১৯. সীতার অন্বেষণে পূর্ব্বদিকে বানর সৈন্য প্রেরণ

শ্রীরাম বলেন, মিতা সৈন্য নানা দেশে।
পাঠাইয়া দেহ শীঘ্র সীতার উদ্দেশে।।
তুমি যদি জানকীর করহ উদ্ধার।
তবে ত আমার ঠাঁই সত্যে হও পার।।
শ্রীরামের ঠাঁই রাজা লয়ে অনুমতি।
নানাদিকে পাঠাইল সৈন্য সেনাপতি।।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ কপি ওর নাহি পাই।
পর্ব্বতের উপরে বসিতে নাই ঠাঁই।।
সুগ্রীব বিনোদ সেনাপতি প্রতি ভণে।
পূর্ব্বদিকে যাও তুমি সীতা অন্বেষণে।।
বানর সহস্র কোটি তোমার ভিড়ন।
সীতা অন্বেষিতে তুমি করহ গমন।।
নদ নদী মিলিবে, মিলিবে কত দেশ।
যেই সেই স্থানে গিয়া করিবে প্রবেশ।।
যত যত পুণ্যদেশ দেখ পুণ্য স্থান।
সকল বানর লইয়া করিবে পয়ান।।
স্বর্গ হৈতে গঙ্গাকে আনিল ভগীরথে।
গঙ্গাদেবী পার হইও কটক সহিতে।।
তরিহ সরযূ-নদী পুণ্যতরঙ্গিণী।
কৌশিকী তরিহ বিশ্বামিত্রের ভগিনী।।
দুই কূলে গরু চরে, মধ্যেতে গোমতী।
গোমতী হইয়া পার পাবে সরস্বতী।।
অপূর্ব্ব মলয় দেশ, দেশ কোকনদ।
কশ্যপের দেশে যাও পাণ্ডব মগধ।।
ব্রহ্মপুত্র তরি রঙ্গে করিহ প্রবেশ।
মন্দর পর্ব্বতে যাইও কিরাতের দেশ।।
যাইবে কর্ণাট দেশ আর শাকদ্বীপে।
কিরাত জাতিরা আছে অত্যদ্ভুত রূপে।।
কনক চাঁপার মত শরীরের বর্ণ।
উঠান থানার মত ধরে দুই কর্ণ।।
থালা কেন মুখখান, তাম্রবর্ণ ক্শে।
এক পায়ে চলে পথ বলেতে বিশেষ।।
জলের ভিতরে বৈসে মৎস্যবৎ মুখ।
মানুষ ধরিয়া খায়, আইলে সম্মুখ।।
বলিয়া মানুষ-ব্যাঘ্র তাহাদের খ্যাতি।
আতপ সহিতে নারে কিরাতের জাতি।।
সীতা লৈয়া থাকে যদি কিরাতের ঘরে।
যত্ন করি চাহিও তথায় লঙ্কেশ্বরে।।
ঋষভ পর্ব্বতে যাইও কিরাতের পার।
দেবগণ করে কেলি নিত্য অবতার।।
সর্ব্বকালে আইসে তথায় পুরন্দরে।
যত্ন করি চাইও তথা সীতা লঙ্কেশ্বরে।।
তার পূর্ব্বদিকে যাইও ক্ষীরোদসাগর।
শ্বেতগিরি দেখিবা সে ক্ষীরোদ উপর।।
শ্বেত নাগ ধরে তথা সহস্র শিখর।
সহস্রেক ফণায় আছে যেন মহেশ্বর।।
সহস্রেক ফণায় আছে সহস্রেক মণি।
মণির আলোকে তুল্য দিবস রজনী।।
ক্ষীরোদ-সাগর করে পৃথিবী ধবল।
শ্বেতগিরি শ্বেত করে গগনমণ্ডল।।
শ্বেত নাগ ধরে শিবে সহস্রেক ফণা।
পূর্ব্বদিক ধন্য করে সেই তিন জনা।।
সকলে বন্দিবে সে অনন্ত মহারাজ।
মহেশ্বর বন্দি গেলে সিদ্ধ হবে কাজ।।
উভয় পর্ব্বতে যাইও তার পূর্ব্বদিকে।
স্বর্ণ তালবৃক্ষ তথা আছে চারি যুগি।।
মণি মাণিক্যেতে বান্ধিয়াছে তার গুঁড়ি।
কনক-রচিত তার শোভিত বাগুড়ি।।
দেখিও বানরগণ শিখরে শিখর।
অন্বেষণ কর তথা সীতা লঙ্কেশ্বর।।
তথা যদি নাহি পাও তাহার উদ্দেশ।
কালোদর পর্ব্বতেতে করিহ প্রবেশ।।
সে পর্ব্বতে আছে সরোবরে কালো জল।
তিন কোটি সর্পী সর্প থাকে সেই স্থল।।
সর্পী যদি হাই ছাড়ে, সর্ব্বলোক মরে।
তার কাছে দেব দৈত্য নাহি যায় ডরে।।
নদ নদী গিরি গুহা খুঁজহ বিস্তর।
সেখানে মিলিতে পারে দুষ্ট লঙ্কেশ্বর।।
তথা যদি নাহি পাও তাহার উদ্দেশ।
লোহিত পর্ব্বতে গিয়া করিহ প্রবেশ।।
সে পর্ব্বতে আছে এক বড় চমৎকার।
ত্রিযোজন নদী, তাহে বিষম পাথার।।
তার পূর্ব্বদিকে আছে লোহিত সাগর।
দুরন্ত রাক্ষস আছে জলের ভিতর।।
অগাধ সলিল তার রক্তবর্ণ ধরে।
চারিযুগ এক বৃক্ষ আছে তার তীরে।।
সোণার শিমূলগাছ, সর্ব্ব গায়ে কাঁটা।
সুবর্ণের ফল ফুল ধরে গোটা গোটা।।
জল হৈতে রাক্ষসেরা চড়ে তদুপরে।
তার কাছে দেবগণ নাহি যায় ডরে।।
তথা যদি জানকীর না পাও উদ্দেশ।
পূর্ব্ব সাগরের তীরে করিহ প্রবেশ।।
আড়ে দীর্ঘে সে সাগর দ্বাদশ যোজন।
সাবধানে পার হইও যত কপিগণ।।
উদয় গিরির অঙ্গ সর্ব্ব স্বর্ণময়।
পৃথিবী উজ্জ্বল করে সূর্য্যের উদয়।।
তিন লক্ষ দুই শত যোজনের পথ।
চক্ষুর নিমিষে সূর্য্য করে গতায়াত।।
মুনিগণ তপ করে যেমন বিধান।
বালখিল্য নামে মুনি বিঘত প্রমাণ।।
উদয়গিরির পূর্ব্ব নাহি সূর্য্যোদয়।
অন্ধকারময় দেশ জানিহ নিশ্চয়।।
সে দেশ কখন নহে আমার গোচর।
দেখিয়া উদয়গিরি ফিরিবে বানর।।
যাইতে উদয়গিরি লাগে এক মাস।
মাসেকের বাড়া হৈলে সবার বিনাশ।।
মাসেকের মধ্যে যে বানর না আইসে।
সবংশে মরিবে সেই আপনার দোষে।।
বানরকটক সুগ্রীবের আজ্ঞা পায়।
সীতার উদ্দেশে তারা পূর্ব্বদিকে যায়।।
কৃত্তিবাস কবির কবিত্বময় বাণী।
অদ্ভূত রচিল পূর্ব্বদিকের পাঁচনি।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত মুরারি ওঝার নাতি।
যাঁর কণ্ঠে বিরাজ করেন সরস্বতী।।