হোন। কারণ, আপনি আল্লাহর রাসূল এবার রাসূলুল্লাহ্ স্বগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে যত গাছ ও পাথরের পাশ দিয়ে তিনি অতিক্রম করলেন, তার সবগুলো সিজদাবস্থায় তাকে উদ্দেশ করে বলল, আসসালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ। এতে তাঁর মনে প্রশান্তি আসলো এবং তার প্রতি আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ তিনি উপলব্ধি করলেন। তাঁর সহধর্মিণী খাদীজা (রা)-এর নিকট পৌছার পর তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি দ্রুত তার কাছে যান এবং তার চেহারার ঘাম মুছে দেন। তিনি বলেন, আপনি ইতোপূর্বে যা দেখতেন এবং যা শুনতেন সম্ভবত ওই জাতীয় কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার এ অবস্থা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হে খাদীজা! ইতোপূর্বে যা আমি স্বপ্নে দেখতাম এবং যে শব্দ শুনতাম এবার তা আমি সজাগ অবস্থায় দেখেছি। হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রকাশ্যে আমার সম্মুখে এসেছেন, আমার সাথে কথা বলেছেন এবং আমাকে কিছু বাণী পড়িয়েছেন। তাতে আমি অস্থির ও বিচলিত হয়ে পড়েছি। এরপর তিনি পুনরায় আমার নিকট আসেন এবং আমাকে জানান যে, আমি এই উম্মতের নবী। এরপর আমি যখন বাড়ী ফিরে আসছিলাম, তখন আমার সম্মুখস্থ সকল পাথর ও বৃক্ষ আমাকে সালাম জানিয়ে বলছিল–আসসালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ!

খাদীজা (রা) বললেন, আপনি সুসংবাদ নিন! আল্লাহর কসম আমি জানতাম যে, আল্লাহ আপনার কল্যাণই করবেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি এই উম্মতের নবী। ইয়াহুদিগণ যার প্রতীক্ষায় রয়েছে। আমার ক্রীতদাস নাসিাহ এবং ধর্মযাজক বাহীরা আমাকে তা জানিয়েছেন। আজ থেকে কুড়ি বছর পূর্বে বাহীরা আমাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্যে বলে দিয়েছিলেন। এরপর হযরত খাদীজা তার সাথে সাথে থাকলেন যতক্ষণ না তিনি পানাহার সেরে নিলেন এবং স্বাভাবিক হাসিখুশী অবস্থায় ফিরে এলেন। এবার হযরত খাদীজা তাকে যাজকের নিকট নিয়ে গেলেন। মক্কার নিকটেই যাজকের বসবাস ছিল। কাছে যেতেই তিনি খাদীজা (রা)-কে চিনলেন এবং বললেন, হে কুরায়শ নারীদের নেত্ৰী! কী সংবাদ? তিনি বললেন, আমি আপনার নিকট এসেছি জিবরাঈল-এর পরিচয় জানার জন্যে। যাজক বললেন, সুবহানাল্লাহ, আমার প্রতিপালক পবিত্র। যে দেশের মানুষ মূর্তিপূজা করে, সে দেশে আবার জিবরাঈল (আ.)-এর আলোচনা? তবে জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর বিশ্বস্ত ফেরেশতা, নবী ও রাসূলগণের নিকট আল্লাহর বিশ্বস্ত বাণীবাহক এবং হযরত মূসা (আ:) ও ঈসা (আ:)-এর সাখী।

এতে তিনি মুহাম্মাদ (সা)-এর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ উপলব্ধি করলেন। এরপর হযরত খাদীজা উতবা ইবন রাবীআর ক্রীতদাস আদাস-এর নিকট গেলেন। তাকে তিনি জিবরাঈল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। যাজক যা বলেছেন আদাসও তাই বললেন। বরং এতটুকু অতিরিক্ত বললেন যে, আল্লাহ তা’আলা ফিরআওন ও তার সম্প্রদায়কে যখন পানিতে ডুবিয়ে মারলেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) হযরত মূসা (আ.)-এর সাথে ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তুর পাহাড়ে যখন মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেন, তখনও জিবরাঈল (আ) মূসা (আ:)-এর সাথে। তিনি হযরত ঈসা (আ:)-এর সাথেও ছিলেন। তাঁর দ্বারা আল্লাহ তা’আলা ঈসা (আ:)-কে সাহায্য করেন। সেখান থেকে উঠে। হযরত খাদীজা (রা) গেলেন ওয়ারাক ইবন নাওফিলের নিকট।

জিবরাঈল (আ.)-এর পরিচয় জানতে চাইলে তাঁর নিকট তিনি ও পূর্ববৎ উত্তর দিলেন। ওয়ারোকা খাদীজা (রা)-এর নিকট প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলেন। তিনি যা বলবেন ওয়ারোকা তা অবশ্যই গোপন রাখবেন এই বিষয়ে ওয়ারাকার শপথ নিলেন। ওয়ারাকা সেরূপ শপথ করলেন। এরপর খাদীজা (রা) বললেন, আবদুল্লাহ-এর পুত্র মুহাম্মাদ (সা:) আমাকে জানিয়েছেন, তিনি তো চির সত্যবাদী। তাঁর বক্তব্য মিথ্যা নয়। তার বক্তব্য এই যে, হেরা গুহায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর নিকট এসেছিলেন। তিনি তাকে জানিয়েছেন যে, তিনি এই উম্মতের নবী। উপরন্তু প্রেরিত কতগুলো আয়াত তিনি মুহাম্মাদ (সা)-কে পাঠ করিয়েছেন। এ কথা শুনে ওয়ারোকা নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন এবং বললেন, জিবরাঈল যদি পৃথিবীতে পদার্পণ করেন, তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নিকট আসেন। নবী ব্যতীত কারো নিকট তিনি আসেন না। তিনি নবী-রাসূলগণের সাথী। আল্লাহ্ তা’আলা তাকে তাদের নিকটই পাঠান। তবে তাঁর সম্পর্কে তোমার বক্তব্য আমি সত্য বলে গ্রহণ করছি। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ (সা)-কে তুমি আমার নিকট পাঠিয়ে দিবে। আমি তার অবস্থা জানিব, তার কথা শুনব এবং তার সাথে কথা বলব। আমি শংকাবোধ করছি এ জন্যে যে, ওই আগন্তুক জিবরাঈল না হয়ে অন্য কেউও হতে পারে। কারণ, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এবং সত্যচ্যুত করার জন্যে কতক শয়তানও জিবরাঈলের আকৃতি নিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে। ফলে সুস্থ বুদ্ধি বিবেক সম্পন্ন মানুষ কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় ও উন্মাদ হয়ে পড়ে।

হযরত খাদীজা (রা) ওয়ারাকার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসলেন। আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি খাদীজার (রা) সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি মুহাম্মাদ (সা)-এর কল্যাণই করবেন। ওয়ারাকার সকল পরামর্শ তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জানালেন। তখন আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন :

নূন— শপথ কলমের এবং তা যা লিপিবদ্ধ করে তার, আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনি উন্মাদ নন (৬৮ : ১-২)। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আল্লাহর কসম ওই আগভুক অবশ্যই জিবরাঈল (আ.)। খাদীজা বললেন, আমি চাই আপনি ওয়ারাকার সাথে দেখা করুন। আশা করি, আল্লাহ তাকে সঠিক পথ দেখাবেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) উপস্থিত হলেন ওয়ারাকার নিকট। ওয়ারোকা বললেন, আচ্ছা, আপনার নিকট যিনি এসেছিলেন তিনি কি আলোর মধ্যে এসেছিলেন, নাকি অন্ধকারে? রাসূলুল্লাহ (সা) তার দেখা জিবরাঈলের অবস্থা, মাহাত্ম্য এবং তার প্রতি যে ওহী নিয়ে এসেছিলেন তার সবই ওয়ারাকাকে জানালেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই তিনি জিবরাঈল (আ.) আর এটি আল্লাহর বাণী। এগুলো আপনার সম্প্রদায়ের নিকট পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে আল্লাহ। আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এগুলো অবশ্যই নবুওয়াত বিষয়ক নির্দেশ। আপনার যুগে আমি যদি বেঁচে থাকি, তবে আমি আপনার অনুসরণ করব। এরপর তিনি বললেন, হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর। আল্লাহ আপনাকে যে সুসংবাদ দিয়েছেন। আপনি তা গ্ৰহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কে ওয়ারাকার মন্তব্য ও সত্যায়নের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে তাঁর সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বিব্ৰতবোধ করে। এরপর কিছু দিনের জন্যে ওহী আসা বন্ধ হয়ে যায়। কুরায়শের লোকেরা বলতে থাকে যে, ওই বাণী যদি সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসত, তবে তা বন্ধ হত না, অনবরত আসত। কিন্তু আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা। নাযিল করলেন : ৩ . 16 J11, … … IT, এবং এ1–2.5, 11 দুটো পূর্ণ সূরা।

আল্লামা বায়হাকী বলেন, আবু আবদিল্লাহ হাফিয–খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন নবুওয়াত লাভে মহিমান্বিত হলেন, তখন খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, হে চাচাত ভাই! আপনার যে সাথী আপনার নিকট আসেন তাঁর আগমন সংবাদ আপনি কি আমাকে জানাতে পারেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হ্যা, পারব। খাদীজা (রা) বললেন, তিনি আসলে আমাকে জানাবেন।

এক সময়ের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) খাদীজার নিকট ছিলেন। তখন জিবরাঈল (আ) এলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিবরাঈলকে দেখে খাদীজা (রা)-কে ডেকে বললেন, হে খাদীজা! এই যে জিবরাঈল (আঃ)। খাদীজা বললেন, আপনি এখনও তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন?? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হ্যা। খাদীজা (রা) বললেন, এবার আপনি আমার ডান দিকে এসে বসুন। রাসূলুল্লাহ (সা) স্থান পরিবর্তন করে এখানে এসে বসলেন। খাদীজা (রা) বললেন, আপনি এখনও তাকে দেখছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হ্যা। খাদীজা (রা) বললেন, এবার ওই স্থান ত্যাগ করে আমার কোলে বসুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাই করলেন। খাদীজা (রা) বললেন, এবার তাকে দেখতে পাচ্ছেন?? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, হ্যা। এবার খাদীজা (রা) তাঁর মাথার কাপড় সরিয়ে ফেললেন এবং ওড়না উঠিয়ে ফেললেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখনও তার কোলে বসা। খাদীজা (রাঃ) বললেন, এখন তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন?? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, না।

খাদীজা (রা) বললেন, ইনি শয়তান নন, ইনি নিশ্চয়ই ফেরেশতা। চাচাত ভাই! আপনি স্থির ও অবিচল থাকুন! আপনি সুসংবাদ গ্ৰহণ করুন!! এরপর হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ঈমান আনলেন এবং একথা সাক্ষ্য দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যা পেয়েছেন, তা সত্য ও সঠিক

ইবন ইসহাক বলেন, আমি এ হাদীছ আবদুল্লাহ ইবন হাসানকে শোনাই। তিনি তখন বলেন যে, আমি আমার মা ফাতিমা বিনত হুসাইনকে হযরত খাদীজা (রা)-এর বরাতে এ হাদীছটি বর্ণনা করতে শুনেছি। তবে আমি তাকে আরো বলতে শুনেছি যে, খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে নিজের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললেন। আর তখন জিবরাঈল (আ) চলে যান।

বায়হাকী (র) বলেন, এটি ছিল হযরত খাদীজার একটি কৌশল। নিজের দীনও ঈমান রক্ষার জন্যে তিনি এর দ্বারা বিষয়টির সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করে নিলেন। অন্যদিকে জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে যা বলেছেন এবং একের পর এক যে সকল নিদর্শনাদি দেখিয়েছেন এবং তার প্রতি গাছ ও পাথরের সালাম শুনেছেন, সেগুলো যে সত্য ও যথার্থ এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তো আস্থাবান ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেনই।

ইমাম মুসলিম (র) তাঁর সহীহ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন যে, আবু বকর— জাবির ইবন সামুরা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মক্কার একটি পাথরকে আমি চিনি। আমি রাসূলের দায়িত্ব পাওয়ার পূর্বেও সেটি আমাকে সালাম দিত। এখনও আমি সেটিকে চিনি।

আবু দাউদ তায়ালিসী সুলায়মান ইবন মুআয থেকে এ মর্মে আরো একখানা হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

বায়হাকী (র) আলী ইবন আবী তালিব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে মক্কায় অবস্থান করছিলাম। একদিন তিনি একদিকে যাত্রা করলেন। তখন যত গাছ ও পাথর তার সম্মুখে পড়লো তার সবগুলোই আসসালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে তাকে সালাম দিয়েছে। অপর এক বর্ণনায় আছে, আমি দেখতে পাই যে, আমি তার সাথে এক পার্বত্য উপত্যকায় প্ৰবেশ করলাম। তখন যত গাছ ও পাথরের পাশ দিয়ে তিনি অতিক্রম করলেন তার সবগুলোই তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, আসসালামু আলায়কুম ইয়া রাসূলাল্লাহ্”। আমি তা শুনতে পাচ্ছিলাম।

পরিচ্ছেদ

ইমাম বুখারী (র) তাঁর পূর্বোল্লিখিত বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, তারপর ওহী আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি এমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, একাধিকবার তিনি নিজেকে পর্বতশৃঙ্গ থেকে ফেলে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। এরপর যখনই নিজেকে নীচে ফেলে দেয়ার জন্যে তিনি পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন, তখনই জিবরাঈল (আ) তাঁর নিকট উপস্থিত হযেছেন এবং বলেছেন, হে মুহাম্মাদ (সা), আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। এতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অস্থিরতা প্রশমিত হত এবং তাঁর মন শান্ত হত। তিনি ফিরে আসতেন। ওহীর বিরতিকাল দীর্ঘ হয়ে পড়লে তিনি পুনরায় এরূপ নিজেকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দেয়ার জন্যে উদ্যত হন। তিনি যখন পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতেন, তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) সেখানে উপস্থিত হতেন এবং পূর্বের ন্যায়। তাঁকে আশ্বস্ত করতেন।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এসেছে, আবদুর রাযযাক-জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ওহী-বিরতি সম্পর্কে

বলতে শুনেছি, একদিন আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ উপরের দিকে একটি শব্দ শুনতে পাই। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। তখন দেখি সেই ফেরেশতা, যিনি হেরা গুহায় আমার নিকট এসেছিলেন। আকাশের একটি কুরসীতে তিনি আসীন রয়েছেন। তাকে দেখে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই। আমি যেন মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি আমার পরিবারের নিকট ফিরে আসি এবং বলি, তোমরা আমাকে কম্বলে ঢেকে দাও! কিম্বলে ঢেকে দাও! তখন আল্লাহ তা’আলা। নাযিল করলেন :

يأيها المدير قم فأنذر وربك فكير وثيابك فقطهر والرجز فاهجر —হে বস্ত্ৰাচ্ছাদিত! উঠুন! সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব।

ঘোষণা করুন আপনার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখুন এবং অপবিত্রতা হতে দূরে থাকুন (৭০ : ১-৫)। তারপর থেকে নিয়মিত ওহী নাযিল হতে থাকে।

উপরোক্ত আয়াতগুলো বিরতির পর প্রথম নাযিল হওয়া কুরআনের অংশ। সর্বপ্রথম নাযিল হওয়া অংশ নয়। সর্বপ্রথম নাযিল হওয়া অংশ হল … اقر آباس مریلن الذی خلق–পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন…)। হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সর্বপ্রথম নাযিল হওয়া অংশ হল … …..। :(। আমরা উপরে যে ব্যাখ্যা দিয়েছি তার বক্তব্যটিকে ওই ব্যাখ্যার আলোকে গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতাও তার ইঙ্গিত দেয়। কারণ, তাঁর বর্ণনা প্রমাণ করে যে, ইতোপূর্বেও ওহী নাযিল হয়েছিল। যার ফলে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাকে প্রথম দেখার প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বার রাসূলুল্লাহ (সা) ওই ফেরেশতাকে চিনতে পেরেছিলেন।

উপরন্তু তাঁর বক্তব্য রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওহী-বিরতি সম্পর্কে হাদীছ বৰ্ণনা করছিলেন” দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য ওহী আগমনের পূর্বেও ওহী নাযিলের ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহই ভাল ७gन्मन्म।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ইয়াহইয়া ইবন কাহীর সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আমি আবু সালামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সর্বপ্রথম কুরআনের কোন অংশ নাযিল হয়? উত্তরে তিনি বলেন, … 4.1 L_{। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম এ,–1 ] কি প্রথম নাযিল হয়নি? তিনি বললেন, এ বিষয়ে আমি জাবির ইবন আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জুবাবে তিনি বলেছিলেন … …….। :(। তখন আমি বলেছিলাম এr, ‘.L 1″) নয় কি? তখন তিনি বললেন যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন :–

“আমি একমাস হেরা গুহায় ইবাদতে নিয়োজিত ছিলাম। নির্ধারিত ইবাদত শেষ করে আমি গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ি। মাঠের মধ্যখানে আসার পর আমি শুনতে পাই যে, কে যেন আমাকে ডাক দিল। আমি আমার সামনে, পেছনে, ডানে এবং বায়ে তাকালাম; কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। এরপর আমি তোকালাম আকাশের দিকে। তখন দেখি সেই তিনি শূন্যে একটি আসনে উপবিষ্ট। তাতে আমি কেঁপে উঠি বা ভয় পেয়ে যাই। তখন আমি খাদীজা (রা)-এর নিকট আসি এবং আমাকে কাপড়ে ঢেকে দিতে বলি। তারা আমাকে কাপড়ে ঢেকে দেয়। অনন্তর আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন :

يائها المدبَّر قم فأنذر وربك فكير وثيابك فطور. অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “হঠাৎ আমি দেখলাম সেই ফেরেশতা, যিনি হেরা গুহায় আমার নিকট এসেছিলেন। আসমান ও যমীনের মাঝে একটি আসনে তিনি আসীন। তাতে আমি ভয় পেয়ে যাই।” এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যে, ইতোপূর্বে জিবরাঈল তাঁর নিকট এসেছিলেন এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হয়েছিল। যেমনটি আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

কেউ কেউ বলেন যে, ওহী-বিরতির পর সর্বপ্রথম নাযিল হয় 13 J 11’, ‘ ‘ : 1, আছে … সম্পূর্ণ সূরাটি। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এই অভিমত পোষণ করেন। কতক কির আত বিশেষজ্ঞ বলেন, এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) আনন্দের আতিশয্যে উক্ত সূরার প্রথমে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন। এটি কষ্টকল্পিত বক্তব্য। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এই মর্মের বর্ণনা যে ওহী-বিরতির পর সর্বপ্রথম নাযিল হওয়া আয়াত হল,,,,,, ‘.’)1 L__

—–উপরোক্ত অভিমতকে নাকচ করে দেয়। তবে একথা সত্য যে, অন্য একটি স্বল্পকালীন ওহী-বিরতির পর ১.১। সূরাটি নাযিল হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সহীহ বুখারী ও মুসলিম আবদুল্লাহ বাজালী (র) সূত্রে হাদীস উদ্ধৃত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ বাজালী (র) বলেছেন, একবার রাসূলুল্লাহ্ (সা) অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক রাত কিংবা দু’ রাত কিংবা তিন রাত তিনি রাত্রিকালীন ইবাদত করতে পারেননি। তখন জনৈক দুষ্ট মহিলা তার উদ্দেশ্যে বলেছিল, “আমি মনে করি, তোমার শয়তান তোমাকে ত্যাগ করেছে।” তখন আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন :

والضحى والليل اذا سجلى ما ودّعك ربك وما قلى শপথ পূর্বাহের। শপথ রজনীর যখন সেটি হয় নিঝুম, আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি বিরূপও হননি (৯৩ : ১-৩)। এই সূরাতে বৰ্ণিত নির্দেশের মাধ্যমে প্রিয়নবী (সা)-এর রাসূল রূপে প্রেরণ কার্যকর হল এবং প্রথম ওহীর মাধ্যমে তার নবুওয়াত অর্জিত হয়েছিল।

কেউ কেউ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওহী-বিরতির মেয়াদ দুই বছর, আবার কারো মতে আড়াই বছর। স্পষ্টতই এই বিরতিকাল ছিল মীকাঈল ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাকাল পর্যন্ত। শাবী (র) প্রমুখ এরূপ ফায়সালা দিয়েছেন। এরূপ ফায়সালা ইতোপূর্বে জিবরাঈল ফেরেশতার মাধ্যমে এL, .L1_। নাযিল হওয়ার বিপরীত নয়। এরপর

يأيها المرئر قم فأنذر وربك فكير وثيابك فطور والرجز فاهجر আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর থেকে হযরত জিবরাঈল (আঃ) নিয়মিত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে ছিলেন। এরপর থেকে যথারীতি ওহী নাযিল হতে থাকে। অর্থাৎ সময় ও প্রয়োজন অনুসারে ওহী আসতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা) রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্যে তখন পরিপূর্ণ প্ৰস্তুতি গ্রহণ করেন এবং সাধ্যমত প্রচেষ্টা শুরু করেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বাধীন-পরাধীন নির্বিশেষে সবাইকে তিনি আল্লাহর প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। যারা বুদ্ধিমান, অভিজাত ও

সৌভাগ্যের অধিকারী, তারা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। সত্যান্দ্রোহী অহংকারীরা তার বিরোধিতা ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। স্বাধীন বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ন করেন হযরত আবু বকর সিদীক (রা)। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ন করেন। হযরত আলী ইবন আবী তালিব (রা) মহিলাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সহধর্মিণী হযরত খাদীজা (রা) এবং আযাদকৃত দাসদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ক্রীতদাস হযরত যায়দ ইবন হারিছা! কালবী। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।

ওহী সম্পর্কিত সংবাদ পাওয়ার পর ওয়ারাক ইবন নাওফিলের ঈমান আনয়ন সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর প্রতি ওহী-বিরতিকালে ওয়ারোকা ইনতিকাল

করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *