৫৪. বিপ্রপুত্রের অকালমৃত্যু ও পুনজ্জীবন লাভ এবং শ্রীরাম কর্ত্তৃক শূদ্র-তপস্বীর মস্তক ছেদন

বিপ্রপুত্রের অকালমৃত্যু ও পুনজ্জীবন লাভ এবং শ্রীরাম কর্ত্তৃক শূদ্র-তপস্বীর মস্তক ছেদন

অযোধ্যায় রাজা রাম ধর্ম্মেতে তৎপর।
অকাল-মরণ নাই রাজ্যের ভিতর।।
অকস্মাৎ এক বিপ্র আইল কান্দিয়া।
মৃত এক শিশু পুত্র কোলেতে করিয়া।।
পঞ্চ বৎসরের মৃত পুত্র তার কোলে।
শ্রীরামের দ্বারে আসি কান্দে উচ্চরোলে।।
ধর্ম্মের সংসার মোর পাপ নাহি করি।
অকস্মাৎ পুত্রশোকে কেন পুড়ে মরি।।
না করেন রাজ্যচর্চ্চা রাম রঘুবর।
ব্রহ্মাশাপ দিব আজি রামের উপর।।
কি পাপে মরিল পুত্র কিছুই না জানি।
পুত্র কোলে করি কান্দে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।।
বৃথা গর্ভে ধরি পুত্র পঞ্চ বর্ষ পুষি।
অকালে মরিল পুত্র রামরাজ্য বসি।।
পিতা মাতা রাখি পুত্র ছাড়ি গেল কোথা।
কোন্ দোষে মৈল পুত্র প্রাণে দিয়া ব্যথা।।
অধর্ম্মীর রাজ্যে হয় দুর্ভিক্ষ মড়ক।
কর্ম্মদোষে সেই রাজা ভুঞ্জয়ে নরক।।
অকালেতে মরে পুত্র শ্রীরামের রাজ্যে।
নহে অন্যদেশে যাব এই রাজ্য ত্যজে।।
এত বলি স্ত্রী পুরুষে ভাসে অশ্রুনীরে।
লক্ষ্মণ সত্বর যান রামের গোচরে।।
অকস্মাৎ প্রমাদ পড়িল রঘুমণি।
মৃতপুত্র লয়ে আইল ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী।।
বয়সেতে বৃদ্ধ দোঁহে, পুত্র নাহি আর।
ক্রন্দনেতে ব্যাকুল করিছে রাজদ্বার।।
দ্বিজ বলে পাপ নাহি আমার শরীরে।
তবে অকালেতে মোর পুত্র কেন মরে।।
এত বলি স্ত্রী পুরুষে করয়ে রোদন।
শুনিয়া শ্রীরাম হৈল বিরস বদন।।
ত্রাস পাইলা রঘুনাথ শুনিয়া বচন।
অকালেতে দ্বিজ পুত্র মরে কি কারণ।।
পাত্র মিত্র সভাসদ করে হাহাকার।
রামের আজ্ঞাতে সবে হৈল আগুসার।।
আইল বশিষ্ঠ-মুনি কুল-পুরোহিত।
কশ্যপ নারদ আদি হৈল উপনীত।।
পাত্র মিত্র লয়ে রাম বসিলা দেওয়ানে।
ব্রাহ্মণের কথা রাম কহে সভাস্থানে।।
তোমা সবে লয়ে আমি করি রাজ-কাজ।
অকালে ব্রাহ্মণ মরে পাই বড় লাজ।।
শুনিয়া রামের কথা সকলে নীরব।
শ্রীরামের পানে চাহি কহেন নারদ।।
মুনি বলে রঘুনাথ শাস্ত্রের বিচার।
সত্যযুগে তপস্যা দ্বিজের অধিকার।।
ত্রেতাযুগে তপস্যা ক্ষত্রিয়-অধিকার।
দ্বাপরেতে তপ করে বৈশ্যের বিচার।।
কলিযুগে তপস্যা করিবে শূদ্রজাতি।
তপস্যার নীতি এই শুন রঘুপতি।।
অকালে অনধিকারে শূদ্র তপ করে।
সেই রাজ্যে অকালেতে দ্বিজ-পুত্র মরে।।
কলিকালে শূদ্র আর পতিহীনা নারী।
তপস্যা করিলে সৃষ্টি নাশিবারে পারি।।
অকালে করিলে তপ ঘটায় উৎপাত।
অকাল-মরণ রীতি শুন রঘুনাথ।।
না মরে তোমার পাপে দ্বিজের কুমার।
তপস্যা করিছে কোথা শূদ্র দুরাচার।।
এই হেতু মিথ্যা দোষী করয়ে তোমাকে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী দ্বারে কান্দে পুত্রশোকে।।
নারদের বচন রামের লয় মনে।
ডাক দিয়া সভামধ্যে আনেন লক্ষ্মণে।।
পাত্র মিত্র লয়ে ভাই বৈসহ বিচারে।
প্রিয়বাক্যে ব্রাহ্মনেরে রাখহ দুয়ারে।।
যাবৎ না আসি আমি করিয়া বিচার।
তাবৎ রাখিও দ্বিজে না ছাড়িহ দ্বার।।
নারায়ণ-তৈলে ফেলি রাখ দ্বিজসুতে।
দেহ তার নষ্ট যেন না হয় কোনমতে।।
এত বলি কৈলা রাম রথে আরোহণ।
পশ্চিম দিকেতে রাম করিলা গমন।।
পশ্চিমের যত দেশ করিয়া বিচার।
উত্তর দিকেতে রাম কৈলা আগুসার।।
উত্তরের যত দেশ করি অন্বেষণ।
পূর্ব্বদিকে রঘুনাথ করেন গমন।।
পূর্ব্বদিক বিচারিয়া গেলেন দক্ষিণে।
এক শূদ্র তপ করে মহাঘোর বনে।।
করয়ে কঠোর তপ বড়ই দুষ্কর।
অধোমুখে ঊর্দ্ধপদে আছে নিরন্তর।।
বিপরীত অগ্নিকুণ্ড জ্বলিছে সম্মুখে।
ব্যাপিল বহ্নির ধূম সুবর্ণ নাশিকে।।
দেখিয়া কঠোর তপ শ্রীরামের ত্রাস।
ধন্য ধন্য বলি রাম যান তার পাশ।।
জিজ্ঞাসা করেন তারে কমল-লোচন।
কোন্ জাতি তপ কর কোন প্রয়োজন।।
তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি।
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্ল্লভ সংসারে।
তপস্যার ফলে যাব বৈকুণ্ঠ-নগরে।।
তপস্বীর বাক্যে কোপে কাঁপে রাম-তুণ্ড।
খড়্গ হাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড।।
সাধু সাধু শব্দ করে যত দেবগণ।
রামের উপরে করে পুষ্প বরিষণ।।
ব্রহ্মা বলিলেন, রাম কৈলে বড় কাজ।
শূদ্র হয়ে তপ করে পাই বড় লাজ।।
রামে তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা কহেন তখন।
মনোনীত বর মাগি লহ যে এখন।।
শ্রীরাম বলেন যদি দিবে বরদান।
তব বরে জীয়ে যেন ব্রাহ্মণ সন্তান।।
ব্রহ্মা বলে এ বর না চাহ রঘুমণি।
শূদ্র কাটা গেল, দ্বিজ বাঁচিল আপনি।।
আপনা বিস্মৃত তুমি দেব নারায়ণ।
মারিয়া বাঁচাতে পার এ তিন ভুবন।।
দৃষ্টে সৃষ্টিনাশ কর নিমিষে সৃজন।
তোমার আশ্চর্য্য মায়া বুঝে কোন জন।।
এত বলি বিরিঞ্চি হৈলেন অন্তর্দ্ধান।
শুনিয়া রামের অতি হরষিত মন।।
এখানে বাঁচিয়া উঠে দ্বিজের কুমার।
দেখি সভাসদ লোকে লাগ চমৎকার।।
ভরত লক্ষ্মণে কহি দ্বিজ গেল ঘর।
রঘুনাথে আশীর্ব্বাদ করিয়া বিস্তর।।
হইল রামের হাতে তপস্বী বিনাশ।
স্বর্গ-বিমানেতে চড়ি গেল স্বর্গবাস।।
ব্রহ্মার বচন শুনি শ্রীরামের হাস।
রচিল উত্তরকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।