রাজস্থান প্রহর - খানেক রাত হয়েছে শুধু , ঘন ঘন বেজে ওঠে শাঁখ । বরকন্যা যেন ছবির মতো আঁচল - বাঁধা দাঁড়িয়ে আঁখি নত , জানলা খুলে পুরাঙ্গনা যত দেখছে চেয়ে ঘোমটা করি ফাঁক । বর্ষারাতে মেঘের গুরুগুরু — তারি সঙ্গে বাজে বিয়ের শাঁখ । ঈশান কোণে থমকে আছে হাওয়া , মেঘে মেঘে আকাশ আছে ঘেরি । সভাকক্ষে হাজার দীপালোকে মণিমালায় ঝিলিক হানে চোখে — সভার মাঝে হঠাৎ এল ও কে , বাহির - দ্বারে বেজে উঠল ভেরী ! চমকে ওঠে সভার যত লোক উঠে দাঁড়ায় বর - কনেরে ঘেরি । টোপর - পরা মেত্রিরাজকুমারে কহে তখন মাড়োয়ারের দূত , ‘ যুদ্ধ বাধে বিদ্রোহীদের সনে , রামসিংহ রানা চলেন রণে — তোমরা এসো তাঁরি নিমন্ত্রণে যে যে আছ মর্তিয়া রাজপুত ।' ‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় ' গর্জি উঠে মাড়োয়ারের দূত । ‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় ' মেত্রিপতি ঊর্ধ্বস্বরে কয় । কনের বক্ষ কেঁপে ওঠে ডরে , দুটি চক্ষু ছলো ছলো করে — বরযাত্রী হাঁকে সমস্বরে , ‘ জয় রানা রাম সিঙের জয় ' ‘ সময় নাহি মেত্রিরাজকুমার ' মহারানার দূত উচ্চে কয় । বৃথা কেন উঠে হুলুধ্বনি , বৃথা কেন বেজে ওঠে শাঁখ ! বাঁধা আঁচল খুলে ফেলে বর , মুখের পানে চাহে পরস্পর — কহে , ‘ প্রিয়ে , নিলেম অবসর , এসেছে ওই মৃত্যুসভার ডাক ।' বৃথা এখন ওঠে হুলুধ্বনি , বৃথা এখন বেজে ওঠে শাঁখ ! বরের বেশে টোপর পরি শিরে ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার । মলিন মুখে নম্র নতশিরে কন্যা গেল অন্তঃপুরে ফিরে , হাজার বাতি নিবল ধীরে ধীরে — রাজার সভা হল অন্ধকার । গলায় মালা , টোপর - পরা শিরে ঘোড়ায় চড়ি ছুটে রাজকুমার । মাতা কেঁদে কহেন , ‘ বধূবেশ খুলিয়া ফেল্ হায় রে হতভাগী ! ' শান্তমুখে কন্যা কহে মায়ে , ‘ কেঁদো না মা , ধরি তোমার পায়ে , বধূসজ্জা থাক্ মা , আমার গায়ে - মেত্রিপুরে যাইব তাঁর লাগি ।' শুনে মাতা কপালে কর হানি কেঁদে কহেন , ‘ হায় রে হতভাগী ! ' গ্রহবিপ্র আশীর্বাদ করি ধানদূর্বা দিল তাহার মাথে । চড়ে কন্যা চতুর্দোলা - ' পরে , পুরনারী হুলুধ্বনি করে , রঙিন বেশে কিংকরী কিংকরে সারি সারি চলে বালার সাথে । মাতা আসি চুমো খেলেন মুখে , পিতা আসি হস্ত দিলেন মাথে । নিশীথ - রাতে আকাশ আলো করি কে এল রে মেত্রিপুরদ্বারে ! ‘ থামাও বাঁশি' কহে , ‘ থামাও বাঁশি — চতুর্দোলা নামাও রে দাসদাসী । মিলেছি আজ মেত্রিপুরবাসী মেত্রিপতির চিতা রচিবারে । মেত্রিরাজা যুদ্ধে হত আজি , দু : সময়ে কারা এলে দ্বারে ? ' ‘ বাজাও বাঁশি , ওরে , বাজাও বাঁশি ' চতুর্দোলা হতে বধূ বলে , ‘ এবার লগ্ন আর হবে না পার , আঁচলে গাঁঠ খুলবে না তো আর — শেষের মন্ত্র উচ্চারো এইবার শ্মশান - সভায় দীপ্ত চিতানলে ।' ‘ বাজাও বাঁশি , ওরে , বাজাও বাঁশি ' চতুর্দোলা হতে বধূ বলে । বরের বেশে মোতির মালা গলে মেত্রিপতি চিতার'পরে শুয়ে । দোলা হতে নামল আসি নারী , আঁচল বাঁধি রক্তবাসে তাঁরি শিয়র - ' পরে বৈসে রাজকুমারী বরের মাথা কোলের'পরে থুয়ে । নিশীথ - রাতে মিলনসজ্জা - পরা মেত্রিপতি চিতার'পরে শুয়ে । ঘন ঘন জাগল হুলুধ্বনি , দলে দলে আসে পুরাঙ্গনা । কয় পুরোহিত ‘ ধন্য সুচরিতা ' , গাহিছে ভাট ‘ ধন্য মৃত্যুজিতা ' , ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল চিতা — কন্যা বসে আছেন যোগাসনা । জয়ধ্বনি উঠে শ্মশান - মাঝে , হুলুধ্বনি করে পুরাঙ্গনা ।
Leave a Reply