প্রজাপতির নির্বন্ধ

প্রজাপতির নির্বন্ধ

বেশি মেয়ে পাওয়া জীবনে কিছু না, বেশ মেয়ে পাওয়াই কঠিন। সুবেশ মেয়ে অনেক মেলে, তাতে চোখ ভরে গেলেও মন ভরে না। সত্যি বলতে, অনেক মেয়ে নিয়ে কী হবে? একটি মেয়ে, কিন্তু বেশ মেয়ে, মনের মতো সেই একটিকে পাওয়াই যথেষ্ট। প্রেজেন্ট টেন্সে তো প্রায় সব মেয়েকেই ভালো লাগে, কিন্তু অ্যাবসেন্টটেন্সেও ভালো লাগতে পারে—আড়ালে থেকেও আবেশ জাগায়—কেবল তাকেই তো বলতে হয় মেয়ের মতো মেয়ে? তাকে পাওয়াটাই হচ্ছে আসল! জীবনের দেবীমন্দিরে সত্যিকার প্রবেশ।

এইসব কথাই তড়িৎ ভাবছিল, তড়িদবেগেই ভাবছিল, হাওড়া স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুমে বসে বসে। কফির পেয়ালা হাতে চিন্তাশীলতার পরাকাষ্ঠার মতো দেখাচ্ছিল ওকে।

ভেবে দেখলে বিদ্যাপতির সময়েও এই সমস্যা দেখা গেছে। নইলে ‘প্রাণ জুড়াইতে লাখে না মিলল এক’—বিদগ্ধ কবির এই খেদোক্তি কেন? অবশ্যি, তড়িতের এমন কোনো আক্ষেপ ছিল না, সেই একটিকে সেপেয়ে গেছে—লাখের একেবারে গোড়াতেই—লাক যাকে বলে!—কিন্তু তড়িৎ আর জ্যোৎস্নার মাঝখানে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা ওর পিসিমা। পিসিমান্ত প্রদেশ পার হয়ে জ্যোৎস্নায় পাড়ি-জমানো, লক্ষ মেয়ের লক্ষ্যভেদ করে প্রাণ-জুড়োনো একটিতে গিয়ে পৌঁছোনোর মতোই দুঃসাধ্য ব্যাপার। তড়িতের পিসিমা একাই যে এক লাখ!

তবু মরিয়া হয়ে সেটেলিফোনটা হাতে নিল।—‘হ্যালো! কে? জ্যোৎস্না নাকি? জ্যোৎস্না—, আমি? আমি হচ্ছি আমি, আদি এবং অকৃত্রিম তোমার তড়িৎ। আমি এখন এখানে।’

‘এখানে মানে কোনখানে?’ জ্যোৎস্নার গলা।

‘এখানে মানে কলকাতায়। এখন হাওড়া স্টেশনের খাবারঘরে। এইমাত্র বোম্বে মেল থেকে নামলাম। দিন দশেকের ছুটি পাওয়া গেছে। পিসিমার ওখানেই থাকতে হবে, উপায় নেই। তবে তাঁকে লিখেছি যে, সন্ধ্যেয় পৌঁছোব—আজকাল ট্রেনের ভারি গোলমাল—কিচ্ছু ঠিক নেই। অতএব, এখন থেকে বিকেল পর্যন্ত অবকাশ আমার হাতে।’

‘দুপুরটাও আছে এর মধ্যে।’ জ্যোৎস্না যোগ করে।

‘অনিবার্যভাবেই।…মধ্যাহ্নভোজনটা তোমাদের ওখানেই সারা যাবে সেটাও আমার ভাবা ছিল।’ জানাল তড়িৎ।

‘তাহলে তো ভাবনায় ফেললে! মা-টা সবাই বেলুড় মঠের উৎসবে গেছেন, ফিরতে সেই সন্ধ্যে! আমিও যেতাম, কিন্তু পরীক্ষার পড়া নিয়ে আমার যাওয়া হয়নি, কিন্তু ঝি-চাকর সবার আজ ছুটি, রান্নাবান্নার কোনো হাঙ্গামা নেই বাড়িতে।’

‘তুমি কী খাচ্ছ তাহলে?’

‘সকালের পাঁউরুটির যে ভগ্নাবশেষ আছে, মাখন আর চিনি দিয়ে তাতেই চালাব এঁচে রেখেছিলাম।’

‘কত বড়ো রুটির ভগ্নাবশেষ?’ তড়িৎ জানতে চায়।

‘তা বেশ বড়োই।’ জবাব আসে।

‘তাহলেই হবে। আমার ব্যাগের মধ্যে কাঁকড়ার তরকারি আছে। খাসা জিনিস! এই রেস্তরাঁ থেকেই কিনেছি একটু আগে।…কেমন হবে রুটির সঙ্গে?’

‘ওঃ! অদ-ভূত!’ জ্যোৎস্নার উল্লাস শোনা যায়।

‘তাহলে আমি ট্যাক্সি ধরলাম।’ বলে তড়িৎ টেলিফোন ছেড়ে দিল এবং ট্যাক্সির মতোই হুড়মুড় করে উঠল গিয়ে জ্যোৎস্নাদের ফ্ল্যাটে। প্রথম আলাপের মৌখিকতা ইত্যাদি মামুলি মিষ্টিমুখের পরে কাঁকড়ার প্রসঙ্গ এল।

‘দেখি কেমন কাঁকড়া?’ জ্যোৎস্না জিজ্ঞেস করে।

‘সুটকেসের মধ্যে আছে। খুলি, দাঁড়াও।’ সুটকেসের মুখ খোলে তড়িৎ।

অদ্যকার দিবসের সবচেয়ে বড়ো খবর (কিংবা খাবার) বলেই বোধ হয় আজকের খবরের কাগজে মুড়ে রাখা, পায়জামার আচ্ছাদনে ঢাকা সেই কাঁকড়ার কাবাব! অত্যন্ত স্নেহভরে তড়িৎ তার ঘোমটা খুলল।

‘অদ্ভুত!’ প্রথম দর্শনেই জ্যোৎস্না বিগলিত হয়।—‘দাঁড়াও, ততক্ষণে আমি রুটিটা কেটে মাখন মাখিয়ে ফেলি!’ বলে সেলাফিয়ে ওঠে। যে কাঁকড়ার কামড়েই মানুষকে লাফাতে হয় তাতে কামড় বসাবার সুযোগ পাওয়া কিছু কম লোভনীয় নয়—ভেবে দেখলে।

‘ইস! এর ঝোল দেখছি অনেক দূর গড়িয়েছে। খবরের কাগজ ভেদ করে আমার পায়জামা পর্যন্ত—’ তড়িৎ একটু আপশোস করে। কিন্তু তক্ষুনি সেনিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়—‘যাক গে!’

‘যাবে কেন? টাটকা দাগ তো, গরম জল ঢাললেই ধুয়ে যাবে। আমি কেচে দিচ্ছি এক্ষুনি।’

‘না না, ও নিয়ে তুমি ব্যস্ত হোয়ো না।’ তড়িৎ নিজেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

‘ব্যস্ত কীসের! চায়ের জল তো চাপাতেই হবে। স্টোভ ধরাই—’

‘তা হোক। তোমায় ধুতে হবে না আমার পায়জামা।’

‘ব্যাস! বিচ্ছিরি দাগ থেকে যাবে যে!’

‘থাক গে! কে দেখচে আমার পায়জামার দাগ? আমি তো একলা শুই।’

‘কতক্ষণের হাঙ্গাম? কেচে টাঙিয়ে দেব, বিকেলের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে—ভাবচ কেন?’

শুকোনোর দিকটা মোটেই ভাবছিল না তড়িৎ, কাজটার শুষ্কতার কথাই তাকে পীড়িত করেছে। জল ফুটিয়ে তার পায়জামা পরিষ্কার করছে জ্যোৎস্না, এহেন নির্জলা ব্যাপার সেভাবতেই পারে না। জ্যোৎস্নার চিন্তাধারা কিন্তু অন্য রকমের।

রুটি কাঁকড়ার চর্বণের সাথে তাদের চিরন্তন সমস্যা দেখা দিয়েছিল—খেতে খেতে পিসিমার কথা আলোচনা করছিল ওরা। ‘বাবা যে কী মুশকিলেই ফেলে গেছেন’—দীর্ঘনিশ্বাস-সহ জানাচ্ছিল তড়িৎ, ‘তাঁর উইলে পিসিমাকে সমস্ত সম্পত্তির ট্রাস্টি করে গিয়ে! তাঁর অনুমতি ছাড়া আমি বিয়েই করতে পারব না। যদি করি উইলের শর্তমতো একটি পয়সাও পাব না আমি আর। ভাবো দেখি, কী বিপদ!…হায়, মা যদি বেঁচে থাকতেন! তাহলে আমার আর এ দশা হত না!’ আবার সেতার দীর্ঘনিশ্বাস পাড়ে।

‘কী দরকার আমাদের সম্পত্তির?’ জ্যোৎস্না আপত্তি জানায়। ‘কী হবে বেশি টাকায়? দুজনে মিলে চাকরি করে চালিয়ে নিতে পারব। পারব না?’

‘সেটা চাকুরেজীবন হবে। দাম্পত্যজীবন হবে না।’ তড়িৎ এবার দীর্ঘতর নিশ্বাস ফেলার চেষ্টা করে।—‘আমার পিসিমা যদি অতটা সেকেলে না হতেন, কী সুখের যে হত!’

‘আমাকে তিনি দু-চোখে দেখতে পারেন না।’ জ্যোৎস্নাও পান্ডুর হয়ে আসে।

‘বিয়ের কথা তুলব কী, তোমার সঙ্গে মিশতে পর্যন্ত মানা, তা জান?’ তড়িৎ ঝিলিক মারে।—‘বালিগঞ্জের মেয়েরা তাঁর অসহ্য। তোমাদের কথা তিনি সইতেই পারেন না। তোমাদের সম্বন্ধে তিনি মনে মনে যা ভাবেন তা মুখে আনা যায় না।’

‘তাঁর ধারণা, আমরা, বালিগঞ্জের মেয়েরা প্রজাপতির পাখায় উড়ছি। তাই না?’

‘কেবল পাখায় উড়লে তো রক্ষে ছিল। তার চেয়েও বেশি’—তড়িৎ আলোক হানে।—‘তার চেয়েও বিচ্ছিরি।’

‘মানে, কেবল উড়ছিই না, ওড়াচ্ছিও? তাই তো? মানে, আমার সঙ্গে বিয়ে হলে দু-দিনে তোমার সব টাকা উড়িয়ে দিয়ে ফতুর করে তোমায় পথে বসাব—এই তো?’

‘এ তো বটেই, কিন্তু এর চেয়েও আরও। কেবল এ ভাবলে তো কথাই ছিল না—কিন্তু আমার পিসিমার কল্পনার দৌড় আরও বেশি। তিনি ভাবেন—তিনি ভাবেন যে—কী করে যে তোমাকে আমি বোঝাই—! তিনি মনে করেন যে তোমাদের কাছে আমরা অসহায় শিশুমাত্র। ছলে বলে কৌশলে তোমরা—কী বলে গিয়ে— তোমরা আমাদের—কী করে যে বলা যায় কথাটা!—এককথায়, তোমাদের কাছে ঘেঁষলে আমাদের পতিত্বহানি হবার ভয় আছে। এবার বুঝেছ?’

প্রকাশ করে বলার প্রয়াসে তড়িতের চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে। জ্যোৎস্না হাসতে থাকে।—‘মানে, তোমাদের বখিয়ে দিতে পারি, এই তো?’

আহার-পর্বের পর আবার চায়ের জল চেপেছিল। প্রথম কেটলির জলে পায়জামাটা ধুয়ে শুকোতে দেয়া হয়েছে আলনায়। কিন্তু কাঁকড়াঘটিত পাকা রং একেবারে যাবার নয়—ফ্যাকাশে-মার্কা হয়ে রয়ে গেছে তখনও। তবু জৌলুসের চটক ঢের কমে গেছে বলতে হবে।

পেয়ালা পিরিচ সাজিয়ে কেটলিটা নামাতে যাবে, এমন সময়ে বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ এল। দরজা খুলে দিতে গিয়ে জ্যোৎস্না দেখল—সরাসরি চোখের সামনে—তড়িতের পিসিমা!

পিসিমার চোখে চাবুক—সংকল্পের দৃঢ়তা তাঁর চিবুকে।—‘তোমার মাকে একটা কথা বলতে এলাম।’ তিনি বললেন।

‘মা তো বেলুড়ে গেছেন আজ। দাদা-টাদা সবাই।’ জ্যোৎস্না জানায়—‘আমি একলা আছি বাড়িতে।’

‘বেশ, তাহলে তোমাকেই বলে যাব। তোমার সম্বন্ধেই কথাটা। আমাদের তরুর বিষয়ে। তরু আজ সন্ধ্যের গাড়িতে আসছে—’ পিসিমা শুরু করেন।

‘ও—আজ আসছেন বুঝি—?’ জ্যোৎস্না আমতা আমতা করে। কী বলবে, কী বলে যে পিসিমাকে দরজা থেকেই বিদায় দেবে সেভেবে পায় না।

‘হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যেয় আসবে। তাই আগে থেকেই তোমাকে স্পষ্ট করে জানানো আমি কর্তব্য মনে করছি। আমি চাই না যে—’

চাইতে না চাইতেই সেই দুর্ঘটনা। আগামী সন্ধ্যার তড়িৎ এই মুহূর্তেই বিকশিত হয়ে ওঠে—হঠাৎ—‘কার সঙ্গে কথা বলছ জ্যোৎস্না? মা-রা ফিরে এলেন নাকি!’

‘তরু—তড়িৎ—!’ পিসিমা চমকে ওঠেন।

‘আপনি—আপনি কি ভেতরে আসবেন না?’ জ্যোৎস্না অনুরোধ জানায়। কিন্তু অনুরোধের অপেক্ষা ছিল না। তার আগেই পিসিমা তড়িৎগতিতে তড়িতের প্রান্তসীমায় উপস্থিত হয়েছেন। ‘—তরু, তুই আমায় অবাক করেছিস!’

তড়িৎ থতোমতো খায়।—‘আমার গাড়ি সন্ধ্যেয় আসবার কথা ছিল পিসিমা, কিন্তু যুদ্ধের হিড়িকে এখন কোনো কিছুরই তো সঠিক নেই, দৈবাৎ আজ সকালেই এসে গেল—’

‘সকালে? সেই সকালে এসেছিস তাহলে?’ পিসিমা আরও বেশি অবাক হন। ‘বলিস কী রে?’

‘সকালে মানে—এই একটু আগেই তো! এই পথ দিয়ে যাবার সময়ে ভাবলুম একবার জ্যোৎস্নাদের সঙ্গে দেখাটা করে যাই—’

‘সকালে মানে, একটু আগে?’ বিস্মিত স্বগতোক্তি শোনা যায় পিসিমার। এবং তাঁর সুতীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি ঘরময় ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে ঘরের মেজেয় উন্মুক্ত সুটকেসের ওপরে পড়ে। সেখান থেকে এক লাফে গিয়ে আলনায় ওঠে। ভিজে পায়জামার গায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। তারপর তার দাগের জায়গায় গিয়ে আটকায়। সে-দৃষ্টি সেইখানেই নিবদ্ধ হয়ে স্থির হয়ে থাকে, তার পর আর ঘোরে না।

পিসির নির্বাক তীব্রদৃষ্টির অনুসরণ করে তড়িতের হৃৎপিন্ডও বুঝি স্থির হয়ে যায়। তার পায়জামার মতো তাকেও যেন দাগি দেখাতে থাকে। জ্যোৎস্নাও খুব ম্লান হয়ে পড়ে।

‘বুঝেছি।’ কী যেন বুঝে পিসিমা ঘাড় নাড়েন।

‘ও—ওই পায়জামাটা? বড্ড ময়লা হয়ে গেছল—তাই একটু কেচে টাঙিয়ে দিয়েছি।’ তড়িৎ বলে ওঠে। কিন্তু ওই কথা বলে ধোপদুরস্ত পায়জামাকে পরিষ্কার করা সহজ নয়। বরং সেই দুশ্চেষ্টায় পিসিমার মনের সন্দেহকে যে আরও কালো করে ঘোরালো করে তোলা হল মাত্র পরক্ষণেই তা সেটের পায়।

‘গরম জলে এত করে কাচলুম তবু—তবু কাঁকড়ার দাগ কি সহজে ওঠে?’ জ্যোৎস্না সাফাই দেয় এবার। মরিয়া হয়ে সেও একটা শেষ চেষ্টা করে।

‘ঠিক।’ পিসিমা বললেন—‘ঠিক কথা।’ তড়িতের দিকে তাকিয়ে।

তড়িৎ ঘাড় হেঁট করে কী যেন ভাবে, তারপরে দৃঢ়স্বরে জানায়—‘পিসিমা, তোমাকে একটা কথা বলব? আমি জ্যোৎস্নাকে বিয়ে করতে চাই।’ পিসিমার সম্মতি এবং পৈতৃক সম্পত্তি লাভের আর কোনো আশা তার নেই জেনেও—এই অভাবিত অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পৌঁছে—একথা সেনা বলে পারে না। কাঁকড়াঘটিত ঘটকালির এই কালিমা আর সুযোগ সেঘাড় পেতে নেয়।

‘যত শিগগির তা করো ততই মঙ্গল। ততই সবার পক্ষে ভালো।’ পিসিমাও না বলে পারেন না—‘আমি এতদিন যা ভয় করছিলাম তাই হয়েছে। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে—এখন—একটু কাগজ কলম দাও তো আমায়। তোমাদের বিয়েয় আমার অনুমতি নেয়া প্রয়োজন, আমার অনুমতিটা দিয়ে যাই।’

এই বলে ৪৪০ গজের দৌড়ে শেষপর্যন্ত এসেও হেরে যাবার মতো পিসিমা এক হাঁপ ছাড়েন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *