০২৬. রাবণের প্রথম দিবস যুদ্ধ

বিভীষণ কহিছে লঙ্কার সমাচার।
রাম বলে, বিভীষণ হও আগুসার।।
জিজ্ঞাসা করিল যদি প্রভু রঘুনাথ।
কটক চিনায়ে দেয় তুলে ডানি হাত।।
রাবণের ধনু ওই রতনে খচিত।
রাজার দক্ষিণে ঐ কুমার ইন্দ্রজিৎ।।
মেঘ সম অঙ্গ তাম্রবর্ণ দ্বি-লোচন।
নাগপাশে বেঁধেছিল তোমা দুইজন।।
নগেন্দ্র দেবেন্দ্র আদি রণে পরাভব।
কোটি ইন্দ্র জিনি দশাননের বৈভব।।
এমন ঐশ্বর্য্য কেন হারায় রাবণ।
তোমার সংগ্রামেতে বাঁচিবে কোন্ জন।।
রাবণেরে দেখিয়া সুগ্রীব জ্বলে কোপে।
রুষিয়া সুগ্রীব রাজা যায় বীরদাপে।।
কুপিয়া সুগ্রীব সে পর্ব্বতে দিল টান।
একটানে উপাড়ে পর্ব্বত একখান।।
ঘুরায় পর্ব্বত গোটা অতিশয় রোষে।
গর্জ্জিয়া হানিল বীর রাবণ-উদ্দেশে।।
কোপেতে রাবণ এড়ে দশ গোটা বাণ।
বাণে কাটি পর্ব্বত করিল খান খান।।
ব্যর্থ গেল পর্ব্বত সুগ্রীব রাজা দেখে।
কোপেতে রাবণ বাণ যুড়িল ধনুকে।।
তিন শত বাণ রাবণ যুড়িয়া ধনুকে।
গর্জ্জিয়া মারিল বাণ সুগ্রীবের বুকে।।
বাণ খেয়ে সুগ্রীব সঘনে ঘুরে বুলে।
ভাগ্যেতে বাঁচিল প্রাণ পূর্ব্ব পুণ্যফলে।।
সুগ্রীব হারিল যদি পলায় বানর।
কোপেতে ধনুক করে নিলা রঘুবর।।
সন্ধান পূরিয়া যান করিবারে রণ।
হেনকালে যোড়হস্তে বলেন লক্ষ্মণ।।
লক্ষ্মণ বলেন, প্রভু তুমি থাক বসে।
আমি দশাননে মারি চক্ষুর নিমিষে।।
রাম বলে, কত সন্ধি জানহ লক্ষ্মণ।
রাবণ-সম্মুখে যুদ্ধ সংশয় জীবন।।
বাহুবলে ত্রিভুবন জিনিল রাক্ষস।
রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে না কর সাহস।।
তথাপি লক্ষ্মণ যান পূরিয়া সন্ধান।
হেনকালে লক্ষ্মণেরে বলে হনুমান।।
হনুমান বলে, তুমি তিষ্ঠহ লক্ষ্মণ।
কৌতুক দেখহ আমি মারিব রাবণ।।
আমার সংগ্রামে যদি পায় সে নিস্তার।
তবে ত লক্ষ্মণ তব যুঝিবার ভার।।
লক্ষ্মণের পদধূলি হনু লয় মাথে।
লাফ দিয়া পড়ে গিয়া রাবণের রথে।।
সম্মুখে দাঁড়ায় বীর পরম সন্ধানী।
সারথির কেড়ে লয় হাতের পাঁচনী।।
দেব দানব জিন বেটা ব্রহ্মার কারণ।
বানর হইয়া তোর বধিব জীবন।।
হের মুণ্ড দেখ মোর সুমেরুর চূড়া।
হেন পদ দেখ মোর কৈলাসের গোড়া।।
হের হস্ত দেখ মোর পর্ব্বতের সার।
হাতের অঙ্গুলি দেখ সর্পের আকার।।
হের নখ দেখি মোর বজ্রের সোসর।
এক চড়ে তোমারে পাঠাব যমঘর।।
রাবণ বলে, তোরে পেলে অন্যে নাহি কথা।
পড়িলি আমার হাতে আজি যাবি কোথা।।
হনু বলে, তোরে কি আর মারিব এক্ষণে।
পূর্ব্বে মারিয়াছি বেটা ভেবে দেখ্ মনে।।
অক্ষয়-কুমারে মেরে পোড়ালাম শোকে।
সে শোক রাবণা তোর বিন্ধিয়াছে বুকে।।
আপনা পাসরে কোপে বীর হনুমান।
রাবণে চাপড় মারে বজ্রের সমান।।
চাপড় খাইয়া রাবণ হৈল অচেতন।
ভাগ্যেতে রহিল প্রাণ ব্রহ্মার কারণ।।
সম্বিত পাইয়া পুনঃ উঠিল সত্বর।
ডাক দিয়া হনুমানে করিছে উত্তর।।
রাবণ বলে, বানরা রে তুই বড় বীর।
তোর চাপড়েতে মোর কাঁপিল শরীর।।
হনুমান বলে, মোর কিসের বাখান।
মোর চাপড়েতে তোর রহিল পরাণ।।
তোরে মারিলাম বেটা উঠে তোর রথে।
হারি সিদ্ধি হলো তোর সবার সাক্ষাতে।।
আপনা পাসরে কোপে রাজা ত রাবণ।
হনুরে চাপড় মারে করিয়া গর্জ্জন।।
হনুমানের বুকে মারে সে বজ্র চাপড়।
রথ হতে পড়ে হনু করি ধড়ফড়।।
ভূমে পড়ি হনুমান ঘুরে ঘুরে বুলে।
হনুমানে ছাড়ি বিন্ধে সেনাপতি নীলে।।
সম্বিত পাইয়া উঠে বীর হনুমান।
ডাক দিয়া বলে, রাবণ হও সাবধান।।
রাক্ষস রাবণ তোর এই বীরপণা।
মোর সনে যুদ্ধ করে অন্যে দেও হানা।।
হনুমান যত বলে রাবণ না শুনে।
নীল সেনাপতি বিন্ধে আপনার মনে।।
বাছিয়া বাছিয়া মারে চোখ চোখ শর।
নীলেরে বিন্ধিয়া বীর করিল জর্জ্জর।।
আপন রক্তেতে তিতে নীল সেনাপতি।
কেমনে জিনিব রণ করয়ে যুকতি।।
দীর্ঘাকার নীল বীর যেমন দেউল।
মায়া করি নীল বীর হইল নেউল।।
নেউল প্রমাণ বীর হইল মায়াতে।
এক লাফে চড়ে গিয়া রাবনের রথে।।
রাবণের রথে চড়ে নাহি করে ডর।
নীলের বিক্রম দেখি রাবণ ফাঁফর।।
নীলেরে মারিতে ধনুকেতে বাণ যোড়ে।
লাফ দিয়া নীল গিয়া রথধ্বজ ধরে।।
মাথা তুলি রাবণ রাজা উপরে নেহাল।
নীল বীর পড়ে তার ধনুকের হুলে।।
নীলবীরে ধরিবারে রাবণ চিন্তিল।
লাফ দিয়া নীল তার মস্তকে উঠিল।।
নীলেরে ধরিতে হাত বাড়ায় রাবণ।
মাথা হৈতে মুকুটে উঠিল ততক্ষণ।।
রাবণের মুকুট শোভিছে সারি সারি।
মুকুট উপড়ে বেড়ায় ফিরি ঘুরি ঘুরি।।
মায়া করি বেড়ায় রাবণে দিয়া ফাঁকি।
ঘনপাকে ঘুরে যেন নাচনীয়া পাখী।।
কুড়ি চক্ষে চায় তবু না দেখে রাবণ।
দেখে পুনঃ পুনঃ নাহি পায় দরশন।।
ক্ষনেকে দেখিতে পায় চক্ষুর নিমিষে।
ধরি ধরি মনে করে স্থানান্তরে আসে।।
নানা মায়া জানে বীর মায়ার নিদান।
নেউল প্রমাণে বীর ফিরে স্থানে স্থান।।
কুপিল সে নীল বীর বুদ্ধির সাগর।
লাথি মারে রাবণের মুকুট উপর।।
ভাগ্যফলে রাবণের রহে দশ মাথা।
বহু মতে রাবণের করিল অবস্থা।।
নীলের বিক্রম যেন সিংহের প্রতাপ।
রাবণের মস্তকেতে করিল প্রস্রাব।।
রাবণের মস্তকেতে নীল বীর মুতে।
মুখ বয়ে পড়ে মূত্র সর্ব্ব অঙ্গ তিতে।।
প্রস্রাবের ধারা বহে রাবণ-অঙ্গেতে।
আভরণ কুঙ্কুম ভাসিয়া গেল স্রোতে।।
দেখিয়া ত দেবগণ দিল টিটকারী।
কুপিল রাবণ রাজা লঙ্কা-অধিকারী।।
ধনুকে যুড়িয়া বাণ আছে ত সন্ধানে।
দেখিতে না পায় বাণ মারিবে কেমনে।।
একবার মায়া করি উঠে মুকুটেতে।
আরবার লাফ দিয়া পড়ে গিয়া রথে।।
মুকুট হতে রথে যেতে দেখিলেক ছায়া।
সন্ধান পূরিয়া নীলের ভাঙ্গি দিল মায়া।।
বাণ খেয়ে নীল বীর পড়ে ভূমিতলে।
ভাগ্যেতে বাঁচিল প্রাণ পূর্ব্ব পূণ্যফলে।।
নীলবীর হনুমান হইল বিমুখ।
লক্ষ্মণ আইল রণে পাতিয়া ধনুক।।
লক্ষ্মণ বলেন, তোর বুঝি বীরপণ।
আমার সঙ্গেতে যুদ্ধ করহ রাবণ।।
লক্ষ্মণের কথা শুনে রাবণ রাজা হাসে।
পলা রে তপস্বী বেটা প্রাণ লয়ে দেশে।।
এত যদি দুই জনে হৈল গালাগালি।
দুই জনে যুদ্ধ বাজে দোঁহে মহাবলী।।
দুই শত বাণ এড়ে রাজা দশানন।
বাণেতে কাটিয়া পাড়ে ঠাকুর লক্ষ্মণ।।
ব্যর্থ গেল বাণ সব চিন্তিত রাবণ।
লক্ষ্মণ উপরে করে বাণ বরিষণ।।
তিন শত বাণ মারে যুড়িয়া ধনুকে।
ফুটে তিন শত বাণ লক্ষ্মণের বুকে।।
বুকে ফুটে বিন্ধি রহে বাণের যে ফলা।
লক্ষ্মণের অঙ্গে যেন রক্তপদ্ম-মালা।।
বাণে বাণে লক্ষ্মণের নাহি চলে দৃষ্টি।
খসে পড়ে লক্ষ্মণেরে ধনুকের মুষ্টি।।
সম্বরিয়া লক্ষ্মণ সুস্থির কৈল বুক।
কাটিলেন রাবণের হাতের ধনুক।।
কাটা গেল ধনুক, বানরগণ হাসে।
আর ধনু লয় রাবণ চক্ষুর নিমেষে।।
লক্ষ্মণ-উপরে করে বাণ বরিষণ।
রাবণের বাণে আচ্ছাদিল সে গগন।।
কোপ করি লক্ষ্মণ ধনুকে দিল চাড়া।
কাটিলেন রাবণের রথের অষ্ট ঘোড়া।।
ঘোড়া কাটা গেল রথ হইল অচল।
সারথির মাথা কাটি পাড়ে ভূমিতল।।
পড়িল সারথি অশ্ব, দেবগণ হাসে।
আর রথ যোগাইল চক্ষুর নিমেষে।।
লাফ দিয়া দশানন সেই রথে চড়ে।
তিন শত বাণ তবে একবারে যোড়ে।।
দেখিয়া গন্ধর্ব্ব-বাণ যুড়িল লক্ষ্মণ।
রাবণের যত বাণ কৈল নিবারণ।।
লক্ষ্মণ রাবণ দোঁহে বাণ বরিষণ।
দুজনার বাণে ঢাকে রবির কিরণ।।
দুইজনে বাণ বর্ষে নাহি লেখাজোখা।
প্রাণপণে মারে বাণ যার যত শিক্ষা।।
অমর্ত্ত্য সমর্থ বাণ, বাণব্রহ্মজাল।
চারিদিকে পড়ে যেন অগ্নির উথাল।।
অরুণ বরুণ বান, বাণ খরশান।
অগ্নিবাণ যমবাণ যমের সমান।।
সুচীমুখী শিলীমুখী বাণ বিরোচন।
সিংহদন্ত বজ্রদন্ত ঘোর দরশন।।
কালদন্ত ঐষিক আর দীর্ঘ কর্ণিকার।
ক্ষুরপার্শ্বে শেলান্তক অতি তীক্ষ্মধার।।
নীল হরিতাল বাণ বিকট দর্শন।
অর্দ্ধচন্দ্র চক্রবাণ যমের সমান।।
এত বাণ দুইজনে করে অবতার।
দশদিক জল স্থল হৈল অন্ধকার।।
লক্ষ্মণ বরিষে বাণ তারা যেন ছুটে।
রাবণের হাতের ধনুকখান কাটে।।
আর যে পঞ্চাশ বাণ পূরিল সন্ধান।
রাবণের বুকে বাজে বজ্রের সমান।।
খাইয়া পঞ্চাশ বাণ ভাবে মনে মনে।
ব্রহ্মা দিয়াছেন শেল তাহা পড়ে মনে।।
মন্ত্র এড়িয়া রাবণ শেলপাট এড়ে।
যমের দোসর শেল বাণেতে উখাড়ে।।
শেলপাট এড়িলেক দিয়া হুহুঙ্কার।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে লাগিল চমৎকার।।
লক্ষ্মণ এড়েন বাণ শেল কাটিবারে।
ঠেকিয়া শেলের মুখে ভস্ম হয়ে উড়ে।।
রাখা নাহি যায় শেল ব্রহ্মার যে বরে।
বায়ুবেগে যায় শেল লক্ষ্মণ উপরে।।
পড়িল লক্ষ্মণ বীর শেলের আঘাতে।
পুনরায় শেল যায় রাবণের হাতে।।
লক্ষ্মণ পড়িল রণে হয়ে অচেতন।
কুড়ি হস্তে লক্ষ্মণেরে ধরিল রাবণ।।
রথে তুলি লঙ্কার ভিতরে লইতে চায়।
শত মেরু-ভার হৈল লক্ষ্মণের কায়।।
কুড়ি হাতে টানিছে লঙ্কার অধিপতি।
নাড়িতে লক্ষ্মণ বীরে নহিল শকতি।।
হাত দিয়া কটিতে ভাবিছে দশানন।
জটিল তপস্বী বেটা ভারি কি এমন।।
তুলিলাম হিমালয় পর্ব্বত মন্দর।
তা হতে অধিক কি মনুষ্য বেটা ভার।।
তুলিলাম কৈলাস পর্ব্বত বাম হাতে।
কুড়ি হস্তে লক্ষ্মণেরে না পারি নাড়িতে।।
লক্ষ্মণে নাড়িতে নারে হৈল অপমান।
দূর হতে দেখে তাহা বীর হনুমান।।
রাবনের গালেতে মারিল এক চড়।
চড় খেয়ে দশানন উঠে দিল রড়।।
চড় খেয়ে দশানন লাগিল ঘুরিতে।
ঘুরিতে ঘুরিতে রাবণ পড়ে গিয়া রথে।।
পলাইল রাবণ দেখিয়া হনুমানে।
করিয়া পাথালিকোলে তুলিল লক্ষ্মণে।।
বৈরিস্পর্শে হয়েছিলেন পর্ব্বতের ভার।
সেবকের হাতে হৈল তূলার আকার।।
লক্ষ্মণে রাখিল লয়ে শ্রীরামের পাশে।
ধেয়ানে জীয়ান রাম চক্ষুর নিমিষে।।