১৮. শ্রীরাচন্দ্রের বিলাপ ও সীতার অন্বেষণ

হাতে ধনুর্ব্বাণ রাম আইসেন ঘরে।
পথে অমঙ্গল যত দেখেন গোচরে।।
বামে সর্প দেখিলেন, শৃগাল দক্ষিণে।
তোলাপাড়া করেন শ্রীরাম কত মনে।।
বিপরীত ধ্বনি করিলেক নিশাচর।
লক্ষ্মণ আইসে পাছে শূন্য রাখি ঘর।।
মারীচের আহ্বানে কি লক্ষ্মণ ভুলিবে।
সীতারে রাখিয়া একা অন্যত্র যাইবে।।
দুঃখের উপরে দুঃখ দিবে কি বিধাতা।
যা ছিল কপালে তাহা দিলেন বিমাতা।।
বলেন শ্রীরাম, শুন সকল দেবতা।
আজিকার দিন মোর রক্ষা কর সীতা।।
যেমন চিন্তেন বাম, ঘটিল তেমন।
আসিতে দেখেন পথে সম্মুখে লক্ষ্মণ।।
লক্ষ্মণেরে দেখিয়া বিস্ময় মনে মানি।
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন মঘুমণি।।
কেন ভাই আসিতেছ তুমি যে একাকী।
শূন্যঘরে জানকীরে একাকিনী রাখি।।
প্রমাদ পাড়িল বুঝি রাক্ষস পাতকী।
জ্ঞান হয় ভাই, হারাইলাম জানকী।।
আইলাম তোমায় করিয়া সমর্পণ।
রাখিয়া আইলে কোথা মম স্থাপ্যধন।।
মম বাক্য অন্যথা করিলে কেন ভাই।
আর বুঝি সীতার সাক্ষাৎ নাহি পাই।।
কি হইল লক্ষ্মণ, কি হইল আমারে।
যে দুঃখে দুঃখিত আমি কহিব কাহারে।।
শুন রে লক্ষ্মণ সেই সোণার পুতলি।
শূন্যঘরে রাখিয়া কাহারে দিলে ডালি।।
দুরন্ত দণ্ডকারণ্য মহা ভয়ঙ্কর।
হিংষ্র জন্তু কত মত, কত নিশাচর।।
কোন্ দণ্ডে কোন্ দুষ্ট পাড়িবে প্রমাদ।
কি জানি রাক্ষসগণে সাধিবেক বাদ।।
এই বনে কত দুষ্ট রাক্ষসের থানা।
মুনিগণ সকলে করেন সদা মানা।।
পূর্ব্বাপর লক্ষ্মণ তোমারে আছে জানা।
তথাপি লক্ষ্মণ বিবেচনা করিলে না।।
তোমারে কি দিব দোষ, মম কর্ম্মফল।
যেমন বিধির লিপি, ঘটিবে সকল।।
আমারে অধিক ভাই তব বুদ্ধি বল।
কর্ম্মযোগে হেন বুদ্ধি গেল রসাতলে।।
মায়ামৃগ ছলে আমা লইল কাননে।
হের, সেই রাক্ষস পড়েছে মম বাণে।।
ভয়ঙ্কর বিকট মুষল ডানি হাতে।
হের ভাই, মারীচ পড়িয়া আছে পথে।।
এই মত কহিতে কহিতে দুই ভাই।
বায়ুবেগে চলিলেন, অন্য জ্ঞান নাই।।
উপনীত হইলেন কুটীরের দ্বারে।
সীতা সীতা বলিয়া ডাকেন বারে বারে।।
শূন্যঘর দেখেন, না দেখেন জানকী।
মূর্চ্ছাপন্ন অবসন্ন শ্রীরাম ধানুকী।।
শ্রীরাম বলেন ভাই, একি চমৎকার।
সীতা না দেখিলে প্রাণ না রাখিব আর।।
তখনি বলিনু ভাই সীতা নাই ঘরে।
শূন্যঘর পাইয়া হরিল কোন্ চোরে।।
প্রতি বন প্রতি স্থান প্রতি তরুমূল।
দেখেন সর্ব্বত্র রাম হইয়া ব্যাকুল।।
পাতি পাতি করিয়া চাহেন দুই বীর।
উলটি পালটি যত গোদাবরী-তীর।।
গিরিগুহা দেখেন মুনির তপোবন।
নানা স্থানে সীতারে করেন অন্বেষণ।।
একবার যেখানে করেন অন্বেষণ।
পুনর্ব্বার যান তথা সীতার কারণ।।
এইরূপে এক স্থানে যান শতবার।
তথাপি না পান দেখা শ্রীরাম সীতার।।
কান্দিয়া বিকল রাম, জলে ভাসে আঁখি।
রামের ক্রন্দনে কান্দে বন্য পশু পাখী।।
রামের আশ্রমে আসি যত মুনিগণ।
রামেরে কহেন কত প্রবোধ বচন।।
উপদেশ-বাক্য নাহি মানেন শ্রীরাম।
সদা মনে পড়ে সে সীতার গুণগ্রাম।।
সীতা সীতা বলিয়া পড়েন ভূমিতলে।
করেন লক্ষ্মণ বীর শ্রীরামেরে কোলে।।
রঘুবীর নহে স্থির জানকীর শোকে।
হাহাকার বার বার করে দেবলোকে।।
বিলাপ করেন রাম লক্ষ্মণের আগে।
ভুলিতে না পারি সীতা সদা মনে জাগে।।
কি করিব, কোথা যাব অনুজ লক্ষ্মণ।
কোথা গেলে সীতা পাব কর নিরূপণ।।
মন বুঝিবারে বুঝি আমার জানকী।
লুকাইয়া আছেন, লক্ষ্মণ দেখ দেখি।।
বুঝি কোন মুনিপত্নী সহিত কোথায়।
গেলেন জানকী না জানাইয়া আমায়।।
গোদাবরী-তীরে আছে কমল-কানন।
তথা কি কমলমুখী করিছে ভ্রমণ।।
পদ্মালয়া পদ্মমুখী সীতারে পাইয়া।
রাখিলেন বুঝি পদ্মবনে লুকাইয়া।।
চিরদিন পিপাসিত করিয়া প্রয়াস।
চন্দ্রকলা ভ্রমে রাহু করিল কি গ্রাস।।
রাজ্যচ্যুত আমাকে দেখিয়া চিন্তান্বিতা।
হরিলেন পৃথিবী কি আপন দুহিতা।।
রাজ্যহীন যদ্যপি হয়েছি আমি বটে।
রাজলক্ষ্মী তথাপি ছিলেন সন্নিকটে।।
আমার যে রাজলক্ষ্মী হারাইলাম বনে।
কৈকেয়ীর মনোভীষ্ট সিদ্ধ এত দিনে।।
সৌদামিনী যেমন লুকায় জলধরে।
লুকাইল তেমন জানকী বনান্তরে।।
কনকলতার প্রায় জনক-দুহিতা।
বনে ছিল, কে করিল তারে উৎপাটিতা।।
দিবাকর নিশাকর দীপ্ত তারাগণ।
দিবানিশি করিতেছে তব নিবারণ।।
তারা না হরিতে পারে তিমির আমার।
এক সীতা বিহনে সকল অন্ধকার।।
দশদিক শূন্য দেখি সীতা অদর্শনে।
সীতা বিনা অন্য কিছু নাহি লয় মনে।।
সীতা ধ্যান, সীতা জ্ঞান, সীতা চিন্তামণি।
সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী।।
দেখ রে লক্ষ্মণ তাই, কর অন্বেষণ।
সীতারে আনিয়া দেহ বাঁচাও জীবন।।
আমি জানি পঞ্চচটী তুমি পুণ্যস্থান।
তেঁই সে এখানে করিলাম অবস্থান।।
তাহার উচিত ফল দিলে হে আমারে।
শূন্য দেখি তপোবন, সীতা নাই ঘরে।।
শুন পশু মৃগ পক্ষী শুন বৃক্ষলতা।
কে হরিল আমার সে চন্দ্রমুখী সীতা।।
কান্দিয়া কান্দিয়া রাম ভ্রমেন কানন।
দেখিলেন পথিমধ্যে সীতার ভূষণ।।
দেখিলেন পড়ে আছে ভগ্ন রথ-চাকা।
কনক-রচিত, কাছে পতিত পতাকা।।
রথচূড়া পড়িয়াছে, আর তার জাঠি।
মণি মুক্তা পড়িয়াছে সুবর্ণের কাঁঠি।।
শ্রীরাম বলেন, দেখ ভাই রে লক্ষ্মণ।
এইখানে সীতারে করহ অন্বেষণ।।
সম্মুখে পর্ব্বত বড় অতি উচ্চ দেখি।
লুকাইয়া রাখিল পর্ব্বত চন্দ্রমুখী।।
যমদণ্ড সম আমি ধরি ধনুর্ব্বাণ।
পর্ব্বত কাটিয়া আজি করি খান খান।।
মহাযুদ্ধ হইয়াচে করিঅনুমান।
লক্ষ্মণ লক্ষণ তার, দেখ বিদ্যমান।।
লক্ষ্মণ বলেন, ইহা নহে কোনমতে।
সীতা কেন রহিবেন এ ঘোর পর্ব্বতে।।
পর্ব্বত কাটিতে প্রভু চাহ অকারণ।
সীতা লয়ে অন্তরীক্ষে গেল কোন্ জন।।
নানামতে শ্রীরামের বুঝান লক্ষ্মণ।
শোকাকুল শ্রীরাম না মানেন বচন।।
ধনুকে দিলেন গুণ, সর্প যেন গর্জ্জে।
বলেন দহিব বিশ্ব, আছে কোন্ কার্য্যে।।
বিশ্ব পুড়াইতে রাম করেন সন্ধান।
দক্ষযজ্ঞ বিনাশে যেমন মহেশান।।
লক্ষ্মণ চরণে ধরি করেন মিনতি।
এক কথা অবধান কর রঘুপতি।।
সৃষ্টিকর্তা ‍সৃষ্টি করিলেন চরাচর।
কেন সৃষ্টি নষ্ট কর দেব রঘুবর।।
সবংশে মরিবে যে হইবে অপরাধী।
অপরাধ একের অন্যকে কেন বধি।।
তোমার বাণেতে কার নাহিক নিস্তার।
অকারণে কেন প্রভু পোড়াও সংসার।।
কোথায় আছেন সীতা করহ বিচার।
দুই ভাই অন্বেষণ করিব সীতার।।
গ্রাম আর তপোবন পর্ব্বত শিখর।
নদ নদী দেখি আর দীঘি সরোবর।।
তবে যদি সীতার না পাই দরশন।
পশ্চাৎ করিহ চেষ্টা যেবা লয় মন।।
শুনি অস্ত্র সম্বরিয়া রাখিলেন তূণে।
সীতার উদ্দেশে চলিলেন দুই জনে।।
ক্ষণেক উঠেন রাম, বৈসেন ক্ষণেক।
যেমন উন্মত্ত রাম বলেন অনেক।।
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে করেন উদ্দেশ।
বনে বনে ভ্রমিয়া অনেক পান ক্লেশ।।
যাইতে দেখেন যাকে, জিজ্ঞাসেন তাকে।
দেখিয়াছ তোমরা কি এ পথে সীতাকে।।
ওহে গিরি এ সময়ে কর উপকার।
কহিয়া বাঁচাও জানকীর সমাচার।।
হে অরণ্য তুমি ধন্য বন্য বৃক্ষগণ।
কহিয়া সীতার কথা রাখহ জীবন।।