প্রজাপতির নির্বন্ধ ১২

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

পূর্বদিনে পূরবালা তাহার মাতার সহিত কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। অক্ষয় কহিলেন, “দেবী, যদি অভয় দাও তো একটি প্রশ্ন আছে।”

পুরবালা। কী শুনি।

অক্ষয়। শ্রীঅঙ্গে কৃশতায় তো কোনো লক্ষণ দেখছি নে।

পুরবালা। শ্রীঅঙ্গ তো কৃশ হবার জন্যে পশ্চিমে বেড়াতে যায় নি।

অক্ষয়। তবে কি বিরহবেদনা বলে জিনিসটা মহাকবি কালিদাসের সঙ্গে সহমরণে মরেছে?

পুরবালা। তার প্রমাণ তুমি। তোমারও তো স্বাস্থ্যের বিশেষ ব্যাঘাত হয় নি দেখছি।

অক্ষয়। হতে দিল কই? তোমার তিন ভগ্নী মিলে অহরহ আমার কৃশতা নিবারণ করে রেখেছিল– বিরহ যে কাকে বলে সেটা আর কোনোমতেই বুঝতে দিলে না।–

গান। পিলু

বিরহে মরিব বলে ছিল মনে পণ।
কে তোরা বাহুতে বাঁধি করিলি বারণ?
ভেবেছিনু অশ্রুজলে, ডুবিব অকূল তলে,
কাহার সোনার তরী করিল তারণ?

প্রিয়ে, কাশীধামে বুঝি পঞ্চশর ত্রিলোচনের ভয়ে এগোতে পারেন না?

পুরবালা। তা হতে পারে, কিন্তু কলকাতায় তো তাঁর যাতায়াত আছে।

অক্ষয়। তা আছে– কোম্পানির শাসন তিনি মানেন না, আমি তার প্রমাণ পেয়েছি।

নৃপবালা ও নীরবালার প্রবেশ

নীরবালা। দিদি!

অক্ষয়। এখন দিদি বৈ আর কথা নেই– অকৃতজ্ঞ! দিদি যখন বিচ্ছেদদহনে উত্তেরোত্তর তপ্তকাঞ্চনের মতো শ্রী ধারণ করছিলেন তখন তোমাদের কটিকে সুশীতল করে রেখেছিল কে?

নীরবালা। শুনছ দিদি! এমন মিথ্যে কথা! তুমি যতদিন ছিলে না আমাদের একবার ডেকেও জিজ্ঞাসা করেন নি– কেবল চিঠি লিখেছেন আর টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিয়ে বই হাতে করে পড়েছেন। তুমি এসেছ এখন আমাদের নিয়ে গান হবে, ঠাট্টা হবে, দেখাবেন যেন–

নৃপবালা। দিদি, তুমিও তো, ভাই, এতদিন আমাদের একখানিও চিঠি লেখ নি?

পুরবালা। আমার কি সময় ছিল ভাই? মাকে নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।

অক্ষয়। যদি বলতে “তোদের ভগ্নীপতির ধ্যানে নিমগ্ন ছিলুম’ তা হলে কি লোকে নিন্দে করত?

নীরবালা। তা হলে ভগ্নীপতির আস্পর্ধা আরো বেড়ে যেত। মুখুজ্যেমশায়, তুমি তোমার বাইরের ঘরে যাও-না। দিদি এতদিন পরে এসেছেন, আমরা কি ওঁকে নিয়ে একটু গল্প করতে পাব না?

অক্ষয়। নৃশংসে, বিরহদাবদগ্ধ তোর দিদিকে আবার বিরহে জ্বালাতে চাস? তোদের ভগ্নীপতিরূপ ঘনকৃষ্ণ মেঘ মিলনরূপ মুষলধারা বর্ষণ-দ্বারা প্রিয়ার চিত্তরূপ লতানিকুঞ্জে আনন্দরূপ কিসলয়োদ্‌গম করে প্রেমরূপ বর্ষায় কটাক্ষরূপ বিদ্যুৎ–

নীরবালা। এবং বকুনিরূপ ভেকের কলরব–

শৈলের প্রবেশ

অক্ষয়। এসো এসো– উত্তমাধমমধ্যমা এই তিন শ্যালী না হলে আমার–

নীরবালা। উত্তমমধ্যম হয় না।

শৈল। (নৃপ ও নীরর প্রতি) তোরা ভাই, একটু যা তো, আমাদের কথা আছে।

অক্ষয়। কথাটা কী বুঝতে পারছিস তো নীরু? হরিনামকথা নয়।

নীরবালা। আচ্ছা, তোমার আর বকতে হবে না।

[নৃপ ও নীরর প্রস্থান

শৈল। দিদি, নৃপ-নীরর জন্যে মা দুটি পাত্র তা হলে স্থির করেছেন?

পুরবালা। হাঁ, কথা একরকম ঠিক হয়ে গেছে। শুনেছি ছেলে দুটি মন্দ নয়– তারা মেয়ে দেখে পছন্দ করলেই পাকাপাকি হয়ে যাবে।

শৈল। যদি পছন্দ না করে?

পুরবালা। তা হলে তাদের অদৃষ্ট মন্দ।

অক্ষয়। এবং আমার শ্যালী দুটির অদৃষ্ট ভালো।

শৈল। নৃপ-নীরু যদি পছন্দ না করে?

অক্ষয়। তা হলে ওদের রুচির প্রশংসা করব।

পুরবালা। পছন্দ আবার না করবে কী? তোদের সব বাড়াবাড়ি। স্বয়ম্বরার দিন গেছে, মেয়েদের পছন্দ করবার দরকার হয় না– স্বামী হলেই তাকে ভালোবাসতে পারে।

অক্ষয়। নইলে তোমার বর্তমান ভগ্নীপতির কী দুর্দশাই হত শৈল।

জগত্তারিণীর প্রবেশ

জগত্তারিণী। বাবা অক্ষয়, ছেলে দুটিকে তা হলে তো খবর দিতে হয়। তারা তো আমাদের বাড়ির ঠিকানা জানে না।

অক্ষয়। বেশ তো মা, রসিকদাদাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাক।

জগত্তারিণী। পোড়া কপাল! তোমার রসিকদাদার যেরকম বুদ্ধি! তিনি কাকে আনতে কাকে আনবেন ঠিক নেই।

পুরবালা। তা মা, তুমি কিছু ভেবো না। ছেলে দুটিকে আনবার ব্যবস্থা করে দেব।

জগত্তারিণী। মা পুরি, তুই একটু মনোযোগ না করলে হবে না। আজকালকার ছেলে, তাদের সঙ্গে কিরকম ব্যাভার করতে হয় না-হয় আমি কিছুই বুঝি নে।

অক্ষয়। (জনান্তিকে) পুরির হাতযশ আছে। পুরি তাঁর মার জন্যে যে জামাইটি জুটিয়েছেন, পসার খুব বেড়ে গেছে! আজকালকার ছেলে কী করে বশ করতে হয় সে বিদ্যে–

পুরবালা। (জনান্তিকে) মশায় বুঝি আজকালকার ছেলে?

জগত্তারিণী। মা, তোমরা পরামর্শ করো, কায়েত-দিদি এসে বসে আছেন, আমি তাঁকে বিদায় করে আসি!

শৈল। মা, তুমি একটু বিবেচনা করে দেখো– ছেলে দুটিকে এখনো তোমরা কেউ দেখ নি, হঠাৎ–

জগত্তারিণী। বিবেচনা করতে করতে আমার জন্ম শেষ হয়ে এল– আর বিবেচনা করতে পারি নে–

অক্ষয়। বিবেচনা সময়মত এর পর করলেই হবে, এখন কাজটা আগে হয়ে যাক।

জগত্তারিণী। বলো তো বাবা, শৈলকে বুঝিয়ে বলো তো।

[প্রস্থান

পুরবালা। মিথ্যে তুই ভাবছিস শৈল, মা যখন মনস্থির করেছেন ওঁকে আর কেউ টলাতে পারবে না। প্রজাপতির নির্বন্ধ আমি মানি ভাই– যার সঙ্গে যার হবার হাজার বিবেচনা করে ম’লে সে হবেই।

অক্ষয়। সে তো ঠিক কথা। নইলে যার সঙ্গে যার হয়ে থাকে তার সঙ্গে না হয়ে আর-একজনের সঙ্গে হত।

পুরবালা। কী যে তর্ক কর, তোমার অর্ধেক কথা বোঝাই যায় না।

অক্ষয়। তার কারণ আমি নির্বোধ।

পুরবালা। যাও, এখন স্নান করতে যাও, মাথা ঠাণ্ডা করে এসোগে।

[প্রস্থান

রসিকের প্রবেশ

শৈল। রসিকদাদা, শুনেছ তো সব? মুশকিলে পড়া গেছে।

রসিক। মুশকিল কিসের? কুমারসভারও কৌমার্য রয়ে গেল, নৃপ-নীরুও পার পেলে, সব দিক রক্ষা হল।

শৈল। কোনো দিক রক্ষা হয় নি।

রসিক। অন্তত এই বুড়োর দিকটা রক্ষা হয়েছে– দুটো অর্বাচীনের সঙ্গে মিশে আমাকে রাত্রে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শ্লোক আওড়াতে হবে না।

শৈল। মুখুজ্যেমশায়, তুমি না হলে রসিকদাদাকে কেউ শাসন করতে পারে না– উনি আমাদের কথা মানেন না।

অক্ষয়। যে বয়সে তোমাদের কথা বেদবাক্য বলে মানতেন সে বয়স পেরিয়েছে কিনা, তাই লোকটা বিদ্রোহ করতে সাহস করছে। আচ্ছা, আমি ঠিক করে দিচ্ছি। চলো তো রসিকদা, আমার বাইরের ঘরটাতে বসে তামাক নিয়ে পড়া যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *