প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৪

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

নির্মলা বাতায়নতলে আসীন। চন্দ্রের প্রবেশ

চন্দ্র। (স্বগত) বেচারা নির্মল বড়ো কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছে। আমি দেখছি কদিন ধরে ও চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে রয়েছে। স্ত্রীলোক, মনের উপর এতটা ভার কি সহ্য করতে পারবে? (প্রকাশ্যে) নির্মল!

নির্মলা। (চমকিয়া) কী মামা!

চন্দ্র। সেই লেখাটা নিয়ে বুঝি ভাবছ? আমার বোধ হয় অধিক না ভেবে মনকে দুই-একদিন বিশ্রাম দিলে লেখার পক্ষে সুবিধা হতে পারে।

নির্মলা। (লজ্জিত হইয়া) আমি ঠিক ভাবছিলুম না মামা! আমার এতক্ষণ সেই লেখায় হাত দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এই কদিন থেকে গরম পড়ে দক্ষিনে হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে, কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছি নে– ভারি অন্যায় হচ্ছে, আজ আমি যেমন করে হোক–

চন্দ্র। না না, জোর করে চেষ্টা কোরো না। আমার বোধ হয় নির্মল, বাড়িতে কেউ সঙ্গিনী নেই, নিতান্ত একলা কাজ করতে তোমার শ্রান্তি বোধ হয়। কাজে দুই-একজনের সঙ্গ এবং সহায়তা না হলে–

নির্মলা। অবলাকান্তবাবু আমাকে কতকটা সাহায্য করবেন বলেছেন; আমি তাঁকে রোগীশুশ্রূষা সম্বন্ধে সেই ইংরাজি বইটা দিয়েছি, তিনি একটা অধ্যায় আজ লিখে পাঠাবেন বলেছেন, বোধ হয় এখনই পাওয়া যাবে– তাই আমি অপেক্ষা করে বসে আছি।

চন্দ্র। ঐ ছেলেটি বড়ো ভালো–

নির্মলা। খুব ভালো– চমৎকার–

চন্দ্র। এমন অধ্যবসায়, এমন কার্যতৎপরতা–

নির্মলা। আর এমন সুন্দর নম্র স্বভাব–

চন্দ্র। ভালো প্রস্তাবমাত্রেই তাঁর উৎসাহ দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি।

নির্মলা। তা ছাড়া, তাঁকে দেখবামাত্র তাঁর মনের মাধুর্য মুখে এবং চেহারায় কেমন স্পষ্ট বোঝা যায়।

চন্দ্র। এত অল্পকালের মধ্যেই যে কারো প্রতি এত গভীর স্নেহ জন্মাতে পারে তা আমি কখনো মনে করি নি– আমার ইচ্ছা করে, ঐ ছেলেটিকে নিজের কাছে রেখে ওর সকলপ্রকার লেখাপড়ায় এবং কাজে সহায়তা করি!

নির্মলা। তা হলে আমারও ভারি উপকার হয়, অনেক কাজ করতে পারি! আচ্ছা, এরকম প্রস্তাব করে একবার দেখোই-না! ঐ-যে বেহারা আসছে! বোধ হয় তিনি লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন।– রামদীন, চিঠি আছে? এই দিকে নিয়ে আয়।

বেহারার প্রবেশ ও চন্দ্রবাবুর হাতে চিঠি-প্রদান

মামা, সেই প্রবন্ধটা নিশ্চয় তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, ওটা আমাকে দাও।

চন্দ্র। না ফেনি, এটা আমার চিঠি।

নির্মলা। তোমার চিঠি! অবলাকান্তবাবু বুঝি তোমাকেই লিখেছেন? কী লিখেছেন?

চন্দ্র। না, এটা পূর্ণর লেখা।

নির্মলা। পূর্ণবাবুর লেখা? ওঃ–

চন্দ্র। পূর্ণ লিখছেন–“গুরুদেব আপনার চরিত্র মহৎ, মনের বল অসামান্য, আপনার মতো বলিষ্ঠপ্রকৃতি লোকেই মানুষের দুর্বলতা ক্ষমার চক্ষে দেখিতে পারেন ইহাই মনে করিয়া অদ্য এই চিঠিখানি আপনাকে লিখিতে সাহসী হইতেছি।’

নির্মলা। হয়েছে কী? বোধ হয় পূর্ণবাবু চিরকুমার-সভা ছেড়ে দেবেন তাই এত ভূমিকা করছেন। লক্ষ্য করে দেখেছ বোধ হয়, পূর্ণবাবু আজকাল কুমারসভার কোনো কাজই করে উঠতে পারেন না।

চন্দ্র। “দেব, আপনি যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন তা অত্যুচ্চ, যে উদ্দেশ্য আমাদের মস্তকে স্থাপন করিয়াছেন তাহা গুরুভার– সে আদর্শ এবং সেই উদ্দেশ্যের প্রতি এক মুহূর্তের জন্য ভক্তির অভাব হয় নাই, কিন্তু মাঝে মাঝে শক্তির দৈন্য অনুভব করিয়া থাকি তাহা শ্রীচরণ-সমীপে সবিনয়ে স্বীকার করিতেছি।’

নির্মলা। আমার বোধ হয়, সকল বড়ো কাজেই মানুষ মাঝে মাঝে আপনার অক্ষমতা অনুভব করে হতাশ হয়ে পড়ে, শ্রান্ত মন এক-একবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়– কিন্তু সে কি বরাবর থাকে?

চন্দ্র। “সভা হইতে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া যখন কার্যে হাত দিতে যাই তখন সহসা নিজেকে একক মনে হয়, উৎসাহ যেন আশ্রয়হীন লতার মতো লুণ্ঠিত হইয়া পড়িতে চাহে।’ নির্মল, আমরা তো ঠিক এই কথাই বলছিলেম।

নির্মলা। পূর্ণবাবু যা লিখেছেন সেটা সত্য, মানুষের সঙ্গ না হলে কেবলমাত্র সংকল্প নিয়ে উৎসাহ জাগিয়ে রাখা শক্ত।

চন্দ্র। “আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন, কিন্তু অনেক চিন্তা করিয়া এ কথা স্থির বুঝিয়াছি, কুমারব্রত সাধারণ লোকের জন্য নহে– তাহাতে বল দান করে না, বল হরণ করে। স্ত্রী পুরুষ পরস্পরের দক্ষিণ হস্ত– তাহারা মিলিত থাকিলে তবেই সম্পূর্ণরূপে সংসারের সকল কাজের উপযোগী হইতে পারে।’ তোমার কী মনে হয় নির্মল? (নির্মলা নিরুত্তর) অক্ষয়বাবুও এই কথা নিয়ে সেদিন আমার সঙ্গে তর্ক করছিলেন, তাঁর অনেক কথার উত্তর দিতে পারি নি।

নির্মলা। তা হতে পারে। বোধ হয় কথাটার মধ্যে অনেকটা সত্য আছে।

চন্দ্র। “গৃহস্থসন্তানকে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত না করিয়া গৃহাশ্রমকে উন্নত আদর্শে গঠিত করাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।’

নির্মলা। এ কথাটা কিন্তু পূর্ণবাবু বেশ বলেছেন।

চন্দ্র। আমিও কিছুদিন থেকে মনে করছিলেম কুমারব্রত গ্রহণের নিয়ম উঠিয়ে দেব।

নির্মলা। আমারও বোধ হয় উঠিয়ে দিলে মন্দ হয় না, কী বল মামা? অন্য কেউ কি আপত্তি করবেন? অবলাকান্তবাবু, শ্রীশবাবু–

চন্দ্র। আপত্তির কোনো কারণ নেই।

নির্মলা। তবু একবার অবলাকান্তবাবুদের মত নিয়ে দেখা উচিত।

চন্দ্র। মত তো নিতেই হবে। (পত্রপাঠ) “এপর্যন্ত যাহা লিখিলাম সহজে লিখিয়াছি, এখন যাহা বলিতে চাহি তাহা লিখিতে কলম সরিতেছে না।’

নির্মলা। মামা, পূর্ণবাবু হয়তো কোনো গোপনীয় কথা লিখছেন, তুমি চেঁচিয়ে পড়ছ কেন?

চন্দ্র। ঠিক বলেছ ফেনি! (আপন-মনে পাঠ) কী আশ্চর্য! আমি কি সকল বিষয়েই অন্ধ! এতদিন তো আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। নির্মল, পূর্ণবাবুর কোনো ব্যবহার কি কখনো তোমার কাছে–

নির্মলা। হাঁ, পূর্ণবাবুর ব্যবহার আমার কাছে মাঝে মাঝে অত্যন্ত নির্বোধের মতো ঠেকেছিল।

চন্দ্র। অথচ পূর্ণবাবু খুব বুদ্ধিমান। তা হলে তোমাকে খুলে বলি– পূর্ণবাবু বিবাহের প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন–

নির্মলা। তুমি তো তাঁর অভিভাবক নও– তোমার কাছে প্রস্তাব–

চন্দ্র। আমি যে তোমার অভিভাবক — এই পড়ে দেখো।

নির্মলা। (পত্র পড়িয়া রক্তিমমুখে) এ হতেই পারে না।

চন্দ্র। আমি তাকে কী বলব?

নির্মলা। বোলো কোনোমতে হতেই পারে না।

চন্দ্র। কেন নির্মল, তুমি তো বলছিলে কুমারব্রত পালনের নিয়ম সভা হতে উঠিয়ে দিতে তোমার আপত্তি নেই।

নির্মলা। তাই বলেই কি যে প্রস্তাব করবে তাকেই–

চন্দ্র। পূর্ণবাবু তো যে-সে নয়, অমন ভালো ছেলে–

নির্মলা। মামা, তুমি এ-সব বিষয়ে কিছুই বোঝ না, তোমাকে বোঝাতে পারবও না– আমার কাজ আছে।

[প্রস্থানোদ্যম

মামা, তোমার পকেটে ওটা কী উঁচু হয়ে আছে?

চন্দ্র। (চমকিয়া উঠিয়া) হাঁ হাঁ, ভুলে গিয়েছিলেম– বেহারা আজ সকালে তোমার নামে লেখা একটা কাগজ আমাকে দিয়ে গেছে–

নির্মলা। (তাড়াতাড়ি কাগজ লইয়া) দেখো দেখি মামা, কী অন্যায়, অবলাকান্তবাবুর লেখাটা সকালেই এসেছে, আমাকে দাও নি? আমি ভাবছিলেম তিনি হয়তো ভুলেই গেছেন– ভারি অন্যায়!

চন্দ্র। অন্যায় হয়েছে বটে। কিন্তু এর চেয়ে ঢের বেশি অন্যায় ভুল আমি প্রতিদিনই করে থাকি ফেনি, তুমিই তো আমাকে প্রত্যেকবার সহাস্যে মাপ করে করে প্রশ্রয় দিয়েছ।

নির্মলা। না, ঠিক অন্যায় নয়– আমিই অবলাকান্তবাবুর প্রতি মনে মনে অন্যায় করছিলেম, ভাবছিলেম– এই-যে রসিকবাবু আসছেন। আসুন রসিকবাবু, মামা এইখানেই আছেন।

রসিকের প্রবেশ

চন্দ্র। এই-যে রসিকবাবু এসেছেন ভালোই হয়েছে।

রসিক। আমার আসাতেই যদি ভালো হয় চন্দ্রবাবু, তা হলে আপনাদের পক্ষে ভালো অত্যন্ত সুলভ। যখনই বলবেন তখনই আসব, না বললেও আসতে রাজি আছি।

চন্দ্র। আমরা মনে করছি আমাদের সভা থেকে চিরকুমার ব্রতের নিয়মটা উঠিয়ে দেব– আপনি কী পরামর্শ দেন?

রসিক। আমি খুব নিঃস্বার্থভাবেই পরামর্শ দিতে পারব, কারণ, এ ব্রত রাখুন বা উঠিয়ে দিন আমার পক্ষে দুই-ই সমান। আমার পরামর্শ এই যে, উঠিয়ে দিন– নইলে সে কোন্‌ দিন আপনিই উঠে যাবে। আমাদের পাড়ার রামহরি মাতাল রাস্তার মাঝখানে এসে সকলকে ডেকে বলেছিল, বাবা-সকল, আমি স্থির করেছি এইখানটাতেই আমি পড়ব। স্থির না করলেও সে পড়ত, অতএব স্থির করাটাই তার পক্ষে ভালো হয়েছিল।

চন্দ্র। ঠিক বলেছেন রসিকবাবু, যে জিনিস বলপূর্বক আসবেই তাকে বল প্রকাশ করতে না দিয়ে আসতে দেওয়াই ভালো। আসছে রবিবারের পূর্বেই এই প্রস্তাবটা সকলের কাছে একবার তুলতে চাই।

রসিক। আচ্ছা, শুক্রবারের সন্ধ্যাবেলায় আপনারা আমাদের ওখানে যাবেন, আমি সকলকে সংবাদ দিয়ে আনাব।

চন্দ্র। রসিকবাবু, আপনার যদি সময় থাকে তা হলে আমাদের দেশে গোজাতির উন্নতি-সম্বন্ধে একটা প্রস্তাব আপনাকে–

রসিক। বিষয়টা শুনে খুব ঔৎসুক্য জন্মাচ্ছে, কিন্তু সময় খুব যে বেশি–

নির্মলা। না রসিকবাবু, আপনি ও ঘরে চলুন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা কবার আছে। মামা, তোমার লেখাটা শেষ করো, আমরা থাকলে ব্যাঘাত হবে।

রসিক। তা হলে চলুন।

নির্মলা। (চলিতে চলিতে) অবলাকান্তবাবু আমাকে তাঁর সেই লেখাটি পাঠিয়ে দিয়েছেন– আমার অনুরোধ যে তিনি মনে করে রেখেছিলেন সেজন্যে আপনি তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

রসিক। ধন্যবাদ না পেলেও আপনার অনুরোধ রক্ষা করেই তিনি কৃতার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *