০১৭. ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে শ্রীরাম লক্ষ্মণের নাগপাশে বন্ধন

অঙ্গদেগর ভৎসনে ক্রোধিত দশমুখ।
অসম্মান লজ্জায় হইল অধোমুখ।।
বহু কোটি সেনাপতি তাহার প্রধান।
যুঝিবারে সবাকারে করে সম্বিধান।।
সপ্ত স্বর্গ জিনিলাম সপ্ত যে পাতাল।
মম ডরে দেবগণ কাঁপে সদাকাল।।
ইন্দ্র যম সূর্য্য মম ডরে নাহি আঁটে।
এত দূরে আসিয়া বানর বেটা ঠাটে।।
ইন্দ্রজিৎ বলি তোরে সবার প্রধান।
রাম-লক্ষ্মণেরে মারি রাখহ সম্মান।।
হস্তী ঘোড়া ঠাট আদি লহ ত অপার।
আজিকার যুদ্ধে মার তার চারি দ্বার।।
সাবধান হয়ে বাপু কর গিয়া রণ।
আগে মার অঙ্গদেরে শেষে অন্য জন।।
বাপের দুলাল বেটা বীর মেঘনাদ।
সর্ব্বাঙ্গ ভরিয়া পরে রাজার প্রসাদ।।
সাজিল যে মেঘনাদ বাপের আরতি।
লেখা জোখা নাহি তার সাজে সেনাপতি।।
সারথি আনিল রথ সংগ্রামে গমন।
মনোহর রথখান করিল সাজন।।
কনক রচিত রথ বিচিত্র নির্ম্মাণ।
বায়ুবেগে অষ্ট ঘোড়া রথের যোগান।।
পার্ব্বতীয় ঘোড়া মুখে হীরার বিম্বকী।
ক্ষণে রথখানি দেখি ক্ষণে হয় লুকি।।
স্বর্ণ রৌপ্য সাজে রথ করে ঝিকিমিকি।
অষ্ট অক্ষৌহিণী ঠাট যুঝায় ধানুকী।।
দশ কোটি হাতী চলে বিশ কোটি ঘোড়া।
পঁচাশীতি কোটি চলে শেল আর ঝকড়া।।
নানামত রথ লয়ে যোগায় সারথি।
নানা অস্ত্র লয়ে চলে সব যোদ্ধৃপতি।।
পিতৃপ্রদক্ষিণ করি রথে গিয়া চড়ে।
বিংশতি যোজন পথ সৈন্য আড়ে যোড়ে।।
কটকের পদভরে কম্পিতা মেদিনী।
কটকে বাদ্য বাজায় তিন অক্ষৌহিণী।।
সহস্র দগড় বাজে সহস্র কাহাল।
কোটি কোটি ঘন্টা বাজে মৃদঙ্গ বিশাল।।
ভেউরী ঝাঁঝরী বাজে ত্রিশ কোটি কাড়া।
কাংস করতাল বাজে তিন লক্ষ পড়া।।
ঘন ঘন বাজে তায় কত কোটি দামা।
দণ্ডী ও মহরী বাজে নাহি তার সীমা।।
সহস্র ভোরঙ্গ বাজে ডম্প কোটি কোটি।
দশ লক্ষ দগড়েতে ঘন পড়ে কাটি।।
বহু লক্ষ শিঙ্গা বাজে অতি খরশান।
কত কোটি বাজে সিন্ধু আর বিন্দুয়ান।।
বিরানব্বই কোটি বাজে ধুসরী মহরী।
ত্রিশ কোটি শানাই বাজে মহরী ঝাঁঝরি।।
খমক ঠমক বাজে পঞ্চাশ হাজার।
বিশ কোটি বাজে পাখোয়াজ উরমার।।
নানা শব্দ করি বাজে পায়ের নূপুর।
মালসাট মার কেহ শব্দ যায় দূর।।
বাজে স্বর-মঙ্গল সাতাইশ লক্ষ কাঁসী।
মৃদুস্বরে বাজে আটাইশ লক্ষ বাঁশী।।
বাদ্যশব্দে দেবতার মনে লাগে ত্রাস।
সহস্র সহস্র বাজে রুদ্রক পিনাশ।।
ডহর বিশাল ঢাক বাজে জয়ঢোল।
সকল পৃথিবী যুড়ে উঠে গণ্ডগোল।।
রাক্ষস কটক ভরে পৃথিবীর কাঁপ।
হাতী ঘোড়া রথ নড়ে হৈয়া এক চাপ।।
কটকের ধূলায় পৃথিবী অন্ধকার।
প্রথমে চাপিল গিয়া পূর্ব্বকার দ্বার।।
এক চাপে করে বীর বাণ বরিষণ।
গাছ আর পাথর বরিষে কপিগণ।।
রাক্ষস বানরেতে হইল মিশামিশি।
কৌতুক দেখিতে দেবগণ তথা আসি।।
বাণ যুড়ে রাক্ষস ধনুকে দিয়া চাড়া।
বানরের উপরে পড়িছে যোড়া যোড়া।।
বানর পাথর গাছ করে বরিষণ।
কোটি কোটি রক্ষ রণে ত্যজিছে জীবন।।
চাপড় মুকুটি মাত্র বানরের তাড়া।
মুকুটির ঘায়ে কারো মাথা হৈল গুঁড়া।।
বাঘের যেমন রূপ বানরের অঙ্গ।
মরণের ভয় নাহি রণে নাহি ভঙ্গ।।
উভয় কটকে যুঝে রক্তে হৈল রাঙ্গা।
রক্তে নদী বহে যেন ভাদ্রমাসে গঙ্গা।।
ঘোড়া হাতী বীর আদি রক্তরসে ভাসে।
হরিষে বানর-সৈন্য মনে মনে হাসে।।
তার তুল্য ঢেউ উঠে রক্ত কলকলি।
যুদ্ধের নাহিক সীমা অধিক কি বলি।।
কোন যুগে এইমত যুদ্ধ নাহি হয়।
অসময়ে জ্ঞান হয় প্রলয় উদয়।।
পূর্ব্বদ্বারে সমর করিয়া যথোচিত।
চলিল দক্ষিণ দ্বারে বীর ইন্দ্রজিত।।
অঙ্গদেরে দেখি তবে ইন্দ্রজিৎ হাসে।
গালাগালি দেয় তায় যত মনে আসে।।
মোর বাপে গালি দিয়া পলাইলি ডরে।
আয় তোর কোন্ বাপ আজি রক্ষা করে।।
বাপকে মারিয়া তোর মাকে নিল অন্যে।
ধিক্ রে বানরা তোর লাজ নাহি মনে।।
যার শরে মরে তোর পিতা বালিরাজ।
ধিক্ তোরে অধম করিস্ তারি কাজ।।
খাইব ঘাড়ের রক্ত কামড়ার মাস।
মোর হাতে আজি তোর অবশ্য বিনাশ।।
দেশেতে জীয়ন্ত যাবি না করিস্ সাধ।
অন্য জন নহি আমি বীর মেঘনাদ।।
অঙ্গদ বলিছে দুষ্ট গর্জ্জ অকারণ।
পদাঘাতে তোর আজি লইব জীবন।।
মারিতে গেলাম আজি লঙ্কার ভিতর।
সে কোপ পড়িল চারি রাক্ষস উপর।।
যোগিবেশে তোর বাপ সীতাদেবী হরে।
তার পাপে মোর বাপ মরে এক শরে।।
তার পাপে পড়ে রণে ত্রিশিরা কবন্ধ।
তোর বাপের পাপে সাগরেতে সেতুবন্ধ।।
তোর বাপ নারীচোরা তোর রণ চুরি।
আজি তোরে অবশ্য পাঠাব যমপুরী।।
চোর-পুত্র চোর তুই, চুরি কর রণ।
আজিকার যুদ্ধে তোর লইব জীবন।।
এত শুনি ইন্দ্রজিৎ পূরিল সন্ধান।
কোটি কোটি বানরের লইল পরাণ।।
অঙ্গদে এড়িয়া সবে পলায় বানর।
রণমধ্যে অঙ্গদ রহিল একেশ্বর।।
মহাক্রোধে অঙ্গদ কাঁপিছে থর থর।
ইন্দ্রজিৎ পরে ফেলে পাদপ পাথর।।
কুপিয়া অঙ্গদ বীর রথে মারে লাথি।
লাথির চোটে চূর্ণ করে রথ ও সারথি।।
অঙ্গদ-বিক্রমে ইন্দ্রজিৎ কাঁপে ত্রাসে।
লাফ দিয়া ইন্দ্রজিৎ উঠিল আকাশে।।
আকাশে থাকিয়া দেখে দুই সৈন্যে রণ।
রাক্ষস বানরে যুদ্ধ নাহি নিবারণ।।
প্রচণ্ড রাক্ষস এল হয়ে আগুয়ান।
সম্পাতি বানরে মারে তিন শত বাণ।।
বাণ খেয়ে সম্পাতি যে হইল বিবর্ণ।
উপাড়িয়া আনে বৃক্ষ নামে অশ্বকর্ণ।।
অশ্বকর্ণ বৃক্ষ ধরে দিল এক পাক।
বায়ুবেগে ঘুরে যেন কুমারের চাক।।
এড়িলেক গাছ গোটা করিয়া হুঙ্কার।
বৃক্ষাঘাতে প্রচণ্ড হইল চুরমার।।
সম্পাতি বানর-বীর প্রচণ্ডে মারিয়া।
অসংখ্য রাক্ষস মারে লেজে জড়াইয়া।।
চারি বীরে লেজে বান্ধি মারিল আছাড়।
মাথার খুলি ভেঙে গেল চূর্ণ হৈল হাড়।।
তপন নামে নিশাচর আইল গজস্কন্ধে।
সন্ধান পূরিয়া বাণ নীলবীরে বিন্ধে।।
বাণ খাইয়া নীলবীর উঠে দিল রড়।
চড়িয়া হাতির স্কন্ধে তারে মারে চড়।।
চড় চাপড়েতে গেল দুই আঁখি উড়ে।
সংগ্রামের মাঝেতে তপন গেল পড়ে।।
রথে চড়ে আইল বিদ্যুৎমালী নাম।
বানরের সঙ্গে করে দুর্জ্জয় সংগ্রাম।।
হেনকালে হনুমানে দেখিল সম্মুখে।
তিন শত বাণ মারে হনুমানের বুকে।।
বাণ খেয়ে হনুমান চিন্তিত নহে চিতে।
লাফ দিয়া উঠিল বিদ্যুৎমালীর রথে।।
রথেতে উঠিয়া তার ধরিলেক চুলে।
টানাটানি করে তার মাথা ছিড়ে ফেলে।।
রণেতে প্রবেশ করে সুবর্ণ রাক্ষস।
একবারে মদ খায় সাতাইশ কলস।।
সোণার পবিত্র পরে সোণার উপর সোণা।
বানর কটকেতে আসিয়া দিল হানা।।
খাঁড়া ধরে কখন, কখন ধনুর্ব্বাণ।
বানর কটক কেটে কৈল খান খান।।
ঘোর অন্ধকার হৈল সেই রণস্থলে।
বানর কটক সব ধরে ধরে গিলে।।
রণস্থলে বানরের দেখিতে দুর্গতি।
আইল দারুণ কোপে নীল সেনাপতি।।
কুপিয়া সে নীলবীর চারিদিকে চায়।
বিদ্যুৎমালীর রথচক্র দেখিবারে পায়।।
উপাড়িয়া চাকা-গোটা তুলে নিল হাতে।
দানবে রুষিল যেন দেব জগন্নাথে।।
এড়িলেক চাকা-গোটা তুলি বাহুবলে।
অন্তরীক্ষে ফিরে চাকা গগন-মণ্ডলে।।
বায়ুবেগে আইসে চাকা কি কহিব কথা।
চাকার ধারে কাটি পাড়ে সুবর্ণের মাথা।।
সুষেণ বানররাজ রাজার শ্বশুর।
দুই পুত্র লয়ে বুড়া যুঝিছে প্রচুর।।
যুঝিতে যুঝিতে বুড়ার বেড়ে গেল রঙ্গ।
লাফ দিয়া উঠে যেন বয়সে তরঙ্গ।।
যুঝিতে যুঝিতে বুড়া পড়ে গেল ভোলে।
দশ বিশ রাক্ষস চাপিয়া ধরে কোলে।।
বুড়ার চাপড়ে চড়ে কর্ণে তালি লাগে।
নিমিষে রাক্ষস সব লঙ্কামধ্যে ভাগে।।
যুঝেন লক্ষ্মণ বীর সুমিত্রা-নন্দন।
অবসাদ নাহি বীরের প্রথম যৌবন।।
রঘুবংশে উদ্ভব লক্ষ্মণ মহামতি।
সূর্য্যের কিরণ বীর শশধর-জ্যোতি।।
উদয় অস্ত যুঝে বীর নাহি অবসান।
ধন্য শিক্ষা বীরের সে ধন্য ধনুর্ব্বাণ।।
মারে লক্ষ নিশাচরে চক্ষুর নিমিষে।
কোটি সহস্র রাক্ষস মারে বেলা অবশেষে।।
লক্ষ্মণের যুদ্ধ দেখি দেবতার ধন্ধ।
তিন লক্ষ রাক্ষসের কাটি পাড়ে স্কন্ধ।।
রক্তে নদী বহে বাট রক্তে উঠে ফেণা।
লক্ষ্মণের বাণে পড়ে রাক্ষসের থানা।।
বাদ্যভাণ্ড ভঙ্গ দিয়া পলাইল ত্রাসে।
ইন্দ্রজিৎ দেখে তাহা থাকিয়া আকাশে।।
পিতা মোর কটক সঁপিল হাতে হাতে।
রাখিতে নারিলাম ঠাট যাইব কিমতে।।
অগ্নিকেতু ভস্মকেতু বিক্রমে বিশাল।
বজ্রদন্ত বীর পড়ে লঙ্কার কোটাল।।
পড়ে ষট্ নিষট সাক্ষাৎ যমদূত।
অক্ষয় রাক্ষস পড়ে সমরে অদ্ভুত।।
বজ্রমুষ্টি পড়ে শব্দে কর্ণে লাগে তালি।
পনস রাক্ষস পড়ে লয়ে সৈন্যগুলি।।
হাতী ঘোড়া পড়িল অনেক রাজ্যখণ্ড।
মাহুত পড়িল রণে সমরে প্রচণ্ড।।
দেবমুষ্টি পড়িল সকল সেনাপতি।
তিন লক্ষ পড়ে রাজার প্রধান পদাতি।।
তাহীর পৃষ্ঠে পড়ে সৈন্য দেউলের চূড়া।
পড়িল অর্ব্বুদ কোটি পার্ব্বতীয় ঘোড়া।।
রাজ্যের মহামাত্র পড়ে রাজ্য শূন্য করি।
কোন্ মুখে প্রবেশ করিব লঙ্কাপুরী।।
আদর করিয়া পিতা দিলা গুয়া পান।
এতেক কটক পড়ে মোর বিদ্যমান।।
কটকের ভাল মন্দ মোরে সব লাগে।
কোন্ লাজে গিয়া দাণ্ডাইব পিতৃ-আগে।।
দেখাদেখি যুদ্ধ করি জিনিবারে নারি।
অদেখা হইলে যুদ্ধ করিবারে পারি।।
মহাযুদ্ধ করিব মায়াতে করি ভর।
মেঘের আড়ে থেকে মারি নর আর বানর।।
ডাক দিয়া শ্রীরামের বলে মেঘনাদ।
জীয়ন্তে যাইতে দেশে না করিহ সাধ।।
নির্ব্বল রাক্ষস মারি হরিষ অন্তর।
আজিকার যুদ্ধে পাঠাইব যমঘর।।
এতেক বলিয়া ধনুকেতে দিল চাড়া।
দেউল দোহারে যেন ভাঙ্গি পড়ে চূড়া।।
সোণার ধনুকে বীর যোড়ে তীক্ষ্ণ শর।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবী কাঁপিছে থর থর।।
ধনুকেতে দিয়া গুণ তিনবার লোফে।
ব্রহ্মা আদি দেবগণ থরথরি কাঁপে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ বলি ঘন ডাক ছাড়ে।
সম্বর আমার বাণ ঝাঁকে ঝাঁকে পড়ে।।
এড়িলাম বাণ এই যমের দোসর।
ছুটিল দুর্জ্জয় বাণ সম্বর সম্বর।।
এত বলি করে ভীর বাণ বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
নানা বর্ণে বাণ এড়ে, জানে নানা ছলা।
রাম লক্ষ্মণের কাটি পাড়িল মেখলা।
তিলার্দ্ধ নাহিক স্থান রক্ত পড়ে স্রোতে।
দুভায়ের রক্তধারে বসুমতী তিতে।।
হেথা ইন্দ্রজিৎ বিন্ধে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
উত্তর দ্বার বার্ত্তা পায় সুগ্রীব রাজন।।
উত্তর দ্বারে তখন নাহি হানাহানি।
রক্ষক রাখিয়া রাজা চলিল আপনি।।
পশ্চিম দ্বারেতে যুদ্ধ করে ইন্দ্রজিৎ।
চলিল সুগ্রীব রাজা বাঁচাইতে মিত।।
ধাইল সুগ্রীব রাজা অতি শ্রীঘ্রগতি।
ছত্রিশ কোটি সেনাপতি চলিল সংহতি।।
পূর্ব্বদ্বারে থানায় আসিয়া শীঘ্রগতি।
সমাচার দিল যথা নীল সেনাপতি।।
নীল ও কুমুদ ধায় কটক যুঝিবারে।
থানা ভাঙ্গি গেল সবে পশ্চিম দুয়ারে।।
দক্ষিণ দ্বারেতে আছে অঙ্গদের থানা।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র তাহে আছে দুই জনা।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র চলে যত সেনাগণ।
আশী কোটি বানর আছ তাহার ভিড়ন।।
ধাওয়াধাই বার্ত্তা তারা কহে জনে জন।
সবে মাত্র না জানে রাক্ষস বিভীষণ।।
বিভীষণে না কহিল বিপক্ষের জ্ঞানে।
এই হেতু সংবাদ না পায় বিভীষণে।।
চারি দ্বারে কটক হইল এক ঠাঁই।
মেঘের আড়ে ইন্দ্রজিৎ বিন্ধে দুই ভাই।।
লাফ দিয়া বানর সে উঠয়ে আকাশ।
কোথায় থাকিয়া যুঝে না পায় তল্লাস।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ বলে হৈলাম নিরাশ।
মেঘের আড়ে ইন্দ্রজিৎ করে উপহাস।।
সহস্র লোচনে না দেখিল পুরন্দর।
দুই চক্ষে কি দেখিবি নর আর বানর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ তোরা মানুষের জাতি।
আজি বুঝি তোদের পোহাল কালরাতি।।
মেঘের আড়ে থাকি করে বাণ বরিষণ।
জর্জ্জর করিয়া বিন্ধে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
কোথা থাকি যুঝে বেটা দেখিতে না পাই।
জীবনের বাসনা ছাড়িল দুই ভাই।।
এত বাণ মারি বেটা ক্ষমা নাহি মানে।
নাগপাশ-বাণ যুড়ে ধনুকের গুণে।।
নাগপাশ-বাণ এড়ে বড়ই দারুণ।
যার নামে যম ইন্দ্র কাঁপয়ে বরুণ।।
ব্রহ্ম-অস্ত্র নাগপাশ দুর্জ্জয় প্রতাপ।
এক বাণে হইল চৌরাশী লক্ষ সাপ।।
সাপ হয়ে বাণ আকাশেতে ধরে ফণা।
সাপর মুখে জ্বলে যে আগুনের কণা।।
মুখেতে দারুণ অগ্নি জ্বলে ধিকি ধিকি।
আছয়ে অন্যের কাজ কাঁপয়ে বাসুকি।।
চলিল সে বাণগোটা দুর্জ্জয় প্রতাপ।
অগ্নির সমান যেন এক এক সাপ।।
বায়ুবেগে যায় বাণ মেঘের গর্জ্জনে।
হাতে পায়ে বান্ধে গিয়া শ্রীরাম লক্ষ্মণে।।
কোন সাপ গলায় জড়ায় কেহ পায়।
পাক দিয়া ভুজঙ্গ জড়ায় সর্ব্ব গায়।।
হাত-পা নাড়িতে নারে গলায় লাগে ফাঁস।
যমের দোসর হৈল বন্ধন নাগপাশ।।
সাপের বিষের জ্বালায় অধৈর্য্য শরীর।
উত্তর শিয়ড়ে ঢলে পড়েন দুই বীর।।
লক্ষ্মণ পড়িল আর রাম রঘুমণি।
চন্দ্র সূর্য্য খসে যেন পড়িল অবনী।।
লোটায় কমল-অঙ্গ আলুথালু বেশ।
লোটায় ধনুক তূণ আলুয়িত কেশ।।
রণ জিনি ইন্দ্রজিৎ ছাড়ে সিংহনাদ।
পিতৃস্থানে যায় বীর লইতে প্রসাদ।।
বানরের শুন আজ ক্রন্দনের রোল।
লঙ্কায় প্রবেশে বীর বাজাইয়া ঢোল।।
আগে পাছে পড়ে কত চন্দনের ছড়া।
তাহার উপরে পাতে নেতের পাছড়া।।
এতেক প্রমাণ পড়ে পুষ্প পারিজাত।
সৌরভেতে পূর্ণিত শীতল বহে বাত।।
পিতৃ-আগে দাণ্ডাইল করি যোড় করে।
তিনবার মাথা নোয়ায় রাজ-ব্যবহারে।।
রাবণ জিজ্ঞাসা করে রণের সংবাদ।
যোড়হাতে কহিছে কুমার মেঘনাদ।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব দেবতা চরাচর।
সবার কঠিন যুদ্ধ নর আর বানর।।
প্রথম করিতে যুদ্ধ বানর সংহতি।
চূর্ণ কৈল রথছত্র মারিল সারথি।।
আপনা রাখিতে আমি হলাম কাতর।
প্রাণভয়ে পলাইলাম আকাশ উপর।।
দাণ্ডাইয়া দেখিলাম রাক্ষস্-দুর্গতি।
এক দণ্ডে পড়িল সকল সেনাপতি।।
পড়িল সকল সেনা পাই অপমান।
রাম লক্ষ্মণে বিন্ধিয়া করি খান খান।।
খণ্ড খণ্ড করিলাম মাথার টোপর।
রক্ত মাত্র না রহিল শরীর ভিতর।।
বাণে বিন্ধে দুই ভায়ে করিনু জর্জ্জর।
পড়িল অনেক ঠাট অসঙ্খ্য বানর।।
ব্রহ্ম-অস্ত্র নাগপাশ প্রচণ্ড প্রতাপ।
একবারে জন্মিল চৌরাশী লক্ষ সাপ।।
সাপ হয়ে চলে বাণ আকাশে ধরে ফণা।
হাতে পায় গলায় বান্ধিল দুই জনা।।
ত্রিভুবন মিলে যদি করে আকিঞ্চন।
তবু না খসিবে নাগপাশের বন্ধন।।
রাম লক্ষণের তরে আর নাহি ডর।
সীতা সনে কেলি কর লঙ্কার ভিতর।।
হরিষে যুদ্ধের কথা মেঘনাদ কহে।
রাবণ করিয়া কোলে চুম্ব দিল তাহে।।
হস্তী ঘোড়া রত্ন দিল ভাণ্ডার প্রচুর।
অমূল্য রতন হার দিলেক কেয়ূর।।
নানা অলঙ্কার দিল নীলকান্ত মণি।
বিদ্যাধরী আনি দিল রূপসী রমণী।।
রাজপ্রসাদ দিল রাজ্য করে লণ্ড ভণ্ড।
সবে মাত্র নাহি দিল নব ছত্রদণ্ড।।