০২. সুগ্রীবের সহিত শ্রীরামের মিত্রতা বন্ধন ও সুগ্রীবের প্রাপ্ত সীতার ভূষণ শ্রীরামকে প্রত্যর্পণ

মুনিবেশে হনুমান দেখে দুই জন।
তপস্বীর বেশ ধরি করে সম্ভাষণ।।
হনুমান বলে, প্রভু দেখি যে আকার।
অবশ্য হইবে কোন রাজার কুমার।।
চন্দ্র সূর্য্য জিনি রূপ ভ্রম ভূমিতলে।
গগন-মণ্ডল ছাড়ি কেন বনস্থলে।।
কোথা ঘর, কি কারণে হেথা আগমন।
বিশেষিয়া কহ প্রভু সব বিবরণ।।
সুগ্রীব বানর রাজা লোকে খ্যাতিমান।
তাঁহার সচিব আমি, নাম হনুমান।।
তোমা সহ মিত্রতা করিতে অভিলাষ।
পাঠাইল সুগ্রীব আমারে তব পাশ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন লক্ষ্মণ বচন।
সুগ্রীবের পাত্র সহ কর সম্ভাষণ।।
এতেক কহেন যদি কমললোচন।
নিজ পরিচয় দেন তাহারে লক্ষ্মণ।।
মহারাজ দশরথ পৃথিবী-ভূষণ।
আমরা তাঁহার পুত্র শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
আসিলাম পিতৃসত্য পালিতে কানন।
শূন্য ঘরে সীতা পেয়ে হরিল রাবণ।।
কোন্ সিদ্ধপুরুসে কহিল উপদেশ।
সুগ্রীব হইতে সব খণ্ডিবেক ক্লেশ।।
ভ্রমিতেছি আমরা সে সুগ্রীবের উদ্দেশে।
দোঁহারে লইয়া চল সুগ্রীবের পাশে।।
হনুমান বলেন উভয় দরশনে।
পরস্পর তুষ্টি হবে উভয়ের মনে।।
সুগ্রীবের রাজ্য নাহি, নাই তার নারী।
বালি রাজা হরিয়া করিল দেশান্তরী।।
সুগ্রীব পাইবে রাজ্য সাহায্যে তোমার।
সুগ্রীব করিবে তব সীতার উদ্ধার।।
হারাইয়া রাজ্য ভ্রমে সুগ্রীব কাননে।
রাজ্যসুখ পাইবে সে তোমা দরশনে।।
শ্রীরাম বলেন, কপি করহ গমন।
সুগ্রীবের সহ মোর করাহ মিলন।।
শুনিয়া রামের বাক্য যান হনুমান।
কহেন সকল সুগ্রীবের বিদ্যমান।।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতে উঠিয়া সেইক্ষণে।
হনুমান কহেন, সুগ্রীব রাজা শুনে।।
ছাড়হ বানর-মূর্ত্তি কুৎসিত আকার।
ধরহ মনুষ্য-রূপ দেখিতে সুসার।।
পাদ্য অর্ঘ্য লইয়া করহ শিষ্টাচার।
আসিলেন রাম দশরথের কুমার।।
তাঁহারে সহায় যদি কর মহারাজ।
ইহ পরকালে তব স্দ্ধি হবে কাজ।।
রামের অনুজ সে লক্ষ্মণে সুলক্ষণ।
সুবর্ণ কুবর্ণ মানি করি নিরীক্ষণ।।
রামের রমণী সীতা হরিল রাবণ।
সেই হেতু তোমাকে তাঁহার প্রয়োজন।।
সুগ্রীব তোমাকে আজি অনুকূল বিধি।
কোথা হৈতে মিলাইলা রাম গুণনিধি।।
এতদিনে তোমার দুঃখের বিমোচন।
তোমারে সদয় রামরূপী জনার্দ্দন।।
যাঁর তত্ত্ব চারি বেদে না হয় কিঞ্চিৎ।
বিরিঞ্চি বাঞ্ছিত যাতে শঙ্কর বাঞ্ছিত।।
যোগে যাগে যোগিগণ না পান যাঁহারে।
সেই রাম রমানাথ উপস্থিত দ্বারে।।
শুনিয়া সুগ্রীব রাজা আপনা পাসরে।
ফল পুষ্প লয়ে গেল রামের গোচরে।।
বড় ভাগ্য সুগ্রীবের, বিধির লিখন।
শুভক্ষণে করিল শ্রীরাম দরশন।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া ম্রীরামের পূজা করে।
প্রেমানন্দে সুগ্রীবের নেত্র নীর ঝরে।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল কপিরাজ।
হইয়াছি জ্ঞাত রাম, তোমার যে কাজ।।
কহিলেক সকল আমারে হনুমান।
সীতার উদ্ধার হেতু আসিলে এ স্থান।।
মিত্রতা করিবে রাম পশুর সহিত।
এই হনুমান বাক্য না হয় প্রতীত।।
পশু প্রতি যদি রাম হয় অনুগ্রহ।
মিত্র বলি রঘুবীর হস্তে হস্ত দেহ।।
দাস-যোগ্য নহি আমি, জাতিতে বানর।
করুণা প্রকাশ রাম করুণা-সাগর।।
পাষাণের উপরে অর্পিয়া নিজ পদ।
অনায়াসে দিলা তারে মনুষ্যের পদ।।
চণ্ডালেরে সখ্যভাবে করিলা উদ্ধার।
নীচের নিস্তার হেতু তব অবতার।।
দয়াল শ্রীরামচনদ্র কমললোচন।
বানরের হাহে দেন হাত নারায়ণ।।
পুঞ্জ পুঞ্জ পূর্ব্ব পুণ্য সুগ্রীবের ছিল।
বিরিঞ্চি-বাঞ্ছিত পদ প্রত্যক্ষ পাইল।।
পরম দয়াল রাম, গুণে নাহি সন্ধি।
যাঁর গুণে বনের বানর হয় বন্দী।।
বানরের হাত দিতে নহেন বিমর্ষ।
দিলেন দক্ষিণ হাত শ্রীরাম সহর্ষ।।
মুনিবেশ ছাড়ি হয়ে কপি হনুমান।
কাষ্ঠ আনে বাছিয়া ডাগর দুই খান।।
দুই কাষ্ঠ ঘর্ষণ করিতে অগ্নি জ্বলে।
অগ্নি সাক্ষী করি দোঁহে মিত্র মিত্র বলে।।
পরস্পর বৈরী মারি উদ্ধারিব নারী।
অগ্নি সাক্ষী এই সত্য হইল দোঁহারি।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কেবা করিবে খণ্ডন।
বানরের সঙ্গে সত্যে বদ্ধ নারায়ণ।।
সবা হৈতে সুগ্রীবের অধিক কপাল।
মিতালি করেন রাম পরম দয়াল।।
উভয়ে কহেন কথা, শুনেন উভয়।
উভয়ে উভয় প্রতি প্রীতি অতিশয়।।
উভয়ের মিত্রতা যে শুনে কিম্বা কয়।
সুগ্রীবের মত তার হয় ভাগ্যোদয়।।
সুগ্রীব বলেন, রাম কহি অবশেষে।
পাইয়াছিলাম বুঝি সীতার উদ্দেশ।।
আমরা বানর পঞ্চ ছিলাম পর্ব্বতে।
দেখিলাম এক কন্যা রাবণের রথে।।
হাত পা আছাড়ে, করে কঙ্কণের ধ্বনি।
গরুড়ের মুখে যেন বদ্ধা ভুজঙ্গিনী।।
গলার উত্তরীয়, গায়ের আভরণ।
রথ হৈতে পড়িল যেমন তারাগণ।।
অনুমানে বুঝি, তিনি তোমার সুন্দরী।
যত্ন করি রাখিয়াছি ভূষণ উত্তরী।।
যদি আজ্ঞা হয় তব, আনি তা এখন।
হয় নয়, চিন মিত্র সীতার ভূষণ।।
শ্রীরাম বলেন, মিত্র কর সে বিধান।
দেখাও সীতার চিহ্ন রাখ মম প্রাণ।।
আভরণ আনেন সুগ্রীব সে স্থলে।
দেখিয়া রামের শোক-সাগর উথলে।।
অবশ হইয়া রাম পড়েন ভূতলে।
শরীর ভাসিল তাঁর নয়নের জলে।।
বিলাপ করেন, কোথা রহিলে সুন্দরি।
তোমার ভূষণ এই তোমার উত্তরী।।
জানাইতে আমারে ফেলিয়াছিলে পথে।
কোন্ দিকে গেল প্রিয়ে জানিব কি মতে।।
কহ কহ সুগ্রীব, আমার তুমি সখা।
পুনঃ কি পাইব আমি জানকীর দেখা।।
জানকীর রূপ মনে হইলে উদয়।
জ্ঞানহত হই, দেখি বিশ্ব তমোময়।।
স্থির নহে মন, দহে দিবস রজনী।
কোথা গেলে পাইব সে সুধাংশু -বদনী।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে রাবণ বৈসে যথা।
ঘুচাইব সর্ব্বত্র রাক্ষসজাতি কথা।।
ত্রিভুবনে জানে মম ধনুকের ছটা।
মারিব রাক্ষসগণে, রক্ষা করে কেটা।।
লক্ষ্মণ উদ্যোগ কর আন ধনুর্ব্বাণ।
অরি বধ করি, করি শোকাগ্নি নির্ব্বাণ।।
সুগ্রীব বিবিধরূপে রামকে বুঝান।
কৃত্তিবাস রচে গীত অদ্ভুত ব্যাখান।।