০২৮. কুম্ভকর্ণের অকালে নিদ্রাভঙ্গ ও রাবণের সহিত কথোপকথন

ভঙ্গ দিয়া গেল রাবণ পেয়ে অপমান।
পাত্রমিত্র লয়ে বৈসে করিয়া দেয়ান।।
ছত্রিশ কোটি সেনাপতি চৌদিকে বেষ্টন।
সভামধ্যে সিংহানসেন বসিল রাবণ।।
রাবণ বলে, বুঝিলাম দেবতার ফন্দি।
এতদিনে গড়াইল যা বলিল নন্দী।।
কুবেরে জিনিয়া আসি কৈলাস-শিখরে।
নন্দী দাঁড়াইয়াছিল শিবের ‍দুয়ারে।।
শিব-দুর্গা দরশনে বাসনা আমার।
বিস্তর বিনয়ে নন্দী না ছাড়িল দ্বার।।
বিকৃত বানর-মুখ নন্দী যে দুয়ারী।
মুখপানে চাহি তারে দিলাম টিটকারী।।
নন্দী কোপ করি মোরে দিল অভিশাপ।
সেই শাপে পাই এত মনেতে সন্তাপ।।
নন্দী কহিলেন, আমি শিবের কিঙ্কর।
মোরে উপহাস কর দুষ্ট নিশাচর।।
বানর-মুখ দেখি তুই কৈলি উপহাস।
এই মুখে হবে তোর সবংশে বিনাশ।।
ফলিল নন্দীর শাপ এতদিন পরে।
পরাজয় করিলেক বনের বানরে।।
করেছি বিস্তর তপ হইতে অমর।
অমর হইতে ব্রহ্মা নাহি দিলা বর।।
এই বর দিলা ব্রহ্মা হইয়া সদয়।
যক্ষ রক্ষঃ দেবতা গন্ধর্ব্বে নাহি ভয়।।
সবারে জিনিব রণে মাগি নিলাম বর।
সবে মাত্র বাকি ছিল নর আর বানর।।
ভেবেছিলাম ভক্ষ্য মধ্যে এরা দুইজন।
কে জানে বানর নর দুর্জ্জয় এমন।।
পুনঃ ব্রহ্মা বর দিলা অনুকূল হয়ে।
কাটামুণ্ড যোড়া যাবে স্কন্ধেতে আসিয়ে।।
দেব দানব গন্ধর্ব্বেতে তোর নাহি ডর।
সবংশে মারিবে তোরে নর আর বানর।।
ব্রহ্মার বচন মোরে কভু নহে আন।
এতদিনে পাইলাম বড় অপমান।।
সর্ব্বাঙ্গ পুড়িছে মোর মনুষ্যের বাণে।
রাজা হয়ে হারিলাম জিনে কোন্ জনে।।
নিদ্রা যায় কুম্ভকর্ণ জাগিবেক কবে।
বিচার করিয়া দেখ সভাখণ্ড সবে।।
যার অর্দ্ধ লঙ্কাপুরী কুম্ভকর্ণ ভোগে।
ছয় মাস নিদ্রা যায়, একদিন জাগে।।
পাঁচ মাস গত নিদ্রা একমাস আছে।
আজি লঙ্কা মজিলে কি করিবে সে পাছে।।
কুম্ভকর্ণে জাগাইতে করহ যতন।
প্রাণসত্ত্বে মোর যেন হয় সচেতন।।
এত যদি আজ্ঞা দিল রাজা লঙ্কেশ্বর।
তিন লক্ষ রাক্ষস চলে কুম্ভকর্ণ-ঘর।।
ভক্ষ্যদ্রব্য মদ্য মাংস অনেক প্রকার।
সুগন্ধি চন্দন পুষ্প আনে ভারে ভার।।
পালে পালে মহিষ হরিণ আনে কত।
ছাগল গাড়র নাহি হয় পরিমিত।।
সোণার নির্ম্মিত গৃহ অতি মনোহর।
বিশ্বকর্ম্মা-নির্ম্মিত বিচিত্র বহুতর।।
সারি সারি সোণার কলস সব সাজে।
নেতের পতাকা উড়ে জয়ঘন্টা বাজে।।
ত্রিশ যোজন ঘরখান দীর্ঘ নিরূপণ।
আড়ে দশ যোজন দেখিতে সুগঠন।।
চারিক্রোশ যুড়ে দ্বার আড়েতে নির্ণয়।
দীর্ঘেতে যোজন অষ্ট দৃষ্টি নাহি হয়।।
চারিদিকে এইরূপ দ্বার শোভে চারি।
মধ্যে মধ্যে গবাক্ষ শোভিছে সারি সারি।।
রত্নখাটে কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় অচেতন।
নাকের নিশ্বাস যেন প্রলয় পবন।।
দুয়ারের নিকটেতে যে রাক্ষস আসে।
উড়াইয়া ফেলে তারে নাকের নিশ্বাসে।।
টানিয়া নিশ্বাস যবে তুলে নিশাচর।
রাক্ষস কতেক ঢোকে নাকের ভিতর।।
যে সব রক্ষস জানে সন্ধি উপদেশ।
অনেক শক্তিতে ঘরে করিল প্রবেশ।।
মদ্য তোলে সাত তাল-বৃক্ষের সমান।
মুখের গহ্বর যেন পাতাল প্রমাণ।।
অঙ্গ ভঙ্গে আলসে যখন তুলে হাই।
মুখের গভীর যেন বড় গড়খাই।।
কিরূপেতে কুম্ভকর্ণের হবে নিদ্রাভঙ্গ।
কত শত নিশাচর করে কত রঙ্গ।।
বাজাইল লক্ষ ঢাক চারিদিকে বেড়ে।
নিদ্রা যায় কুম্ভকর্ণ কর্ণ নাহি নড়ে।।
ঘড়া ঘড়া চন্দন ঢালিয়া দিল বুকে।
সুগন্ধি শীতলে আরো নিদ্রা যায় সুখে।।
বাজায় কর্ণের কাছে তিন লক্ষ শাঁখ।
দ্বিগুণ বাড়িল আরো নাসিকার ডাক।।
শাঁখ নাক-গর্জ্জনে গভীর মহাশব্দ।
শঙ্কায় লঙ্কার লোক হয়ে রহে স্তবদ্ধ।।
পালে পালে আনিলেক ছাগল গাড়র।
প্রবেশ করায় তার নাকের ভিতর।।
তিন অর্দ্ধ নাসারন্ধ্রে রহিতে না পারে।
নিশ্বাসে পড়িল গড়ে দিগ্ দিগন্তরে।।
যতেক প্রবন্ধ করে নিশাচরগণে।
ব্রহ্মা-বরে নিদ্রা যায় কিছু নাহি জানে।।
রাবণ গোচরে বার্ত্তা কহিল সত্বরে।
রাজাজ্ঞাতে রাক্ষসেরা চারিভিতে মারে।।
রাজার ভাই বলি কেহ নাহি করে ডর।
বুকের উপরে মারে বৃক্ষ আর পাথর।।
মুষল মুদগর কেহ অঙ্গে মারে তেড়ে।
সাঁড়াশিতে মাংস টানে শেল শূল ফোড়ে।।
কেহ কামড়ায় কেহ চুলে ধরি টানে।
ব্রহ্মা-বরে নিদ্রা যায় কিছুই না জানে।।
মার খেয়ে কুম্ভকর্ণ হইল বিদীর্ণ।
সকল রাক্ষস বলে মৈল কুম্ভকর্ণ।।
মহোদর বলে, এক যুক্তি মনে গণি।
লঙ্কার ভিতর হৈতে আনহ কামিনী।।
শোয়াও সে সবাকারে কুম্ভকর্ণ পাশে।
আপনি জাগিবে বীর নারীর পরশে।।
এত বলি সব বীর ধাইল সত্বর।
বিদ্যাধরী তুল্যা নারী আনিল বিস্তর।।
তাহারা শুইল কুম্ভকর্ণের আসনে।
সর্ব্বাঙ্গ করিল তার লেপন চন্দনে।।
তার পাশে কন্যা সব করে আলিঙ্গন।
অতি সুশীতল লাগে কন্যা-পরশন।।
একে কুম্ভকর্ণ তাহে স্ত্রীগণ পাইয়া।
পাশ ফিরি শোয় বীর অঙ্গ মোড়া দিয়া।।
নাকের নিশ্বাস যেন ঘন বহে ঝড়।
ভয় পেয়ে কন্যা সব উঠি দিল রড়।।
মহোদর বলে, এক যুক্তি অনুমানি।
মদিরা মাংসের দেহ খুলিয়া ঢাকনি।।
জাগাইতে না পারিবে এ সব প্রবন্ধে।
আপনি জাগিবে বীর মদ্য-মাংস-গন্ধে।।
ঘূর্ণিত লোচনে বীর উঠে বসে খাটে।
নিদ্রাভঙ্গ হয়ে তবে কুম্ভকর্ণ উঠে।।
অনন্ত বাসুকি হেন মেলিলেক হাই।
চন্দ্র সূর্য্য দুই চক্ষু দেখিয়া ডরাই।।
শয্যায় বসিয়া বীর নিশাচরে বলে।
কি লাগিয়া নিদ্রাভঙ্গ করিলি অকালে।।
অকালে জাগালি মোরে ছোট নহে কাজ।
কোন্ বেটা লঙ্ঘিল রাবণ মহারাজ।।
ধেয়ে গিয়া রাবণেরে বলে নিশাচর।
কুম্ভকর্ণ জাগিলেন শুন লঙ্কেশ্বর।।
ভাইকে দেখিতে হৈল রাবণের সাধ।
কুম্ভকর্ণে জানাইল রাবণ সম্বাদ।।
শয্যা হৈতে উঠি বীর চক্ষে দিল পানি।
ভক্ষণের দ্রব্য দিল থরে থরে আনি।।
মদ্য পান করিলেন সাত শকলসী।
পর্ব্বত প্রমাণ মাংস খায় রাশি রাশি।।
হরিণ মহিষ বরা সাপটিয়া ধরে।
বার তের শত পশু খায় একে বারে।।
কুম্ভকর্ণ বলে, বুঝিলাম অনুমানে।
অকালে জাগাও মোরে যাহার কারণে।।
কোন্ লাজে ইন্দ্র বেটা দিতে এলো হানা।
বারে বারে হেরে যায় না ভাবে আপনা।।
ইন্দ্রের আছুক কাজ যম যদি আইসে।
যম হয়ে তাহারে গিলিব এক গ্রাসে।।
বিরূপাক্ষ রাক্ষস সে ধর্ম্ম-অধিষ্ঠান।
যোড় হাতে কহে কুম্ভকর্ণ বিদ্যমান।।
দেবে কোপ না কর, নির্দ্দোষ পুরন্দর।
প্রমাদ পাড়িল এত নর আর বানর।।
সূর্পণখা গিয়াছিল পঞ্চবটী বনে।
অগ্রে তার নাক কাণ কাটিল লক্ষ্মণে।।
শ্রীরামের সীতা রাজা আনে সেই রোষে।
সাগর ডিঙ্গায়ে হনু লঙ্কাপুরে আসে।।
লঙ্কা দগ্ধ করিল বানর হনুমান।
তুমি থাকিতে লঙ্কার এতেক অপমান।।
প্রমাদ করিছে নর বানর আসিয়ে।
রাজা প্রজা রয়েছে তোমার মুখ চেয়ে।।
কুম্ভকর্ণ বলে আগে জিনে আসি রণ।
তবেত ভেটিব গিয়া রাজা দশানন।।
এত বলি কুম্ভকর্ণ চলে রণমুখে।
মহোদর ভাই গিয়া কহিছে সম্মুখে।।
রাজার নাহিক আজ্ঞা রণে দিতে হানা।
কেমনে যাইবে ‍যুদ্ধে না কর মন্ত্রণা।।
যাত্রাকালে কুম্ভকর্ণ আরো খাইতে চায়।
রাজভোগ দ্রব্য আনি রাক্ষসে যোগায়।।
বহুদিন অনাহারে খায় বাড়াবাড়ি।
মদ খেয়ে উজাড়িল সাত শত হাঁড়ি।।
নহে সে সামান্য হাঁড়ি কি কব বাখান।
পঁচিশের বন্দ যেন ঘর একখান।।
মহারক্ত কত খাইল সংখ্যা নাহি হয়।
পালে পালে শূকর মহিষ আদি চয়।।
যাত্রা করি চলিলেন কুম্ভকর্ণ বীর।
মেঘ হইতে সূর্য্য যেন হইল বাহির।।
পর্ব্বত প্রমাণ উচ্চ লঙ্কার প্রাচীর।
প্রাচীর জিনিয়া কুম্ভকর্ণের শরীর।।
চলে যায় পথে যেন সুমেরু সমান।
দেখিয়া তা বানরের উড়িল পরাণ।।
দরশেনে ভঙ্গ দিল যত বানরগণ।
আশ্বাসিয়া রাখিল রাক্ষস বিভীষণ।।
বিভীষণের আশ্বাসে রহিল কপিগণে।
রঘুনাথ জিজ্ঞাসা করেন বিভীষণে।।
এতদিন কোথা ছিল এই মহাবীর।
ত্রিভুবন জিনিয়া ত দুর্জ্জয় শরীর।।
না বুঝে কটক আমি করিয়াছি পার।
ইহার সংগ্রামে কারো নাহিক নিস্তার।।
বিভীষণ বলে, শুন রাম রঘুবর।
কুম্ভকর্ণ নামেতে মধ্যম সহোদর।।
ব্রহ্মার বরেতে রাজা দশানন যুঝে।
কুম্ভখর্ণ বীর যুঝে আপনার তেজে।।
গদা হাতে কুম্ভকর্ণ যদি করে রণ।
এক দণ্ডে জিনিতে পারয়ে ত্রিভুবন।।
কুম্ভকর্ণ ভূমিষ্ঠ হইল যেইকালে।
সূতিকা-ঘরের নারীগণে ধরি গিলে।।
স্বর্গ-বিদ্যাধরী আদি বিস্তর রূপসী।
ধরে ধরে খাইল অনেক মুনি ঋষি।।
কোপ করি পুরন্দর বজ্র-অস্ত্র হানে।
বজ্র-অস্ত্র গিলেছিল অমরের রণে।।
ঐরাবতের দন্ত উপাড়িয়া এক টানে।
সেই দন্ত প্রহারিল সহস্রলোচনে।।
মূর্চ্ছা হয়ে পড়ে ইন্দ্র ধরণী উপর।
অমর কারণেতে বাঁচিল পুরন্দর।।
কুম্ভকর্ণের কথা শুন রাজীবলোচন।
গোকর্ণপুরেতে তপ করি তিন জন।।
ব্রহ্মা বর দিতে এল ভাই তিনজনে।
প্রথমে দিলেন বর জ্যেষ্ঠ দশাননে।।
ব্রহ্মা বলেন, ত্রিভুবন জিনিবে রাবণ।
নর বানরের হাতে সবংশে নিধন।।
তুষ্ট হয়ে আমারে বিধাতা দিলা বর।
সেই বরে আমি দেখ হয়েছি অমর।।
বর দিতে গেল ব্রহ্মা কুম্ভকর্ণ-স্থান।
ইন্দ্র আদি দেবতার উড়িল পরাণ।।
বিনা বরে কুম্ভকর্ণে দেখে লাগে ডর।
সৃষ্টিনাশ করিবে ব্রহ্মার পাইলে বর।।
যতেক দেবতাগণ দিয়া অনুমতি।
যুক্তি করি পাঠাইলা দেবী সরস্বতী।।
দেবী গিয়া বসিলেন কণ্ঠের উপর।
ব্রহ্মা বলে, কুম্ভকর্ণ চাহ কোন বর।।
কুম্ভকর্ণ বলে ব্রহ্মা নাহি চাহি আন।
চিরকাল নিদ্রা যাই করহ বিধান।।
ব্রহ্মা বলে, দিলাম বর চাহিলে যেমন।
দিবানিশি নিদ্রা যাহ হয়ে অচেতন।।
বর শুনে শোকাকুল হইল রাবণ।
কান্দিয়া ধরিল গিয়া ব্রহ্মার চরণ।।
রাবণ বলে, সৃষ্টি তুমি সৃজিলে আপনি।
আপনি বিনাশ কেন কর পদ্মযোনি।।
তোমার বচন কভু না হইবে আন।
নিদ্রা-জাগরণ প্রভু করহ বিধান।।
ব্রহ্মা বলে, দিনু বর শুনহ রাবণ।
ছয় মাস নিদ্রা এক দিন জাগরণ।।
অদ্ভুত ধরিবে বল, অদ্ভুত আহার।
কাঁচা নিদ্রা ভঙ্গ হলে সে দিন সংহার।।
এত বলি চতুর্ম্মুখ করিল গমন।
কুম্ভকর্ণ হইল নিদ্রায় অচেতন।।
স্কন্ধে করি নিবাসে আনিনু দুই ভাই।
কুম্ভকর্ণ-কথা এই শুনহ গোঁসাই।।
কাঁচা নিদ্রা ভঙ্গ আজি হয়েছে উহার।
অবশ্য তোমার হাতে হইবে সংহার।।
শুনি হরষিত হৈল শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
কুম্ভখর্ণ গেল তবে ভেটিতে রাবণ।।
কুম্ভকর্ণে দেখিয়া রাবণ কুতূহলী।
সিংহাসন হৈতে উঠে করে কোলাকুলি।।
কুম্ভকর্ণ রাবণের বন্দিল চরণ।
বসিতে দিলেন রাজা রত্ন-সিংহাসন।।
কুম্ভকর্ণ বলে তব কারে এত ডর।
আজ্ঞা কর, কাহারে পাঠাব যমঘর।।
আমি থাকিতে তোমার কারে নাহি ডর।
কতবার জিনিয়াছি যম পুরন্দর।।
সাগর শুষিব আজি খাইব আগুনি।
শূলে খান খান করে কাটিব মেদিনী।।
চন্দ্র সূর্য্য চিবাইয়া ফেলাইব দাঁতে।
পৃথিবী উপাড়ি ফেলাইব খরস্রোতে।।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবী করিব খণ্ড খণ্ড।
ত্রিভুবনের উপরে ধরাব ছত্রদণ্ড।।
এতেক বলিয়া বীর জিজ্ঞাসে তখন।
নর-বানরের সঙ্গে যুদ্ধ কি কারণ।।
রাবণ বলে, নিদ্রা যাও হয়ে অচেতন।
কিরূপেতে জানিবে এতেক বিবরণ।।
তিন সহোদর মোরা, ভগ্নী মাত্র একা।
জননীর আদরের কন্যা সূর্পণখা।।
বিধবা হইয়া ভগ্নী কান্দিল বিস্তর।
মনে মনে বাসনা থাকিতে স্বতন্তর।।
শিবের সাধনা হেতু রহে স্থানান্তরে।
স্থান দিয়া রাখিলাম সাগরের পারে।।
সঙ্গে দিলাম দুই ভাই খর আর দূষণ।
চৌদ্দ হাজার নিশাচর তাহার ভিড়ন।।
এইরূপে সূর্পনখা কিছুদিন থাকে।
দৈবের নির্ব্বন্ধ তাই কি কব তোমাকে।।
দশরথ রাজা ছিল অযোধ্যায় ধাম।
চারি পুত্র হয় তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম।।
ভরতেরে দিল রাজ্য না দিল রামেরে।
দুর্ভাগার পুত্র বলি দিল দূর করে।।
বনেতে আইল রাম হইয়া সন্ন্যাসী।
সঙ্গেতে লক্ষ্মণ ভাই, ভার্য্যা সে রূপসী।।
কুঁড়ে বেঁধেছিল বেটা পঞ্চবটী বনে।
সূর্পণখা গিয়াছিল পুষ্প অন্বেষণে।।
সূর্পণখার নাক কান কাটিল লক্ষ্মণ।
পরিতাপে যুদ্ধ করে খর আর দূষণ।।
রাম চন্দ্র যুদ্ধ করি মারে সর্ব্বজনে।
ভগ্নী এসে কান্দিলেক ধরিয়া চরণে।।
সূর্পণখার পরিতাপ সহিতে না পারি।
আমি গিয়া হরিয়া এনেছি তার নারী।।
বুঝিতে না পারি বেটা ফেরে কত রঙ্গে।
মিতালি করিল গিয়া বানরের সঙ্গে।।
বালির ভাই সুগ্রীব সে কিষ্কিন্ধ্যায় থাকে।
কটক সঞ্চয় কৈল সেবা করি তাকে।।
আজ্ঞাকারী করিয়াছে যত কপিগণে।
বুড়া এক ভল্লুক মিলেছে তার সনে।।
সেই বেটা কুমন্ত্রণা দেয় নিরন্তর।
বৃক্ষ পাথরেতে বান্ধে অলঙ্ঘ্য সাগর।।
সেই বাঁধ বয়ে বানর এসেছে এপার।
ঘেরেছে কনক-লঙ্কা চারিটা দুয়ার।।
বসেছে পশ্চিম দ্বারে সে রাম লক্ষ্মণ।
বড় বড় নিশাচরে করিল নিধন।।
বড়ই দুষ্কর নর-বানরের রণ।
বিপদে পড়িয়া তোমা করেছি চেতন।।
কুম্ভকর্ণ বলে, শুন ভাই দশানন।
শুনালে আশ্চর্য্য কথা এ আর কেমন।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ যদি সামান্য হৈত নর।
জলের উপরে কেন ভাসিবে পাথর।।
বনের বানর বন্ধ যে রামের গুণে।
সামান্য মনুষ্য তারা না ভাবিহ মনে।।
কুম্ভকর্ণ বলে, হেন লয় মম মন।
মায়াতে মনুষ্যরূপে দেব নারায়ণ।।
রাবণ বলে, রাম যদি দেব নারায়ণ।
সন্ন্যাসীর বেশে কেন করিবে ভ্রমণ।।
কুম্ভকর্ণ বলে, রাম হইবে তপস্বী।
রাবণ বলে, কেন না সে হয় তীর্থবাসী।।
কুম্ভকর্ণ বলে, রাম হবে রাজার বেটা।
রাবণ বলে, সে কেন মাথায় ধরে জটা।।
কুম্ভকর্ণ বলে, রাম ব্যাধ হৈতে পারে।
রাবণ বলে, কেন সে যজ্ঞসূত্র ধরে।।
কুম্ভকর্ণ বলে, রাম হবে ব্রহ্মচারী।
রাবণ বলে, তবে কেন সঙ্গে তার নারী।।
রাবণ বলিছে রাম কিসের ব্রহ্মচারী।
ভক্তিতে ডাকিলে যায় চণ্ডালের বাড়ী।।
দিন পাঁচ ছয় ছিল পঞ্চবটী মূলে।
সেখানে পাকালে জটা আঠা মেখে চুলে।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ পুরন্দরে।
শঙ্কাতে আসিতে নারে লঙ্কার ভিতরে।।
মনুষ্য হইয়া বেটার এত অহঙ্কার।
বানরের সহায়ে সাগর হৈল পার।।
বলিতে না পারি একি দৈবের ঘটনা।
ত্রিভুবনের বানর লয়ে রামের মন্ত্রণা।।
আছিল সাগর সেই অগাধ গভীর।
আপনার তেজেতে আপনি নহে স্থির।।
রত্নাকর ভীত হৈল মনুষ্যের আগে।
যোড়হস্ত করিয়া বন্ধন নিল মেগে।।
এতদিনে অপযশ হৈল রত্নাকরে।
বৃক্ষ পাথরেতে বান্ধে নর আর বানরে।।
বীর নাহি লঙ্কাতে ভাণ্ডারে নাহি ধন।
এতেক প্রমাদ তব নিদ্রার কারণ।।
ছিল ভাই বিভীষণ ধর্ম্ম-অধিষ্ঠান।
আমা সনে দ্বন্দ্ব করি গেল রামের স্থান।।
বুদ্ধিহীন বিভীষণ কার লাগি মরে।
মনুষ্যের হিত চিন্তে জ্ঞাতি-হিংসা করে।।
অরুণ বরুণ যমে শঙ্কা নাহি করি।
সীতা ফিরে দিলে যে হাসিবে সুরপুরী।।
অন্যে হাসে হাসুক, হাসিবে পুরন্দর।
সেই বেটা বলিবেক হীন লঙ্কেশ্বর।।
বুঝিয়া করহ ভাই যে হয় বিধান।
তুমি বিনা লঙ্কার নাহিক পরিত্রাণ।।
ত্রিভুবন জিনিলাম তব বাহুবলে।
বানরের সঙ্গে রণে কি আছে কপালে।।
লঙ্কাপুরী রাখহ আমার কর হিত।
ভাবহ উপায় মনে যে হয় বিহিত।।