কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে। সেদিন সে উজ্জয়িনীপ্রাসাদশিখরে কী না জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উৎসব, উদ্দামপবনবেগ, গুরুগুরু রব। গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘসংঘর্ষের জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের অন্তর্গূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদ ক্রন্দন এক দিনে। ছিন্ন করি কালের বন্ধন সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোকরাশি। সেদিন কি জগতের যতেক প্রবাসী জোড়হস্তে মেঘপানে শূন্যে তুলি মাথা গেয়েছিল সমস্বরে বিরহের গাথা ফিরি প্রিয়গৃহপানে? বন্ধনবিহীন নবমেঘপক্ষ-’পরে করিয়া আসীন পাঠাতে চাহিয়াছিল প্রেমের বারতা অশ্রুবাষ্প-ভরা— দূর বাতায়নে যথা বিরহিণী ছিল শুয়ে ভূতলশয়নে মূক্তকেশে, ম্লান বেশে, সজল নয়নে? তাদের সবার গান তোমার সংগীতে পাঠায়ে কি দিলে, কবি, দিবসে নিশীথে দেশে দেশান্তরে, খুঁজি’ বিরহিণী প্রিয়া? শ্রাবণে জাহ্নবী যথা যায় প্রবাহিয়া টানি লয়ে দিশ-দিশান্তের বারিধারা মহাসমুদ্রের মাঝে হতে দিশাহারা। পাষাণশৃঙ্খলে যথা বন্দী হিমাচল আষাঢ়ে অনন্ত শূন্যে হেরি মেঘদল স্বাধীন-গগনচারী, কাতরে নিশ্বাসি সহস্র কন্দর হতে বাষ্প রাশি রাশি পাঠায় গগন-পানে; ধায় তারা ছুটি উধাও কামনা-সম; শিখরেতে উঠি সকলে মিলিয়া শেষে হয় একাকার, সমস্ত গগনতল করে অধিকার। সেদিনের পরে গেছে কত শত বার প্রথম দিবস স্নিগ্ধ নববরষার। প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন তোমার কাব্যের’পরে করি বরিষন নববৃষ্টিবারিধারা, করিয়া বিস্তার নবঘনস্নিগ্ধচ্ছায়া, করিয়া সঞ্চার নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের, স্ফীত করি স্রোতোবেগ তোমার ছন্দের বর্ষাতরঙ্গিণীসম। কত কাল ধরে কত সঙ্গীহীন জন, প্রিয়াহীন ঘরে, বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী আষাঢ়সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন! সে সবার কন্ঠস্বর কর্ণে আসে মম সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি-সম তব কাব্য হতে। ভারতের পূর্বশেষে আমি বসে আজি; যে শ্যামল বঙ্গদেশে জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর। আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর্, দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার। বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া। অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া পড়িতেছি মেঘদূত; গৃহত্যাগী মন মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন, উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে। কোথা আছে সানুমান আম্রকূট; কোথা বহিয়াছে বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধ্যপদমূলে উপলব্যথিতগতি; বেত্রবতীকূলে পরিণতফলশ্যাম জম্বুবনচ্ছায়ে কোথায় দশার্ণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা; পথতরুশাখে কোথা গ্রামবিহঙ্গেরা বর্ষায় বাঁধিছে নীড়, কলরবে ঘিরে বনস্পতি; না জানি সে কোন্ নদীতীরে যূথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে, তপ্ত কপোলের তাপে ক্লান্ত কর্ণোৎপল মেঘের ছায়ার লাগি হতেছে বিকল; ভ্রূবিলাস শেখে নাই কারা সেই নারী জনপদবধূজন, গগনে নেহারি ঘনঘটা, ঊর্ধ্বনেত্রে চাহে মেঘপানে, ঘননীল ছায়া পড়ে সুনীল নয়ানে; কোন্ মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা স্নিগ্ধ নবঘন হেরি আছিল উন্মনা শিলাতলে, সহসা আসিতে মহা ঝড় চকিত চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড় সম্বরি বসন ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি, বলে, ‘মা গো, গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি!’ কোথায় অবন্তিপুরী; নির্বিন্ধ্যা তটিনী; কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী স্বমহিমচ্ছায়া— সেথা নিশিদ্বিপ্রহরে প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে সুপ্ত পারাবত, শুধু বিরহবিকারে রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে সূচিভেদ্য অন্ধকারে রাজপথ-মাঝে ক্বচিৎ-বিদ্যুতালোকে; কোথা সে বিরাজে ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র; কোথা কন্খল, যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল, গৌরীর ভ্রুকুটিভঙ্গী করি অবহেলা ফেনপরিহাসচ্ছলে করিতেছে খেলা লয়ে ধূর্জটির জটা চন্দ্রকরোজ্জ্বল। এইমতো মেঘরূপে ফিরি দেশে দেশে হৃদয় ভাসিয়া চলে উত্তরিতে শেষে কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে, বিরহিণী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে সৌন্দর্যের আদিসৃষ্টি। সেথা কে পারিত লয়ে যেতে, তুমি ছাড়া, করি অবায়িত লক্ষ্মীর বিলাসপুরী— অমর ভুবনে! অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে নিত্য চন্দ্রালোকে, ইন্দ্রনীলশৈলমূলে সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকূলে মণিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা। মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা শয্যাপ্রান্তে লীনতনু ক্ষীণ শশীরেখা পূর্বগগনের মূলে যেন অস্তপ্রায়। কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায় রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যথা; লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক, যেথা চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিণী প্রিয়া অনন্তসৌন্দর্যমাঝে একাকী জাগিয়া। আবার হারায়ে যায়— হেরি চারি ধার বৃষ্টি পড়ে অবিশ্রাম; ঘনায়ে আঁধার আসিছে নির্জননিশা; প্রান্তরের শেষে কেঁদে চলিয়াছে বায়ূ অকূল-উদ্দেশে। ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রনয়ান, কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান? কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ? কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ? সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে, মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে, রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।
পূর্ববর্তী:
« মায়া
« মায়া
পরবর্তী:
মেঘের খেলা »
মেঘের খেলা »
Leave a Reply