অনুবাদ কবিতা

অনুবাদ কবিতা
হুমায়ুন আজাদ

নাইটিংগেলের প্রতি
জন কীটস্

আমার হৃদয় ব্যথা করছে, আর নিদ্রাতুর এক বিবশতা পীড়ন করছে
আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে, যেনো আমি পান করেছি হেমলক,
 কিংবা সেবন করেছি কোনো অসহ্য আফিম
এক মুহূর্ত আগে, আর ভুলে গেছি সব :
এমন নয় যে আমি ঈর্ষা করছি তোমার সুখকে,
বরং তোমার সুখে আমি অতিশয় সুখী,
আর তুমি, লঘু-ডানা অরণ্যের পরী,
সবুজ বিচের মধ্যে
কোনো সুরমুখরিত স্থলে, অসংখ্য ছায়ার তলে,
সহজিয়া পূর্ণ কণ্ঠে গেয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মের সঙ্গীত।

.

আহা, এক ঢোক মদের জন্যে! গভীর মাটির তলে
বহুকাল ঢাকা থেকে যেই মদ হয়েছে শীতল,
দেহে যার পুষ্প আর গেঁয়ো সবুজের স্বাদ,
নাচ, আর প্রোভেন্সীয় গান, আর রোদে পোড়ার উল্লাস!
আহা, উষ্ণ দক্ষিণভরা একটি পেয়ালার জন্যে,
পরিপূর্ণ খাঁটি, রক্তাভ হিপ্পোক্রেনে,
কানায় কানায় উপচে পড়ছে বুদ্বুদ,
এবং রক্তবর্ণরাঙা মুখ;
 যদি পান করতে পারতাম, আর অগোচরে ছেড়ে যেতে পারতাম পৃথিবী,
এবং তোমার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে বনের আঁধারে :

.

মিলিয়ে যেতাম দূরে, গলতাম, এবং যেতাম ভুলে
যা তুমি পত্রপল্লবের মধ্যে কখনো জানো নি,
ক্লান্তি, জ্বর, এবং যন্ত্রণা
এখানে, যেখানে মানুষেরা ব’সে শোনে একে অন্যের আর্তনাদ;
 যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মাথায় কাঁপে গুটিকয়, বিষণ্ণ, অবশিষ্ট শাদা চুল,
যেখানে বিবর্ণ হয় যুবকেরা, আর প্রেতের মতোন কৃশ হয়ে মারা যায়;
যেখানে ভাবতে গেলেই ভ’রে উঠতে হয় দুঃখে
এবং সীসাভারী চোখের হতাশায়,
যেখানে সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারে না তার দ্যুতিময় চোখ,
অথবা আজকের প্রেম ক্ষয় হয় আগামীকাল আসার আগেই।

.

দূরে! আরো দূরে! কেননা তোমার কাছে উড়ে যাবো আমি,
তবে বাক্কাস ও তার চিতাদের রথে চড়ে নয়,
যাবো আমি কবিতার অদৃশ্য ডানায়,
যদিও অবোধ মগজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিবশ :
 এর মাঝেই তোমার সঙ্গে আমি! সুকোমল এই রাত,
এবং দৈবাৎ চন্দ্ররানী উপবিষ্ট তার সিংহাসনে,
তাকে ঘিরে আছে তার সব তারার পরীরা;
কিন্তু এখানে কোনো আলো নেই,
শুধু সেইটুকু ছাড়া যেটুকু আকাশ থেকে বাতাসে উড়াল দিয়ে
শ্যামল আঁধার আর শ্যাওলার আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এখানে এসেছে।

.

দেখতে পাচ্ছি না আমি আমার পায়ের কাছে ফুটেছে কী ফুল,
বা কোন কোমল গন্ধ ঝুলে আছে শাখায় শাখায়,
তবে, সুবাসিত অন্ধকারে, অনুমান করি প্রত্যেক মধুকে
যা দিয়ে এই কুসুমের মাস ভরে দেয় ঘাস,
ঝোপ, আর বুনো ফলের গাছকে;
শুভ্র হথর্ন, আর বন্যগোলাপ;
পাতার আড়ালে দ্রুত বিবর্ণ ভাইওলেটরাশি;
আর মধ্য-মের জ্যেষ্ঠ সন্তান,
 শিশিরের মদে পূর্ণ আসন্ন কস্তুরিগোলাপ,
গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় মৌমাছির গুঞ্জরণমুখর আবাস।

.

অন্ধকারতলে আমি শুনি; কেননা অজস্রবার
জড়িয়ে পড়েছি আমি সহজ মৃত্যুর আধোপ্রেমে,
প্রিয় নাম ধরে তাকে কতোবার ডেকেছি কবিতার পংক্তিতে,
আমার নিঃশব্দ নিশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দেয়ার জন্যে;
যে-কোনো সময়ের থেকে এখন মৃত্যুকে মনে হচ্ছে বেশি বরণীয়,
ব্যথাহীন থেমে যাওয়া এই মধ্যরাতে,
যখন তোমার আত্মা ঢেলে দিচ্ছো তুমি
এরকম তুরীয় আবেগে!
তারপরও গেয়ে যাবে তুমি, এবং আমার কানে সাড়া জাগবে না
 তুমি গাইবে প্রার্থনাসঙ্গীত আমি মিশে যাবো তখন মাটিতে।

.

মৃত্যুর জন্যে তোমার জন্ম হয় নি, মৃত্যুহীন পাখি!
কোনো ক্ষুধার্ত প্রজন্ম ধ্বংস করতে পারবে না তোমাকে;
যে-সুর শুনছি আমি ক্ষয়িষ্ণু এ-রাতে সে-সুরই
সুপ্রাচীন কালে শুনেছিলো সম্রাট ও ভাঁড়েরা :
 হয়তো এ-একই গান ঢুকেছিলো।
রুথের বিষণ্ণ হৃদয়ে, যখন, স্বদেশকাতর,
 অশ্রুভারাতুর সে দাঁড়িয়েছিলো বিদেশি জমিতে;
একই গানে বারবার
মুগ্ধ হয়েছে ভয়ঙ্কর সমুদ্রের ফেনপুঞ্জের দিকে খোলা
যাদুবাতায়ন, পরিত্যক্ত পরীদের দেশে।

.

পরিত্যক্ত! এ-শব্দ ঘণ্টাধ্বনির মতো আমাকে জাগিয়ে
তোমার নিকট থেকে পৌঁছে দেয় নিজেরই কাছে।
বিদায়! কল্পনাও তার খ্যাতি অনুসারে
প্রতারণা করতে পারে না, প্রতারক পরী।
 বিদায়! বিদায়! তোমার করুণ গান মিশে যাচ্ছে
নিকট বনভূমিতে, স্তব্ধ নদীর ওপরে,
পাহাড়ের ঢালে; এবং এখন মিশে গেছে
 পার্শ্ববর্তী উপত্যকার উন্মুক্ত ভূমিতে :
এটা কি কল্পনা ছিলো, না কি ছিলো জাগ্রত স্বপ্ন?
পালিয়েছে সে-সঙ্গীত:–আমি কি জেগে আছি না কি নিদ্রিত?

*

ডোভার সৈকত
ম্যাথিউ আরনল্ড

সমুদ্র প্রশান্ত আজ রাতে।
ভরা জোয়ার এখন, ভাসে রূপবতী চাঁদ
প্রণালির জলের ওপরে;–ফরাশিদেশের উপকূলে
আলো মৃদু হ’য়ে নেভে গেলো এইমাত্র; বিলেতের উপকূলশৈলগুলো,
মৃদু আলোকিত ও বিস্তৃত, দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্ত উপসাগরের থেকে মাথা তুলে।
 জানালার ধারে এসো, কী মধুর রাতের বাতাস!
শুধু, পত্রালির দীর্ঘ সারি থেকে
 যেখানে সমুদ্র মেশে চাঁদের আলোয় শাদা তটদেশে,
 শোনো! তুমি শোনো ঢেউয়ের টানে স’রে-যাওয়া নুড়িদের
 ঘর্ষণের শব্দ, এবং অবশেষে,
যখন ফিরে আসে উচ্চ বালুময় তটে,
শুরু হয়, আর থামে, তারপর শুরু হয় পুনরায়,
 কোলাহলপূর্ণ ধীর লয়ে, এবং বয়ে আনে
 মনে বিষাদের চিরন্তন সুর।

সোফোক্লিজ বহুকাল আগে
 শুনেছিলেন এ-সুর অ্যাজিআনে, আর এটা তার মনে
বয়ে এনেছিলো মানুষের দুর্দশার
ঘোলাটে জোয়ার-ভাটা; আমরাও
 এই শব্দে পাই একটি ভাবনা,
 সেই সুর শুনে এই দূর উত্তর সাগরের তীরে।

বিশ্বাসের সমুদ্রও
একদিন ছিলো ভরপুর, এবং পৃথিবীর তটদেশ ঘিরে
 ছিলো উজ্বল মেখলার মতো ভাঁজেভাঁজে।
 কিন্তু এখন আমি শুধু শুনি
তার বিষণ্ণ, সুদীর্ঘ, স’রে-যাওয়ার শব্দ,
 সরে যাচ্ছে, রাত্রির বাতাসের শ্বাস, বিশাল বিষণ্ণ সমুদ্রতীর,
আর বিশ্বের নগ্ন পাথরখণ্ডরাশি থেকে।

আহা, প্রিয়তমা, এসো আমরা
সৎ হই একে অপরের প্রতি! কেননা এই বিশ্ব, যা আমাদের সামনে
স্বপ্নের দেশের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বলে মনে হয়
, যা এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ, এতোই সুন্দর, এমন নতুন,
তার সত্যিই নেই কোনো আনন্দ, কোনো প্রেম, কোনো আলো,
নেই কোনো নিশ্চয়তা, নেই শান্তি, নেই বেদনার শুশ্রূষা;
আর আমরা এখানে আছি যেনো এক অন্ধকার এলাকায়,
ভেসে যাচ্ছি যুদ্ধ ও পালানোর বিভ্রান্ত ভীতিকর সংকেতে,
যেখানে মূর্খ সৈন্যবাহিনী রাত্রির অন্ধকারে যুদ্ধে ওঠে মেতে।

*

দ্বিতীয় আগমন
ডব্লিউ বি ইএটস্

বড়ো থেকে বড়ো বৃত্তে পাক খেতে খেতে
বাজ শুনতে পায় না বাজের প্রভুকে;
সব কিছু ধসে পড়ে; কেন্দ্র ধরে রাখতে পারে না;
নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্ব জুড়ে,
 ছাড়া পায় রক্তময়লা প্রবাহ, আর চারদিকে
আপ্লাবিত হয় নিষ্পাপ উৎসব;
শ্রেষ্ঠরা সমস্ত বিশ্বাসরিক্ত, যখন নষ্টরা
পরিপূর্ণ সংরক্ত উৎসাহে।

নিশ্চয়ই কোনো প্রত্যাদেশ এখন আসন্ন;
 নিশ্চয়ই দ্বিতীয় আগমন এখন আসন্ন;
দ্বিতীয় আগমন! যেই উচ্চারিত হয় ওই শব্দ
 অমনি মহাস্মৃতি থেকে এক প্রকাণ্ড মূর্তি
পীড়া দেয় আমার দৃষ্টিকে : কোথাও মরুভুর বালুর ওপরে
 সিংহের শরীর আর মানুষের মুণ্ডধারী এক অবয়ব,
সূর্যের মতোন শূন্য আর অকরুণ এক স্থিরদৃষ্টি,
চালায় মন্থর উরু, আর তাকে ঘিরে
সব কিছু ঘূর্ণিপাকে ছায়া ফেলে মরুভূর বিক্ষুব্ধ পক্ষীর।
অন্ধকার নামে পুনরায়; তবে আমি জানি
 বিশ শতাব্দীর পাথুরে নিদ্রাকে
একটি আন্দোলিত দোলনা পরিণত করেছে বিক্ষুব্ধ দুঃস্বপ্নে,
কোন্ রুক্ষ পশু, তার সময় এসেছে অবশেষে,
জন্ম নেয়ার জন্যে জবুথবু কুশ্রী ভঙ্গিতে এগোয় বেথেলহেমের অভিমুখে?

*

বাইজেন্টিয়ামের উদ্দেশে নৌযাত্রা
ডব্লিউ বি ইএটস্

সেটা নয় বুড়োদের দেশ। যুবকযুবতী
বাহুপাশে একে অপরের, পাখিরা শাখায়,
–ওই মুমূর্ষ প্রজন্মরা–সঙ্গীতমুখর,
শ্যামনপ্রপাত, ম্যাকেরেল-বোঝাই সাগর,
মাছ, মাংস, পাখির গোত, সারা গ্রীষ্ম
 স্তব করে তার, যা কিছু উৎপন্ন, জন্মপ্রাপ্ত, এবং নশ্বর।
ইন্দ্রিয়বিলাসী গানে মেতে সারা বেলা
 জরাহীন মননের কীর্তিকে করে অবহেলা।

.

বৃদ্ধ মানুষ এক তুচ্ছ বস্তুমাত্র,
লাঠির মাথায় ঝোলা ঘেঁড়া বস্ত্র, যদি না আত্মা
করতালি দিয়ে গান গায়, এবং আরো উঁচু স্বরে
 গান গায় তার মরপোশাকের প্রতিটি ছেঁড়ার জন্যে,
নেই সেখানে কোনো সঙ্গীতনিকেতন শুধু আছে
 আপন মহত্ত্ব বন্দনার সমূহ কীর্তি;
 তাই আমি পাল তুলে অসংখ্য সাগরে
এসেছি বাইজেন্টিয়ামের পবিত্র নগরে।

.

ঈশ্বরের পূত আগুনে দাঁড়ানো হে ঋষিগণ
যেনো খচিত দেয়ালের স্বর্ণ মোজায়িকে,
 এসো ওই পূত অগ্নি থেকে, কাটিমের পাক খেয়ে,
হও আমার আত্মার সঙ্গীতের প্রভু।
 গ্রাস করো আমার হৃদয়; বাসনায় রোগা হয়ে,
বাঁধা পড়ে একটা মুমূর্ষ পশুর সাথে
 জানে না সে কী; আমাকে তুলে করতলে
সংগ্রথিত করো শাশ্বতের নির্মাণকৌশলে।

.

একবার প্রকৃতিনিষ্ক্রান্ত হলে আবার কখনো আমি
ধরবো না দেহ প্রাকৃতিক বস্তু থেকে কোনো,
 নেবো সেই রূপ ন্দ্রিাতুর সম্রাটকে
জাগিয়ে রাখার জন্যে যা বানায় গ্রীসীয় স্বর্ণকারেরা
হাতুড়িপেটানো স্বর্ণ আর স্বর্ণ এনামেলে;
অথবা বাইজেন্টিয়ামের সম্ভান্ত নরনারীদের উদ্দেশে
 যা কিছু অতীত, বা অতীতমান, অথবা আসন্ন
 তার গাথা গাওয়ার জন্যে উপবিষ্ট করে কোনো সুবর্ণ শাখায়।

*

একটুখানি ছুঁই বললো সে
 ই ই কামিংস

একটুখানি ছুঁই বললো সে
(কেঁপে উঠবোই বললো সে
 শুধু একবার বললো সে)
তবে তো মজার বললো সে

(একটু কাছে টানি বললো সে
 ঠিক কতোখানি বললো সে
খুব বেশি হবে বললো সে)
কেনো নয় তবে বললো সে।

(চলো আসি ঘুরে বললো সে
 নয় বেশি দূরে বললো সে
 কতোটা বেশি দূর বললো সে
যতোটা তুমি মোর বললো সে)

একটু ঘষি মুখ বললো সে
(কীভাবে পাবে সুখ বললো সে
এভাবে যদি চাও বললো সে
 যদি চুমো খাও বললো সে।

একটু দিই ঠেলা বললো সে
এ যে প্রেমখেলা বললো সে)
 যদি ইচ্ছে হয় বললো সে
 (আমার লাগছে ভয় বললো সে

এই তো জীবন-মউ বললো সে
তোমার আমি বউ বললো সে
 এখনি হু বললো সে)
উহ্ বললো সে

(লাগছে সুখ বেশ বললো সে
এখনি কোরো না শেষ বললো সে
না না রাত ভরে বললো সে)
আস্তে ধীরে ধীরে বললো সে

(হহয়েয়েছে? বললে সে
আআআআ বললো সে)
 তুমি স্বর্গীয় বললো সে
তুমি আমার, প্রিয়, বললো সে)