৭১. বাল্মীকি কর্ত্তৃক সীতাকে আশ্বাস দান এবং সসৈন্যে রাম লক্ষ্মণাদির পুনর্জ্জীবন লাভ

বাল্মীকি কর্ত্তৃক সীতাকে আশ্বাস দান এবং সসৈন্যে রাম লক্ষ্মণাদির পুনর্জ্জীবন লাভ

চিত্রকূট-পর্ব্বতে বাল্মীকি তপোধন।
দেখিয়া অগ্নির ধূম বিচলিত মন।।
রক্তেতে তর্পণ করে মুনির বিস্ময়।
তর্পণ করেন সব যেন রক্তময়।।
মুনি বলে লব কুশ পাড়িল প্রমাদ।
দেশেতে চলেন মুনি করিয়া বিষাদ।।
ছয় মাসের পথ এল চক্ষুর নিমিষ।
তিন জনে দেখে অগ্নি করিছে প্রবেশ।।
অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়াছে মহামুনি দেখে।
হেনকালে গেল মুনি সীতার সম্মুখে।।
গৃধিনী শকুনি আর শৃগালের রোল।
কল কল ধবনি আর জলের হিল্লোল।।
দেখিয়া সীতার প্রতি জিজ্ঞাসেন মুনি।
প্রমাদ পড়িল কিবা সীতা কহ শুনি।।
জানকী বলেন প্রভু না জানি কারণ।
লব কুশ তোমার করিল মহারণ।।
পড়িলেন তাহাতে রাঘব চারি জন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ শ্রীভরত শত্রুঘন।।
কেমনে কহিব কথা মুখে না আইসে।
পিতৃবধ করিলেক লব আর কুশে।।
এত দিন ভাল ছিনু তোমার প্রসাদে।
ধনুর্ব্বিদ্যা শিখাইলা যে পড়িনু প্রমাদে।।
তুমি শিখাইলে মুনি নানা অস্ত্রশিক্ষা।
ত্রিভুবন যুঝে যদি করো নাহি রক্ষা।।
আপনি শ্রীরঘুনাথ ত্রিভুবন জিনে।
শিশু হয়ে সে রামেরে জিনে দুই জনে।।
রঘুনাথ বিনা মোর না রবে জীবন।
অগ্নিতে প্রবেশ করি এই তিন জন।।
বাল্মীকি বলেন সীতা প্রাণ ত্যজ নাই।
বাঁচিবেন এখনি রাঘব চারি ভাই।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ শ্রীভরত শত্রুঘন।
উঠিবেন পড়িয়াছে তাঁর যত জন।।
ক্ষমা দেহ জানকী তোমারে বলি আমি।
দুই পুত্র লইয়া আশ্রমে যাহ তুমি।।
জানকী বলেন দেখি প্রভুর চরণ।
তবে ত আশ্রমে আমি করিব গমন।।
এতেক শুনিয়া মুনি বসিলেন ধ্যানে।
ত্রিভুবনে যত কথা মুনি সব জানে।।
তপোবনে কুণ্ড আছে মৃত্যুজীবী জল।
মুনি ধ্যান করিয়া জানিল যে সকল।।
মুনি বলে শিষ্য শুন আমার বচনে।
এই জল ছড়াইয়া দেহ তপোবনে।।
মৃত-সৈন্য পড়িয়াছে যত যত দূরে।
ততদূরে ছড়াইয়া দেহ এই নীরে।।
এক মন্ত্রে জল পড়ি দিল মহামুনি।
তপোবনে ছড়াইয়া দিলেন তখনি।।
কটকের গায়েতে যতেক লাগে ছড়া।
অসংখ্য কটক উঠে দিয়া অঙ্গ ঝাড়া।।
মৃত্যুজীবী জল যদি হৈল পরশন।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আদি উঠিল তখন।।
উঠিল ছাপ্পান্ন কোটি মুখ্য-সেনাপতি।
তিন কোটি উঠিলেক মদমত্ত হাতী।।
উঠিল তিরাশী কোটি শ্রেষ্ঠ তেজী ঘোড়া।
সত্তর অক্ষৌহিণী উঠে জাঠি ও ঝগড়া।।
সুগ্রীব অঙ্গদ উঠে লয়ে কপিগণ।
ভল্লুক রাক্ষস যত উঠে ততক্ষণ।।
কটকের কোলাহলে হৈল গণ্ডগোল।
মুনি বলে শুন সীতা কটকের রোল।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আদি যত যত বীর।
উঠে সৈন্য সামন্ত যে অক্ষত শরীর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ শ্রীভরত শত্রুঘন।
দূর হৈতে দেখে সীতা পাইল জীবন।।
রাম জয় করিয়া ডাকিছে কপিগণ।
মুনি বলে শুন সীতা আমার বচন।।
আমি হেথা থাকিলে না হৈত এমন।
দুই পুত্র লৈয়া ঘরে করহ গমন।।
লব কুশ সীতা তিনে মুনি নমস্করি।
লুকাইয়া রহিলেন বাল্মীকির পুরী।।
সীতারে চিনিয়াছিল পবন-নন্দন।
বাল্মীকির মায়াতে পাসরিল তখন।।
শ্রীরামের সঙ্গে মুনি করে সম্ভাষণ।
চারি ভাই করিলেন মুনিরে বন্দন।।
শ্রীরাম বলেন মুনি তোমার প্রসাদে।
রক্ষা পাইলাম সবে পড়িয়া প্রমাদে।।
কিন্তু মুনি জানিতে বাসনা মনে হয়।
কাহার তনয় দুটি দেহ পরিচয়।।
মুনি বলে রাম আমি না ছিলাম দেশে।
কাহার তনয় সেই না জানি বিশেষে।।
এখন সে বালকের না পাবে দর্শন।
দেশে লৈয়া আমি দোঁহে করাব মিলন।।
অশ্ব লৈয়া রঘুনাথ যাও নিজ দেশে।
যজ্ঞে পূর্ণা দেহ গিয়া অশেষ বিশেষে।।
সকলে লইয়া রাম চলিলেন দেশে।
রচিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।