২১. কবন্ধ এবং শবরীর স্বর্গগমন

রজনী আইল, স্থান থাকিবার নাই।
শূন্যঘরে পুনঃ আইলেন দুই ভাই।।
বাহিরে ছিলেন রাম বরঞ্চ আশ্বস্ত।
শূন্যঘর দেখি হইলেন আরো ব্যস্ত।।
শ্রীরাম বলেন শুন ভাই রে লক্ষ্মণ।
গোদাবরী সলিলেতে ত্যজিব জীবন।।
এতেক বলিয়া লক্ষ্মণেরে করি কোলে।
গাঁথিল মুক্তার হার নয়নের জলে।।
রজনীতে নিদ্রা নাহি, ঘন বহে শ্বাস।
সে ঘরে করেন রাম তিন উপবাস।।
সীতার বিচ্ছেদে রাম যে পাইল ক্লেশ।
বিশেষ লিখিতে গেলে হয় সে অশেষ।।
রজনী প্রভাত হয় উদিত অরুণ।
সীতার উদ্দেশে রাম চলেন দক্ষিণ।।
ঘর ছাড়ি যান রাম দুই ক্রোশ পথে।
প্রবেশেন দুই ভাই কুশের বনেতে।।
সিংহ ব্যাঘ্র মহিষাদি চরে পালে পালে।
দুই ভাই বসিলেন এক বৃক্ষতলে।।
বুদ্ধিতে বিক্রমে বড় চতুর লক্ষ্মণ।
রামেরে বলেন কিছু প্রবোধ-বচন।।
কেন ভাই হয় হস্ত লোচন স্পন্দন।
বামদিকে করিতেছে খঞ্জন গমন।।
বিষম কুশের বন দেখি হয় ভয়।
নানা অমঙ্গল দেখি, না জানি কি হয়।।
দুই ভাই করেন চলিতে অনুবন্ধ।
পথ আশুলিয়া রাখে রাক্ষস কবন্ধ।।
পেটের ভিতর নাক কাণ চক্ষু মাথা।
শতেক যোজন দীর্ঘ, অপূর্ব্ব সে কথা।।
রাম লক্ষ্মণেরে দেখি করিয়া তর্জ্জন।
দুই হাত প্রসারিয়া রাখে দুই জন।।
কবন্ধ বলিল, তোরা আমার আহার।
মোর হাতে পড়িলি কি পাইবি নিস্তার।।
এ বিষম বনে তোরা এলি কি কারণ।
পরিচয় দেহ, শুনি তোরা কোন্ জন।।
শ্রীরাম বলেন, ভাই হইল সংশয়।
প্রাণ রক্ষা কর ভাই দেহ পরিচয়।।
লক্ষ্মণ বলেন, ভাই বুদ্ধ কেন ঘাটি।
রাক্ষসের দুই হাত দুই ভাই কাটি।।
কবন্ধের ডান হাত কাটেন শ্রীরাম।
খড়্গাঘাতে লক্ষ্মণ কাটেন হস্ত বাম।।
দুই ভাই কটিলেন তার হস্ত দুটি।
পড়িয়া কবন্ধ বীর করে ছটফটি।।
ডাক দিয়া রামেরে সে করে সম্ভাষণ।
কোন্ দেশে বৈস তুমি হও কোন্ জন।।
লক্ষ্মণ বলেন, রাম জগতের রাজা।
রাজা দশরথের পুত্র সবে করে পূজা।।
শ্রীরামের ভাই আমি নামেতে লক্ষ্মণ।
পিতৃসত্য পালিতে বেড়াই বনে বন।।
তুমি কোন্ নিশাচর বিকৃতি আকৃতি।
বনের ভিতর থাক হও কোন্ জাতি।।
এত যদি লক্ষ্মণ করেন সম্ভাষণ।
পূর্ব্বকথা কবন্ধের হইল স্মরণ।।
কুবের নামেতে দৈত্য ছিলাম সুন্দর।
কন্দর্প জিনিয়া রূপ যেন নিশাকর।।
সকল দেবতা নিন্দা করি নিজ রূপে।
ক্রোধে মুনিবর মোরে শাপ দিল কোপে।।
যেমন রূপের তেজে কর উপহাস।
বিরূপ হউক সব, রূপ যাউক নাশ।।
যখন হবেন বিষ্ণু রাম -অবতার।
তাঁর বাণস্পর্শ তোর হইবে নিস্তার।।
আমার উপরে ক্রুদ্ধ দেব শচীনাথ।
করিলেন আমার শরীরে বজ্রাঘাত।।
বজ্রাঘাত প্রবেশিল আমার উদরে।
চক্ষু কর্ণ ঘ্রাণ পদ না রহে বাহিরে।।
গতিশক্তি নাহি, কিসে মিলিবেক ভক্ষ্য।
তেঁই মম দুই হস্ত দীর্ঘে দুই লক্ষ।।
দুই হস্ত মোর যেন দুইটা পর্ব্বত।
দুই হস্তে যুড়ি আমি বহুদূর পথ।।
দুই প্রহরের পথে যত বনচর।
দুই হাতে সাপটিয়া ভরি হে উদর।।
কুৎসিত আমার মোর, কুৎসিত ভোজন।
তোমা দরশনে মোর শাপ বিমোচন।।
তব কিছু হিত করি যাই ইন্দ্রবাস।
কেন রাম বনে ভ্রম, কোন্ অভিলাষ।।
শ্রীরাম বলেন, সীতা হরিল রাবণ।
যুক্তি কর, কেমনে পাইব দরশন।।
কবন্ধ বলিল রাম কহি উপদেশ।
যাহা হৈতে পাবে তুমি সীতার উদ্দেশ।।
যাবৎ আমার তনু না হয় সংহার।
তাবৎ যা দেখি কিছু সব অন্ধকার।।
রাক্ষস শরীর গেলে পাব অব্যাহতি।
তবে ত বলিতে পারি ইহার যুকতি।।
তখন লক্ষ্মণ বীর অগ্নিকুণ্ড কাটি।
কবন্ধেরে দহিলেন করি পরিপাটি।।
শরীর পুড়িয়া তার হইল অঙ্গার।
অগ্নি হৈতে উঠে বীর অদ্ভুত আকার।।
আকাশে উঠিয়া করে রাম-সম্ভাষণ।
দেবমূর্ত্তি সে পুরুষ, দ্বিতীয় তপন।।
পুরুষ বলেন, শুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
সাবধান হয়ে শুন আমার বচন।।
সুগ্রীবের উদ্দেশ করিও ঋষ্যমূকে।
আজ্ঞা কর রামচন্দ্র, যাই স্বর্গলোকে।।
রাম-দরশনে কবন্ধের স্বর্গবাস।
কুশের বনেতে রাম করেন প্রবাস।।
প্রভাত হেইল নিশা, উদিত মিহির।
চলিলেন দুই ভাই পম্পানদী-তীর।।
কেলি করে নানা পক্ষী পক্ষিণী সহিত।
দেখিলেন মৃগ মৃগী বিচ্ছেদ বঞ্চিত।।
রাজহংস রাজহংসী ক্রীড়া করে জলে।
দেখিয়া রামের শোক-সাগর উথলে।।
জিজ্ঞাসা করেন রাম, ওহে মৃগ পাখী।
দেখিয়াছ তোমরা আমার চন্দ্রমুখী।।
পম্পাতে করিয়া স্নান করিয়া তর্পণ।
সুগ্রীব উদ্দেশে রাম করেন গমন।।
প্রবেশ করেন রাম মতঙ্গ-আশ্রমে।
তথায় শবরী ছিল দেখিল শ্রীরামে।।
চক্ষেতে আনন্দবারি ধরিতে না পারে।
শ্রীরামের প্রতি বলে আজ্ঞা অনুসারে।।
মতঙ্গ মুনির সেবা করি বহুকাল।
বৈকুণ্ঠ গেলেন মুনি হয়ে প্রাপ্তকাল।।
কহিলেন, আমার আশ্রমে কর স্থিতি।
আসিবেন এখানে অবশ্য রঘুপতি।।
শববী যখন পাবে রাম-দরশন।
তখনি হইবে তব পাপ বিমোচন।।
রাম রাম শ্রীরাম রাঘব রঘুপতি।
হইয়া প্রসন্ন এ দাসীরে দেহ গতি।।
শবরী রামের আগে অগ্নিকুণ্ড কাটে।
আনিয়া জ্বালিল অগ্নি নানা শুষ্ককাঠে।।
করে অগ্নি প্রবেশ স্মরিয়া নারায়ণ।
তাহার চরিতে রাম চমকিত মন।।
অগ্নিতে পুড়িয়া তনু হইল অঙ্গার।
তাহার ভাগ্যের কথা কহিতে বিস্তার।।
যাঁহার স্মরণ মাত্রে মুক্তি সঙ্গে ধায়।
তাঁহার সম্মুখে দেখি ত্যজিল সে কায়।।
শ্রীরাম-প্রসাদে তার হয় পাপ নাশ।
অনায়াসে শবরী করিল স্বর্গবাস।।
শ্রীরাম-চরিত্র কথা অমৃতের ভাণ্ড।
এত দূরে সমাপ্ত হইল অরণ্যকাণ্ড।।