০৪. ভরতকে রাজা করিয়া রামকে বনে পাঠাইতে কুঁজীর কৈকেয়ীকে মন্ত্রণা দান

পূর্ণ স্বর্ণকুম্ভের উপরে আম্রসার।
শাস্ত্রের বিহিত সব মঙ্গল আচার।।
নানা রত্নে নিম্মাইল টুঙ্গী শতে শতে।
নানাবর্ণে পতাকা উড়িছে প্রতি পথে।।
প্রতি ঘরে শোভা করে সুবর্ণের ঝারা।
নানা রত্নে শোভে লক্ষ লক্ষ চবুতারা।।
নানা রত্নে নির্ম্মিত আগার সারি সারি।
জিনিয়া অমরাবতী রম্যবেশধারী।।
ইন্দ্রপুরে যেমন সবার রম্যবেশ।
তেমন মঙ্গলযুক্ত অযোধ্যার দেশ।।
দৈবের নির্ব্বন্ধ কভু না যায় খণ্ডণ।
কে জানে পড়িবে আসি প্রমাদ কখন।।
পূর্ব্বজন্মে ছিল নামে দুন্দুভি অপ্সরা।
জন্মিল সে কুঁজী হয়ে নামেতে মন্থরা।।
তার পৃষ্ঠে কুঁজ যেন ভরন্ত ডাবরী।
কুটিল কুরূপা কুঁজী ক্রূরকর্ম্মকারী।।
কৈকেয়ীর বেড়ী, ভরতের ধাত্রীমাতা।
রামের দুঃখের হেতু সৃজিল বিধাতা।।
দশরথ পেয়েছিল বিবাহে সে চড়ী।
রাম রাজা হন দেখি করে ধড়ফড়ি।।
আকৃতি প্রকৃতিতে কুৎসিতা দেখি তারে।
সর্ব্বনাশ করে কুঁজী থাকে যার ঘরে।।
রামের দুঃখের হেতু তার উপাদান।
রাজার মরণ, কৈকেয়ীর অপমান।।
মরিবে রাবণ যাতে, বিধাতা সে জানে।
বিধাতা সৃজিল তারে এই সে কারণে।।
আচম্বিতে কুঁজী চেড়ী আইল বাহিরে।
প্রজা আনন্দিত সব দেখিল নগরে।।
টুঙ্গীর উপরে উঠি কুঁজী তাহা দেখে।
রাম রাজা হবে, মহা হরিষত লোকে।।
চেড়ী চেড়ী এক ঠাঁই টুঙ্গীর উপরে।
কুঁজী চেড়ী জিজ্ঞাসিল ইতর চেড়ীরে।।
কি কারণে হরষিত অযোধ্যা নগর।
কি হেতু কৌশল্যা রাণী হরিষ অন্তর।।
কি জন্য রামের মাতা করে বহু দান।
সবে মেলি তোমরা কি কর অনুমান।।
আর চেড়ী বলে, তুমি না জান মন্থরা।
রামেরে করিতে রাজা ভূপতির ত্বরা।।
রাজার নিকট মৃত্যু গণিয়া অসার।
এই হেতু রামেরে দিলেন রাজ্যভার।।
এমত শুনিল কুঁজী সে চেড়ীর মুখে।
বজ্রাঘাত হয় যেন মন্থরার বুকে।।
বিধাতার বাজী কেবা করয়ে খণ্ডন।
কৈকেয়ীরে গালি দিতে করিল গমন।।
কৈকেয়ী আপন ঘরে ছিলেন শয়নে।
সত্বর মন্থরা গিয়া কহিল সেখানে।।
নিব্বুর্দ্ধি কৈকেয়ী শুনে আছ কোন্ লাজে।
তো হেন পুত্রের সনে কেহ নাহি মজে।।
মানেতে মরিবি তুই শোকের সাগরে।
ভরতে এড়িয়া রাজা রামে রাজা করে।।
ভরতেরে রাজা কর, রাখ নিজ পণ।
রাজারে কহিয়া রামে পাঠাও কানন।।
রাম রাজা হইলে কিসের অধিকার।
ভরত হইলে রাজা সকলি তোমার।।
এতেক রাজার হও তুমি মুখ্যা রাণী।
ভরত হইলে রাজা, রাজার জননী।।
কৈকেয়ী বলেন রাম ধার্ম্মিক তনয়।
কোন্ দোষে করিব রামের অপচয়।।
আমার গৌরব রাম রাখে অতিশয়।
করিতে রামের মন্দ উপযুক্ত নয়।।
গুণের সাগর রাম, বিচারে পণ্ডিত।
পিতৃরাজ্য জ্যেষ্ঠপুত্র পাইতে উচিত।।
রাম রাজা হইলে সন্তুষ্ট সর্ব্বজনে।
তুষিবেন সবাকারে রাম বহু ধনে।।
ভরতেরে রাজ্য রাম দিবেন আপনি।
রাখিবেন আমার গৌরব বড় রাণী।।
রাম রাজা হইলে আমার বহু মান।
শুভবার্ত্তা কহিলি, কি দিব তোরে দান।।
রাম রাজা হবেন হরিষ সর্ব্বজন।
হরিষে বিষাদ কুঁজী কর কি কারণ।।
যত গুণ রামের কৈকেয়ী তাহা জানে।
মন্থরাকে দান দিতে চিন্তে মনে মনে।।
অঙ্গ হৈতে অলঙ্কার খুলি শশব্যস্তে।
আদরে কৈকেয়ী যেন মন্থরার হস্তে।।
কৈকেয়ী কহেন, কুঁজী না কর উত্তর।
রাম রাজা হৈলে ধন দিব তা বিস্তর।।
কুপিয়া মন্থরা চেড়ী দুই ওষ্ঠ কাঁপে।
কৈকেয়ীরে গালি পাড়ে অতুল প্রতাপে।।
হাত হৈতে অলঙ্কার ছড়াইয়া ফেলে।
দুই চক্ষু রাঙ্গা করি কৈকেয়ীরে বলে।।
কৈকেয়ী তোমার দুঃখ আমার অন্তরে।
বলি হিত, বিপরীত বুঝাও আমারে।।
সপত্নী-তনয় রাজা, তুমি আনন্দিতা।
কৌশল্যা তোমার চেয়ে বুদ্ধিতে পণ্ডিতা।।
নিজ পুত্রে রাজা করে স্বামীর সোহাগে।
থাকিবা দাসীর ন্যায় কৌশল্যার আগে।।
থাকিল কৌশল্যা রাণী সীতার সম্পদে।
দাঁড়াইতে নারিবি সীতার পরিচ্ছদে।।
কৌশল্যা জিনিলা তুমি সোহাগের দাপে।
নিজ পুত্রে রাজা করে এই মনস্তাপে।।
ভরত থাকিল গিয়া মাতামহ ঘরে।
রাজার কি দোষ দিব, না দেখি তাহারে।।
সতীনের আনন্দেতে আনন্দা সতিনী।
হেন অপরূপ কভু না দেখি না শুনি।।
লালিয়া পালিয়া বড় করিনু ভরতে।
মাতা পুত্রে পড়িলা সে কৌশল্যার হাতে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দুই একই শরীর।
উভয়ে করিবে রাজ্য, ভরত বাহির।।
তবে ত ভরত তোর হইল বঞ্চিত।
হিত কথা বলিলাম, বুঝিস অহিত।।
ভরত না পেয়ে রাজ্য না আসিবে দেশে।
না দেখিবে তব মুখ, থাকিবে প্রবাসে।।
মন্ত্রণা করিয়া রামে পাঠাও কানন।
ভরতেরে রাজ্য দেহ যদি লয় মন।।
শুনিয়া কুঁজীর কথা কৈকেয়ীর আশ।
কুঁজীর বচনে তার বুদ্ধি হৈল নাশ।।
দেব দৈত্য আদি লোক রাম হেতু সুখী।
প্রমাদ পাড়িল চেড়ী কোথাও না দেখি।।
কৈকেয়ী বলেন, কুঁজী তুমি হিতৈষিণী।
রাম মম মন্দকারী কিছুই না জানি।।
ভরত প্রবাসে, রাম রাজা হবে আজি।
কেমনে অন্যথা করি, যুক্তি বল কুঁজী।।
নৃপতির প্রাণ রাম গুণের সাগর।
কেমনে পাঠাব তারে বনের ভিতর।।
ঘরেতে রাখিব বরং রাজ্য নাহি দিব।
কোন্ দোষে শ্রীরামেরে বনে পাঠাইব।।
চারি পুত্র আছে তাঁর ভরত বিদেশে।
অংশ-অনুসারে ভাগ পাইবেন শেষে।।
জ্যেষ্ঠ ভাই আছে তার কর বিবেচনা।
কহ দেখি কুঁজী তুমি কর কি মন্ত্রণা।।
সবে তুষ্ট শ্রীরামের মধুর বচনে।
হেন রামে কেমনে পাঠাবে রাজা বনে।।
ভরত পাইবে রাজ্য না দেখি উপায়।
যুক্তি বল ভরত কিরূপে রাজ্য পায়।।
কি প্রকারে রামের হইবে বনবাস।
ভরতেরে রাজ্য দিয়া পূরাইব আশ।।
কুঁজী বলে, যুক্তি চাহ যুক্তি দিতে পারি।
হেন যুক্তি দিব যে ভরতে রাজা করি।।
পূর্ব্বকথা সকল আমার আছে মনে।
সে সকল কথা কহি, শুন সাবধানে।।
পূর্ব্বে যুদ্ধ করিল যে দানব সম্বর।
সেই যুদ্ধে মহারাজ ক্ষত কলেবর।।
তাহাতে করিলা তাঁর তুমি সেবা পূজা।
সুস্থ হৈয়া বর দিতে চাহিলেন রাজা।।
আরবার রাজার যে হইল বিষ্ফোট।
তাপ দিতে মুখের ঠেকিল দুই ঠোঁট।।
রক্ত পূঁজ যতেক লাগিল তব মুখে।
তব যত দুঃখ রাজা দেখিল সম্মুখে।।
তোমার সেবায় রাজা পাইল নিস্তার।
বর দিতে চাহিল তোমায় পুনর্ব্বার।।
তখন বলিলে তুমি রাজার গোচর।
কুঁজী যবে বর চাহে, তবে দিও বর।।
দুই বারে দুই বর থাক তব ঠাঁই।
কুঁজী যবে বর চাহে, তবে যেন পাই।।
এই কথা কহিলা আসিয়া মোর স্থানে।
তুমি পাসরিলে মোর সব আছে মনে।।
আমি রাম রাজা হবে বেলা অবশেষে।
আগে আসিবেন রাজা তোমার সম্ভাষে।।
পট্টবস্ত্র এড়ি পর মলিন বসন।
খসাইয়া ফেল যত গায়ের ভূষণ।।
ভূমিতে পড়িয়া থাক ত্যজিয়া আহার।
রাজা জিজ্ঞাসিবে তব দেখিয়া আকার।।
জিজ্ঞাসা করিবে রাজা কোপের কারণ।
না দিও উত্তর তুমি, করিও রোদন।।
বিবিধ প্রকারে তোমা করিবে সান্ত্বনা।
যাচিবে তোমারে বস্ত্র অলঙ্কার নানা।।
তবে পূর্ব্বে নির্ব্বন্ধ কহিবা তার স্থান।
আগে সত্য করাইয়া পিছে মাগ দান।।
পূর্ব্বকথা রাজার অবশ্য হবে মনে।
দুই বর মাগিহ রাজার বিদ্যমানে।।
এক বরে করাইবা রাজা ভরতেরে।
আর বরে পাঠাইবা অরণ্যে রামেরে।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ যদি রাম থাকে বনে।
পৃথিবী পূরাবে তুমি ভরতের ধনে।।
তুমি যদি প্রাণ চাহ, রাজা প্রাণ দেয়।
রাম হেন প্রিয় পুত্র বনে উপেক্ষায়।।
এমনি আসক্ত রাজা তোমার উপর।
সত্যে বদ্ধ আছে, কেন নাহি দিবে বর।।
ফিরিল কৈকেয়ী রাণী কুঁজীর বচনে।
অধর্ম্ম অযশ কিছু নাহি করে মনে।।
ঘোর ব্রহ্মশাপ আছে কৈকেয়ীর তরে।
সেই দোষে কৈকেয়ী প্রমাদ এত করে।।
পিত্রালয়ে কৈকেয়ী ছিলেন শিশুকালে।
করিয়াছিলেন ব্যঙ্গ ব্রাহ্মণেরে ছলে।।
তাহাতে জন্মিল ব্রাহ্মণের মনে তাপ।
কুপিয়া ব্রাহ্মণ তারে দিল ব্রহ্মশাপ।।
দেখিয়া করিস্ ব্যঙ্গ কহিস্ কর্কশ।
সর্ব্বলোক গায় যেন তব অপযশ।।
ব্রহ্মশাপ কৈকেয়ীর না হয় খণ্ডন।
সেই হেতু ঘটিলেক এ সব ঘটন।।
অনন্তর কৈকেয়ীর প্রসন্ন বদন।
করে ধরি কুঁজীরে করিল আলিঙ্গন।।
কুঁজীরে কৈকেয়ী কহে অতি হৃষ্টমনে।
তব তুল্য গুণবতী না দেখি ভুবনে।।
যত বল সকলি সে নহেত কুৎসিত।
সকলি অহিত মম, তুমি মাত্র হিত।।
গৌরবর্ণ ধর তুমি যেন চন্দ্রকলা।
গলায় তুলিয়া দেহ দিব্য পুষ্পমালা।।
রত্নহার লও, পর কুঁজের উপর।
ভরত হইলে রাজা দিব ত বিস্তর।।
যেমন বিস্তর সেবা করিলি আমার।
যদি দিন পাই তবে শুধিব সে ধার।।
যদি রাজা রামেরে পাঠায় আজি বন।
তবে সে করিব স্নান, করিব ভোজন।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি তব বিদ্যমানে।
কাননে পাঠাই রামে দেখ এইক্ষণে।।
কৈকেয়ীর কথা শুনি কুঁজীর উল্লাস।
রচিল অযোধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাস।।