১৫. রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণের জন্ম, তপস্যা ও বরলাভ

রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণের জন্ম, তপস্যা ও বরলাভ

কুবের পুষ্পক রথে বেড়ায় অন্তরীক্ষে।
পাতালে থাকিয়া তাহা রাক্ষসেরা দেখে।।
দেখিয়া দ্বিগুণ খেদ বাড়িল অন্তরে।
রাক্ষসের স্বর্ণলঙ্কা লইল কুবেরে।।
বসিয়া মন্ত্রণা করে লয়ে মন্ত্রিগণে।
কুবেরের স্থানে লঙ্কা লইব কেমনে।।
বিশ্বশ্রবা অধিকারী হয়েছে লঙ্কার।
পিতৃধন কুবের করেছে অধিকার।।
পুনঃ যদি বিশ্বশ্রবার পুত্র এক হয়।
পিতৃধন বলি সে লঙ্কার অংশ লয়।।
যদ্যপি দৌহিত্র হয় বিশ্বশ্রবা-নন্দন।
দুইদিকে অধিকারী হবে হেন জন।।
এতেক মন্ত্রণা করি ভাবিল মনেতে।
বিশ্বশ্রবায় দান দিব আপন দুহিতে।।
খলের স্বভাব খল ছাড়িতে না পারে।
কোপে ডাকে মাল্যবান আপন কন্যারে।।
নিকষা তাহার নাম নবীনা যৌবনী।
অকলঙ্ক শশিমুখী মরালগামিনী।।
মৃগেন্দ্র জিনিয়া কটি রামরম্ভা ঊরু।
হরিণাক্ষি কামের সমান যুগ্ম ভুরু।।
জিনি রম্ভা তিলোত্তমা নিরুপমা নারী।
তিল-ফুল জিনি নাসা নিকষা সুন্দরী।।
যৌবন-তরঙ্গে রঙ্গে ভঙ্গিমা সুঠাম।
পিতার চরণে আসি করিল প্রণাম।।
মাল্যবান বলে এস প্রানের কুমারী।
সাবিত্রী সমান হও আশীর্ব্বাদ করি।।
মাল্যবান বলে কন্যা রূপেতে রূপসী।
তাহাতে মায়াবী বড় জাতিতে রাক্ষসী।।
এই উপরোধ করি তোমার গোচর।
বিশ্বশ্রবার কাছে গিয়া মাগ পুত্রবর।।
তাহার রমণী হয়ে থাক তার ঘরে।
যেরূপেতে পুত্র জন্মে তোমার উদরে।।
পিতার বচনে অতি হইয়া লজ্জিতা।
যে আজ্ঞা বলিয়া চলে হইয়া ত্বরিতা।।
একেত রুপসী শশী ভুবনমোহিনী।
করিয়া বিচিত্র সাজ চলে সুবদনী।।
মহামুনি বিশ্বশ্রবা আছে তপস্যায়।
নিকষা বিচিত্র বেশে সম্মুখে দাঁড়ায়।।
বিশ্বশ্রবা জিজ্ঞাসা করে কে তুমি রূপসী।
নিকষা কহিল আমি পুত্র-অভিলাষী।।
পত্নীভাবে আলয়েতে থাকিব তোমার।
মুনি বলে থাক প্রিয়ে গৃহেতে আমার।।
সর্ব্বমতে আদরিণী হবে মম বরে।
এক কন্যা তিন পুত্র ধরিবে উদরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র হবে অতি বিকৃত আকার।
বাহুবলে শাসিবেক এ তিন সংসার।।
হইবে মধ্যম পুত্র অতি সে দুর্জ্জন।
অদ্ভুত ধরিবে বলে অদ্ভুত ভক্ষণ।।
করিবেক অনাচার দেব-দ্বিজ-হিংসে।
আপনার দোষে তারা মরিবে সবংশে।।
কন্যা হবে দুরন্ত দুঃশীলা অতি লোভা।
সেই মজাইবে সৃষ্টি হইয়া বিধবা।।
কুলের উচিত পুত্র হইবে কনিষ্ঠ।
দেব-দ্বিজ-গুরুভক্ত ধর্ম্মশীল শ্রেষ্ঠ।।
এতেক কহিল যদি মুনি মহাশয়।
নিকষার দুই চক্ষে বারিধারা বয়।।
যোড়হাতে কহে তবে মুনির গোচর।
আমারে কেমন আজ্ঞা কৈলে মুনিবর।।
তোমার ঔরসে পুত্র জন্মিবে যে জন।
ধর্ম্মশীল না হইবে বিচিত্র কথন।।
মুনি বলে বিষাদিতা না হও সুন্দরী।
দৈবের ঘটনা আমি খণ্ডাইতে নারি।।
অগ্নির পতন কালে চাহিয়াছ বর।
অগ্নি হেন দুই পুত্র হইবে দুষ্কর।।
ইহা বলি বিশ্বশ্রবা তপস্যাতে যান।
নিকষা প্রসব কৈল চারিটি সন্তান।।
প্রথম সন্তান হয় অপূর্ব্ব গঠন।
দশ মুণ্ড কুড়ি হস্ত বিংশতি লোচন।।
সর্ব্ব জ্যেষ্ঠ রাবণ ভুবন কাঁপে ডরে।
কুম্ভকর্ণে প্রসব করিল তার পরে।।
বিকৃত-আকার দেহ বিষম লক্ষণ।
তারে দেখি অন্তরে কাঁপিল দেবগণ।।
সূতিকাগৃহেতে এসেছিল যত নারী।
মুখে পূরে একবারে সাপটিয়া ধরি।।
কন্যারত্ন ভূমিষ্ঠ হইল তার পরে।
মুখের গঠন দেখি সবে কাঁপে ডরে।।
লিহ লিহ করে জিহ্বা বিপরীত মাথা।
নাকের বিশ্বাস তার কামারের জাঁতা।।
অঙ্গুলিতে নখ যেন কুলার আকার।
সূর্পণখা নাম তার বিখ্যাত সংসার।।
কন্যা দেখি নিকষার পুলকিত মন।
অবশেষে ভূমিষ্ঠ ধার্ম্মিক বিভীষণ।।
তিন পুত্র এক কন্যা হইল প্রসব।
শুভ সমাচার পায় রাক্ষসেরা সব।।
অনেক রাক্ষস সঙ্গে এল মাল্যবান।
বহু রত্ন ধন দিয়া করিল কল্যাণ।।
ক্ষণমাত্র দেখিয়া সুস্থির কৈল মন।
বিষ্ণুর ভয়েতে করে পাতালে গমন।।
বিশ্বশ্রবার আশ্রমেতে নিকষা রহিল।
মনুষ্য-আচারে তথা কত দিন গেল।।
দশানন বসিয়াছে নিকষার কোলে।
পিতৃ-সম্ভাষিতে কুবের এল হেনকালে।।
কুবের প্রণাম করে পিতার চরণে।
সঙ্কেতে নিকষা তারে দেখায় রাবণে।।
আসিয়াছে কুবের দেখহ বিদ্যমান।
বৈমাত্রেয় ভাই তোর যক্ষের প্রধান।।
বিধাতা দিয়াছে করি ধন-অধিকারী।
সেই অহঙ্কারে ভোগ করে লঙ্কাপুরী।।
তোর মাতামহের নির্ম্মিত সেই লঙ্কা।
পেয়ে রাক্ষসের রাজ্য নাহি করে শঙ্কা।।
উহারে জিনিয়া লঙ্কা পার যদি নিতে।
তবেত আমার ব্যথা ঘুচিবে মনেতে।।
দশানন বলে, মাতা না ভাব বিষাদে।
কেড়ে লব লঙ্কাপুরী তোমার প্রসাদ।।
কঠোর তপস্যা যদি করিবারে পারি।
কুবেরে জিনিয়া তবে লব লঙ্কাপুরী।।
শুনিয়া মায়ের খেদ হইল কাতর।
তপস্যা করিতে যায় হিমাদ্রি-শিখর।।
কুম্ভকর্ণ দশানন আর বিভীষণ।
গোকর্ণ-বনেতে তপ করে তিন জন।।
কুম্ভকর্ণ করে তপ বড়ই দুষ্কর।
ঊর্দ্ধপদে হেঁটমাথে থাকে নিরন্তর।।
গ্রীষ্মকাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালে চারিপাশে।
সে অগ্নির শিখা গিয়া লাগয়ে আকাশে।।
শীতকালে জলে থাকে দিবস রজনী।
নাহি আহারাদি নিদ্রা শ্বাসগত প্রাণী।।
কত দিনে ফল মূল করিলা আহার।
রাক্ষসের তপ দেখি দেবে চমৎকার।।
কঠোর তপস্যা তারা করে তিন জন।
বৃক্ষের গলিত পত্র করয়ে ভক্ষণ।।
অনাহারে নিরন্তর বায়ু-আহারেতে।
তিন ভাই তপস্যা করিল হেনমতে।।
নাহিক শিশির উষ্ণ নাহিক বরিষে।
করয়ে কঠোর তপ রাজ্য-অভিলাষে।।
মাথায় পিঙ্গল জটা বল্ক পরিধান।
আচরিল তপস্যার যেমন বিধান।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ ছাড়ি ছয় রিপু।
অস্থিচর্ম্ম সার মাত্র জীর্ণতম বপু।।
তপস্যা করিল পাঁচ হাজার বৎসর।
রাক্ষসের তপস্যাতে ত্রিভুবনে ডর।।
যতেক দেবতাগণ চিন্তিত অন্তর।
কাহার সম্পদ লবে দুষ্ট নিশাচর।।
ইন্দ্র বলে আমার ইন্দ্রত্ব পাছে লয়।
চন্দ্র সূর্য্য ভাবে সদা কি জানি কি হয়।।
যম বলে লইবেক মম অধিকার।
পাতালে বাসুকি ভাবে কি হবে আমার।।
না জানি কি বর চাহে দুষ্ট নিশাচর।
সকল দেবতা গেল ব্রহ্মার গোচর।।
ব্রহ্মার নিকটে গিয়া কহে সমাচার।
রাক্ষস তপস্যা করে অতি ভয়ঙ্কর।।
কি জানি কাহার পদ লইবে কাড়িয়া।
নিশাচরে সান্ত্বনা করহ তুমি গিয়া।।
এতেক শুনিয়া ব্রহ্মা গেলেন সত্বর।
ব্রহ্মা বলিলেন বর মাগ নিশাচর।।
রাবণ বলে বর যদি দিবে মহাশয়।
আমারে অমর বর দিতে আজ্ঞা হয়।।
ব্রহ্মা বলিলেন তুমি চাহ অন্য বর।
আমি না পারিব তোরে করিতে অমর।।
দুষ্ট নিশাচর জাতি নহ যে ধর্ম্মিষ্ঠ।
তোমরা অমর হলে মজাইবে সৃষ্ট।।
রাবণ বলয়ে যদি না কর অমর।
তোমার স্থানেতে নাহি চাহি অন্য বর।।
যথা ইচ্ছা তথা ব্রহ্মা করহ গমন।
ইহা বলি পুনঃ তপ করয়ে রাবণ।।
রাক্ষসের তপ দেখি কাঁপে ত্রিভুবন।
বিষম উৎকট তপ করে তিন জন।।
কুম্ভকর্ণ করে তপ দেখিতে দুষ্কর।
হেঁট মাথা করি রহে দুই পা উপর।।
গ্রীষ্মকালে অগ্নিকুণ্ড জ্বালে চারিপাশে।
উপরেতে খরতর ভাস্কর প্রকাশে।।
বরিষাতে চারিমাস থাকে পদ্মাসনে।
শিলা-বরিষণ ধারা বহে রাত্রি দিনে।।
শীতকালে স্নিগ্ধ জলে থাকে নিরন্তর।
এইরূপে তপ করে অযুত বৎসর।।
অযুত বৎসর তপ তপনের স্থানে।
ঊর্দ্ধ করে দুই বাহু ঠেকিছে গগনে।।
অযুত বৎসর তপ করে বিভীষণ।
স্বর্গেতে দুন্দুভি বাজে পুষ্প-বরিষণ।।
অযুত বৎসর তপ করিল রাবণ।
অনেক কঠোর তপ করে দশানন।।
এক মাথা কাটে এক হাজার বৎসরে।
ব্রহ্মারে আহুতি দেয় আগুন উপরে।।
নয় মাথা কাটে নয় হাজার বৎসরে।
শেষ মুণ্ড কাটিবারে ভাবিল অন্তরে।।
খড়্গ ধরি শেষ মুণ্ড করিতে ছেদন।
ব্রহ্মা আসি উপনীত রাবণ সদন।।
ব্রহ্মা বলিলেন তপ না করিস আর।
যত চাহ তত দিব ধন-অধিকার।।
দশানন বলে যদি মোরে দিবে বর।
তব বরে সংসারেতে হইব অমর।।
ব্রহ্মা বলে অমর বড় বড়ই দুষ্কর।
ছাড়িয়া অমর বর চাহ অন্য বর।।
রাবণ বলেন যদি না কর অমর।
সদয় হইয়া দেহ চাহি যেই বর।।
যক্ষ রক্ষ দেবতা কি গন্ধর্ব্ব অপ্সরা।
চরাচর খেচর পিশাচ বিষধর।।
কারো হাতে না মরিব এই বর দেহ।
সকলে জিনিব আমি না পারিবে কেহ।।
ব্রহ্মা বলে যে বর চাহিলে নিজ-মুখে।
তুষ্ট হয়ে সেই বর দিলাম তোমাকে।।
যত যত বীর জাতি আছয়ে সংসারে।
নিজ বাহুবলে তুমি জিনিবে সবারে।।
বাকি আছে দুই জাতি নর আর বানর।
দশানন বলে মোর তাহে নাহি ডর।।
বাকি যে বানর নর ধরি ভক্ষ্য মধ্যে।
নর আর বানরে কি জিনিবেক যুদ্ধে।।
রাবণ বলিছ পুনঃ করি যোড়কর।
কাটা মুণ্ড যোড়া যাবে দেহ এই বর।।
ব্রহ্মা বলে দিই বর শুন হে রাবণ।
মুণ্ড কাটা গেলে তোর না হবে মরণ।।
কাটা মুণ্ড যোড়া তোর লাগিবেক স্কন্ধে।
রাবণ প্রণাম কৈল মনের আনন্দে।।
তবে ব্রহ্মা উপনীত বিভীষণ স্থানে।
বর মাগ বিভীষণ যাহা লয় মনে।।
বিভীষণ প্রণমিল যুড়ি দুই কর।
ধর্ম্মেতে হউক মতি মাগি এই বর।।
ব্রহ্মা বলিলেন তুষ্ট হইলাম মনে।
অক্ষয় অমর হও আমার বচনে।।
বিনা শ্রমে সর্ব্ব শাস্ত্রে হইবে নিপুণ।
ত্রিভুবনে সকলে ঘুষিবে তব গুণ।।
তার পরে কুম্ভকর্ণে গেলা বর দিতে।
দেখিয়া দেবগণ লাগিল কাঁপিতে।।
দেবগণ বলে ভাগ্যে না জানি কি হয়।
বিনা বরে কুম্ভকর্ণে দেখে লাগে ভয়।।
বিধির নিকটে বর পেলে কুম্ভকর্ণ।
ধরিয়া দেবতাগণে করিবেক চূর্ণ।।
এত ভাবি দেবগণ করিয়া যুকতি।
ডাক দিয়া আনাইল দেবী সরস্বতী।।
দেবীরে কহিল তবে যত দেবগণে।
এই নিবেদন মাতা তোমার চরণে।।
বিধি গিয়াছেন কুম্ভকর্ণে দিতে বর।
বৈস গিয়া রাক্ষসের কণ্ঠের উপর।।
বর দিতে প্রজাপতি চাহিবে যখন।
তুমি বল নিদ্রা আমি যাব অনুক্ষণ।।
পাঠালেন যুক্তি করে যতেক অমর।
দেবী বসিলেন তার কণ্ঠের উপর।।
বিধি বলে কিবা বর মাগ নিশাচর।
কুম্ভকর্ণ বলে নিদ্রা যাব নিরন্তর।।
বিরিঞ্চি বলেন বর চাহিলে যেমন।
দিবানিশি নিদ্রা যাও হয়ে অচেতন।।
সরস্বতী চলিলেন আপন ভবন।
নিদ্রা যায় কুম্ভকর্ণ হয়ে অচেতন।।
বর শুনি দশানন এল শীঘ্রগতি।
ব্রহ্মার চরণ ধরি করয়ে মিনতি।।
দশানন বলে সৃষ্টি আপনি সৃজিলে।
ফল সহ বৃক্ষ কেন কাট ডালে-মূলে।।
কুম্ভকর্ণ তোমার সম্বন্ধে হয় নাতি।
এমন দারুণ শাপ না হয় যুকতি।।
নিদ্রা যাবে তব বাক্যে না হইবে আন।
নিদ্রা জাগরণ প্রভু করহ বিধান।।
কাতর হইয়া ধরে ব্রহ্মার চরণে।
কুম্ভকর্ণ-বর শুনি হাসে দেবগণে।।
সদয় হইয়া ব্রহ্মা বলিল বচন।
ছয় মাস নিদ্রা, একদিন জাগরণ।।
অদ্ভুত ধরিবে বল অদ্ভুত ভক্ষণ।
একেশ্বর সমরে জিনিবে ত্রিভুবন।।
যুদ্ধে কেহ না আঁটিবে কুম্ভকর্ণ বীরে।
কাঁচা নিদ্রা ভাঙ্গিলে যাইবে যমঘরে।।
এতেক বলিয়া ব্রহ্মা গেল নিজস্থানে।
দুই ভাই কুম্ভকর্ণে স্কন্ধে করে আনে।।
বিশ্বশ্রবার ঘরেতে আইল তিন জন।
রাবণ পাইল বর কাঁপে ত্রিভুবন।।