৮১. অযোধ্যায় কালপুরুষের আগমন ও লক্ষ্মণ বর্জ্জন

অযোধ্যায় কালপুরুষের আগমন ও লক্ষ্মণ বর্জ্জন

পরে কালপুরুষ যে সংসার-বিনাশী।
অযোধ্যায় প্রবেশিল হইয়া সন্ন্যাসী।।
সভাতে বসিয়া রাম দুয়ারী লক্ষ্মণ।
রীতিমত বসিয়াছে পাত্র মিত্রগণ।।
হেনকালে আসি কালপুরুষ বলিল।
আমি যে ব্রহ্মার দূত ব্রহ্মা পাঠাইল।।
লক্ষ্মণ রামের কাছে কর নিবেদন।
তাঁহার সহিত আছে কথোপকথন।।
শ্রীরামের কাছে গিয়া লক্ষ্মণ সম্ভ্রমে।
যোড়হাতে করিয়া যে জানান শ্রীরামে।।
আইল ব্রহ্মার দূত দ্বারে আচম্বিতে।
আজ্ঞা কর রঘুনাথ উচিত আনিতে।।
শ্রীরাম বলেন আন করি পুরস্কার।
কি হেতু আইল দূত জানি সমাচার।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা লক্ষ্মণ সত্বর।
কালপুরুষের নিল রামের গোচর।।
পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়া রাম দিলেন আসন।
যোড়হস্তে জিজ্ঞাসেন কহ প্রয়োজন।।
সে কালপুরুষ বলে শুনহ বচন।
যে কথা কহিব পাছে শুনে অন্য জন।।
এ সময়ে যে করিবে হেথা আগমন।
ব্রহ্মার বচনে তারে করিবে বর্জ্জন।।
এই সত্য ব্রহ্মার যে করিবে পালন।
দ্বার রক্ষা হেতু তবে রাখ একজন।।
শ্রীরাম বলেন শুন প্রাণের লক্ষ্মণ।
সাবধানে থাক না আইসে কোনজন।।
অধিক কি কহিব যে দ্বার পানে চায়।
তাহাকে ত্যজিব আমি জানিহ নিশ্চয়।।
এই সত্য করিলাম দূতের গোচরে।
সাবধানে লক্ষ্মণ রহিবে তুমি দ্বারে।।
বিধাতার নির্ব্বন্ধ যে না যায় খণ্ডন।
কালপুরুষের সঙ্গে হয় সম্ভাষণ।।
সে কালপুরুষ বলে পরিচয় করি।
মর্ত্ত্যেতে রহিলে শূণ্য বৈকুণ্ঠ-নগরী।।
সংসারের লোক নাশি মোর দূতে আনে।
তোমারে লইতে আমি আইনু আপনে।।
ব্রহ্মার বচন রাম কর অবধান।
সংসার ছাড়িয়া তুমি চল নিজ স্থান।।
এগার হাজার বর্ষ অবতার করি।
ভুলিয়া রহিলা প্রভু যেমন সংসারী।।
রহিবার যোগ্য নহে মর্ত্ত্যের ভিতর।
আমারে কি আজ্ঞা প্রভু বলহ সত্বর।।
শ্রীরাম বলেন যম যে কহ এখন।
সংসার ছাড়িয়া আমি করিব গমন।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ আছে না যায় খণ্ডন।
ব্রহ্মার মায়াতে দূর্ব্বাসার আগমন।।
সভা করি দ্বারে বসি আছেন লক্ষ্মণ।
মুনি বলে গিয়া করি রাম-সম্ভাষণ।।
লক্ষ্মণ বলেন কৃপা কর দাস বলে।
ব্রহ্মার দূতের সনে আছেন বিরলে।।
যে কর্ম্ম সাধিবে রাম করি সম্ভাষণ।
আজ্ঞা কর করি আমি সেই প্রয়োজন।।
কুপিল দুর্ব্বাসা মুনি লক্ষ্মণের প্রতি।
লক্ষ্মণের পানে চাহি কহে কোপমতি।।
লক্ষ্মণ আমার শাপে কার বাপে তরি।
শাপ দিয়া পোড়াইব অযোধ্যা-নগরী।।
যত রাজ্যখণ্ড আজি করিব সংহার।
পোড়াইয়া অযোধ্যা করিব ছারখার।।
বালক বনিতা বৃদ্ধ আজি করি ধ্বংস।
দশরথ-ভূপতিরে করিব নির্ব্বংশ।।
দেখিয়া মুনির কোপ লক্ষ্মণের ত্রাস।
ভাবেন আমার লাগি হয় সর্ব্বনাশ।।
বুঝি রাম করিবেন আমারে বর্জ্জন।
এড়াইতে নারি আমি ললাট লিখন।।
বর্জ্জন মরণ দুই একই প্রকার।
আমা হেতু বংশ কেন হইবে সংহার।।
আমারে বর্জ্জিলে আমি মরি একজন।
পিতৃবংশ নাশ করি কিসের কারণ।।
পূর্ব্বকথা লক্ষ্মণের পড়িলেক মনে।
এ বর্জ্জন সুমন্ত্র কহিল তপোবনে।।
কালপুরুষের সঙ্গে রামের কথন।
মুনিকে লইয়া তথা গেলেন লক্ষ্মণ।।
কালপুরুষেরে রাম করিয়া বিদায়।
প্রণাম করেন রাম মুনি দুর্ব্বাসায়।।
বিনয়ে বলেন রাম কোন্ প্রয়োজন।
দুর্ব্বাসা বলেন চাহি উচিত ভোজন।।
এক বর্ষ করিয়াছি আমি অনাহার।
দেহ অন্ন ব্যঞ্জন যে অমৃত সুসার।।
দুর্ব্বাসার কথাতে রামের হৈল হাস।
এক বর্ষ কেমনে করেছ উপবাস।।
শ্রীরাম বলেন তুমি এ নহে কারণ।
অনুমানে বুঝি যে মজিল পুরীজন।।
ভোজন দিলেন রাম অমৃত সুসার।
ভোজন করিয়া মুনি গেল নিজ ঘর।।
শ্রীরাম ভাবেন মুনি পাড়িল প্রমাদ।
কেমনে বর্জ্জিব ভাই করেন বিষাদ।।
কালপুরুষের সঙ্গে আলাপ যখন।
দুর্ব্বাসার সঙ্গে গেল লক্ষ্মণ তখন।।
সত্য যদি লঙ্ঘি তবে ব্যর্থ এ জীবন।
সত্য পালি যদি হয় লক্ষ্মণ বর্জ্জন।।
লক্ষ্মণে বর্জ্জিতে রাম অত্যন্ত বিকল।
বশিষ্ঠ নারদ আদি ডাকেন সকল।।
কেমনে করেন রাম সত্যের পালন।
সভামধ্যে শ্রীরাম কহেন বিবরণ।।
শ্রীরাম বলেন সীতা আর রাজ্য ধন।
ইহার অধিক মোর ভাই যে লক্ষ্মণ।।
সকলি ত্যজিতে পারি জানকী সুন্দরী।
লক্ষ্মণ বহনে আমি রহিতে না পারি।।
মুনিরা বলিছে রাম কি ভাবিছ মনে।
সত্য যদি পাল তবে বর্জ্জহ লক্ষ্মণে।।
যদি সত্য লঙ্ঘন হয় ব্যর্থ এ জীবন।
লক্ষ্মণে বর্জ্জিয়া কর সত্যের পালন।।
সত্য হেতু তব পিতা তোমা পুত্রে বর্জ্জে।
সত্য পালি মরিয়া গেলেন স্বর্গরাজ্যে।।
ছত্রদণ্ডধর তুমি হৈল অধিবাস।
পিতৃসত্য পালিতে যে গেলে বনবাস।।
অগ্নিশুদ্ধা এড় তুমি পরমা সুন্দরী।
সীতা এড়ি রাজ্য এড় হয়ে ব্রহ্মচারী।।
এ সব বর্জ্জিতে রাম না কর মন্ত্রণা।
লক্ষ্মণে বর্জ্জিতে কেন এত আলোচনা।।
হেনকালে শ্রীরামেরে বলেন লক্ষ্মণ।
আমার বর্জ্জিয়া কর সত্যের পালন।।
যদি সত্য লঙ্ঘ তবে বড় অনাচার।
তুমি সত্য লঙিঘলে মজিবে ত্রিসংসার।।
যত কিছু আজি প্রভু আমার কারণ।
তোমার যে মায়া বুঝিবেক কোন্ জন।।
সংসার ছাড়িতে রামের ঘুচে মায়া মোহ।
দুই ভাই কোলাকুলি চক্ষে পড়ে লোহ।।
সভায় বলেন রাম বর্জ্জিনু লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণ-পশ্চাতে আমি করিব গমন।।
শুনি সর্ব্বলোকের চক্ষেতে পড়ে পানি।
চলিল লক্ষ্মণ বীর করিয়া মেলানি।।
এড়েন হাতের বেত্র গাত্র-আভরণ।
রামে প্রদক্ষিণ করিলেন শ্রীলক্ষ্মণ।।
বন্দিলেন শ্রীবশিষ্ঠ নারদ-চরণ।
আর যত বন্দিলেন কুলের ব্রাহ্মণ।।
ভরতের পদদ্বয় করেন বন্দন।
ভরত কাতর অতি করেন ক্রন্দন।।
প্রজা সমূহের প্রতি বলেন লক্ষ্মণ।
সম্প্রীতিতে বিদায় করহ প্রজাগণ।।
প্রজাগণ বলে শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
তোমা বিনা কেমনে ধরিব এ জীবন।।
লক্ষ্মণ রামের পদে করেন প্রণতি।
জন্মে জন্মে থাকে যেন ভক্তি তোমা প্রতি।।
লক্ষ্মণের বাক্যে রাম হইয়া কাতর।
অচেতন হইলেন নাহিক উত্তর।।
পাত্র মিত্র প্রতি বীর করিয়া মেলানি।
চাহিয়া সবার পানে চক্ষে পড়ে পানি।।
রাজ্যখণ্ড আদি করি সহ সর্ব্বজন।
সরযূ নদীর তীরে করেন গমন।।
প্রার্থনা করেন তারে করিয়া প্রণাম।
আমাতে প্রসন্ন যেন থাকেন শ্রীরাম।।
সরযূত স্রোত বহে অতি খরশাণ।
লক্ষ্মণ নামিয়া স্রোত ত্যাজিলেন প্রাণ।।
নরদেহ পরিহরি গেলেন গোলোক।
অযোধ্যানগরে যে পড়িল মহাশোক।।
হাহাকার রোদন উঠিল চতুর্দ্দিকে।
বিলাপ করেন রাম বর্ণিতে অধিক।।
আমারে এড়িয়া গেলা কোথায় লক্ষ্মণ।
তোমা বিনা বিফল না রাখিব জীবন।।
সীতা বর্জ্জিলাম আমি লোক অপবাদে।
তোমা বর্জ্জিলাম ভাই কোন্ অপরাধে।।
লক্ষ্মণ-বর্জ্জনে মোর মিথ্যা এ সংসার।
লক্ষ্মণ সমান ভাই না পাইব আর।।
লক্ষ্মণ বিহনে আমি থাকি কি কুশলে।
যে জলে নামিল ভাই নামিব সে জলে।।
যে দিকে লক্ষ্মণ গেল উত্তর সে দিক্।
লক্ষ্মণ বিহনে প্রাণ রাখাই যে ধিক।।
করিলা বিস্তর সেবা হইয়া সদয়।
তোমা বর্জ্জিলাম আমি হইয়া নির্দ্দয়।।
লক্ষ্মণের মরণে কাতর প্রাণ অতি।
ছত্রদণ্ড ধরিতে না চান রঘুপতি।।
ভরতে করিতে রাজা শ্রীরামের মতি।
ভরত কহেন কিছু শ্রীরামের প্রতি।।
এতকাল নানা সুখ করিলাম রাম।
তব সঙ্গে যাইতে এমন মনস্কাম।।
ভরতের কথা শুনি রামের উদাস।
হেঁটমাথা করি রাম ছাড়েন নিঃশ্বাস।।
শ্রীরাম বলেন শুন, আমার উত্তর।
শত্রুঘ্নে আনিতে দূত পাঠাও সত্বর।।
রামের আজ্ঞায় দূত পাঠাইল ত্বরা।
তিন দিবসেতে গেল নগর মথুরা।।
শত্রুঘ্নের ঠাঁই দূত কহে কাণে কাণে।
যাইবে সকল লোক শ্রীরামের সনে।।
ভরতাদি করিয়া যতেক পুরজন।
শ্রীরামের সঙ্গে স্বর্গে করিবে গমন।।
রামের বর্জ্জনে ছাড়ে লক্ষ্মণ শরীর।
লক্ষ্মণ বিহনে রাম হলেন অস্থির।।
মহারাজ শত্রুঘন না ভাবিহ মনে।
সত্বরে চলহ তুমি রাম-সম্ভাষণে।।
এত শুনি শত্রুঘ্ন করেন হেঁট মাথা।
পাত্র মিত্র আনিয়া কহেন সব কথা।।
সুবাহু পুত্রেরে করে মথুরার রাজা।
সাবধানে পালিতে কহেন সব প্রজা।।
দুই পুত্র প্রতি রাজ্য করি সমর্পণ।
অযোধ্যায় যাত্রা করিলেন শত্রুঘন।।
তিন দিবসেতে আসি অযোধ্যানগরী।
প্রণাম করেন শ্রীরামের পদ ধরি।।
শত্রুঘ্নে দেখিয়া রাম হরষিত মন।
পুনশ্চ রামের পদ বন্দে শত্রুঘন।।
তোমার চরণ বিনা আর নাহি গতি।
স্বর্গবাসে যাব প্রভু তোমার সংহতি।।
যোড়হস্তে শ্রীরামেরে কহে সর্ব্বলোকে।
তোমার প্রসাদে প্রভু স্বর্গে যাব ‍সুখে।।
তোমার মরণে প্রভু সবার মরণ।
তোমার জীবনে আমা সবার জীবন।।
শুনিয়া শ্রীরাম করিলেন অঙ্গীকার।
আমার সহিত চল বাঞ্ছা থাকে যার।।
জীবনের আশা ছাড়ি সবার এ আশ।
শ্রীরামের সঙ্গে গিয়া করি স্বর্গবাস।।
তিন কোটি রাক্ষসে আইল বিভীষণ।
সুগ্রীব অঙ্গদ এল সহ কপিগণ।।
নল নীল আইল সে মন্ত্রী জাম্ববান।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র এল বীর হনুমান।।
আর যত লোক ছিল অযোধ্যানগরে।
যত যত লোক ছিল পৃথিবী ভিতরে।।
স্ত্রী পুরুষ এল সবে অযোধ্যানগরে।
বাল বৃদ্ধ আদি কেহ নাহি রহে ঘরে।।
রামের কিনটে এল সবে শীঘ্রগতি।
যোড় হাত করি সবে রামে করে স্তুতি।।
কতবার দেখিলাম দেব ত্রিলোচন।
কত শত দেখিলাম সিদ্ধ ঋষিগণ।।
গন্ধর্ব্বের গীত শুনিলাম মনোহর।
বিদ্যাধরী নৃত্য করে দেখিনু বিস্তর।।
তোমার বিহনে রাম থাকি কোন্ সুখে।
তোমার পাছেতে মোরা যাব স্বর্গলোকে।।
পৃথিবীর যত লোক যোড় করে হাত।
একে একে সবারে বলেন রঘুনাথ।।
শ্রীরাম বলেন শুন রাজা বিভীষণ।
মম সঙ্গে নহে তব স্বর্গেতে গমন।।
হইয়া লঙ্কার রাজা থাক চারিযুগে।
আর কিছু না বলিও আজি মম আগে।।
শুন বলি তোমারে হে পবন-নন্দন।
মম সঙ্গে নহে তব স্বর্গেতে গমন।।
যাবৎ আমার নাম থাকিবে সংসারে।
চন্দ্র সূর্য্য যতকাল জগতে প্রচারে।।
তাবৎ থাকহ তুমি হইয়া অমর।
তোমার প্রসাদে মুক্ত হয় চরাচর।।
হনুমান বলে নাহি চাহি স্বর্গবাস।
তোমার যে গুণ শুনি এই অভিলাষ।।
শ্রীরাম তোমার নাম হইবে যেখানে।
সেইখানে সুস্থির থাকিব রাত্রিদিনে।।
হনু প্রতি বলেন শ্রীকমল-লোচন।
তুমি আমি এক দেহ করিবা গহণ।।
আমা ভক্ত কপি তুমি পরম সুস্থির।
যেই তুমি সেই আমি একই শরীর।।
ব্রহ্মার বরেতে চারি যুগ চিরজীবী।
আমার বদলে তুমি পালহ পৃথিবীর।।
শুন বলি মহাজ্ঞানী মন্ত্রী জাম্ববান।
চারি যুগে অমর যে ব্রহ্মার কল্যাণ।।
আরবার হউক তব প্রথম যৌবন।
তোমারে জিনিতে নারিবেক কোন জন।।
আরবার আমি যদি হই অবতার।
তোমার সঙ্গেতে দেখা হইবে আমার।।
আর যত মনুষ্য আসুক মোর সনে।
স্বর্গবাসে যাইতে যাহার থাকে মনে।।
দিলেন শ্রীরাম লব কুশে ছত্রদণ্ড।
হাতে হাতে সমর্পেন যত রাজ্যখণ্ড।।
হনুমান জাম্ববান মহেন্দ্র বানর।
লব কুশের সনে দেন করিয়া দোসর।।
বিভীষণে আনি রাম করে সমর্পণ।
লব কুশে রাজা করি করেন গমন।।