রবিবার

রবিবার

কি ব্যাপার? মিট মিট করে হাসতে হাসতে কি দেখছ?

দেখছি আর ভাবছি।

কি দেখছ আর কি ভাবছ?

অনেক কিছু।

দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে আর ভাববে? কথা বলবে না?

বলব বলেই তো এসেছি, কিন্তু…।

কিন্তু কি?

ভাবছি তুমি বলব নাকি আপনি বলব

চমৎকার! প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, আগে কি বলতে?

আগে তো তুমিই বলতাম, কিন্তু তুমি তো আর সেই আগের তুমি নেই।

কেন? আমি কি পাল্টে গেছি? প্রজ্জ্বল সোজাসুজি মায়াবৌদির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, নাকি ভালো চাকরি করছি বলে তুমি বলতে দ্বিধা হচ্ছে?

এবার মায়াবৌদিও চোখ তুলে তাকায়। বলে, তুমি হঠাৎ এত বড় হয়ে গেছ যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বিধা হওয়া স্বাভাবিক।

তাই নাকি?

নিশ্চয়ই।

এখন খুব বড় হয়েছি আর আগে বুঝি খুব ছোট ছিলাম?

তা তো বলছি না।

তবে তুমি যে এখন অনেক বড় হয়েছ, তা তো ঠিক?

তার জন্য তোমার সঙ্কোচ বোধ করার কি কারণ ঘটল? আমি যাই হই, তুমি তো আমার বৌদিই আছ!

মায়াবৌদি জানত, প্রজ্জ্বল বড় হলেও পাল্টাতে পারে না। পাল্টাবে না। তবুও দ্বিধা এসেছিল। আসাটা স্বাভাবিক। ডিজি পি অ্যান্ড টি অফিসের আপার ডিভিশন কেরানির স্ত্রীর পক্ষে একজন আইএএস অফিসারের কাছে সহজ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। সে প্রজ্জ্বল হলেও নয়।

প্রজ্জ্বলের কথায় মায়াবৌদি খুশি হয়।

মামী দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েই মায়াবৌদিকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কিরে মায়া, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

মাযাবৌদি কিছু বলার আগেই প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে বলল, জান মামী, মায়াবৌদি পুজোর সময় থিয়েটার করবে বলে এখন থেকেই রিহার্সাল দিচ্ছে।

সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মামী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তার মানে?

আমি মামার অন্ন ধ্বংস করে ভালো চাকরি পেয়েছি বলে মায়াবৌদি আমাকে তুমি বলতে ভরসা পাচ্ছে না। প্রজ্জ্বল মায়াবৌদির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল।

এবার মামীও হাসে। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে মায়া? মানা আইএএস হয়েছে বলে কি আমি মামী নেই, নাকি তুই বৌদি নেই?

মামী আর কথা না বলে রান্নাঘরে চলে গেল। মামা বাথরুমে! বেরুলেই খেতে বসবেন। আটটা চল্লিশ হয়ে গেছে। মামী চলে যেতেই প্রজ্জ্বল উঠে গিয়ে মায়াবৌদির হাত ধরে এনে পাশে বসাল।

নাও, চা খাও।

খাচ্ছি।

চা খেতে খেতে প্রজ্জ্বল জিজ্ঞাসা করল, বল কি ব্যাপার?

শুনলাম তুমি এসেছ। তাছাড়া কদিন থাকছ বলে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।

কি কথা?

সামনের শনিবার দিল্লিতে থাকবে?

শনিবার আছি, তবে রবিবার সকালেই চলে যাবার কথা।

এই শনিবার তো সেকেন্ড স্যাটারডে। আমরা সবাই পিকনিকে যাচ্ছি, তুমি যাবে?

.

এই রামকৃষ্ণপুরমের মামার বাড়িতে কটা বছর থাকার সময় প্রজ্জ্বল তখন প্রত্যেকটা পিকনিকে গেছে। আনন্দ করেছে। দারুণ আনন্দ করেছে। প্রথমবার যেতে চায়নি। তখন কলকাতা থেকে ও নতুন এসেছে। পাড়ার সবার সঙ্গে পরিচয় হয়নি! ঘনিষ্ঠতা তো দূবের কথা! প্রজ্জল ভেবেছিল পিকনিকে গিয়ে চুপচাপ একলা একলা কাটাবার চাইতে বাড়িতে থাকাই ভালো, কিন্তু পারেনি। যেতে হয়েছিল। মামামামী এসব ব্যাপারে সবার চাইতে বেশি উৎসাহী। মামীর কাছেই পাড়ার সবাই চাঁদা জমা দিচ্ছিলেন। মামামামীর কথা ফেলতে পারেনি। প্রল নতুন হলেও পিকনিকে গিয়েছিল।

প্রজ্জ্বলের মামামামী দুজনেই বড় ভালোমানুষ। মনটা বড় উদার। পোস্টাপিসে সামান্য চাকবি করেন মামা, কিন্তু তবুও প্রজ্জ্বল যখন ইসলামিক হিস্ট্রি নিয়ে এম. এ. পড়বার জন্য দিল্লি জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নিল, তখন কিছুতেই ওকে হোস্টেলে থাকতে দিলেন না।

তা হয় না রে মানা। আমি দিল্লিতে থাকতে তুই হোস্টেলে থাকবি, তা কখনোই হতে পারে না।

মামী বললেন, আচ্ছা কয়েক মাস তো থাক। তারপর যদি তোমার অসুবিধে হয় তাহলে তখন হোস্টেলে চলে যেও।

এরপর আর কি বলবে। হোস্টেলের জন্য ফরম ভর্তি করেও জমা দিল না। রামকৃষ্ণপুরমে মামার ফ্ল্যাটে থেকেই জামিয়া মিলিয়াতে পড়তে লাগল।

এ মামা কিন্তু ওর আপন মামা নয়। মার মাসতুতো ভাই। তবে আপন মামা না থাকায় এই মামার সঙ্গে প্রজ্জ্বলদের সম্পর্ক বরাবরই বড় নিবিড়। এই মামা যখন কলকাতার সিটিওতে ছিলেন তখন প্রত্যেকবার প্রজ্জ্বলের মার কাছে ভাইফোঁটা নিয়েছেন। দিল্লিতে আসার পরও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। মামামামী ছুটিতে কলকাতায় গেলেই দুএকদিন ওদের মানিকতলার বাড়িতে থাকেন, দলবেঁধে সবাইকে নিয়ে স্টারে থিয়েটার দেখান, আর সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরও প্রজ্জ্বলের বাবামার সঙ্গে গল্প করেন।

এখানে এসে নতুন করে মামামামীকে ভালোবাসল প্রজ্জ্বল। রামকৃষ্ণপুরমের সেক্টর সিক্স মানেই ডাকতার বিভাগের সাধারণ কর্মচারীদের আবাসভূমি। ঘোট ঘোট খানা ঘরের ফ্ল্যাট। তা হোক। ঐ দুখানা ঘরের ফ্ল্যাটেই মামামামী সারা পাড়ার সবাইকে টেনে আনেন। গোরাবাবু তো কথায় কথায় বলেন, দাশদার ধর্মশালা থাকতে রিহার্সাল দেবার জায়গা নিয়ে এত আলোচনার কি দরকার? মামী পেটে ধরেছেন একটি মেয়ে কিন্তু সারা পাড়ার সব বাচ্চাদের হাসিমুখে কোলে তুলে নেন। বিশ্বাসের ফুটফুটে দুটো বাচ্চা তো প্রায় সারাদিন মামীর কাছে থাকে। বীণাবৌদির বড় বাচ্চাটা দেড় বছর হতে না হতেই তিনি আবার বাচ্চা হবার জন্য সফদারজং হাসপাতালের তিনতলার কোণার ঘরে আশ্রয় নিলেন। বড় বাচ্চাটা তখন মামীর কাছে বেশ কাটিয়ে দিল তিন সপ্তাহ। উষাবৌদির স্বামী নতুন স্কুটার কিনলেন। রোজ অফিস থেকে ফিরে একবার বৌকে নিয়ে না বেড়াতে বেরুলে তার মন ভরে না। অথচ ছেলেটা স্কুটারের আওয়াজ শুনলেই ভয়ে চীৎকার করতে শুরু করে। কিন্তু তার জন্য তাদের সান্ধ্য অভিসার বন্ধ হল না। মামী তো আছেন। দুচারদিন বাপ্পাকে রাখার পরই মামী ওর মাকে বললেন, হারে উষা, ছেলেটাকে একটা কুমারেশ খাওয়া তো?

প্রথম প্রথম প্রজ্জ্বল দারুণ অস্বস্তিবোধ করত। এত লোকজন বাচ্চাকাচ্চার হৈ চৈ তো ও কোনদিন সহ্য করেনি। কিন্তু আস্তে আস্তে ভালো লাগল। বিশ্বাসদার স্ত্রী চমৎকার ঘুগনি করতে পারেন। বিশ্বাসবৌদি সে ঘুগনি এ বাড়িতে না পাঠিয়ে নিজের স্বামীকেও দেবেন না। গোরাবাবুর মা এই দিল্লিতে এসেও সারা শীতকাল পিঠেপায়েস বানিয়ে শান্তি পান না। মামামামীর পুণ্যের জোরে প্রজ্জ্বল সারা শীতকাল পিঠে পায়েস খেয়েছে। শনিবাররবিবার বিকেলে চায়ের সঙ্গে সিঙাড়া পেলেই প্রজ্জ্বল বুঝত সুনীলদার স্ত্রী তত্ত্ব পাঠিয়েছেন।

.

এই মামামামীর জন্যই প্রথমবার পিকনিকে গিয়েছিল। একদল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে গিয়েও মন ভরে গিয়েছিল প্রজ্জ্বলের। তারপর থেকে প্রত্যেকবারই গিয়েছে। মামা মামীর তাগিদে নয়, নিজের আগ্রহেই গিয়েছে।

এই মায়াবৌদির সঙ্গে তো পিকনিকে গিয়েই ওর প্রথম আলাপ। পিকনিকের কথা শুনতেই প্রলের মনে অনেক দিনের অনেক মিষ্টি ছবি ফুটে উঠল।

প্রজ্জ্বল খুশি হয়ে বলল, এবার কোথায় যাচ্ছ?

দাসনায়।

দাসনায় আগে পিকনিক হয়নি?

না।

সবাই যাচ্ছে?

হ্যাঁ।

প্রজ্জ্বল একটু ভেবে বলল, কিন্তু বৌদি, আমি কি শনিবারে যেতে পারব?

কেন? সেকেন্ড স্যাটারডে তো সব বন্ধ।

তবুও আমাদের মিটিং বোধহয় চলবে।

যাই হোক, একটু চেষ্টা কর। তুমি গেলে সবাই খুশি হবে।

শুধু তোমরা কেন, আমিও খুব খুশি হব। তাছাড়া এখন তো এই সব সুযোগ পাই না।

মায়াবৌদি চলে যাবার পর মামাও অফিস রওনা হলেন। মামী তখনও রান্নাঘরে ব্যস্ত। মামী এই একবেলাতেই দুবেলার রান্না করেন বরাবর। প্রজ্জ্বল বাইরের ঘরে জানালার ধারে বসে দূরের কুতুবমিনার দেখতে পেয়েই ওর মনে পড়ল আগেকার কত কথা, কত স্মৃতি।

.

সেবার কুতুবমিনারের পিছন দিকের পাহাড়ের উপরে পিকনিক হচ্ছিল। সুনীলবাবু আর গোরাবাবু মাংস রাঁধতে ব্যস্ত। আর সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বিশ্বাসদা বললেন, জয়া, দুএকটা গান শোনাও তো। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ জয়া, গান শোনাও। এতদিন পর প্রজ্জ্বলের ঠিক মনে নেই, তবে বোধহয় তিনচারটে গান গেয়েছিল। তার মধ্যে একটা রবীন্দ্রনাথের গান, বাকিগুলো বাংলা সিনেমার গান। সবাই বাহবা দিলেও প্রজ্জ্বলের ভালো লাগেনি। রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটা পুরো প্যারাগ্রাফ বাদ দিয়েছিল বলে মনে মনে বড় বিরক্ত হয়েছিল। অবাকও হয়েছিল। জয়ার পর একটি ছেলে গান শোনাল। ভাটিয়ালী বোধহয়। তবে স্পষ্ট মনে আছে মণিমালার কথা।

মাংস রাঁধতে রাঁধতে হঠাৎ গোরাবাবু এসে বললেন, এই মণিমালা, এবার তুই গান শোনা।

প্রজ্জ্বল, এক কোণায় বসেছিল। এতক্ষণ মণিমালাকে দেখতে পায়নি। এবার দেখল ঐ কোণায় একটা মিষ্টি মেয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলল, কাকু, আমাকে গাইতে বলবেন না।

গোরাবাবু তবুও বললেন, কেন রে? অন্তত একটা গান তো শোনাবি।

মামীও বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ একটা গান শোনা। কতদিন তোর গান শুনি না।

মণিমালা গাইল। প্রজ্জ্বলের স্পষ্ট মনে আছে ও ফানীর আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে গেয়েছিল। ঐ একটাই গান গেয়েছিল কিন্তু তাতেই প্রজ্জ্বলের মন ভরেছিল।

একটু পরে একটু ফাঁকায় মামীকে বলেছিল, মামী, তোমাদের ঐ জয়াকে অন্তত রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে বারণ করে দিও।

কেন রে?

পুরো একটা প্যারাগ্রাফ বাদ দিয়ে গেল।

তাই নাকি?

তবে কি!

মণিমালা ঠিক গেয়েছে?

হ্যা মামী। মেয়েটি ভারি সুন্দর গেয়েছে।

খাওয়াদাওয়ার পর মামী আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ওদের। এদিকে শোন মালা। মালা কাছে এলে বললেন, আমাদের ভাগ্নের সঙ্গে আলাপ নেই তো তোর?

মণিমালা শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।

আমাদের ভাগ্নে প্রজ্বল। জামিয়া মিলিয়াতে ইসলামিক হিস্ট্রি নিয়ে এম. এ. পড়ছে। তারপর রিসার্চ করবে। তোর গান ওর খুব ভালো লেগেছে।

মণিমালা লম্বা বিনুনির শেষে রবার ব্যান্ডটার মধ্যে একটা আঙুল দিয়ে নাড়তে নাড়তে মাথা নীচু করে বলল, বোধহয় সুচিত্রা কণিকার চাইতেও ভালো গেয়েছি, তাই না বড়মাসী?

প্রজ্জ্বল বলেছিল, তা তো কেউ বলেনি। তবে সত্যি আপনি ভালো গেয়েছেন।

মণিমালা এক মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ধন্যবাদ।

বেশ লেগেছিল প্রজ্জ্বলের। সহজ সরল ব্যবহার। অথচ তার চারপাশে একটা সলজ্জ আবরণ। মনে হল দুচোখ দিয়ে যা দেখল, তার চাইতে বোধহয় ওকে বেশি অনুভব করতে হয়। এ যেন ভোরের সূর্যের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। আনন্দ হলেও মন ভরে না। শতবার শতরূপে দেখেও আশা মেটে না। মিটতে পারে না। একেই বলে মাধুর্য? নারীর মাধুর্য? প্রজ্জ্বল মনে মনে কথা বলে।

মামামামীর সংসারে থেকে একদল সাধারণ মানুষের মধ্যেও কেমন যেন একটু অসাধারণত্বের স্বাদ পায় প্রজ্জ্বল। মাসের শেষে সবারই টানাটানি। তবু বড়ি দিয়ে পালঙের তরকারি পাঠিয়ে দেন মণিমালার মা! কলকাতা থেকে এক শিশি কাসুন্দি এলেও ভাগাভাগি হয় সবার মধ্যে। মাস ছয়েক পরে ছুটিতে কলকাতা যাবার আগে মামী প্রজ্জ্বলকে জিজ্ঞাসা করলেন, হারে মানা, কলকাতা থেকে ফিরে এসে এখানে আসছিস তো?

প্রজ্জ্বল পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, কেন? তুমি কি আমাকে না তাড়িয়ে শান্তি পাচ্ছ না?

মামী হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ঠিক বলেছিস। তোকে আর সহ্য করতে পারছি না।

পরের বার তুঘলকবাদে পিকনিক করতে গিয়ে প্রজ্জ্বল আর চুপ করে কোণায় বসে থাকেনি। সুনীলবাবুর হুকুম মতো মাংসে নুন দিয়েছে, গোরাবাবুর ফরমায়েশ মতো জল টেনে এনেছে। তারপর গানের আসরে সবার সামনে জয়াকে বলেছে, গতবারের মতো পুরো প্যারাগ্রাফ বাদ দিয়ে গাইলে এবার আর সহ্য করছি না।

জয়া চুপ করে থাকেনি। তুমি কি রবিঠাকুরের নাতজামাই যে তোমার কথামতো আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে?

মণিমালা বলেছিল, মানাদাকে অমন করে চিমটি কাটিস না জয়া। জামিয়া মিলিয়াতে ইসলামিক হিস্ট্রি নিয়ে এম. এ. পড়তে হলে রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনার্স থাকতে হয়, তা বুঝি জানিস না?

প্রজ্জ্বল বলেছিল, জয়া যে রবীন্দ্রনাথের গান গায় সে রবীন্দ্রনাথ কি গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার আন্ডারসেক্রেটারী?

জানালার ধারে বসে বসে ঐ দূরের কুতুবমিনার দেখতে দেখতে সে সব দিনের কথা মনে পড়ে প্রজ্জ্বলের। শুধু আজ নয়, কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে মাঝেও মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। মাঝে মাঝে মনে হয় হঠাৎ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আইএএস পরীক্ষা না দিলেই ভালো করত। দারোগার স্যালুট না পেলেও বিশ্বাসবৌদির ঘুগনি, সুনীলবৌদির সিঙাড়া, গোরাদার মার পিঠেপায়েস, মণিমালার মার বড়ির তরকারি তো পেত। তাছাড়া দুপুর বারোটার শোতে কমলএ সিনেমা দেখে বেরুবার মুখে মণিমালার সঙ্গে তো দেখা হতে পারত!

.

সত্যি ভারি মজা হয়েছিল। ডঃ মাসুদের ক্লাস না হওয়ায় প্রজ্জ্বল বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ কি মনে হল! ঢুকে পড়ল কমলএ। শো শেষ হলে বাইরে বেরুতেই মণিমালার সঙ্গে দেখা। দুজনেই চমকে উঠেছিল। তবুও প্রজ্জ্বল নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আজ বুঝি অনার্স ক্লাস কমলএই হল?

আজ হঠাৎ এসে মনে হল ইসলামিক হিস্ট্রির ক্লাস করব। তাই এসেছিলাম।

বয়ফ্রেন্ড কোথায় পালাল?

তোমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গেল।

প্রজ্জ্বল হঠাৎ বলে ফেলল, আমার গার্লফ্রেন্ড তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আঃ! কেউ শুনে ফেলবে।

.

অনেকদিন এসব কথা মনে পড়েনি। মনে পড়ার সুযোগ ছিল না। নতুন জীবনের সম্মানপ্রতিপত্তির জোয়ারে পুরনো দিনের সব স্মৃতি ভেসে গিয়েছিল। অনেকদিন পর দিল্লি এসে আবার যেন টুকরো টুকরো স্মৃতির দ্বীপপুঞ্জগুলো চোখে পড়েছে। ভালো লাগছে।

কিরে মানা, তুই কি মায়াকে কথা দিলি? হঠাৎ মামীর কথা শুনে প্রজ্জ্বল ঘুরে বসল।

পিকনিকে গেলে খুব মজা হবে, তাই না মামী?

তা তো হবেই, কিন্তু তুই কি শনিবারে যেতে পারবি?

সেটাই তো সন্দেহ। আজ খোঁজ করব। তবে রবিবার হলে নিশ্চয়ই যেতাম।

রবিবার হলে যেতে পারবি?

প্রোগ্রামটা একটু ওলটপালট হয়ে গেলেও তা পারব!

তাহলে শনিবারের বদলে রবিবার করতে বলব?

কিন্তু তাতে তো সবারই মুশকিল হবে।

আচ্ছা আমি ওদের বলেই দেখি না কি হয়।

মিটিং শেষ হবার পর দুতিনজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফিরতে ফিরতে প্রজ্জ্বলের বেশ রাত হয়ে গেল। সামনের ঘরে ঢুকতেই দেখল পাড়ার অনেকেই বসে। গোরাবাবু, সুনীলবাবু, বিশ্বাসবাবু। আরো দুতিনজন। মামামামীও। প্রজ্জ্বলকে দেখেই মামী বললেন, জানিস মানা, রবিবারেই পিকনিক হবে।

আমার জন্য অনেক ঝামেলা হল তো এদের সবার

গোরাবাবু বললেন, কি যে বল ভাগ্নে? তুমি গেলে সবাই কত খুশি হবে, তা জান?

প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে মামীর পাশে বসল। মামী কত চাঁদা দিতে হবে?

তোর আবার চাঁদা কিসের?

তার মানে?

তোর চাঁদা আমি দিয়ে দিয়েছি।

তা হবে না মামী। বরং তোমাদের চাঁদাও আমি দেব!

মামা বললেন, তুই কি পাগল হয়েছিস মানা?

প্রজ্জ্বল হাসতে হাসতে বলল, তুমি সাধাসিধে মানুষ বলে মামীর চালাকি ধরতে পারছ না। মামী ভাবছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নিলে ভালো শাড়িটা আর বাগাতে পারবে না!

মামী সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্জ্বলের পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, তুই কি ভেবেছিস আমি তোর মতো ঘুষখোর আইএএস?

কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছ। বল কত চাঁদা দিতে হবে?

মধ্যস্থতা করলেন গোরাবাবু। না বৌদি, এবার আর তোমরা চাঁদা দেবে না। ভাগ্নেই তোমাদের চাঁদা দেবে। নট ওনলি দ্যাট, তুমি নতুন শাড়ি পরে পিকনিকে যাবে।

প্রজ্জ্বল আবার হাসে। জাজমেন্টে ফাঁক থেকে গেল গোরাদা।

কেন? কি ফাঁক থাকল?

আমি শাড়ি কিনে দেব ঠিকই, কিন্তু সায়াব্লাউজ মামী মামার গ্যাঁড়ামারা টাকা দিয়ে বানাবে।

মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।

 

রবিবার।

বাইরের ঘরের বেডকামসোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে প্রজ্জ্বল তখনও বোধহয় স্বপ্ন দেখছিল। মামী চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে ডাক দিলেন, এই মানা ওঠ! ছটা বাজে।

প্রজ্জ্বল অঘোরে ঘুমুচ্ছে। উঠল না। মামী এবার ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন, মানা উঠবি না? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!

আস্তে আস্তে চোখ মেলল প্রজ্জ্বল। ঘুরে দেখল মামী। কি ব্যাপার? ডাকছ নাকি?

ওঠ। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

হ্যা, হ্যাঁ, উঠছি; মামা উঠেছেন?

হ্যা! ও বাথরুমে।

এত ভোরে?

সাতটায় বাস ছাড়বে যে!

ও তাই নাকি? এখন কটা বাজে?

সওয়া ছটা হবে।

প্রজ্জ্বল চায়ের কাপ তুলে নিতেই মামী বললেন, তোর মামা বেরুলেই বাথরুমে যাবি। দেরি করিস না।

না।

.

সাতটায় না, বাস ছাড়তে ছাড়তে প্রায় আটটা হল। প্রত্যেকবারই এমন হয়! এর চাইতে আগে হওয়া সম্ভব নয়। বাস ছাড়ার সময় সুনীলবাবু বললেন, রওনা হতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। মাংসটা খারাপ না হয়ে যায়।

গোরাবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? অত রাত্রে কাটা মাংস সারা রাত বরফ দিয়ে রাখার পর কখনও খারাপ হতে পারে?

প্রায় দুবছর পর এতগুলো পরিচিত মানুষের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রজ্জ্বল খুব খুশি।

মাসিমা চিনতে পারছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনব না কেন?

বলুন তো আমি কে?

কে আবার। তুমি তো মানা।

মানিকদা কেমন আছেন?

ভালো। আপনার খবর ভালো তো?

এমনি ভালোই, তবে তখনকার মত হৈহুঁল্লোড় করার সুযোগ তো আর পাই না।

মানিকদা হেসে বললেন, এখন আপনি এত বড় হয়ে গিয়েছেন যে সেসব ফ্রীডম এনজয় করা অসম্ভব।

প্রজ্জ্বলও হাসে। কিন্তু বয়স তো ছাব্বিশ। মন যে মানে না।

কিছুতেই নিজের জায়গায় বসে থাকতে পারছে না প্রজ্জ্বল। প্রত্যেকটা সীটের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আরে জয়া! কেমন আছ?

ভালো। তাহলে চিনতে পেরেছেন?

চিনতে পারব না?

অনেকে পারে না।

আমি তো অনেক না, আমি সামান্য একজন।

জয়া হাসে। কথা বলে না।

হাসছ যে?

দেখছি এত বড় অফিসার হয়েও কথাবার্তার ধরন বদলায়নি।

বদলালে বুঝি খুশি হতে?…আরে মায়াবৌদি! তোমাকেই খুঁজছিলাম!

কেন?

তুমি পিকনিকে যাচ্ছ অথচ চাঁদাটা তো এখনও দিলে না!

এমন ঘুষ খাবার হ্যাবিট হয়েছে যে পিকনিকের চাঁদা পর্যন্ত পকেটে পুরতে শুরু করেছ?

.

রিং রোড দিয়ে বাস ছুটে যমুনা ব্রিজ পার হল। মামী বিশ্বাসদার ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বলছেন, ঐ দ্যাখ উট।

প্রজ্জ্বলকে দেখে মামী বললেন, কিরে, তুই ঘুরে ঘুরেই বেড়াবি? বসবি না?

রোজই তো বসে বসে কাটাই।

প্রজ্জ্বল আর একটু এগিয়ে যায়। কি মণিমালা এখানে লুকিয়ে রয়েছ?

বড় বড় চোখ দুটো তুলে এক মুহূর্তের জন্য প্রজ্জ্বলকে দেখেই মণিমালা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। একটু হাসল। একটু যেন শুকনো হাসি। লুকিয়ে রয়েছি কোথায়?

এতদিন পর দিল্লি এলাম অথচ একবারও খোঁজখবর নিলে না?

আমি জানতাম না আপনি এসেছেন।

যাই হোক, আজ কিন্তু অনেক গান শুনব।

আমি আর আজকাল গান গাই না।

কেন?

ভালো লাগে না।

না লাগলেও শোনাতে হবে। দাসনায় পৌঁছেই ফাল্গুনীর সেই গানটা শোনাবে।

কোন গানটা?

সেই যে, আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।

মণিমালা বিস্মিত হয়। এখনও মনে আছে ঐ গানটার কথা?

কখন যে হিন্দন নদী পার হয়ে হাপুরের রাস্তায় বাস প্রায় দাসনার কাছাকাছি এসে গেছে, তা অনেকেই টের পাইনি। হঠাৎ সুনীলবাবু চীৎকার করে উঠলেন, ব্যস! ব্যস! ব্রীজকে বাদ ডাইনা টার্ন লেনা।

ছোট্ট একটা ব্রিজ পার হয়ে বাস ডান দিকে ঘুরল। ছোট খালের পাড় দিয়ে মাইলখানেক যাবার পর একটা গেটের সামনে বাস থামল। দুতিনজন বাস থেকে নেমে চৌকিদারকে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের অর্ডার দেখাতেই সে গেট খুলে দিল।

.

ইন্সপেকশন বাংলোটা পুরনো হলেও পরিবেশটা ভারি সুন্দর। সামনেপেছনে বিরাট লন। সামনের দিকের লনের পাশ দিয়েই ইরিগেশন ক্যানাল ধনুকের মতো বেঁকে ঘুরে গেছে। ক্যানালের জল এক জায়গায় উঁচু থেকে নীচুতে পড়ছে। অনেকটা জলপ্রপাতের মতো। পেছন দিকে লনের শেষ সীমায় দুটি কিচেন। তারপর আমবাগান।

বাস থেকে সমস্ত মালপত্র নামাবার পরই গোরাবাবু আব সুনীলবাবু একটা কিচেন। দখল করে নিলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইটের উনুন তৈরি হল। তারপর কাঠে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালানো হল। এক উনুনে মুগের ডাল ভাজা শুরু হল আর অন্যটায় গরম জল চাপানো হল।

পাশের কিচেনে শুরু হল চাজলখাবারের ব্যবস্থা। কিচেনের খানিকটা দূরে বিরাট লনের মাঝখানে বিরাট বিরাট সতরঞ্চি বিছিয়ে আড্ডা জমেছে মেয়ে পুরুষের। ঘোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমবাগানে লুকোচুরি খেলছে। প্রজ্জ্বল গোরাবাবুর পরিচালনায় ও সুনীলবাবুর প্রযোজনায় মাংস মেখে দিয়ে বাইরে গিয়ে দেখল সান্টুবাবুর ক্যারিকেচার দেখতে সবাই মত্ত। প্রজ্জ্বল দাঁড়াল না। মামা মামীর আড়ালে একটা সিগারেট খাবার জন্য ইন্সপেকশন বাংলোয় চলে গেল। সামনের বারান্দায় বিরাট ইজিচেয়ারে এক ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছিলেন। ও বারান্দা পার হয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখল মণিমালা একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে রয়েছে।

কি ব্যাপার? তুমি এখানে একলা একলা কি করছ?

কিছু না। এমনি একটু শুয়ে আছি!

কেন? শরীর খারাপ নাকি?

মণিমালা মাথা নেড়ে বলল, ওখানে বড় বেশি হৈহুল্লোড় হচ্ছে বলে চলে এলাম।

প্রজ্জ্বল একটু অবাক হল। মণিমালা আগে তো এমনি ছিল না। আচ্ছা তুমি বিশ্রাম কর। আমি যাই।

চলে যাবেন কেন? চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসুন না!

আচ্ছা তুমি আমাকে আপনি আপনি বলে কথা বলছ কেন বল তো?

কোনো কারণ নেই। এমনিই বলছি।

আর আপনি আপনি করবে না, বুঝলে?

মণিমালা একটু হাসল।

প্রজ্জ্বল খানিকটা দূরে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাল। একটা টান দিয়ে মণিমালার দিকে চাইল। তুমি আমাকে ঐ গানটা শোনাবে না?

সত্যি আজকাল গান গাই না।

কেন?

মণিমালা যেন একটু ভাবে। একটুকরো মুহূর্তের জন্য। এমনি। ভালো লাগে না।

কিন্তু ঐ গানটা যে না শুনলে শান্তি পাচ্ছি না।

কেন? কি ব্যাপার বলুন তো?

আবার বলুন তো?

মণিমালা হাসে। বোধহয় একটু জোর করে হাসল। আচ্ছা শুনি কি ব্যাপার।

কি আর ব্যাপার? তোমার ঐ গানটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল।

এতদিন পর্যন্ত মনে আছে?

আরো কি কি মনে আছে শুনবে?

মণিমালা আবার হাসে। বোধহয় অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোই লাগে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে প্রজ্জ্বল বলল, কমলএ সিনেমা দেখার কথা মনে আছে? তাছাড়া দোলের দিন কি কাণ্ডটাই হয়েছিল?

বিশেষ কিছুই না। পুরনো দিনের ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা মিষ্টি স্মৃতির টুকরো। তবু ভাবতে গিয়ে ভালো লাগল মণিমালার। বোধহয় একটু লজ্জাও পেল। মুখ নীচু করে প্রায় আপন মনে বলল, এখনও সেসব মনে আছে দেখছি।

তোমার গানের প্রশংসা করতাম বলে জয়া কি ভীষণ হিংসা করত তোমাকে।

তাও মনে আছে?

সিগারেট শেষ হতেই প্রজ্জল বলল, গান শোনাবে কখন?

আজ না।

তবে কবে?

পরে।

পরে আবার কবে শোনাবে?

ঠিক শোনাব।

কথা দিচ্ছ?

সত্যি শোনাব।

প্রজ্জ্বল এগিয়ে গিয়েও একটু পিছিয়ে এল, তোমার এম. এসসির রেজাল্ট তো বললে না?

মণিমালা চট করে উত্তর দিতে পারল না। একটু পরে বলল, মাঝে পড়াশুনা বন্ধ ছিল। এবছর আবার ভর্তি হয়েছি।

বন্ধ ছিল কেন?

মণিমালা হাসল। নানা ঝামেলায়।

এই বয়সে আবার ঝামেলা কিসের?

সবার জীবন কি প্রজ্জ্বলের মতো উজ্জ্বল হয়? নাকি হতে পারে?

তাই নাকি?

প্রজ্জ্বল ইন্সপেকশন বাংলো থেকে বেরিয়ে গেল। সে জানল না মণিমালা তার চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে রইল।

.

ওদিকে তখন দারুণ উত্তেজনা। ডাল নেমে গেছে। মাংস চড়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা শালপাতা গেলাস ধুচ্ছে। পাশের কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখল জনতা স্টোভে মায়াবৌদি ছোট্ট কড়ায় কি যেন বাঁধছেন। প্রজ্জ্বল জিজ্ঞাসা করল, আপনি আবার কি করছেন?

নিরামিষ রান্না করছি ভাই।

ও!

কেন, কিছু বলবে?

ভাবছিলাম এক কাপ চা পেলে খুব ভালো হত।

তরকারিটা নামিয়ে করছি।

মাঠের মাঝখানে মুক্তাঙ্গনে তখনও চাঞ্চল্য। জয়ার গান হয়ে গেছে। সান্টুবাবু এবার মূকাভিনয় দেখাচ্ছেন। আণ্ডাবাচ্চা থেকে গোরাবাবুর ঐ বুড়ি বিধবা মা পর্যন্ত হাসছেন। বিশ্বাসের ছেলে দুটো দৌড়ে ক্যানালের দিকে যাচ্ছে দেখে মামী তাদের পিছনে ছুটেছেন। এরই মাঝখানে কিচেন থেকে গোরাবাবু আর সুনীলবাবুর গলা শোনা যাচ্ছে। আঃ। আর লঙ্কা দিসনা।

পনেরো কিলো মাংসে ঐ লঙ্কায় কি হবে রে? আবোরা লাগবে।

তুই পাগলামি করিস না তো। শেষে বাচ্চাগুলো মুখে তুলতে পারবে না

এর মধ্যে সান্টুবাবু মূকাভিনয় বন্ধ করে পাশের এক ক্ষেতে গিয়ে আখ খেয়ে এলেন আর আসার সময় একটা ছাগল ধরে এনেছেন। গোরাবাবু, এটাকে বেখে দিন। যদি বাইচান্স মাংস কম পড়ে তাহলে এটাকে একটু ঝোলে ডুবিয়ে সার্ভ করতে পারবেন।

সব চাইতে মজা হল খাওয়ার সময়। যে যেখানে পারল শালপাতা নিয়ে বসে পড়ল। যারা পরিবেশন করল তাদের কষ্ট হল ঠিকই কিন্তু আনন্দ হল অপরিসীম। সবার খাওয়াদাওয়ার পর হাঁড়িকড়া নিয়ে খেতে বসলেন গোরাবাবু আর মামী। প্রজ্জ্বল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘোষবৌদি একটা পান খাওয়ালেন। ঘুরতে ঘুরতে গোরাবাবুর মার কাছে হাজির হয়ে প্রজ্জ্বল জিজ্ঞাসা করল, মাসিমা আপনার খাওয়া হয়েছে?

আজ তো অমাবস্যা।

তাতে কি হল?

আজ তো ভাতটাত কিছু খাই না বাবা।

তবে।

আমি, একটু ছানা আর ফল এনেছিলাম। তাতেই আমার হয়ে গেছে।

প্রজ্জ্বল যেন শেষের কথাগুলো শুনতে পেল না। নিরামিষ রান্না কার জন্য? কাউকে কিছু বলল না কিন্তু মনের মধ্যে প্রশ্নটা বার বার উঁকি দিতে লাগল। মামামামীর আড়ালে সিগারেট খাবার জন্য ক্যানালের দিকে এগিয়ে যেতেই মায়া বৌদির সঙ্গে দেখা। প্রশ্নটা আর চেপে রাখতে পারল না।

আচ্ছা বৌদি, তুমি কার জন্য নিরামিষ রান্না করছিলে?

মণিমালার জন্য।

প্রজ্জ্বল চমকে উঠল, মণিমালার জন্য?

হা! তুমি জান না কিছু?

না তো।

ওর বিয়ে তো তুমি দেখে গিয়েছ?

না না, আমি তো জানি না ওর বিয়ে হয়েছে!

তাই বুঝি? মায়াববৗদি একটু থেমে বললেন, আরে বোলো না ভাই। ছমাসের মধ্যে মেয়েটার সর্বনাশ হল।

বল কি?

হ্যা ভাই। তুমি কিছুই জানতে না?

না।

মায়াবৌদি চলে গেল। প্রজ্জ্বল সিগারেটটা হাতে নিয়ে পাথরের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতেই সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ইন্সপেকশন বাংলোয় ঢুকল। বারান্দা পার হয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েই মণিমালার সঙ্গে দেখা। একেবারে মুখোমুখি। প্রজ্জ্বল থমকে দাঁড়াল কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। মণিমালাই আগে কথা বলল, কি হল? অমন করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

মুখ নীচু করে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে প্রজ্জ্বল তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কি হল? কথা বলছেন না যে?

আমি কিছুই জানতাম না মণিমালা।

মণিমালা হাসল, জেনে আর কি হবে?

আবার একটু নীরবতা।

একটু হাতটা দেবে?

কেন?

দাও না।

আঁচলটা টেনে নিয়ে মণিমালা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিতেই দুহাতের মধ্যে ওর হাতটা ধরে বলল, আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।

তাড়াতাড়ি হাতটা টেনে নিয়ে মণিমালা বলল, কি পাগলামি করছেন?

সময় নেই মণিমালা। কথা দাও।

কি কথা দেব?

তুমি আমার আকাশ আলোয় আর গানে ভরিয়ে দেবে।

তাই কি হয়?

হয়।

তা হয় না।

হয়। নিশ্চয়ই হয়। হতেই হবে। তুমি কথা দিলেই হবে।

কিন্তু

প্রজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা তুলে বলল, বোধহয় তোমাকে পাব বলেই এই পিকনিকে এসেছিলাম, তাই না?

মণিমালা দাঁড়িয়ে রইল। প্রজ্জ্বল ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

.

মামী
জয়পুর ফিরে এসেও বার বার মণিমালার কথা মনে পড়ছে।
মন্দির আছে, বিগ্রহ আছে, অথচ শুধু পূজারীর অভাবে ওর
জীবন এমন ভাবে নষ্ট হতে পারে না। আমি আছি।
আমি রইলাম।
তোমাদের স্নেহের মানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *