০৪. রাম জন্মকথা – চতুর্থ প্রকরণ

০৪. চতুর্থ প্রকরণ – রাম জন্মকথা

রামজন্মর তিনটি স্তর আছে।

প্রথমতঃ ঋষ্যশৃংগ উপাখ্যান, দ্বিতীয়তঃ ঋষ্যশৃংগকে অঙ্গদেশে আনয়ন ও শান্তার সঙ্গে বিবাহ এবং তৃতীয়তঃ দশরথের পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞে ঋষ্যশৃংগর পৌরোহিত্য এবং সেই যজ্ঞে দেবগণের অনুরোধে বিষ্ণুর দশরথের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণের অঙ্গীকার। এই বিস্তর কাহিনী পর্যায়ক্ৰমে বিশ্লেষণ করে মূল বক্তব্যে পৌঁছুতে হবে।

দশরথ অপুত্রক ছিলেন। পুত্ৰ কামনায় অশ্বমেধ যজ্ঞ করার বাসন৷ করলে বশিষ্ঠ প্রমুখ এ বিষয়ে সম্মতি দিয়ে সরযু নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। অতঃপর দশরথ সূত মুখে পুরাকাহিনী জানলেন। সত্যযুগে সনৎকুমার দশরথের পুত্রপ্রাপ্তি বিষয়ে ঋষিগণের নিকট এই কথা বলেছিলেন।

কশ্যপের বিভাণ্ডক নামে এক পুত্র আছে। তার ঋষ্যশৃংগ নামে এক পুত্র হবে। সে বনে পিতার নিকট পালিত ও বধিত হবে। ঋষ্যশৃংগ অনবরত পিতার সঙ্গে থেকে মুখ্য ও গৌণ দ্বিবিধ ব্রহ্মচর্য অনুষ্ঠান করবে, অন্য কিছু জানবে না। তার এই চরিত্র সমস্ত লোকে প্রসিদ্ধ হবে। এই ভাবে অগ্নি ও যশস্বী পিতাকে সেবা করে কাল অতিবাহিত করবে।

কশ্যপ অর্থে বিষ্ণু, অরুণ। অরুণ দ্বাদশাদিত্যের এক আদিত্য, মকর রাশির সূর্য। শ্রবণা নক্ষত্রর বৈদিক নাম বিষ্ণু। সুতরাং কশ্যপ শব্দে মকর রাশির শ্রবণা নক্ষত্র ধরতে হবে। এই নক্ষত্রর সামান্য দক্ষিণে ছায়াপথ ছিন্নবিচ্ছিন্ন এবং উত্তরদিকে ঐ ছায়াপথের পশ্চিমে কালপুরুষ নক্ষত্র।

বিভাণ্ডক-বিভী (দীপ্তি) সমন্বিত অণ্ডক (আশ্রয়, কোষ)। ছায়াপথকে দীপ্তিময় অণ্ডক গণ্য করা হয়েছে।

ঋষ্যশৃংগ—শৃংগে (শীর্ষে বা মাথায়) যে ঋষ্য (মৃগ অর্থে নক্ষত্র), অর্থাৎ মৃগশিরা নক্ষত্র।

বিভাণ্ডক শব্দে ছায়াপথ সংলগ্ন কালপুরুষ নক্ষত্র ধরে তার পুত্র ঋষ্যশৃংগকে মৃগশিরা নক্ষত্র বললেও ভূল হয় না।

খৃঃ পূঃ প্রায় চার হাজার বছর আগে মৃগশিরা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব অনুষ্ঠিত হত।

“ঋগ্বেদের কালে শরৎ ঋতুর আরম্ভে সন্ধ্যার পর মৃগনক্ষত্রের উদয় হলে রুদ্ৰযজ্ঞ হত, সম্ভবতঃ অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) পূর্ণিমায়। অথবা মৃগশিরা নক্ষত্রে চন্দ্র ও সূর্যর অবস্থান কালে বসন্ত ঋতুতে চান্দ্র-জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশীতে কলাচন্দ্র দর্শনের পরদিন যজ্ঞ হত।”

বালগঙ্গাধর তিলক প্রমাণ দিয়েছেন বৈদিক কালে কালপুরুষ নক্ষত্রর দুই পদ ও কটি দেশের তারকাগুলি নিয়ে মৃগনক্ষত্র ধরা হত। পরবর্তীকালে শীর্ষদেশের তিনটি তারাকে মৃগশিরা নামে আখ্যাত করা হয়েছে। মৃগশিরা নক্ষত্র সম্পর্কে এই দ্বিবিধ চিন্তাধারা সুস্পষ্ট করার কারণে বিভাওক শব্দে কালপুরুষ নক্ষত্র এবং ঋষ্যশৃংগ শব্দে কালপুরূষ নক্ষত্রর শীর্ষদেশ ইংগিত করা হয়েছে।

ঋষ্যশৃংগ মুখ্য ও গৌণ দ্বিবিধ ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। অগ্নি ও পিতার সেবা করতেন।

পুরাকালে বৃষ রাশিতে মৃগশিরা নক্ষত্রে সূর্যর অবস্থান কালে বসন্ত ঋতুতে এবং মৃগশিরা নক্ষত্রে চন্দ্রর অবস্থানে পূর্ণিমায় শরৎ ঋতুতে চান্দ্রঅগ্রহায়ণ মাসে মুখ্য ও গৌণ দ্বিবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। অগ্নি অর্থে যজ্ঞ। এই যজ্ঞের কারণে ঋষ্যশৃংগ অর্থাৎ মৃগশিরা নক্ষত্র বিশেষ লোকখাত ছিল। কালপুরুষ নক্ষত্রর উত্তরে ছায়াপথে নিমজ্জিত একটি নক্ষত্রর নাম অগ্নি। মৃগশিরা নক্ষত্রর উদয় কালে ছায়াপথ ও অগ্নি নক্ষত্র দৃষ্ট হয়। এজন্য বলা হয়েছে অগ্নি ও পিতার সেবা করতেন।

সুতরাং সনৎকুমার অতীত কালে মৃগশিরা নক্ষত্রে অনুষ্ঠিত বাসন্তবিষুব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছিলেন।

ঋষ্যশৃংগর এই খ্যাতির কালে অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে একজন প্রতাপশালী মহাবল রাজা হবেন। সেই রাজার অধৰ্মবশতঃ সর্বলোকভয়াবহ সুদারুণ অতিঘোর অনাবৃষ্টি হবে। রাজ নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কারণে ব্রাহ্মণদিগের পরামর্শ চাইলে তার রাজাকে যে কোন উপায়ে বিভাওক পুত্র ঋষ্যশৃংগকে এনে সুসৎকার করে শান্তা নাম্নী কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। রাজ সেই মত ব্যবস্থা করার জন্য পুরোহিত ও অমাত্যদিগকে নির্দেশ দিলে তারা বিভাণ্ডকের ভয়ে অক্ষমতা জ্ঞাপন করে। সকলের পরামর্শমত শেষ পর্যন্ত স্থির হয় গণিকাগণের সাহায্যে ঋষ্যশৃংগকে অঙ্গদেশে আনা হবে। যথারীতি গণিকা নিয়োগ করা হল। বারমুখ্যা বিভাওক ঋষির আশ্রমের নিকট অবস্থান করে ঋষ্যশৃংগের সাক্ষাৎলাভের চেষ্টা করবে। ঋষ্যশৃংগ আশ্রমের বেশী দূরে যেতেন না। সে কখনও স্ত্রী, পুরুষ কি নগর বা রাষ্ট্রজাত অন্যান্য কোন বস্তু দেখে নাই। পরে কোন এক সময়ে যদৃচ্ছাক্রমে সেখানে গিয়ে বরাঙ্গনাকে দেখতে পাবে। পরস্পরের পরিচয় বিনিময় হওয়ার পর সে ঋষ্যশৃংগকে উত্তম ফল প্রদান ও আলিঙ্গন করে বিভাওকের ভয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার অভিলাষ করবে। বিদায়কালে ব্রতানুষ্ঠানের সময় ঋষ্যশৃংগকে আমন্ত্রণ জানাবে। পরদিন ঋষ্যশৃংগ পূর্ব ঘটনা স্মরণ করে যেখানে বারমুখ্যার সংগে সাক্ষাৎ হয়েছিল সেখানে গেলে তারা তাকে নিয়ে অঙ্গরাজ্যে উপস্থিত হবে। ঋষ্যশৃংগর আগমনে সুবৃষ্টি হবে। রাজা তাকে অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে শান্ত নামে কন্যার সংগে বিবাহ দেবেন।

 

এই কাহিনীতে বিশেষ লক্ষণীয় ঋষ্যশৃংগকে অঙ্গদেশে আনয়নের জন্য গণিকা নিয়োগ। এই প্রসঙ্গে গণিকা, বরাঙ্গনা ও বারমুখ্যা তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলি অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ্যা হিসাবে ধরা হয়।

গণিকা—গণক + আপ, গণনাকারিনী। গণক অর্থে যারা জ্যোতিষিক ব্যাপার নিরূপন করে।

বরাঙ্গনা—বর (শ্রেষ্ঠা) + অঙ্গনা। অঙ্গনা অর্থ উত্তরদিগ্‌হস্তিনী, কন্যা রাশি, অঙ্গনাসংজ্ঞক বৃষ কর্কট বৃশ্চিক মীন ও মকর রাশি। অঙ্গনা শব্দে প্রশস্তদেহী বুঝায়। সুতরাং বরাঙ্গনা শব্দে উত্তরদিকের প্রশস্তদেহী কর্কট রাশির অশ্লেষা নক্ষত্রর ইংগিত গ্রহণ করা যায়। অশ্লেষা নক্ষত্রর বৈদিক নাম সর্পরুদ্র। এই নক্ষত্রর পুচ্ছ দক্ষিণে অনুরাধা নক্ষত্র পর্যন্ত প্রসারিত।

বৃষ রাশির শেষপাদে মৃগশিরা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব হলে উত্তরফলুনী নক্ষত্রে দক্ষিণায়ন এবং জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে শারদবিষুব হয়। অনুরুপভাবে কর্কট রাশির শেষ পাদে অশ্লেষা নক্ষত্রে দক্ষিণায়ন হলে কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব এবং বিশাখা নক্ষত্রে শারদবিষুব হয়।

বারমুখ্যা অর্থে বারের (জলের) মুখ্যা (প্রথমা, আদ্যা)। অর্থাৎ যে নক্ষত্রে দক্ষিণায়নাদি তথা বর্ষার প্রথম মাসের শুরু। গণিকা, বরাঙ্গনা এবং বারমুখ্যা শব্দ তিনটি প্রয়োগ করে সাধারণ অর্থে বেশ্যার ইংগিত দেওয়া হলেও শব্দগুলির গৃঢ় অর্থ প্রযুক্ত হয়েছে।

শব্দত্রয়ের অর্থভেদ করলে একথাই পরিষ্কার হয় যে অয়নচলন হেতু বাসন্তবিষুব পশ্চাদগামী হওয়ার দরুণ দক্ষিণায়ন উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্র হতে অশ্লেষা নক্ষত্রে এসেছে। পণ্ডিতগণের মতে মৃগশিরা ও কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব যথাক্ৰমে ঋগবেদ ও যজুর্বেদের কালে অনুষ্ঠিত হত।

রোমপাদ এবং অঙ্গদেশ শব্দদুটিও রহস্যপূর্ণ।

অঙ্গ অর্থ অংশ। সূর্যর ক্লাস্তিবৃত্ত বারোটি সমান অংশ বা রাশিতে বিভক্ত। সুতরাং অঙ্গদেশ শব্দে একটি বিশেষ রাশিকে বুঝানো হয়েছে যে রাশির অধিপতি রোমপাদ। রোমপাদ অর্থে পাদদেশে (পায়ে, লেজে) যার রোম (লোম) আছে। রাশিগুলির অন্তর্গত নক্ষত্রগুলির অবস্থান সাদৃশ্যে মেষ, বৃষ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রাশি নামগুলির একটি বৃশ্চিক। বৃশ্চিক বা বিছার পাদদেশে অর্থাৎ লেজে লোম আছে। সুতরাং অঙ্গদেশ অধিপতি রোমপাদ মূলতঃ বৃশ্চিক রাশি। এই রাশির অনুরাধা নক্ষত্রটি সাতটি তারায় বৃশ্চিক আকৃতি সদৃশ।

ঋষ্যশৃংগ অঙ্গদেশে আনীত হলে রোমপাদ তাকে অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে শান্তমনে শান্তার সঙ্গে বিবাহ দেন অন্তঃপুর অর্থে পুরের মধ্যস্থ পুর, শুদ্ধান্ত। শান্ত অর্থ নিবৃত্ত, বিরত। শান্ত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গে শান্তা। অতএব ঋষ্যশৃংগ ও শান্তার বিবাহ বলতে জ্যোতিবিদগণের গণনা অনুসারে নিদিষ্ট নক্ষত্রে বিষুব স্থিরীকৃত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শান্তাকে দশরথ-কন্যাও বলা হয়েছে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই শান্তার মাতার উল্লেখ নাই। শান্তার সঙ্গে রোমপাদ এবং দশরথ উভয়ের পিতৃত্ব জড়িয়ে থাকায় মনে হয় বাসন্তবিষুব কৃত্তিকা নক্ষত্রে এবং শারদবিষুব বিশাখা নক্ষত্রে ছিল এই ইংগিত করা হয়েছে। কৃত্তিকা ও বিশাখা উভয় নক্ষত্রই যথাক্ৰমে মেষ ও বৃষ এবং বৃশ্চিক ও তুলা রাশিতে বিভক্ত।

অতএব ঋষ্যশৃংগর দ্বিতীয় কাহিনীর বিশ্লেষণ অনুসরণে বলা ষায় যজুৰ্বেদ কালের কোনও এক সময়ে অয়নচলনের ভিত্তিতে জ্যোতিবিজ্ঞানের গণনার সংশোধন করা হয়েছিল।

 

এবার তৃতীয় কাহিনী।

সূত সুমন্ত্র দশরথকে আরও জানালো যে সত্যযুগে সনৎকুমার বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকুবংশে দশরথ নামে রাজা হবে। তার মহাভাগ্যবতী শান্তা নামে কন্যা হবে। অঙ্গরাজের সঙ্গে তার সখ্যতা থাকবে। অঙ্গরাজপুত্র রোমপাদ নামে বিখ্যাত হবে। দশরথ তার বংশবৃদ্ধির কারণে যজ্ঞর জন্য রোমপাদর নিকট শান্তা সহ ঋষ্যশৃংগকে প্রার্থনা করবে। রোমপাদ শান্তা ও ঋষ্যশৃংগকে প্রদান করবে। দশরথ ঋষ্যশৃংগর পৌরোহিত্যে যজ্ঞ করে চারটি পুত্র সন্তান লাভ করবে। সেইমত দশরথ শান্তা ও ঋষ্যশৃংগকে নিজ দেশে এনে অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে যথাবিহিত পূজা করলেন। শান্তার বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে সেখানে পরম সুখে থাকল।(২) অতঃপর বহূকাল অতীত হওয়ার পর একদা বসন্তকালে দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞ করার অভিলাষ হল। ঋষ্যশৃংগকে বংশবৃদ্ধির নিমিত্ত পুত্রেষ্ঠ যজ্ঞ করতে নিয়োগ করলে ঋষি সরযু নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণের আদেশ দিলেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে সূত মুখে সনৎকুমার বিবৃত পুরাকাহিনী শোনার আগেই দশরথ বসিষ্ঠকে পৌরোহিত্যে বরণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞর জন্য সরযুর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছিলেন।(৩) তখন দশরথ সুমন্ত্রকে পাঠিয়ে সুযজ্ঞ, বামদেব, জাবালি, কাশ্যপ এবং পুরোহিত বসিষ্ঠ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সমবেত করে তার অভিলাষ ব্যক্ত করলে সকলেই সম্মতিদান করলেন। পুনরায় বসন্তকালের আগমনে সংবৎসর পূর্ণ হল।

এবার দশরথ বসিষ্ঠর উপর যজ্ঞভার ন্যস্ত করলেন। বসিষ্ঠও সেই মত ব্যবস্থাদির নির্দেশ দিলেন। সকল আয়োজন সমাপ্ত হলে ঋষ্যশৃংগর সম্মতি নিয়ে দশরথ যজ্ঞস্থলের জন্য নির্গত হলেন। অনন্তর সংবৎসর পূর্ণ ও অশ্ব প্রত্যাগত হলে সরযুনদীর উত্তরতীরে যজ্ঞ আরম্ভ হল। যজ্ঞ সমাধা হলে দশরথ তার কুলবৃদ্ধির জন্য ঋষ্যশৃংগকে অনুরোধ করলেন। ঋষ্যশৃংগ কম্পসূত্রোক্ত বিধানানুসারে অথর্ববেদোক্ত মন্ত্রদ্বারা পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ শুরু করলেন। সেই যজ্ঞে সমবেত দেবতাগণ লোককত ব্ৰহ্মাকে রাবণের অত্যাচার হতে ত্রিলোককে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ব্রহ্মার বরে রাবণ দেব, গন্ধৰ্ব, যক্ষ ও রাক্ষসগণের অবধ্য। বর প্রার্থনা কালে রাবণ মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তার উল্লেখ করে নাই। সুতরাং মানুষ কেবল তাকে বধ করতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যে গরুড়পৃষ্ঠে আরূঢ় হয়ে বিষ্ণু সেখানে উপস্থিত হলে দেবতারা তাকে রাবণ বধের জন্য নিজের আত্মাকে চতুর্ধা করে রাজা দশরথের হ্রী, শ্রী ও কীর্তিসদৃশী তিন ভাৰ্যাতে পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। বিষ্ণু নারায়ণ মনুষ্যদেহ ধারণ করে রাবণ বধে কৃতসংকল্প হলেন।

অনন্তর দশরথের পুত্রেষ্ঠী-যজ্ঞীয় অগ্নিকুণ্ড হতে মহান এক প্রাণী আবির্ভূত হয়ে দশরথকে যজ্ঞফল প্রদান করে বললেন,—এই দেবনির্মিত পায়স ‘ভক্ষণ কর’ বলে ভাৰ্যাগণকে দিলে তারা গর্ভ ধারণ করবে। দশরথ সেই পায়সের অর্ধাংশ কৌসল্যাকে, বাকি অর্ধাংশর চার ভাগের এক ভাগ সুমিত্রাকে ও দুই ভাগ কৈকেয়ীকে দিয়ে অবশিষ্ট একভাগ পুনরায় সুমিত্রাকে দিলেন। দশরথের ভার্যাগণ সেই পায়স খেয়ে গর্ভধারণ করলেন।

ততো যজ্ঞে সমাপ্তে তু ঋতুনাং ষট্‌ সমত্যয়ুঃ।
ততশ্চ দ্বাদশে মাসে চৈত্রে নাবমিকে তিথৌ॥ ৮
নক্ষত্রেহদিতিদৈবত্যে স্বোচ্চসংস্থেষু পঞ্চসু।
গ্রহেষু কর্কটে লগ্নে বাক্‌পতাবিন্দুনা সহ॥ ৯
* * * * * *
পুষ্যে জাতস্তু ভরতো মীনলগ্নে প্রসন্নধীঃ।
সার্পে জাতৌ তু সৌমিত্রী কুলীরেহভূদিতে রবৌ॥ ১৫ (১.১৯.৮-৯,১৫)

যজ্ঞ সমাপনের পর ষষ্ঠ ঋতুতে চৈত্রমাসে নবমী তিথিতে, পুনর্বসু নক্ষত্রে, কর্কট লগ্নে কৌশল্যার পুত্র রাম জন্মগ্রহণ করল। রামের জন্মকালে পঞ্চগ্রহ স্বোচ্চস্থানে অর্থাৎ রবি মেঘ রাশিতে, মঙ্গল মকর রাশিতে, শনি তুলা রাশিতে, বৃহস্পতি ও চন্দ্র কর্কট রাশিতে এবং শুক্ল মীন রাশিতে ছিল। রাম বিষ্ণুর অর্ধাংশ। কৈকেয়ী ভরতকে প্রসব করলেন। ভরত বিষ্ণুর এক চতুর্থাংশ। সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন জন্ম নিল। এরা উভয়ে বিষ্ণুর এক অষ্টমাংশ। ভরত মীন লগ্নে পুষ্যা নক্ষত্রে এবং লক্ষ্মণ ও শত্ৰুঘ্ন রবি মেঘ রাশিতে কর্কট লগ্নে ও অশ্লেষা নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করে।

 

এই কাহিনীতে অশ্বমেধ প্রসংগটি খুবই জটিল। কারণ দশরথ অশ্বমেধ যজ্ঞ করা মনস্থ করে প্রথমে বসিষ্ঠের অনুমতিক্ৰমে সরযুর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণের নির্দেশ দেন। তারপর সূতমুখে সনৎকুমার কথিত পুরাকাহিনী শুনে অঙ্গদেশ হতে শান্তা-ঋষ্যশৃংগকে আনার ব্যবস্থা করেন। ঋষ্যশৃংগর আসার পর অনেক কাল অতিবাহিত হওয়ার পরে পুনরায় ঋষ্যশৃংগর অনুমতি ক্রমে সরযুর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণের আয়োজন করা হয়। অপরদিকে বসন্তকালে সংবৎসর পূর্ণ হলে দশরথ বাসিষ্ঠর উপর যজ্ঞভার অপন করলেন। এরপর একবছর পূর্ণ হলে ও অশ্ব প্রত্যাগত হলে যজ্ঞ আরম্ভ হল। অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাধা হলে পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ হয়। পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ শেষ হওয়ার এক বৎসর পরে রাম প্রমুখর জন্ম। কালের ব্যবধানের এই জটিলতাকে আপাততঃ বাদ দিয়ে বলা যায় দশরথের ঋষ্যশৃংগকে নিজ দেশে আনয়ন অর্থে তুলা রাশিতে শারদবিষুব এবং মেঘ-রাশিতে বাসন্ত বিষুবর নির্দেশ। দশরথ অঙ্গদেশে রোমপাদর সংগে সাত-আট দিন বাস করার পর ঋষ্যশৃংগকে পায়। একথায় মনে হয় তুলা রাশিতে বিশাখা নক্ষত্রে ২১০° (দুই শত দশ) অংশে সপ্তমী বা অষ্টমী তিথি গতে শারদ-বিষুব অনুষ্ঠিত হয়েছিল সুদুর অতীতে। মনে হয় এই স্মৃতিই বর্তমান সন্ধিপূজায় রূপায়িত হচ্ছে।

বিশাখা নক্ষত্র হতে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র অবধি যে জ্যোতিস্কপ্রবহ (Gl০bular cluster) বিরাজমান, তাকে সরযু নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং সরযুর উত্তরতীর শব্দে এই জ্যেতিষ্ক প্রবহের উত্তরদিগস্থ বা বামদিগস্থ নক্ষত্রকে ইংগিত করা হয়েছে। কাহিনীতে বার বার বলা হয়েছে ‘সরযন্ধশ্চোত্তরে তীরে’।(৪) সরযু শব্দের অর্থ বায়ু। স্বাতি নক্ষত্রর বৈদিক নাম মরুত্বান অর্থাৎ বায়ু। সুতরাং ‘সরয্বশ্চোত্তরে তীরে’ শব্দে স্বাতি নক্ষত্রের উত্তরে অর্থাৎ পূৰ্ববতী চিত্র নক্ষত্র বুঝানো যায়। শারদ বিষুব চিত্রা নক্ষত্রে উপনীত হওয়ার প্রাকৃ-মুহূতে দশরথের অশ্বমেধের তথা পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞের প্রস্তাবনা। বাসন্তবিষুব অশ্বিনী নক্ষত্রর শেষাংশে ১৩°-২০’ তেরো অংশ কুড়ি কলায় অনুষ্ঠিত হলে শারদ বিষুব হবে ১৯৩°-২০’ একশত তিরানৱই অংশ কুড়ি কলায় স্বাতি নক্ষত্রে। এই অংশ হতে চিত্র নক্ষত্রের শেষাংশে শারদ বিষুব আসতে যে সময় অতিবাহিত হয়েছিল তার নির্দেশনার জন্য ঋষ্যশৃংগর আগমণের পরও বহুকাল অতীত হওয়ার পরে পুনরায় অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তাবনা ও সূচনা। সুতরাং দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপন অর্থে শারদ বিষুব চিত্রা নক্ষত্রের শেষ অংশে এবং বাসন্তবিষুব অশ্বিনী নক্ষত্রের মধ্যস্থলে ৬°-৪০’ ছয় অংশ চল্লিশ কলায়।

এবার পুত্রেষ্ঠ যজ্ঞ। এই যজ্ঞের নূনপক্ষে এক বছর পরে বসন্তকালে রামের জন্ম। রামের জন্মকালে সূর্য মেষ রাশিতে এবং চন্দ্র কর্কট রাশিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে। চন্দ্র এক তিথিতে প্রায় ১২° বারো অংশ অতিক্রম করে। সুতরাং পূর্ববতী অমাবস্যা হয়েছিল রেবতী নক্ষত্রে। নয় তিথিতে সূর্য আন্দাজ আট অংশ অগ্রবর্তী হয়। ফলে রামের জন্মকালে সূর্যর অবস্থান ৬°-৪০’ ছয় অংশ চল্লিশ কলায় হওয়া স্বাভাবিক।

সম্পাতি কাহিনী বিশ্লেষণ করেও ঐ অংশে বাসন্ত-বিষুব স্থির হয়। সুতরাং রামের জন্মকালের সংগে বাসন্ত-বিষুব জড়িয়ে আছে। এজন্য ভবিষ্যতে আর কোন প্রসংগে ঋষ্যশৃংগর কথা রামায়ণে ব্যক্ত করা হয়নি। এই কাহিনীর দশরথ সংবৎসর। সূর্যবংশীয় দশরথ সূর্যরই প্রতীক। সংবৎসর প্রাচীনকালে তিন ঋতুতে বিভক্ত ছিল; গ্রীষ্ম, বর্ষা ও হিম (শীত)। এই তিন ঋতু দশরথের তিন স্ত্রী যথাক্ৰমে কৌসল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। চৈত্র হতে আষাঢ় গ্রীষ্মঋতু কৌসল্যা, শ্রাবণ হতে কার্তিক বৰ্ষাঋতু কৈকেয়ী এবং অগ্রহায়ণ হতে ফাল্গুন হিমঋতু সুমিত্রা। যেহেতু প্রাণ-জগতে বর্ষা শ্রেষ্ঠ ঋতু, সেকারণে রামায়ণে কৈকেয়ী দশরথের অতি আদরণীয়া, কিন্তু বাসন্ত-বিষুবতে মূল যজ্ঞ অনুষ্ঠিতব্য বিধায় এবং সম্ভবতঃ নববর্ষ গণনার বিধান। হেতু কৌসল্যা প্রধান মহিষী। সুসম বর্ষার কল্যাণে ফসলপ্রাপ্তি স্থিরীকৃত এবং হিমঝতু সাধারণের পক্ষে কষ্টদায়ক কারণে সুমিত্রা প্রায় উপেক্ষিতা।। বিষ্ণুর মানবদেহ ধারণ প্রসংগে কৌসল্যাকে হ্রী, কৈকেয়ীকে শ্রী এবং সুমিত্রাকে কীর্তি বলা হয়েছে।

হ্রী অর্থ লজ্জা, ব্রীঢ়া। হ্রী তথা হ্ৰীং দুর্গাবাচক অম্বিকার বীজমন্ত্র। প্রাচীনকালে বাসন্তবিষুবতে রুদ্রযজ্ঞ হত। রুদ্রের শক্তি রুদ্রাণী (দুর্গা, অম্বিকা)। সুতরাং যে ঋতুতে রুদ্রযজ্ঞের যজ্ঞাগীকে আরাধন করা হয় সেই ঋতুকে হ্রী আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুদুরতম বৈদিককালে মৃগশিরা নক্ষত্রে বাসন্তবিষুব হত। সেই কালকে নিয়ে ঋষ্যশৃংগ কাহিনীর নির্দেশনা। পরবর্তীকালে বসন্তবিষুব পিছিয়ে গিয়েছে রোহিনী, তারপর কৃত্তিকা নক্ষত্রে। পরিশেষে রামের জন্মকালে অশ্বিনী নক্ষত্রে।

কৌসল্যা,–কোসল +ষ্ণ অপত্যার্থে+আপ্‌। কোসল,—কু (পৃথিবী)—সল্‌ (গমন করা)+অন্‌ কর্তৃ। পৃথিবীতে গমনকারী। অতএব কৌসল্যা শব্দে গ্রীষ্মঋতুর প্রচণ্ড তাপকে রূপকে নির্দেশ করা যায়, কারণ সূর্যতাপ পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। গ্রীষ্ম ঋতুর প্রচণ্ড তাপে বায়ুমণ্ডলে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হওয়ার দরুণই আগামীতে বর্ষার আগমণ।

শ্রী অর্থ লক্ষ্মী। কৈকেয়ী,—কেকয় + ষ্ণ অপত্যার্থে+ঈপ্‌। কেকয়,–কে (মস্তক) ক (জল) য় (যুক্ত), অর্থাৎ মন্তকে জল সমন্বিত; বর্ষাঋতুর দৌতক। বৰ্ষাঋতুতে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। বৃষ্টির দরুন ধরিত্রী শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে। একারণে লক্ষ্মী, সম্পদদাত্রী।

বর্ষার কল্যাণে প্রাণ-জগতের শ্ৰীবৃদ্ধি। সুতরাং ঋতুর মধ্যে বর্ষা শ্রেষ্ঠ; সংবৎসরের আদরণীয় অংশ।

কীর্তি অর্থও লক্ষ্মী। যশঃ, খ্যাতি।

সুমিত্র,—সু (উত্তম) মিত্র (বন্ধু, সূর্য)+আপ্‌। অর্থাৎ কার্যকরী সূর্য তাপ।

বৃশ্চিক রাশিস্থ আদিত্যর নাম মিত্র, অনুরাধা নক্ষত্রর বৈদিক নাম মিত্র। সুতরাং সুমিত্রার সঙ্গে হিম ঋতুর সম্পর্ক পাওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ বৰ্ষাঋতুর প্রথমার্ধে সুসম বর্ষণ এবং হিম ঋতুর প্রথমাধে কার্যকরী সূর্যতাপ প্রচুর ফসল প্রাপ্তির অনুকুল। লক্ষ্মীর রুপান্তর ফসল সম্পদ। সুতরাং দশরথ ও তার তিন ভাৰ্যার কোন মানবিক সত্ব থাক বা নাই থাক, অন্ততঃ রামের জন্ম সংক্রান্ত কাহিনীতে এর সংবৎসর ও তিন ঋতুর রূপক সত্ব।

দেবতাগণের অনুরোধে বিষ্ণু আপন আত্মা চতুধর্ণ করে দশরথের চারিপুত্ররূপে মানবদেহ ধারণ করেছিলেন। দশরথের পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞে বিষ্ণু গরুড়ে আরোহণ করে এসেছিলেন। এর তাৎপর্য হল গরুড় অর্থাৎ শ্রবণা নক্ষত্রে উত্তরায়ণ। শ্রবণার বৈদিক নাম বিষ্ণু। কৰ্কট রাশিস্থ সূর্য তথ। শ্রাবণ মাসের সূর্যর নাম বিষ্ণু।

ক্ষিরোদসমুদ্র ছায়াপথ; স্বৰ্গঙ্গাও বলা হয়। উত্তরায়ণকালে সূর্য থাকে মকরক্লান্তিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিভাগে। এসময় সূর্যর তাপে সমুদ্রের জল বাষ্পে পরিণত হয়ে পুঞ্জীভূত মেঘের সৃষ্টি করে। বাসন্তবিষুবতে সূর্য এলে দক্ষিণ দিক হতে বাতাস বইতে শুরু হয়। সূর্য যতই দক্ষিণায়নাদির দিকে এগোয় এই বাতাসের গতি তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে সমুদ্রজাত পুঞ্জীভূত মেঘ টেনে আনে, বৰ্ষাঋতু শুরু হয়। অনুরুপভাবে শারদবিষুবতে সূর্য এলে বাতাসের গতি দক্ষিণমুখী হয়। সূর্যর গতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর গতিও বৃদ্ধি পায় যার টানে জলশূন্য মেঘ আবার সমুদ্রগামী হয়।

এই কাহিনীর বিষ্ণু উত্তরায়ণের সূর্য শুধু নয়, এই মেঘচক্রের প্রভিভূ। বিষ্ণুর অর্ধাংশে রাম, অর্থাং উত্তরায়ণ হতে দক্ষিণায়ন। এই সময়কালের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের উর্ধগগনে মেঘ সঞ্জাত হয়। বিষ্ণুর এক অষ্টমাংশে লক্ষ্মণ, অর্থাৎ দক্ষিণায়নাদি হতে দেড়মাস কাল। এই সময়ে বর্ষাকালে প্রচুর বারিবর্ষণ হয়। লক্ষ্মণ অর্থ চিহ্ন। মেঘের স্বরূপ প্রকাশ পায় বারিবর্ষণে। যেখানে মেঘ, সেখানে বর্ষণ। এজন্য লক্ষ্মণ রামের ছায়াসঙ্গী।

পরের তিনমাস বিষ্ণুর এক চতুর্থাংশে ভরত। ভরত,—ভূ (ভরণ করা, ধারণ করা) ধাতু নিষ্পন্ন শব্দটির অর্থ ধারণকারী। ভরত অর্থ ক্ষেত্র। দক্ষিণায়নাদিতে বর্ষাসমাগমে ভূপৃষ্ঠ ও বায়ু মণ্ডল উভয় ক্ষেত্রে জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কৃষি-জমির জলধারণ ক্ষমতাহেতু ফসলের শ্ৰীবৃদ্ধি। এই অবস্থার রূপক নাম ভরত।

বাকি দেড় মাস বিষ্ণুর এক অষ্টমাংশে শত্রুঘ্ন। শত্রুকে যিনি হনন করেন তিনি শত্রুঘ্ন। এই সময় বায়ুমণ্ডলের আদ্রত কমে যায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের জলস্তর নিম্নগামী হয়। শস্যবীজ সুপুষ্ট হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে। কৃষিকাজের ফলশ্রুতি পাক ফসল ঘরে ওঠে। সূর্য তখন ভূ-পৃষ্ঠের সমুদ্রের উপরিভাগে মকরক্লাস্তিতে। সূর্যতেজে জল বাম্পে পরিণত হয় তখন, আগামী বৎসরের বর্ষাকে স্থিরীকৃত করতে। সূর্যর দক্ষিণায়নে বায়ুর গতি পরিবতন হেতু মেঘও দক্ষিণগামী হয়। এই নৈসাগিক ঘটনাকে রামায়ণে রামের বনবাসগমন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রের জলধারণ ক্ষমতাহেতু চারাগাছের পুষ্টি ও শ্ৰীবৃদ্ধি। একারণে রামায়ণে রামকে বনবাসে পাঠিয়ে ভরতের রাজ্যলাভের বিবরণ।

রামজন্ম সংক্রান্ত সকল কাহিনীর বিশ্লেষণ করে রামের মেঘদৈবত স্বরূপটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এছাড়া রামায়ণ কালের বাসন্তবিষুব স্থানটিরও নির্দেশ পাওয়া যায়।

সম্পাতি কাহিনীতে যেমন, এই প্রসঙ্গে ঋষ্যশৃংগ কাহিনীতে তেমনি একাধিক কালের বিষুব স্থানের বিবরণ রাখা হয়েছে। শব্দচয়ণে ও স্বভাবসিদ্ধ রহস্যসৃষ্টির কারণে বহুঅর্থবহ স্বরূপটির সুযোগ নেওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *