প্রতিহিংসা

সৈনিকের ষষ্ঠ অভিজ্ঞতা
প্রতিহিংসা
প্রথম পরিচ্ছেদ – রহস্যময় অন্তর্ধান!

পূর্ব আফ্রিকার পর্তুগিজ উপনিবেশ মোজাম্বিক-এর রাজধানী বায়রার ২,০০০ শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী একদিন অবাক হয়ে ভাবতে লাগল সিডনি ব্যাঙ্কে বিল নামে যে হিসাবরক্ষকটি কাজ করে সে হঠাৎ সেইদিন সকালে তার গৃহে অনুপস্থিত কেন? মাত্র তিনদিন আগে ওই শহরে যে মানুষটি পদার্পণ করেছেন, সেই আত্তিলিও গত্তি নামক নবাগত ভদ্রলোকের সঙ্গে বিলের আসন্নপ্রসবা তরুণী বধূ মারিয়ার শহর ত্যাগ করে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অত্যন্ত রহস্যময়। আত্তিলিওর নিজস্ব গাড়িতে তাঁরই নিগ্রো ড্রাইভারের সঙ্গে মারিয়ার যাত্রা শুরু; সেই সময় যারা মেয়েটিকে দেখেছে তারা চমকে উঠেছে মেয়েটির মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ, রক্তশূন্য!..

কমান্ডার আত্তিলিও গত্তির অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যাঁরা প্রথম থেকে পাঠ করেছেন, তাঁদের কাছে বিল নামধারী যুবকটি অপরিচিত নয়। কিন্তু কায়নাও শয়তানের ফঁদ যাঁদের দৃষ্টিগোচর হয়নি, সেইসব পাঠকের পক্ষেও বর্তমান কাহিনির রসগ্রহণ করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না, যখন তারা জানতে পারবেন যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আত্তিলিও গত্তি নামক মিত্রপক্ষের জনৈক সৈনিকের নেতৃত্বে আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মানুষ, জীবজন্তু ও অরণ্যসম্পদ সম্পর্কে গবেষণা করতে উক্ত মহাদেশে পদার্পণ করেছিলেন দুটি শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রী–প্রফেসর, এক ফরাসি চিকিৎসক এবং বিল, এক দুঃসাহসী মার্কিন যুবক।

প্রফেসর এই কাহিনিতে অনুপস্থিত, শুধু প্রসঙ্গ উঠল বলেই তাঁর নামের উল্লেখ। বিলকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিষয়ের অবতারণা।

প্রথম পরিচয়ের সময়ে আত্তিলিও সাহেব ওই যুবকের আফ্রিকা ভ্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি। পরবর্তীকালে আত্তিলিও জানতে পেরেছিলেন অগণিত হস্তিযুথের সংখ্যাকে রাইফেলের সাহায্যে যথাসম্ভব কমিয়ে দেবার জন্যই আফ্রিকার অরণ্যে বিলের আবির্ভাব। হাতি শিকারের জন্য তার অস্বাভাবিক আগ্রহের আসল কারণটা যখন গোপন রইল না, তখন মনে মনে অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু সেইসময় বিলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার উপায় ছিল না, নিয়তির নিষ্ঠুর নির্দেশে রক্তাক্ত এক পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে অমোঘ ভাগ্যচক্র।

অনেক শিকারির কাছে হাতি-শিকার নিতান্তই একটা শখ, কিন্তু বিলের ব্যাপারটা তা নয়। সমগ্র হস্তীজাতি সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করত বিল। তার বাল্যকালে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী একটি হাতি এবং সেই ঘটনাবিলের মনোরাজ্যে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা করে–শৈশব থেকে কৈশোর আর কৈশোর থেকে যৌবনের পরিণতি এক শোকার্ত শিশুর চিন্তার জগতে ধীরে ধীরে অনুভূতির জন্ম দেয়, দুঃখ-বেদনার পরিবর্তে জেগে ওঠে প্রতিহিংসার রক্ত-লোলুপ সংকল্প।

ঘটনাটা ঘটেছিল আমেরিকার ডেট্রয়েট নামক স্থানে। বিল যখন পাঁচ বছরের শিশু সেইসময় তার বাপ-মা তাকে পূর্বোক্ত স্থানে সার্কাস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সার্কাসের হাতিদের মধ্যে একটি হস্তিনী ছিল শিশুদের অত্যন্ত প্রিয়। লক্ষ লক্ষ শিশু তাকে দেখার জন্য ভিড় করত। হস্তিনীর স্বভাবচরিত্র খুবই শান্ত, বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য খোকা-খুকুর হাত থেকে বাদাম প্রভৃতি লোভনীয় খাদ্যের উপহার গ্রহণ করেছে ওই জন্তুটি, কোনোদিনই তার আচরণে উগ্রতার আভাস দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন সে খেপে গেল–তীব্র বৃংহন-শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে সে ছিঁড়ে ফেলল পায়ের শিকল, তারপরই শুরু হল ভয়ংকর কাণ্ড। সার্কাসের দড়ি আর বেড়া ভেঙেচুরে উড়িয়ে ছুটে চলল ক্রোধোন্মত্ত হস্তিনী, চলার পথে মানুষজন যাকে পেল তাকেই খুঁড়ে জড়িয়ে ধরে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল এদিক-ওদিক এবং অনেকগুলো মানুষকে হতাহত করার পর সে এসে দাঁড়াল একটা মালবহনকারী শকটের সামনে। অন্ধ ক্রোধে আত্মহারা হস্তিনী তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির উপর। তার খর্বাকৃতি গজদন্ত দুটি শকট ভেদ করে গুরুভার বস্তুটিকে অতি সহজেই শূন্যে তুলে ফেলল–পরক্ষণেই শকটসমেত হস্তিনীর প্রকাণ্ড মৃতদেহ ভীষণ শব্দে গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর! বোধ হয় হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে জন্তুটার মৃত্যু ঘটেছিল। হইহই! চিৎকার! ধুন্ধুমার!

(হস্তিনীর গজদন্তের কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই–এশিয়ার হাতিদের মধ্যে নারীজাতি উক্ত মহাস্ত্রে বঞ্চিত হলেও প্রকৃতির কৃপায় আফ্রিকার মহিলারা পুরুষদের মতোই দন্তসজ্জায় সুসজ্জিতা, ভয়ংকরী। বলাই বাহুল্য যে, সার্কাসের হস্তিনী ছিল আফ্রিকার জীব।)

যাই হোক, ওই গোলমালের মধ্যে বাচ্চা বিলকে তার বাপ মা-র কাছ থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনেছিল সার্কাসের জনৈক কর্মচারী। একটু পরেই বিল দেখতে পেল মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে মাটির উপর, পাশেই হাঁটু পেতে বসে আছেন বাবা। এক বছর পরেই বিলের বাবা মারা গেলেন। স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যুর শোক তাঁর আয়ুক্ষয় করে দিয়েছিল।

ওই দুর্ঘটনার তেইশ বছর পরে নিউইয়র্ক শহরে বিল আর আত্তিলিওর সাক্ষাৎকার। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞান বিষয়ক অভিযানকার্যে সাহায্য করার জন্য সঙ্গী হিসাবে বিলকে নির্বাচিত করেছিলেন আত্তিলিও। তার সিদ্ধান্ত জানার সঙ্গেসঙ্গে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বিলের মুখ। প্রথমেই আত্তিলিওর কাছে বিল যে-প্রশ্নটি করেছিল তার মর্ম হচ্ছে আফ্রিকাতে হাতি-শিকারের সুযোগ আছে কি না।

শুধুহাতি কেন, আত্তিলিও উত্তর দিয়েছিলেন, সিংহ, লেপার্ড, বন্য মহিষ, অ্যান্টিলোপ প্রভৃতি সব জানোয়ারই ওখানে বাস করে। চেষ্টা করলে গণ্ডার শিকারের সুযোগ হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু, বিল জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমি হাতি মারতে চাই। জঙ্গলের পথে ঘোরাঘুরি করার কায়দাকানুন শিখে গেলে আমি কি দু-একটা হাতি শিকার করতে পারব না?

আত্তিলিও জানালেন হাতি মারতে গেলে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। বিনা অনুমতিতে আফ্রিকায় কোথাও হাতি মারতে দেওয়া হয় না, হাতি শিকারের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা দরকার। বিভিন্ন উপনিবেশের আইন অনুযায়ী অনুমতিপত্রের জন্য যে মূল্য ধার্য করা হয়, সেটা হচ্ছে বিশ থেকে পঞ্চাশ ডলারের মধ্যে। বেআইনিভাবে হাতি শিকার করলে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকেন কর্তৃপক্ষ।

তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বিল জানিয়ে দিল আইন ভঙ্গ করে হাতিশিকারে তার আগ্রহ নেই। টাকাটা কোনো প্রশ্ন নয়, হাতিশিকারের অনুমতি পাওয়ার জন্য অর্থব্যয় করতে আমি কুণ্ঠিত নই। বিলের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার আভাস, কিন্তু হাতি মারতে হলে কি খুব বেশি অভিজ্ঞতার দরকার? আর আমরা যে-অঞ্চলে যাচ্ছি সেখানে কি হাতি আছে?

আফ্রিকার যে অঞ্চলে অভিযাত্রীরা প্রথমে পদার্পণ করেছিলেন, সেই জায়গাটা হচ্ছে গজরাজ্যের প্রিয় বাসস্থান–রোডেশিয়া। শিকারের অভিজ্ঞতার জন্য বিলকে তালিম দেবার দরকার হয়নি, কারণ মাছকে কখনো সাঁতার কাটার তালিম নিতে হয় না–দক্ষ শিকারির অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে জন্মেছিল বিল, শিকার তার রক্তে রক্তে। দূরদর্শিতা, কষ্টসহিষ্ণুতা প্রভৃতি শিকারিসুলভ সব গুণই তার ছিল, সেইসঙ্গে ছিল তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি এবং অতি বলিষ্ঠ একজোড়া পা–দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বনচারী নিগ্রোরাও যখন শ্রান্ত ক্লান্ত, তখনও দৃঢ় পদক্ষেপে পথ ভেঙে এগিয়ে যেতে বিলের আপত্তি নেই। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করলেও বিপদের সময়ে বিল সম্পূর্ণ শান্ত, সংযত, নির্বিকার।

কয়েক মাসের মধ্যেই আফ্রিকাবাসী বিভিন্ন হিংস্র পশুর সম্মুখীন হল বিল। জন্তুগুলোকে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা অসম্ভব, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মরণফাঁদ থেকে অনায়াসে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে এসেছে বিল, একবার নয়, বহুবার।

ওইসব দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার-এ লিপ্ত হয়ে বিল তার কর্তব্যে কখনো গাফিলতি করেনি। ভোর হওয়ার আগেই সে বেরিয়ে যেত, ফিরে আসত প্রাতরাশের সময়ে। কখনো কখনো অভিযাত্রীদের কর্মবিরতির পরে সে জঙ্গলের পথে বেরিয়ে পড়ত নূতন অভিজ্ঞতার সন্ধানে। কঠিন পরিশ্রমের পর আত্তিলিওর দলবল যখন বিশ্রাম নিতে ব্যর্থ, বিলের উৎসাহ-বহ্নি তখনও প্রদীপ্ত! বিশ্রাম শয্যা ছেড়ে সে এগিয়ে চলেছে শিকারের খোঁজে, সঙ্গে রয়েছে আত্তিলিওর নিগ্রো পথপ্রদর্শক ও বন্দুকবাহক মাততানি!

শিকারের সন্ধানকার্যে মাতোনির দক্ষতা ছিল অসাধারণ, পথপ্রদর্শক হিসাবেও তার তুলনা হয় না। কিন্তু প্রথম বছরের শেষ দিকে সে আত্তিলিওকে চুপি চুপি জানিয়ে দিল হাতিদের সঙ্গে লম্বা মাসাংগার (মাতোনির ভাষায় বিলের নামকরণ!) দেখা হওয়াটা প্রেতাত্মাদের অভিপ্রেত নয়–অতএব যতই চেষ্টা করা যাক লম্বা মাসাংগা কখনো হাতির দেখা পাবে না!

ব্যাপারটা সত্যি বড়োই অদ্ভুত। মাততানির সঙ্গে যথাস্থানে গিয়ে হস্তীযুথের সাক্ষাৎ পেয়েই তাড়াতাড়ি হাতি শিকারের পারমিট বা অনুমতিপত্রের জন্য সচেষ্ট হয়েছে বিল এবং অনুমতিপত্র নিয়ে পূর্বোক্ত স্থানে উপস্থিত হয়ে দর্শন করেছে আফ্রিকার নিসর্গশোভা হাতিরা সেখানে অনুপস্থিত! কয়েকদিন আগেও যেখানে দলে দলে হাতি বিচরণ করেছে, সেখানে আজ একটি হাতিরও পাত্তা নেই! সব ভোঁ ভাঁ!

কিছুদিন পরেই অভিযানের কাজে অভিযাত্রীরা গেছেন আর এক অঞ্চলে। আগেকার অনুমতিপত্র এখানে অচল, কারণ এখানে রাজত্ব করছে আর এক সরকার। সেখানেও হাতিদের দেখা গেল বিল, সঙ্গেসঙ্গে চেষ্টাচরিত্র আর অর্থব্যয় করে আরও একটি পারমিট জোগাড় করল সে, কিন্তু তারপরই আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! বিলও হাতিশিকারের অনুমতি পেয়েছে আর হাতির দলও হাওয়া হয়ে গেছে সেই তল্লাট ছেড়ে! আশ্চর্য কাণ্ড!

অভিযাত্রীরা যখন মাম্বোয়া জাতির আস্তানায় কায়না বা মৃত্যুগহ্বরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত, সেই সময়ে বিলের কাছে জমেছে সাত-সাতটি হাতি শিকারের অনুমতিপত্র কিন্তু অযথা অর্থব্যয় ছাড়া কোনো লাভ হয়নি, একটিও হাতি মারতে পারেনি বিল।

কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের নিয়েই বিল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মাম্বোয়াদের দেশে প্রায় সবরকম শিকারই সুলভ, কিন্তু হাতিরা ওখানে বাস করে না। তা ছাড়া হাতি শিকারের পক্ষে যে-মানুষটির সাহায্য অপরিহার্য, সেই মাততানিকে আগেই মোজাম্বিক সীমান্তে দক্ষিণ রোডেশিয়াতে তার নিজস্ব গ্রামে পৌঁছে দিয়ে অভিযাত্রীরা এসেছিলেন উত্তর রোডেশিয়ার মাম্বায়া রাজ্যে–অতএব হাতির পিছনে তাড়া করার সুযোগ পেল না বিল। সকলে ভাবল বিল বোধ হয় হাতির কথা ভুলে গেছে।

কায়না অভিযানে সাফল্য লাভ করে মাম্বোয়াদের দেশ ছেড়ে অভিযাত্রীরা এলেন জুলুল্যান্ডে। আত্তিলিওর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেখানকার পরিস্থিতি বেশ ভালো প্রথমত কয়েকশো মাইলের মধ্যে হাতির বসবাস নেই, দ্বিতীয়ত নরখাদক সিংহদের নিয়ে সকলে এমন ব্যতিব্যস্ত যে অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানো অসম্ভব। ইনিয়াতি পর্বতমালার মধ্যে জুলুদের দেশে কয়েক মাস কাটিয়ে দিলেন সবাই। এর মধ্যে একবারও বিলের মুখে হাতি শব্দটি শোনা গেল না। অবশেষে সর্দার জিপোশোর আদেশে অভিযাত্রীরা একদিন জুলুল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হলেন–প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে যে মুহূর্তে তারা জুলুল্যান্ডের বাইরের পথটার উপর এসে পড়লেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বিলের মুখে পরিচিত শব্দটি আবার শুনতে পেলেন সকলে হাতি! বিল দৃঢ়স্বরে জানিয়ে দিল অভিযাত্রীরা যা খুশি করতে পারেন, যেখানে খুশি যেতে পারেন কিন্তু সে এখন হাতির সন্ধানে যাত্রা করতে বদ্ধপরিকর, অন্য কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাতে সে মোটেই রাজি নয়। বিল আরও জানাল বায়রা থেকে লন্ডন হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার ভাড়ার টাকা রেখে বাকি সব টাকা প্রয়োজনবশে খরচ করতে তার আপত্তি নেই–একেবারে কপর্দকশূন্য হওয়ার আগে সে হাতি শিকারের আশা ছাড়বে না।

বিলের আগ্রহ আর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে আত্তিলিও আবার মাততানির সঙ্গে দেখা করলেন–এবং প্রফেসর আর বিলের সঙ্গে ওই নিগ্রোশিকারির বায়রা পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

তারপরই হল বিচ্ছেদ। একদিকে গেলেন আত্তিলিও অন্যদিকে বিল আর প্রফেসর। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আর বন্ধুদের খবর পাননি আত্তিলিও। দীর্ঘকাল পরে নূতন অভিযানের উদ্যোগে বায়রাতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আত্তিলিও হঠাৎ বিলের দেখা পেলেন।

বন্দরের মধ্যে যখন আত্তিলিওর নৌকা প্রবেশ করছে, সেইসময়ে একটি পর্তুগিজ লঞ্চ-এর উপর দণ্ডায়মান বিলের দীর্ঘদেহ তার নজরে পড়ল। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন অন্তত দশ মাস আগে যার আমেরিকাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা, সেই মানুষটি এখন হাত দুলিয়ে দন্তবিকাশ করে তাকে তারস্বরে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে! তার পাশেই যে সুন্দরী তরুণীটি দাঁড়িয়ে ছিল, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই আত্তিলিও বুঝলেন সে বিলের স্ত্রী।

মিনিট দুই পরেই বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সঙ্গে মিলিত হলেন আত্তিলিও। শুরু হল করমর্দনের পালা, তুবড়ির মতো ছুটল বাক্যস্রোত। অভিযানের সাজসরঞ্জাম নৌকা থেকে ডাঙার উপর নামল; সেগুলোকে ভালোভাবেই আত্তিলিও তদারক করলেন, ফাঁকে ফাঁকে তবু কথাবার্তার বিরাম নেই। বিল এবং তস্য পত্নী নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে আত্তিলিওকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল, পথে গাড়ির মধ্যেও চলেছে অবিরাম বাক্যের স্রোত। মধ্যাহ্নভোজের সময়েও আলাপের পালা অব্যাহত, সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ঘনিয়ে এল তখনও কথার শেষ নেই–অবশেষে আত্তিলিও যখন তার লোকজনের কাজকর্ম পরিদর্শন করতে শুল্কবিভাগে ছুটলেন তখনই শেষ হল অবিশ্রান্ত বাক্যের ফুলঝুরি। বিলের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাই এর মধ্যে শুনেছেন আত্তিলিও। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিম্নে বর্ণিত হল।

জুলুল্যান্ড থেকে প্রফেসর আর মাততানির সঙ্গে বায়রা শহরে আসার পথে প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনো হাতিকে পরলোকে পাঠানোর সুযোগ পায়নি বিল। তারা যখন বায়রোতে এসে পৌঁছাল, তখন রাজনৈতিক আবহাওয়া খুব খারাপ। ইউরোপের বুকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্ভাবনা পর্তুগিজ উপনিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। প্রফেসরকে তার মাতৃভূমি অর্থাৎ ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ফরাসি দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ। বিলের হাতে তখনও বেশ কিছু টাকা, সময়ও প্রচুর–অতএব নূতন উদ্যমে আবার হাতির সন্ধানে জঙ্গলের দিকে যাত্রার করার জন্য প্রস্তুত হল বিল। বিল নির্ঘাত হাতির পিছনেই তাড়া করত, কিন্তু লিসবন থেকে ম্যরিয়া নামে যে-মেয়েটি বায়রাতে এসেছিল তাকে দেখে বিলের মন বদলে গেল। হাতির কথা ভুলে ম্যরিয়ার মনোরঞ্জনে সচেষ্ট হল বিল।

কিছুদিনের মধ্যেই সে জানতে পারল ম্যরিয়ার দিক থেকেও তার প্রতি অনুরাগের অভাব নেই। অতঃপর ঘটনাচক্রের অনিবার্য পরিণতি, অর্থাৎ বিবাহ। বিয়ের পর সিডনি ব্যাঙ্কে একটা দস্তুরমতো ভালো চাকরি নিয়ে ম্যরিয়ার সাহচর্যে আদর্শ দম্পতির জীবনযাপন করছিল বিল। আত্তিলিওর সঙ্গে যখন বিলের আবার দেখা হল তখন পরবর্তী সপ্তাহ থেকে একটি নয়দিন ব্যাপী ছুটি উপভোগের আনন্দে সে মশগুল।

শুল্কভবনের দিকে আত্তিলিওকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বিল গল্প করছিল। এখানকার আবহাওয়া তার এবং নববধূর স্বাস্থ্যের উপযুক্ত বলে অভিমত প্রকাশ করল বিল; সামাজিক পরিবেশ চমৎকার, স্থানীয় ক্লাবগুলোতে নানাধরনের খেলাধুলার সুযোগও আছে–পরিশেষে তার বক্তব্য হল মানুষের জীবন যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে কত সুন্দর হতে পারে বিয়ের আগে সে-ধারণা তার ছিল না।

বিলের কথাবার্তা এই পর্যন্ত বেশ উপভোগ করেছিলেন আত্তিলিও, অকস্মাৎ বজ্রাঘাত!

এখন আমার ছুটি, বিলের কণ্ঠস্বর আনন্দে উদবেল, হাতি শিকারের নতুন পারমিট পেয়েছি। ভিলা মাচাডো নামে যে-জায়গাটা রয়েছে, সেখানে দানবের মতো অতিকায় একটা হাতি ভীষণ অত্যাচার করছে। এবারের ছুটিতে সেই হাতিটাকেই সাবাড় করব। খবরটা দিয়েছে। মাততানি। সেও আমার সঙ্গে যাচ্ছে। কী মজা!

আবার হাতি! আত্তিলিওর মুখ শুকিয়ে গেল–সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য আর মোটা মাইনের চাকরি বিলের মন থেকে প্রতিশোধের রক্তাক্ত সংকল্পকে মুছে ফেলতে পারেনি!

শুষ্কস্বরে তিনি বললেন, মাততানি? সে কোথা থেকে এল? তোমাদের পৌঁছে দিয়ে তার তো দেশে ফিরে যাওয়ার কথা–এতদিন সে এখানে কী করছে?

একগাল হেসে বিল জানাল সেইরকম কথাই ছিল বটে, কিন্তু মাতোনির জায়গাটা ভালো লেগে গেল বলে সে আর দেশে ফিরল না। বিল আরও বলল যে, ব্যাঙ্কের কাজে অন্তত এক সপ্তাহের ছুটি না-পেলে শিকারে যাওয়া অসম্ভব; সেইজন্যই সে এতদিন হাতিদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে একসময়ে না একসময়ে সুযোগ যে পাওয়া যাবে সে-বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল না। সেই উদ্দেশ্যেই বরাবর নিগ্রোশিকারি মাতোনির সঙ্গে সে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। এখন নয়দিনের লম্বা ছুটি পাওয়া গেছে আর অতিকায় এক হস্তীর সংবাদও উপস্থিত, অতএব মাতোনিকে নিয়ে হস্তিনিধনের অভিযানে যাত্রা করার এমন সুবর্ণসুযোগ হেলায় হারাতে সে রাজি নয়।

আত্তিলিওর সবসময়েই মনে হয়েছে বিল আর হাতির যোগাযোগ এক অশুভ পরিণতির সূত্রপাত করবে। কোনোদিন তিনি বিলের হাতি শিকারের আগ্রহে উৎসাহ প্রকাশ করেননি। এখনও সম্ভব হলে তিনি বাধা দিতেন, কিন্তু বিল এখন তার অধীনে অভিযানকার্যে ব্যাপৃত নয়–তাকে তিনি বাধা দেবেন কী উপায়ে? একমাত্র ভরসা ম্যরিয়া।

আত্তিলিও বললেন, তুমি বলতে চাও কালই তুমি বউকে ফেলে রাইফেল ঘাড়ে হাতির পিছনে ছুটবে?… অসম্ভব। ম্যরিয়া কখনোই রাজি হবে না।

বিল সানন্দে দন্তবিকাশ করল, আজ বিকেলে আমি ম্যরিয়াকে সব কথা খুলে বলব। বিয়ের আগে ম্যরিয়া আমাকে শিকার ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। আমি বলেছিলাম কয়েকটা হাতিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে আমি শিকারে ইস্তফা দেব। ম্যরিয়া খুব ভালো মেয়ে। আমার প্রস্তাবে তার আপত্তি হয়নি। আমি যে এতদিন শিকারে যাইনি তার কারণ স্ত্রীর অসম্মতি নয়–ছুটি পাইনি বলেই আমি হাতি শিকারের চেষ্টা করতে পারিনি। বুঝলে বন্ধু, এবার এমন বিরাট দুটি গজদন্ত আমি তোমার সামনে নিয়ে আসব যে, তেমন জিনিস তুমি জীবনে দেখনি।

আত্তিলিও দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ভবি ভোলবার নয়!…

বিল যেদিন চলে গেল সেদিনটা ছিল শনিবারের সকাল। ম্যরিয়া খুব সপ্রতিভ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে দুশ্চিন্তা ও উদবেগের আভাস আত্তিলিওর কাছে গোপন থাকেনি। শুধু কণ্ঠস্বর নয়, বন্ধুপত্নীর মুখ-চোখে সংশয় ও আশঙ্কার চিহ্ন দেখেছিলেন আত্তিলিও। শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে বিল ছিল ব্যস্ত ও উত্তেজিত, স্ত্রীর ভাবান্তর সে লক্ষ করল না।

যাওয়ার আগে বন্ধুকে শেষবারের মতো নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন আত্তিলিও। অন্তত এই হাতিটার পিছু নিতে বিলকে তিনি নিষেধ করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা অকারণ নয়–মাতোনির কাছ থেকে এর মধ্যেই পূর্বোক্ত হস্তীর দৈহিক আয়তন ও স্বভাবচরিত্রের যে বিবরণ আত্তিলিওর কর্ণকুহরে পরিবেশিত হয়েছিল তাতে বন্ধুর নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিল হেসে জানিয়েছিল তাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা করতে সে সমর্থ। ওই ভয়ংকর জীবের পশ্চাদ্ধাবনের সংকল্প থেকে বিলকে নিরস্ত করতে না-পেরে আত্তিলিও তার সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

বিল তার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, ধন্যবাদ। কিন্তু আমি জানি কালই তোমার বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেছে। অকারণে কারো কাজের ক্ষতি হয় তা আমি চাই না। আমার জন্য দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমি জানি কী করে হাতি মারতে হয়। দুই চোখের একটু উপরে একটা সরলরেখার মধ্যে অবস্থিত দুর্বল জায়গাটা কমলালেবুর মতো বড়ো–ওইখানে গুলি বসাতে পারলে হাতির নিস্তার নেই। ত্রিশ ফুটের বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চালানো উচিত নয়; অতএব হাতি তেড়ে এলে স্থিরভাবে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এসে পড়ে নির্দিষ্ট পাল্লার মধ্যে–তাই নয় কি? এসব ব্যাপার আমি জানি। খেপা জানোয়ারের সামনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে নিশানা করার ক্ষমতা যে আমার আছে সে-কথা তো তোমার অজানা নয়। অতএব বন্ধু, ভয়ের কোনো কারণ নেই।

বিল চলে গেল। আত্তিলিও কর্মসূচি বদলে ফেললেন। যদিও জরুরি কাজে পরের দিনই তার অন্যত্র যাওয়ার কথা, কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল কাজটা এমন কিছু দরকারি নয় যে এই মুহূর্তে হইহই করে ছুটতে হবে–বরং বিল ফিরে এলে তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়াই বিবেচনার কাজ। স্থানত্যাগের পরিকল্পনা বিসর্জন দিয়ে বায়রাতেই থেকে গেলেন আত্তিলিও এবং টেলিফোন করে ম্যরিয়াকে জানিয়ে দিলেন বিল ফিরে আসার আগে তিনি এই জায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ছেন না।

তোমার চিন্তার কারণ নেই, আত্তিলিও বললেন, বিল যেকোনো সময়ে ফিরে আসতে পারে।

না! না! হঠাৎ টেলিফোনের ভিতর দিয়ে ম্যরিয়ার অস্বাভাবিক কণ্ঠ তীব্রস্বরে ফেটে পড়ল আত্তিলিওর কানে, ও আর আসবে না!

আত্তিলিও স্তম্ভিত! আবার ভেসে এল নারীকণ্ঠের দ্রুত উক্তি, ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! আচ্ছা, গুড নাইট।

আত্তিলিও ভাবলেন ম্যরিয়া তার কথা বুঝতে পারেনি, সে বোধ হয় ভেবেছে সেই রাতেই বিলের ফিরে আসার কথা বলছেন তিনি, সেইজন্যই এই প্রতিবাদ। অর্থাৎ তার বক্তব্য হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি বিল ফিরে আসতে পারে না।

ম্যরিয়া কী বলতে চেয়েছিল তা সঠিকভাবে অনুধাবন করলেন আত্তিলিও মঙ্গলবার দুপুরে। সেদিন মধ্যাহ্নভোজের পর একটি ছোটোখাটো দিবানিদ্রা দেবার উদ্যোগ করছেন আত্তিলিও, এমন সময়ে বেজে উঠল টেলিফোন।

ফোন তুলতেই ম্যরিয়ার কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে চলে আসুন। আত্তিলিও হতভম্ব, সেকী! কী হয়েছে?

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদিক থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল। ম্যরিয়া ফোন রেখে দিয়েছে।

নিশ্চয় বিল আহত অবস্থায় ফিরে এসেছে, আত্তিলিও ভাবলেন। তিনি জামাকাপড় পরে নিজস্ব গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি চালিয়ে উপস্থিত হল বিলের বাড়িতে। ম্যরিয়া মাথায় হেলমেট চড়িয়ে বারান্দার উপর থেকে পথের দিকে তাকিয়েছিল। কোনো ভূমিকা না-করে সে আত্তিলিওকে বলল, বিলের কিছু হয়েছে।

কেন? বিলের কোনো খবর পেয়েছ?

খবর পাইনি বলেই বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। বিল কথা দিয়েছিল সোমবারের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবে। আজ মঙ্গলবার, অথচ তার দেখা নেই। কিন্তু এখন কথা বলার সময় নয়, চলুন আমরা যাই। তর্ক করবেন না, দয়া করে চলুন। এক্ষুণি চলুন। এই মুহূর্তে।

আত্তিলিও বোকার মতো বললেন, কোথায় যেতে হবে তা তো জানি না।

উত্তর এল, আমি জানি। রেনল্ট। ভিলা মাচাডোর রাস্তায় যেতে হলে রেনল্টে যেতেই হবে। ওখানকার গাঁয়ের মানুষের কাছে নিশ্চয়ই ওর খবর পাওয়া যাবে।

আত্তিলিও বন্ধুপত্নীকে বাড়িতে অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানালেন এবং তিনি যে এই মুহূর্তে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে যথাসম্ভব শীঘ্র ম্যরিয়াকে প্রয়োজনীয় সংবাদ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবেন সে-কথা জানাতেও ভুললেন না। কিন্তু ম্যরিয়া বাড়ি থাকতে রাজি নয়।

আমি খাবারদাবার তৈরি রেখেছি। পানীয় জল, কম্বল, ফ্ল্যাশ-লাইট প্রভৃতি সব কিছুই সাজানো আছে। বিলের বাড়তি বন্দুকটাও সঙ্গে নিচ্ছি–হয়তো অস্ত্রটা ব্যবহার করার দরকার হতে পারে। আর এক মিনিটও নষ্ট করা উচিত নয়। চলুন।

আত্তিলিও বুঝলেন ম্যরিয়া কোনো কথা শুনবে না, সে যাবেই যাবে। অগত্যা বন্ধুপত্নীকে নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার বমবো গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পথের শেষে

গাড়ি ছুটছে। দীর্ঘ পথ। যাত্রীরা মৌন। দুশ্চিন্তা ও উদবেগ যাত্রীদের নির্বাক করে রেখেছে। শুধু চালনচক্রের ওপর অভ্যস্ত দক্ষতায় ঘুরছে ড্রাইভার বমবোর হাত।

যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। সংকীর্ণ পথের উপর এক জায়গায় পড়ে ছিল একটা গাছ। অনেক কষ্টে সেই বাধা ভেদ করে গাড়ি ছুটল। জোর করে সঙ্গে আসার জন্য বন্ধুপত্নীর উপর বিরক্ত হয়েছিলেন আত্তিলিও, কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করে লাভ নেই–ম্যরিয়া অটল, অবিলম্বে বিলের খবর পাওয়ার জন্য যেকোনো বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে প্রস্তুত।

নির্দিষ্ট স্থানে ৩২নং মাইলপোস্টের কাছ রাস্তা থেকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গার উপর তাঁবুটা যাত্রীদের দৃষ্টিগোচর হল। তাঁবুতে ঢুকে বিলের দেখা পাওয়া গেল না।

আত্তিলিও ম্যরিয়াকে জানালেন শয্যার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমিয়ে সকাল বেলা বেরিয়ে গেছে, খুব সম্ভব এখনই সে মাতোনিকে নিয়ে ফিরে আসবে। ম্যরিয়াকে যাই বলুক না কেন বিলের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আত্তিলিওর মনেও তখন সংশয় উপস্থিত বিছানাতে বিলের দেহের ছাপ থাকলেও সে যে কখন শয্যাত্যাগ করেছে সে-কথা অনুমান করা সম্ভব নয়।

আত্তিলিওর প্রবোধ বাক্য শুনে খুশি হল না ম্যরিয়া, সত্যিকার অবস্থাটা সে জানতে চায় ধাতুনির্মিত যে বাক্সটার মধ্যে বিল খাবারদাবার নিয়ে এসেছিল সেই বাক্সের ডালা খুলে মেয়েটি ভিতরে দৃষ্টিপাত করল। সঙ্গেসঙ্গে আতঙ্কের চমক! সব কিছুই অটুট অবস্থায় আছে, একটুকরো খাবারও বাক্স থেকে অদৃশ্য হয়নি! অর্থাৎ তিনদিন আগে এখানে পৌঁছেই হাতির পিছু নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে বিল আর মাততানি, ফিরে এসে খাদ্যগ্রহণের সুযোগ হয়নি বলেই তাদের খাদ্যসামগ্রী অটুট ও অক্ষত অবস্থায় যথাস্থানে বিরাজ করছে! তিনদিন নিখোঁজ তারা!

ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে মানুষ যেমন করে প্রিয়জনের শবাধারের ডালা বন্ধ করে, ঠিক তেমনি করেই বাক্সের ডালা বন্ধ করল ম্যরিয়া। এতক্ষণ পরে মেয়েটির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। বিলের নাম ধরে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠে সে লুটিয়ে পড়ল পরিত্যক্ত শয্যায়, তার দুই চোখ বেয়ে নামল তপ্ত অশ্রু।

আত্তিলিওর জীবনে এমন দুঃসহ রাত্রি কখনো আসেনি। শোকের প্রথম আবেগ কেটে যেতেই ম্যরিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে, দারুণ আশায় বুক বেঁধে বার বার ছুটে এসেছে পথের উপর আবার নিরাশ হৃদয়ে স্থলিত পদক্ষেপে প্রবেশ করেছে তাঁবুর মধ্যে। সমস্ত রাত এবং পরের দিন সকাল পর্যন্ত সে ওইভাবেই কাটিয়েছে। ওই দীর্ঘসময়ের মধ্যে কোনো খাদ্য তো দূরের কথা, এক কাপ চা পর্যন্ত পান করতে রাজি হয়নি ম্যরিয়া। বার বার অনুরোধ করেও তাকে কিছুই খাওয়াতে পারলেন না আত্তিলিও। এক রাতের মধ্যে তিন-তিনবার নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা হয়েছে, হতচকিত গ্রামবাসীরা বিমূঢ়ভাবে ঘাড় নেড়েছে না, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা তাদের চোখে পড়েনি।

দিনের আলো ফুটতেই আবার অনুসন্ধান শুরু হল। একটার পর একটা গ্রাম পরিদর্শন করলেন আত্তিলিও আর ম্যরিয়া। সবসুদ্ধ প্রায় পাঁচ-ছয়টা গ্রামে তারা পদার্পণ করেছেন, সব জায়গায় একই উত্তর–সাদা চামড়ার কোনো মানুষের খবর জানে না স্থানীয় মানুষ। অবশেষে ৩৪নং মাইলপোস্টটার কাছে এসে যে-গ্রামটাকে তারা দেখলেন, সেটা ছিল সম্পূর্ণ জনশূন্য।

গ্রাম পরিদর্শন করে যাত্রীরা বুঝলেন দু-দিন আগেও সেখানে লোকজন বাস করত। হঠাৎ গৃহত্যাগ করে গ্রামসুদ্ধ লোকের বনের ভিতর উধাও হওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেলেন না আত্তিলিও। কিন্তু ম্যরিয়া দৃঢ়ভাবে জানালেন জনশূন্য গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিলের অন্তর্ধান রহস্য। তার ধারণা গ্রামের মধ্যে খুব শীঘ্রই মানুষের দেখা পাওয়া যাবে।

ম্যরিয়ার চিন্তাধারা যে অভ্রান্ত সে-কথা প্রমাণিত হল বুধবার সকাল দশটার সময়ে।

ধূলিধূসর ক্লান্ত দেহে বিস্তর ঘোরাঘুরির পর আবার ৩৪নং মাইলপোস্টের কাছে ফিরে এসে যাত্রীরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্যে একটি মনুষ্যমূর্তির সাক্ষাৎ পেলেন। পূর্বোক্ত মনুষ্যটি কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করছিল, সাদা চামড়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা তার ছিল না। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কিছুমাত্র মর্যাদা না-দিয়ে ড্রাইভার বমবো লোকটিকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে যাত্রীদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। লোকটি স্থানীয় মানুষ, নাম–জাটা। জাটা চোখে-মুখে আতঙ্কের চিহ্ন পরিস্ফুট। প্রথমে সে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি, কিন্তু ম্যরিয়ার অবস্থা দেখে তার মনে সহানুভূতির উদ্রেক হল। আতঙ্কের পরিবর্তে স্নিগ্ধ কোমল অভিব্যক্তির ছায়া পড়ল জাটার মুখে, চলো।

সম্মোহিতের মতো জাটাকে অনুসরণ করল ম্যরিয়া। প্রায় ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর একটা ফাঁকা জায়গার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল স্থানীয় মানুষ, তার উদবিগ্ন দৃষ্টি এখন আত্তিলিওর দিকে। হঠাৎ জাটার পাশ দিয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে গেল ম্যরিয়া। এত তাড়াতাড়ি সে চালিয়েছিল যে, আত্তিলিও কিংবা নিগ্রোটি তাকে বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না।

নারীকণ্ঠের অবরুদ্ধ আর্তস্বর শোনা গেল; আত্তিলিও ছুটে গেলেন ম্যরিয়ার দিকে। পরক্ষণেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি, কয়েক মুহূর্তের জন্য আড়ষ্ট হয়ে গেল তার সর্বাঙ্গ।

আত্তিলিওর সম্বিৎ ফিরে এল যখন তিনি দেখলেন ম্যরিয়ার দেহ রক্তচিহ্নিত মাটির উপর লুটিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তিনি মূর্তি বন্ধুপত্নীর পতনোন্মুখ দেহটাকে ধরে ফেললেন। এতক্ষণে সন্ধানপর্ব শেষ! সামনেই মাটির উপর জমাট শুষ্ক রক্তের ছড়াছড়ি এবং সেই শোণিত-চিহ্নিত ভূমিতে পড়ে আছে দুটি বিকৃত, নিষ্পিষ্ট, ছিন্নভিন্ন মনুষ্যদেহ বিল আর মাততানি!

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রক্তের ঋণ রক্তেই শুধব

আত্তিলিও চিৎকার করে বমবোকে বললেন সে যেন এখনই শহর থেকে ডাক্তার, নার্স আর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসে। জাটা নামক নিগ্রোটিকে তিনি বমবোর পথপ্রদর্শক হয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চটপট শহরে পৌঁছানোর পথ স্থানীয় মানুষের নখদর্পণে, তাই বমবোর সঙ্গে জাটাকে যেতে বলেছিলেন আত্তিলিও। তার মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই বিদ্যুদবেগে অন্তর্ধান করল বমবো আর জাটা। মূৰ্ছিতা ম্যরিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন আত্তিলিও প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো…

অনেকক্ষণ পরে লোকজন নিয়ে হাজির হল বমবো। ম্যরিয়ার অচেতন দেহটাকে বমবো আর আত্তিলিও ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলে দিলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন স্নায়ুর উপর অত্যধিক চাপ পড়ার ফলে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়েছে, কিন্তু ভয়ের কারণ নেই–সে নিশ্চয়ই আরোগ্য লাভ করবে। ম্যরিয়াকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটল শহরের হাসপাতাল অভিমুখে।

এইবার ভালোভাবে অকুস্থল পর্যবেক্ষণ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযুথের পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত মৃত্তিকার বুক শুষ্ক রক্তের অক্ষরে যে শোচনীয় কাহিনির বর্ণনা ফুটে উঠেছিল, সেটা অনভিজ্ঞের কাছে দুর্বোধ্য হলেও ঝানু শিকারির চোখে সেই চিহ্নগুলো ছিল ছাপানো বইয়ের অক্ষরের মতোই স্পষ্ট–অতএব অকুস্থল পরিদর্শন করার পর আর প্রকৃত ঘটনা আত্তিলিওর অজ্ঞাত রইল না।

শহর থেকে আগত ডাক্তারটির প্রশ্নের জবাবে আত্তিলিও বললেন, মানুষ আর হাতির পায়ের ছাপ দেখে সহজেই বুঝতে পারছি জন্তুটার মগজ লক্ষ করে বিল গুলি চালিয়েছিল। খুব সম্ভব চিৎকার করে যুথপতিকে প্ররোচিত করেছিল বিল। হাতিটা তাকে লক্ষ করে ছুটে আসতেই বিল গুলি ছুঁড়েছিল। মগজের যে-জায়গায় আঘাত লাগলে হাতির মৃত্যু অবধারিত, সেই দুর্বল স্থানটির উপরে ও নীচে অবস্থান করছে কঠিন হাড়ের দুর্ভেদ্য আবরণ। অপ্রত্যাশিতভাবে মস্তক সঞ্চালন করার ফলেই বোধ হয় হাতির মর্মস্থান থেকে একটু দূরে গুলি লেগেছিল এবং ক্রোধে ও যাতনায় ক্ষিপ্ত দানব এসে পড়েছিল বিলের দেহের উপর। এই ধরনেরই একটা ব্যাপার ঘটেছিল সন্দেহ নেই। বিল ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, নিতান্ত দুর্ভাগ্যবশত তার নিশানা ব্যর্থ হয়েছে।

অতঃপর আত্তিলিও ঘটনার যে বিশ্লেষণ করলেন তা হচ্ছে এই–

বিল দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ পায়নি। যূথপতিকে অর্থাৎ বিলের আততায়ীকে লক্ষ করে গুলি চালিয়েছিল মাতোনি। তার নিক্ষিপ্ত গুলিও ক্ষিপ্ত হস্তীর গতি রোধ করতে সমর্থ হয়নি। হাতিদের দলপতি যখন বিলের দেহের উপর ক্রোধ চরিতার্থ করছিল, তখন দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল মাততানি–দুঃখের বিষয় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ছুটে এসেছিল শরীরী ঝটিকার মতো ক্রুদ্ধ হস্তীযুঞ্চ এবং মাততানির দেহটাকে পিষে দলে আবার প্রবেশ করেছিল অরণ্যের গর্ভে। অকুস্থলের নিকটস্থ ভূমিতে একটি স্থানীয় মানুষের পদচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন আত্তিলিও। খুব সম্ভব ওই লোকটির কাছে খবর পেয়েই গ্রামবাসীরা সতর্ক হয়েছিল। পুলিশের ভয় তো ছিলই, কিন্তু পুলিশের চাইতে অনেক বেশি ভয়ংকর মত্ত মাতঙ্গের আক্রমণ আশঙ্কা করেই গ্রাম ছেড়ে বনের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছিল গ্রামের মানুষ।

আত্তিলিও যখন ওইভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করছিলেন তখন ডাক্তারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ড্রাইভার বমবো। সে জানাল আত্তিলিওর অনুমান অভ্রান্ত। জাটা নামক পূর্বে উল্লিখিত যে লোকটি যাত্রীদের অকুস্থলে নিয়ে এসেছিল, সে নিজেই ছিল বিলের পথপ্রদর্শক। মাততানির সঙ্গে জাটার বন্ধুত্ব ছিল; মাতোনির পরিবর্তে তার বন্ধু জাটা বিলকে হাতিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল–দুর্ঘটনার স্থলে নিকটবর্তী ভূমিতে জাটার পায়ের ছাপই দেখেছেন আত্তিলিও। বমবো বেশ বুদ্ধিমান লোক, ওইসব দরকারি খবর সে এখানে এসে জোগাড় করে ফেলেছে কিছুক্ষণের মধ্যে।

আত্তিলিও সাহেবও একটি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন বিলের আততায়ীর একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। আফ্রিকার হাতির সামনের দুটি পায়ে চারটি আঙুল, পিছনের পায়ে তিনটি–কিন্তু বিলের হত্যাকাণ্ডের জন্য যে খুনি হাতিটা দায়ী, সেই জন্তুটার সামনের বাঁ-পায়ে চারটির পরিবর্তে রয়েছে তিনটি আঙুল। অসংখ্য হাতির পদচিহ্নের ভিতর থেকে অপরাধীকে খুঁজে নিতে এখন আর অসুবিধা নেই শুধু তিন আঙুলের বৈশিষ্ট্য নয়, এমন গভীর ও বৃহৎ পদচিহ্ন আগে কখনো আত্তিলিওর চোখে পড়েনি। পায়ের ছাপ দেখেই আত্তিলিও বুঝতে পারলেন আফ্রিকার অতিকায় হস্তীকূলেও বিলের হত্যাকারীর মতো প্রকাণ্ড হস্তী নিতান্তই দুর্লভ। ।

শয়তান, আত্তিলিও সক্রোধে প্রতিজ্ঞা করলেন, তোমাকে আমি শেষ করব।

বিলের দলিত ও ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ হাসপাতালের গাড়িতে তুলে দিতে গেলেন আত্তিলিও। জিজ্ঞাসা করে ডাক্তার জানতে পারলেন আত্তিলিও এখন ওই হাতিটাকে অনুসরণ করবেন।

হ্যাঁ, জন্তুটা আমার বন্ধুকে হত্যা করেছে, আত্তিলিও বললেন, রক্তের ঋণ আমি রক্তেই শুধব। কিন্তু আপনি এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

গাড়িটাকে তাহলে আমি এখনই আবার পাঠিয়ে দেব, ডাক্তার বললেন, হয়তো আর একটা মৃতদেহকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হবে!

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অরণ্য-ভৈরব

বুধবার সকালে বিল এবং মাতোনির মৃতদেহ পেয়েছিলেন আত্তিলিও। সেদিনই অর্থাৎ বুধবারে, রাতের দিকে বমবো এসে জানাল জাটার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রাম এখনও জনমানবশূন্য। আত্তিলিওর দলভুক্ত অভিযাত্রীদের মধ্যে যে চারজন নিগ্রো ছিল, তারা সাগ্রহে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কিন্তু আত্তিলিও তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলেন অভিযানের বিভিন্ন কাজে দক্ষ হলেও এই অরণ্য তাদের পরিচিত নয়, অতএব লোকগুলোর প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। বুঝেই তাদের নিবৃত্ত করা হল।

বৃহস্পতিবার সকালে আত্তিলিওর দলবল বায়রা ছেড়ে অন্যত্র যাত্রা করল। আত্তিলিও অবশ্য তখন তাদের সঙ্গ গ্রহণ করেননি, কথা হল পরে তিনি তাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। বিলের সৎকার-কার্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন, মহা সমারোহের সঙ্গে তাকে কবর দেওয়া হল। হাসপাতালে গিয়ে ম্যরিয়ার সাক্ষাৎ লাভ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। চেষ্টা সফল হয়নি; চিকিৎসকরা জানালেন যদিও মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ নয়, তবু লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা এখন চলবে না। আত্তিলিও জেনে খুশি হলেন যে, ম্যরিয়ার গর্ভস্থ শিশু বেশ ভালোই আছে।

সমস্ত কর্তব্যের পালা চুকিয়ে আত্তিলিও চললেন হন্তারক হস্তীর সন্ধানে, সঙ্গে ড্রাইভার বমবো। হত্যাকাণ্ড যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সেখানকার মানুষ যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল সে-কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এবার পুলিশের সাহায্যে গ্রামের সর্দারকে পাকড়াও করলেন আত্তিলিও। পুলিশ-অফিসার ঘোষণা করল সর্দার যদি আত্তিলিওকে হাতির সন্ধান পেতে সাহায্য না করে, তাহলে তাকে পদচ্যুত করে সেই জায়গায় অন্য সর্দারকে নিযুক্ত করা হবে।

তারপর এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তাই হল। বিলের হত্যাকারী হস্তী এবং তার দলবল সম্বন্ধে সর্দারের ছিল অপরিসীম আতঙ্ক। আতঙ্ক অহেতুক নয়–পুলিশ যা-ই করুক, খুন করবে না; কিন্তু সাদা শিকারির গুলি যদি ফসকে যায় তাহলে উক্ত হস্তীবাহিনীর দলপতি হয়তো গ্রামের উপর হানা দিতে পারে এবং সে-রকম ঘটনা ঘটলে বহু মানুষ যে প্রাণ হারাবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অতএব সর্দার নানাভাবে আত্তিলিওকে ভুলপথে চালিত করতে সচেষ্ট হল।

কায়না নামক মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে গিয়ে কমান্ডার আত্তিলিও গত্তি বুঝেছিলেন, স্থানীয় মানুষ কেমন করে বিদেশিকে দিগভ্রান্ত করে দেয়। সর্দারের চালাকি খাটল না, কয়েকদিনের মধ্যেই আত্তিলিও পূর্বোক্ত হস্তী ও তার দলবলের সন্ধান পেয়ে গেলেন।

পায়ে-চলা বনপথের উত্তর দিকে অবস্থিত জলাভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আত্তিলিও সর্দারকে বললেন, কাল আমি ওইদিকে যাব। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। আমি জানি ওইখানেই আছে সেই শয়তান।

আচমকা মুখের উপর চড় মারলে মানুষের যে অবস্থা হয়, সর্দারের মুখের অবস্থাও হল সেইরকম। স্খলিতস্বরে সে বলল, সাদা মানুষ! তুমি মরবে। তমার আগে অনেক কালো আর সাদা শিকারি ওই জন্তুটাকে মারতে গিয়ে মরেছে। তুমিও তাদের মতো মরবে।

আত্তিলিও বুঝলেন তাঁর অনুমান যথার্থ। ওইখানেই আছে বিলের হত্যাকারী।

কাল আমরা যাচ্ছি, আত্তিলিও ঘোষণা করলেন। পুলিশ অফিসার ভয় দেখিয়ে যে-কথাটা বলেছিল, সেই কথাটাও তিনি সর্দারকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুললেন না।

অবশ্য পুলিশের কাছে সর্দারের সম্বন্ধে অভিযোগ করেননি আত্তিলিও। যতদূর জানা যায় আত্তিলিও সাহেবের বায়রা ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত উক্ত সর্দারকে সর্দারি করতে দেখা গেছে। ঘটনাটা অন্যরকম হতে পারত–কারণ, পরের দিন সকালে আত্তিলিও আর সর্দারকে দেখতে পাননি। এক রাতের মধ্যে সে এলাকা ছেড়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। মুখে যাই বলুন, মনে মনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি আত্তিলিও। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি?

সর্দারের অনুপস্থিতি শিকারীর সংকল্পে বাধা দিতে পারল না। বমবোকে সঙ্গে নিয়ে জলাভূমি পার হলেন আত্তিলিও। তিনি অনুমান করেছিলেন স্যাঁৎসেঁতে জলাভূমির পরেই শক্ত মাটির দেখা পাওয়া যাবে। অনুমানে ভুল হয়নি–জলার সীমানা শেষ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রস্তর-আবৃত কঠিন ভূমি, এখানে ওখানে ফাঁকা জায়গার উপর বিচ্ছিন্নভাবে মাথা তুলেছে সবুজ উদ্ভিদের সারি এবং ছোটো বড়ো পাথরের টুকরো। একটা উঁচু জায়গার উপর উঠে জলের কল্লোলধ্বনি শুনতে পেলেন আত্তিলিও। উচ্চভূমির পরেই একটা খাদ। বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে চলে গেছে সেই খাদ ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়। দু-পাশে খাড়া মাটির দেয়াল-বসানো ফঁকটা দশ ফুটের কম নয়। খাদের বিপরীত দিকে একটা ঝরনা দেখতে পেলেন আত্তিলিও। ওই ঝরনার শব্দই তিনি শুনেছেন একটু আগে।

শুকনো গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য ঝরনার কাছে গেলেন আত্তিলিও আর বমবো। খাদটাকে তারা ডিঙিয়ে যাননি, প্রায় বিশ ফুট খাড়াই ভেঙে ওঠানামা করে তারা ঝরনার কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

কিন্তু জলপান করতে গিয়ে তারা চমকে উঠলেন–আশেপাশে ভিজে জমির উপর ফুটে উঠেছে বহু হাতির পায়ের চিহ্ন! সেই পায়ের ছাপগুলোর ভিতর থেকে তিন আঙুলের প্রকাণ্ড পদচিহ্নটি আত্তিলিওর দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করল অতি সহজেই। একটু আগেও তার আচরণে সতর্কতার চিহ্নমাত্র ছিল না, চলার পথে বমবোর সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝেই কথা বলছেন–এখন পায়ের ছাপগুলো দেখামাত্র তার মনে হল অতর্কিতে মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

সূর্যরশ্মি অত্যন্ত প্রখর; মেরুদণ্ডের উপর ঘর্মস্রোতের অস্বস্তিকর অনুভূতি। নিস্তব্ধ বনভূমির ভিতর থেকে ভয়ংকর শব্দের আভাস–সত্যিই কি শব্দ হয়েছে? না, মনের ভ্রম?… এতক্ষণ হাতির সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আত্তিলিও, এখন তার মনে হল এত তাড়াতাড়ি জন্তুটার সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হয়। শিকারির মন এখনও তৈরি হয়নি, আর একটু সময় পাওয়া দরকার…।

আত্তিলিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টিকে চালিত করলেন। পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া দরকার। অবস্থাটা তার ভালো লাগছে না–সামনে পশ্চিম দিকে বিরাজ করছে নিবিড় অরণ্য। উত্তর ও দক্ষিণে মুক্ত প্রান্তরের উপর টুকরো টুকরো পাথরের ভিড়, পূর্বদিকে অর্থাৎ তাঁদের পিছনে হাঁ করে আছে গভীর খাদ।

ওই দেখো, সভয়ে আঙুল তুলে দেখাল বমবো।

সচমকে নির্দিষ্ট দিকে ঘুরলেন আত্তিলিও। সশব্দে দুটি বৃক্ষকে ধরাশায়ী করে অরণ্যের অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে এক অতিকায় হস্তী! এক নজর তার দিকে তাকিয়ে আত্তিলিও বুঝলেন এই জন্তুটাই বিলের হত্যাকারী। বহুদিন আফ্রিকায় বনেজঙ্গলে ঘুরেছেন আত্তিলিও, কিন্তু এমন প্রকাণ্ড হাতি কখনো তার চোখে পড়েনি।

সম্পূর্ণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আত্তিলিও আর বমবো। জন্তুটা ফাঁকা মাঠের উপর শিকারিদের থেকে প্রায় ২০০ ফুট দূরে অবস্থান করছিল। আত্তিলিও জানতেন হাতি দূরের জিনিস

ভালোভাবে দেখতে পায় না, অতএব এখনও তার নজরে পড়ার ভয় নেই।

কিন্তু হাওয়া? শিকারিদের দিক থেকে হাতির দিকেই ছুটে যাচ্ছে হাওয়া। অতিকায় জন্তুটা শুড় তুলে সন্দেহজনকভাবে বাতাস পরীক্ষা করছে এবং আশপাশ থেকে ভেসে-আসা শব্দের তরঙ্গ ধরার চেষ্টায় সবেগে দুলে দুলে উঠছে বিশাল দুটি কান–হাতির ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর। আত্তিলিও বুঝলেন তারা ফাঁদে পড়েছেন। দোষ তাঁর। বমবো অনভিজ্ঞ, সে শিকারি নয়–ড্রাইভার। তা ছাড়া বমবো যেখানকার অধিবাসী সেই অঞ্চলে হাতি নেই, উক্ত পশুটির স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে তাই সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে। আত্তিলিও যদি আর একটু সতর্ক হতেন তাহলে বিপদকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর শরীরী প্রতিচ্ছবি…

আত্তিলিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দানব আবার জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করতে উদ্যত হয়েছে। বিপদের মুখ থেকে উদ্ধার পেয়েছেন মনে করে আত্তিলিও যখন ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ শূন্যে শুড় তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াল অতিকায় হস্তী–আত্তিলিও বুঝলেন জন্তুটা তাঁদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে।

শিকারিদের বাঁ-দিক থেকে খুব ধীরে ধীরে ঢালু জমি বেয়ে আসতে লাগল হাতি, সঙ্গেসঙ্গে কান দুলিয়ে সন্দেহজনক শব্দ ধরার চেষ্টাও চলল।

আত্তিলিও রাইফেল তুললেন কাঁধে।

হাতি আরও এগিয়ে এল। চোখে না-দেখলেও ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে সে জেনে গেছে শিকারিরা কোথায় আছে।

দানবের চলার গতি বাড়ল। কমে আসতে লাগল দানব ও মানবের মধ্যবর্তী দূরত্ব।

নব্বই ফুট। আত্তিলিওর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। আশি ফুট। সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন, বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের গতি বুঝি থেমে যেতে চায়–রাইফেলের নিশানা স্থির করলেন আত্তিলিও।

সত্তর ফুট। মাথার মাঝখানে দুই চোখের একটু উপরে একটা ক্ষতচিহ্ন। বিলের গুলি ওইখানে কামড় বসিয়ে দাগ করে দিয়েছে।

ষাট ফুট। বিল তো হাতির মর্মস্থানে গুলি চালিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার! হাতিটা এখনও বেঁচে আছে কী করে? ..

পঞ্চাশ ফুট। বিল যেখানে গুলি করেছে সেই জায়গাটা থেকে এক ইঞ্চি উপরে আমি গুলি চালাব। মনে মনে ভাবলেন আত্তিলিও।

চল্লিশ ফুট। প্রকাণ্ড দুই গজদন্ত উদ্যত জিঘাংসায় প্রসারিত। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকেই দাঁত দুটো শিকারিদের দেহে বিদ্ধ হবে।

ত্রিশ ফুট। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলের ছাপ। কর্কশ শব্দ, আগুনের ঝলক। তীব্র তীক্ষ্ণ বৃংহণ-ধ্বনি। হাতি থমকে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু রাইফেলের বুলেট তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারেনি।

পালাও, বাওয়ানা!

আবার জাগল গজকণ্ঠে ভয়ংকর ধ্বনি। শব্দ এগিয়ে আসছে। আত্তিলিও পিছন ফিরে পলায়মান বমবোকে অনুসরণ করলেন। বমবো এক লাফে খাদ পার হয়ে গেল। মুহূর্তের দ্বিধা দশ ফুট ফাঁকটা কি পার হওয়া যাবে? পরক্ষণেই এক প্রচণ্ড লক্ষ্যে শূন্যপথ অতিক্রম করে খাদের বিপরীত পার্শ্বে এসে পড়লেন আত্তিলিও।

ছুট! ছুট! ছুট! সামনে বমবো, পিছনে আত্তিলিও! সুদীর্ঘ শুণ্ড আর প্রকাণ্ড দুই গজদন্তের মারাত্মক স্পর্শের আশঙ্কায় পলাতকদের সর্বাঙ্গে আতঙ্কের শিহরন–যেকোনো মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে ক্রোধোন্মত্ত হস্তী।

হঠাৎ একবার পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল বমবো এবং হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটির উপর। সে একবার ওঠার চেষ্টা করেই নিশ্চল হয়ে গেল, আত্তিলিও দেখলেন তার ভয়ার্ত চক্ষু তারকার নির্নিমেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে তাঁরই পিছন দিকে!

বমবোর স্তম্ভিত দৃষ্টির হেতু নির্ণয় করার জন্যে আত্তিলিও একবারও পিছন পানে চাইলেন না, তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ওঠ! ওঠ!

বমবো উঠল না।

ওঠ–

ক্রুদ্ধ হস্তীর তীব্র বৃংহণ ভেসে এল পিছন থেকে, আত্তিলিওর মনে হল তার কানের পর্দা বুঝি ফেটে গেল।

এবার আর পিছন ফিরে না-তাকিয়ে থাকতে পারলেন না তিনি, সঙ্গেসঙ্গে তাঁর অবস্থাও হল বমবোর মতো–সম্মোহিত মানুষের স্তম্ভিত দৃষ্টি মেলে তিনি নিরীক্ষণ করতে লাগলেন এক ভয়ংকর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য!

নিদারুণ ক্রোধে সংহার-মূর্তি ধারণ করেছে ক্ষিপ্ত গজরাজ, কিন্তু সে এখনও অবস্থান করছে। খাদের বিপরীত পার্শ্বে! বাধাটাকে ডিঙিয়ে আসার চেষ্টা না-করে খাদ পার হওয়ার কোনো সেতুপথ আছে কি না সেইটাই এখন তার অনুসন্ধানের বিষয়। পারাপারের পথ আবিষ্কার করতে

-পেরে নিষ্ফল আক্রোশে গাছগুলোকে সে সবেগে উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করছে ভূমিপৃষ্ঠে, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কর্ণভেদী বৃংহণ শব্দে কঁপছে আকাশবাতাস!

আচম্বিতে অরণ্যের অন্তঃপুর থেকে ভেসে এল বহু হস্তীর কণ্ঠ-নিঃসৃত ভয়ংকর ধ্বনি, দলপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে আসছে দানবের দল! কিছুক্ষণ পরেই তাদের দেখা পাওয়া গেল। ঢালু জমির উপর দিয়ে দলপতিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল ধূসরবর্ণ চলন্ত পর্বতের সারি–আত্তিলিও গুনে দেখলেন সেই ভয়ংকর বাহিনীতে অবস্থান করছে দু-দু-শো বন্য হস্তী।

ব্যাপারটা শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হয় বটে, কিন্তু ক্রোধোন্মত্ত হস্তীযুথের সামনে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদের সংখ্যা গণনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও। নিষ্ফল ক্রোধে চিৎকার করে আকাশ ফাটালেও হাতিদের মধ্যে কেউ খাদ ডিঙিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতে রাজি নয়!

আত্তিলিওর মনে পড়ল খুব ছোটোবেলায় একটা বইতে তিনি পড়েছিলেন–প্রতি পদক্ষেপে খুব বেশি হলে সাড়ে ছয় ফুট জায়গা অতিক্রম করতে পারে হাতি; একটা সাত ফুট চওড়া খাদ পার হওয়ার ক্ষমতা তার নেই।

কেতাবি তথ্য নিয়ে আর মাথা ঘামাননি তিনি। কিন্তু কথাটা যে সত্যি সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে খাদটাকে দুটো তুচ্ছ মানুষ লাফিয়ে পার হয়ে গেছে, সেই খাদটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অমিত বলশালী হস্তীযুথের সামনে! হাতি লাফাতে পারে না এবং সাড়ে ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে পা ফেলার ক্ষমতাও তার নেই–অতএব দশ ফুট চওড়া খাদের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আত্তিলিও নিজেকে বেশ নিরাপদ মনে করলেন।

কিন্তু এই নিরাপত্তা যে নিতান্ত সাময়িক সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল বমবো।

আত্তিলিও যখন হাতিদের সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যস্ত, বমবো তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল, গুলি চালাও বাওয়ানা, গুলি চালাও।

মাঝখানে খাদের বাধা থাকায় হাতির পক্ষে গুলি খেয়ে প্রতি-আক্রমণ চালানোর সুযোগ ছিল না। ভালো শিকারি সর্বদাই শিকারকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিতে চায়, তাই একতরফা সুবিধা নিয়ে গুলি চালাতে অনিচ্ছুক ছিলেন আত্তিলিও–কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য তিনি রাইফেল তুলতে বাধ্য হলেন। বিশালকায় যূথপত দাঁতের আঘাতে মাটি আর পাথর তুলে ফেলছে খাদের গর্তে, সঙ্গীরাও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে একাগ্রচিত্তে যেকোনো সময়ে মাটি ও পাথরে ভরাট হয়ে খাদের উপর হাতিদের পারাপার করার উপযোগী একটা সেতু গড়ে উঠতে পারে এবং সে-রকম কিছু ঘটলে গোটা দলটাই যে ওই পথে খাদ পার হয়ে মানুষ দুটিকে আক্রমণ করতে ছুটে আসবে, সে-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি হলেন না আত্তিলিও, রাইফেল তুলে সর্দার-হাতির মাথার উপর তিনি লক্ষ্য স্থির করতে লাগলেন। বিলের গুলিতে চিহ্নিত ক্ষতস্থানের একটু উপরেই আত্তিলিওর নিক্ষিপ্ত প্রথম গুলির দাগ; ওই দাগের একটু উপরে বিধল রাইফেলের দ্বিতীয় বুলেট। হাতি একটুও কাবু হল না, আঘাতের যাতনায় সে আরও কেঁপে গেল এবং দ্বিগুণ উৎসাহে দাঁত বসিয়ে মাটি তুলে ফেলতে লাগল খাদের মধ্যে। আত্তিলিও অবাক হয়ে গেলেন–এ কেমন হাতি? মাথার উপর দুর্বলতম স্থানে ভারী রাইফেলের গুলি অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এমন হাতির কথা তিনি কখনো শোনেননি। মাথা ছেড়ে তিনি নিশানা করলেন কর্ণমূলে।

গর্জে উঠল রাইফেল। হাঁটু পেতে বসে পড়ল মত্ত মাতঙ্গ। উপবিষ্ট অবস্থায় তার দেহটা একবার দুলে উঠল, তারপর প্রচণ্ড শব্দে শয্যাগ্রহণ করল মাটির উপর–সব শেষ!

যূথপতির মৃত্যু দেখে থমকে গেল হাতির দল। শূন্যে কয়েকবার রাইফেলের আওয়াজ করলেন আত্তিলিও। হস্তীযূথ এইবার শঙ্কিত হল। প্রথমে রণে ভঙ্গ দিল শাবকসহ হস্তিনীর দল, তারপর তাদের অনুসরণ করে বনের মধ্যে অদৃশ্য হল সমগ্র বাহিনী। অকুস্থলে পড়ে রইল কেবল যূথপতির প্রকাণ্ড প্রাণহীন দেহ। বিল, মাততানি এবং আরও অনেক শিকারি ও স্থানীয় মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী খুনি জানোয়ারটা শেষ পর্যন্ত আত্তিলিওর রাইফেলের গুলিতে ইহলীলা সংবরণ করল।

নিহত হস্তীর মস্তক পরীক্ষা করে একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া গেল। রাইফেলের তিনটি বুলেটই হাতির মাথায় লেগে চূর্ণবিচূর্ণ–ভাঙাচোরা বুলেটের ত্র্যহস্পর্শে চিহ্নিত ওই করোটিকে পাঠানে হয়েছিল জাদুঘরে; পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল হাতির মগজের উপর যেখানে মর্মস্থলের অবস্থান, সেই নির্দিষ্ট স্থান থেকে পাক্কা সাড়ে নয় ইঞ্চি উপরে রয়েছে এই সৃষ্টিছাড়া জন্তুটার মর্মস্থান! তামাম দুনিয়ার হাতিদের মধ্যে এমন বিকৃত মস্তিষ্ক-র উদাহরণ কোথাও পাওয়া যায়নি। মস্তিষ্কের ওই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের জন্যই শিকারিদের নিক্ষিপ্ত গুলির পর গুলি ব্যর্থ হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে হতভাগ্য বিল এবং খাদটা না-থাকলে বমবো আর আত্তিলিওর অবস্থাও যে বিলের মতোই হত সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বিদায় আফ্রিকা ১৯৩৯

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কামান-গর্জন যখন শুরু হল, আত্তিলিও তখন আফ্রিকার এক দুর্গম অঞ্চলে বিভিন্ন গবেষণায় ব্যস্ত। আফ্রিকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না, কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল বলে তিনি আমেরিকাতে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন। আফ্রিকা থেকে বিদায় নেবার আগে তিনি দ্বিতীয়বার কিভুর অরণ্যে প্রবেশ করে একটি মস্ত বড়ো গরিলা শিকার করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির জন্য প্রিটোরিয়া মিউজিয়াম অব সাউথ আফ্রিকা।

তবে মোয়ামি ন্‌গাগি নামে যে-জন্তুটাকে তিনি আগে মেরেছিলেন, সেটার সঙ্গে অন্য গরিলার তুলনা হয় না। উক্ত মোয়ামি ন্‌গাগি হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম গরিলা–অন্তত এখন পর্যন্ত অত বড়ো গরিলা কেউ শিকার করতে পারেনি।

কিবালির নিম্নভূমিতে অবস্থিত বনে-জঙ্গলে হানা দিয়ে ওকাপি নামক দুষ্প্রাপ্য পশুকে বন্দি করতে সমর্থ হয়েছিলেন আত্তিলিও। একটি নয় দুটি নয়–পাঁচ-পাঁচটি ওকাপিকে তিনি ধরেছিলেন। এক ধরনের অদ্ভুত জিরাফের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও। জন্তুগুলোর নাম দিয়েছিলেন অকোয়াপিয়া কিবালেনসিস।

ওইসব বিচিত্র তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করার জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আত্তিলিও ভ্রমণ করেছেন। ক্রিস্টাল পর্বতমালার অরণ্যে, লুয়ালালাবা ও কাসাই নদীর তটভূমিতে অ্যালবার্ট, এডওয়ার্ড, টাঙ্গানিকা প্রভৃতি হ্রদের তীর থেকে তীরে–সর্বত্র অশ্রান্ত পদক্ষেপে ঘুরেছেন আত্তিলিও, রহস্যময়ী আফ্রিকার বুকের ভিতর থেকে গোপন সম্পদ উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর গোচরে…

উনচল্লিশ জাতের পশুপক্ষী, সরীসৃপ এবং ছেষট্টি রকমের কীটপতঙ্গ ও দু-শো অজ্ঞাত উদ্ভিদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আত্তিলিও।

আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয় তাহলে আবার আমি ফিরে আসব আফ্রিকাতে, আবার এখানে শুরু করব গবেষণা আর অনুসন্ধানকার্য। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৮০

প্রতিহিংসা

প্রতিহিংসা

প্রতিহিংসা

শিমুল, শিমুল, তুই চুপ করে থাক
জানাস্ নে গোপন কথাটি
ও খুঁজে মরুক, ওর ভিটে মাটি চাঁটি
হয় হোক, ওর বুক দুঃখে পুড়ে খাক!

জারুল, জারুল, তুই দেখাস নে পথ
একা একা সে ঘুরে মরুক
ও চেয়েছে রমণীর সম্মুখ দ্বৈরথ
মাংস, ত্বক ছুঁয়ে ছেনে সুখ!
অশোক, অশোক, ওকে কর বর্ণকানা
যূথী, তুই দিস না সৌরভ
সমস্ত অরণ্যে আজ ওর ঠাঁই মানা
ও চেনেনি রূপের গৌরব।