অন্তর বাহির

অন্তর বাহির

ফটোগ্রাফের সঙ্গে ফটোকর্তার যোগ পুরো নয়—পাহাড় দেখলেম ক্যামেরা খুল্লেম ছবি উঠলো ফটোকর্তার অন্তরের সঙ্গে পাহাড়ের যোগাযোগই হল না। এইজন্যে আর্টিষ্টের লেখা পাহাড় যেমন মনে গিয়ে পৌঁছয়, ফটোতে লেখা পাহাড় ঠিক তেমন ভাবে মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না—শুধু চোখের উপর দিয়েই ভেসে যায় বায়স্কোপের ছবি, মনের মধ্যে তলিয়ে যায় না। খবরের কাগজ খবর দিয়েই চল্লো অনবরত, আজ পড়লেম দুদিন পরে ভুল্লেম। কবি গান গেয়ে গেলেন, শিল্পী রচনা করে গেলেন, চোখ কাণের রাস্তা ধরে’ মর্মে গিয়ে পৌঁছোল গান ও ছবি। ক্যামেরার মতে চোখ খুল্লেম বন্ধ করলেম, একই বস্তু একই ভাবে বারম্বার এল কাছে,—এ হ’ল অত্যন্ত সাধারণ দেখা। শিল্পীর মতো চোখ মেল্লেম বস্তু জগতের দিকে, রূপ চোখে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে রূপাতীত রসের উদয় হ’ল।

ফটোগ্রাফ বস্তু জগতের এক চুল ওলট-পালট করতে অক্ষম, কিন্তু শিল্পীর কল্পনা যে বরফের হাওয়া পেলে—ফটোগ্রাফের মধ্যে যতটা বস্তু তার সমস্তটা পালাই পালাই করে—সেই বরফের চূড়ায় হর-গৌরীকে বসিয়ে দিলে বিনা তর্কে। চোখের দেখা ও মনের দেখা দিয়ে শিল্পী যখন মিল্লেন চোখের সামনে বিদ্যমান যা এবং চোখের বাইরে অবিদ্যমান যা তার সঙ্গে, তখন নিয়তির নিয়ম উল্টে গেল অনেকখানি—দেবতা সমস্ত এসে সামনে দাঁড়ালো ঠিক মানুষের মতই দুই পায়ে কিন্তু অসংখ্য হাত অসংখ্য মাথা নিয়ে, নিচের দিকে রইলো বাস্তব উপরে রইলো অবাস্তব, সম্ভবমতো হ’ল দুই পা, অসম্ভব রকম হ’ল হাত ও মাথা, সৃষ্টির নিয়ম মিল্লো গিয়ে অনাসৃষ্টির অনিয়মে।

ফটোগ্রাফের যে কৌশল তা বস্তুর বাইরেটার সঙ্গেই যুক্ত আর শিল্পীর যে যোগ তা শিল্পীর নিজের অন্তর-বাহিরের সঙ্গে বস্তুজগতের অন্তর-বাহিরের যোগ এবং সেই যোগের পন্থা হ’ল কল্পনা এবং বাস্তব ঘটনা দুয়ের সমন্বয় করার সাধনাটি।

নির্ভুলে ব্যাকরণ ও পরিভাষা ইত্যাদি দিয়ে যেমনটি-তাই ঘটনাকে বলে’ যাওয়া হ’লেই যে বলা হ’ল তা নয়, তা যদি হ’ত তো সাহিত্য খবরের কাগজেই বদ্ধ থাকতো। তেমনি যা-তা এঁকে চলা মানে শিল্পের দিক থেকে বেঁকে ফটোগ্রাফের দিকে যাওয়া, সুর ছেড়ে হরিবোলার বুলি বলা। অবিদ্যমানকে ছেড়ে বিদ্যমানে বর্তে’ নেই একদণ্ড এই সৃষ্টি এবং কল্পনাকে ছেড়ে শুধু ঘটনার মধ্যে বর্তে’ থাকতে পারে না মানুষের রচনা, ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মিলন হ’ল তবে হ’ল একটা শিল্প রচনা। গাছ দাঁড়িয়ে রইলো কিন্তু ফুল পাতা এরা দুল্লো, কখনো আলোর দিকে মুখ ফেরালে কখনো অন্ধকারের দিকে হাত বাড়ালে। মানুষ বাঁধা রইলো মাটির সঙ্গে কিন্তু মন তার বিদ্যমান অবিদ্যমান দুই ডানা মেলে উড়লো, মানুষের শিল্প তার মনের পাখীর গতিবিধির চিহ্ন রেখে গেল কালে কালে—পাথরে, কাগজে, মাটিতে, সোণায়, কাঁসায়, কাঠে, কয়লায়। ইতর জীব তার বর্তমানটুকুর ঘেরে বাঁধাই রয়েছে, বিদ্যমানের প্রাচীর ছাড়িয়ে যাওয়া শুধু মানুষেরই সাধ্য হয়েছে—ঘোড়া সে কোনকালে পক্ষিরাজ হবার কল্পনাই করতে পারলে না কিন্তু মানুষ অতিমানুষের কল্পনা অমানুষি সমস্ত রচনার স্বপ্ন দেখলে, বিদ্যমানের মধ্যে মানুষ আপনাকে ইতর জীবের মতো নিঃশেষে ফুরিয়ে দিতে পারলে না; সে কল্পনা ও স্মৃতি এই দুই টানা-পোড়েনে প্রস্তুত করে’ চল্লো বিশ্বজোড়া মায়াজাল। সে ঘুমিয়ে স্বপন দেখলে, জেগে স্বপন দেখলে, বিদ্যমান থেকে অবিদ্যমান পর্যন্ত তার মন এল গেল—অবিদ্যমানকে আনলে, অনাবিষ্কৃতকে করলে আবিষ্কার। পাখীরা যে সুর পেলে সেই সুরেই গেয়ে গেল, অনাহত সুরের সন্ধান তারা পেলে না; দেওয়া সুরে গাইলে কোকিল, দেওয়া সুরেই ডাকলে ময়ূর, কিন্তু মানুষের গলায় অবিদ্যমানের সুর পৌঁছোলো—অনাহত তারের অপ্রকাশিত সুর, তাই শুনে বিশ্বজগৎ হরিণের মতো কাণ খাড়া করে’ স্তব্ধ হয়ে রইলো, অগোচর রূপ সাগরের জল মানুষ ছুঁয়ে এল, তার হাতের পরশে ফুটলো বিচিত্র ছবি বিচিত্র শিল্পকলা, আর একটি নতুন সৃষ্টি—পলে পলে কালে কালে যা নতুন থেকে নতুনতর রাজত্বে চলেছে তো চলেছেই! বিদ্যমান এবং অবিদ্যমান এই দুই ডানার উত্থানপতনের গতি ধরে’, চলেছে মানুষের মনের সঙ্গে মানুষের মানস-কল্পনার প্রকাশগুলি। অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মধ্যে ধরে’ দিচ্ছে মানুষ, অন্তরকে আনছে বাইরে, বাইরেকে নিয়ে চলেছে অন্তরে,—এই হ’ল শিল্প-রচনার মূলের কথা। শিল্প এলো সামনে, পিছনে লুকিয়ে রইলো শিল্পী,—এই হ’ল শিল্পের সঠিক লক্ষণ। ময়ূর শিল্পী নয় কেননা সে তার চালচিত্র আড়াল করে’ নিজেকে সামনে ধরে’ দেয়। রচনাকে ঠেলে বেরিয়ে এলো সুচতুর রচয়িতা এটা একটা মস্ত দোষ, ছবিটাকে আড়াল করে’ ছবি-লিখিয়ে তাড়াতাড়ি তোড় জোড় নিয়ে যদি সামনে দাঁড়ায়, ছবির কোণের নামটা এবং তুলির টানটাই দেখবার বিষয় বলে, তবে সে লোককে কি সওয়া যায় চিত্রবিদ্ বলে’? অবিদ্যমানের দিকে, কল্পনার দিকে, অগোচরের দিকে যে চিরন্তন টান রয়েছে সমস্ত শিল্পের সমস্ত শিল্পীর, এটা যে না বোঝে চিত্রের বিচিত্র রহস্য সে বোঝে না, তার কাছে বাস্তব ও কাল্পনিক দুয়েরই অর্থ অজ্ঞাত থেকে যায়, দাঁড়ে বাঁধা পাখীর মতো শিল্প শাস্ত্রের বুলিই সে আউড়ে চলে অনর্গল; যথা—“সশ্বাস ইব যচ্চিত্রং তচ্চিত্ৰং” কিম্বা “তরঙ্গাগ্নিশিখাধূমং বৈজয়ন্ত্যম্বরাদিকং। বায়ুগত্যা লিখেৎ যস্তু বিজ্ঞেয়ঃ স তু চিত্রবিৎ॥” অথবা “সুপ্তং চেতনাযুক্তং মৃতং চৈতন্যবর্জ্জিতং। নিম্নোন্নতবিভাগঞ্চ যঃ করোতি স চিত্রবিৎ॥” যে ওস্তাদ বোল সৃষ্টি করে সে বোঝে বোলের মর্ম কিন্তু খোল সে বোল বলে মাত্র, বলে কিন্তু বোঝে না বোলের সার্থকতা অথবা প্রয়োগের কৌশল। মানুষের লেথা পুঁথিগত শিল্পের চেহারা এক, আর মানুষের মনোমত করে’ রচা শিল্পের রূপ অন্য। শাস্ত্রকার চাইলেন শিল্পী আঁকুক ঠিক ঠিক তরঙ্গ অগ্নিশিখা ধূম নিম্ন উন্নত সুপ্ত মৃত জীবিত এক কথায় সশ্বাস ইব চলন্ত বলন্ত ইংরাজীতে যাকে বলি life-like ছবি—কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে আরম্ভ করে’ পূর্ব পশ্চিমের বিস্তার ছাড়িয়ে যে শিল্পলোক এবং কল্পনার রাজ্য তার যে অধিবাসী তারা এঁকে চল্লো এর ঠিক বিপরীত, শুধু নকলনবিশেরাই ধরে’ রইলো সামনে বিদ্যমান শাস্ত্রের বচন ও বস্তুজগৎ।—“Do not imitate; do not follow others—you will be always behind them”—Corot. আসল মেঘ চলে’ যায় পলে পলে রূপ বদলাতে বদলাতে, নকল মেঘের বদল নাই, এটা শাস্ত্রকার পণ্ডিতের ঢের আগে শিল্পী আবিষ্কার ক’রে গেছে, তাই সে বলেছে—অনুসরণ, অনুকরণ, অনুবাদ এ সব করলে পিছিয়ে পড়বে, পটের ‘সশ্বাস ইব’ অবস্থায় স-শে-মি-রা হয়ে হবে পুঁথির ও পরের তল্পিদার মাত্র, শিল্পী হবে না শিল্পকে পাবে না—“Nothing is so tiring as a constant close imitation of life one comes back inevitably to imaginative work”—Weertz.

“তরঙ্গাগ্নিশিখাধূমং বৈজয়ন্ত্যম্বরাদিকং বায়ুগত্যা লিখেৎ যস্তু বিজ্ঞেয়ঃ স তু চিত্রবিৎ,” অথবা “সুপ্তবৎ চেতনাযুক্তং মৃতং চৈতন্যবর্জ্জিতং নিমোন্নতবিভাগঞ্চ যঃ করোতি স চিত্রবিৎ”—এ হ’ল শিল্পে বাস্তবপন্থীর কথা—যেন ঢেউ উঠছে পড়ছে, যেন আগুন জ্বলছে, নিশান লট্‌পট্ করছে, আঁচল উড়ছে বাতাসে, যেন ঘুমন্ত যেন জীবন্ত যেন মৃত যেন নিম্নোন্নত,—এক কথায় ‘সশ্বাস ইব’ হ’ল চরম কথা। কিন্তু এই মতের অনুসরণে গিয়ে কি মানুষ অনুকরণেই ঠেকে রইল না শিল্পী সে ছবি লিখে চল্লো বায়ুর চেয়ে গতিমান কল্পনার সাহায্যে নিজের বর্ণ ও রেখা সমস্তকে কখন তরঙ্গায়িত, শিখায়িত, ধূমায়িত ক’রে দিয়ে—এমন মেঘ এমন আগুন, এমন সমুদ্রের এমন ঢেউ যা বাস্তব জগতে দেখেনি কেউ! শিল্পের জয়পতাকা কল্পনার বাতাসে উড়ে’ অচেতন রেখা চেতন হয়, সচেতন রং ঘুমিয়ে পড়ে কল্পনার সোনার কাঠির স্পর্শে, শয়ন ছেড়ে জেগে ওঠে মনের মধ্যেকার সুপ্ত ভাব, স্থির বিদ্যুল্লেখার মতো শোভা পায় স্বপ্নপুরের অলক্ষ্য রূপরেখা! কল্পনার যেখানে প্রসার নেই সেখানে রেখা শুধু দপ্তরীর রুলটানা, আলো-ছায়া, আনাটমি পারস্‌পেক্‌টিভ ইত্যাদির ঘূর্ণাবর্ত, শুধু কুস্তির মারপেঁচ, ভূষণ সেখানে বারাঙ্গনার সাজের মতো অপদার্থ এবং বর্ণ সেখানে বহুরূপীর রং চং করা সং মাত্র, তা সে শাস্ত্রমতো অনুলোম পদ্ধতিতেই আঁকা হোক বা প্রতিলোম পদ্ধতিতেই টানা হোক। “To make a thing which is obviously stone, wood or glass speak is a greater triumph than to produce wax-works or peep-shows—Rodin. শিল্পী কতখানি প্রকাণ্ড কল্পনা নিয়ে বাস্তব জগৎ থেকে সরে’ দাঁড়ালো যখন সে কাঠ পাথর কাগজকে কথা বলাতে চাইলে! শিল্পের প্রাণ হচ্ছে কল্পনা, অবিদ্যমানের নিশ্বাস। চৌরঙ্গীর মার্কেটে যে মোমের পুতুলগুলো বিক্রী হচ্ছে তারা একেবারে ‘সশ্বাস ইব’, চোখ নাড়ে ঘাড় ফেরায় হাসে কাঁদে “পাপা” “মামা” বলেও ডাকে কিন্তু ‘ইব’ পর্যন্তই তার দৌড়! কোন শিল্পী যদি শিল্পশাস্ত্র লিখতে চায় তবে এই ‘ইব’ কথাটি তার চিত্রশব্দ-কল্পদ্রুম থেকে বাদ দিয়ে তাকে লিখতে হবে ‘সশ্বাস ইব’ নয় ‘সশ্বাসং যচ্চিত্রং তচ্চিত্রং’। শিল্পীর মানস কল্পনা যে কল্পলোকের দিব্য নিশ্বাসে প্রাণবন্ত হয় সে হাওয়া কি এই বাতাস যা ঐ লাট প্রাসাদের নিশান দুলিয়ে গড়ের মাঠের ধূলোয় কলের ধূলোয় মলিন হ’য়ে আমাদের নাকে মুখে দিবারাত্রি যাওয়া আসা করছে? আর্টিষ্টদের মনোরথ যে বাতাস কেটে চলে সে বাতাস হচ্ছে এমন এক তরল হাওয়া যার উপর পালকের ভার সয় না অথচ বিশ্বরচনার ভার সে ধরে’ আছে! শিল্পশাস্ত্র খুবই গভীর, তার একটা লাইনের অর্থ হাজার রকম, কিন্তু তার চেয়ে গভীর জিনিষ হ’ল শিল্প, যার একটা লাইনের মর্ম ঝুড়ি ঝুড়ি শিল্পশাস্ত্রেও কুলোয় না, আবার শিল্পের চেয়ে গভীর হ’ল শিল্পীর মন যার মধ্যে বহির্জগৎ তলিয়ে রইলো—স্মৃতির শুক্তিতে ধরামুক্তি, নূতন জগৎ সৃষ্টি হল জলের মাঝে বড়বানল। এই যে শিল্পীর মন এর কাজই হল বাইরে গিয়ে আবিষ্কার এবং ভিতরে থেকেও আবিষ্কার, আবির্ভূত যে জগৎ এই গাছ-পালা জীবজন্তু আকাশ আলো এর সামনে এসে শিল্পীর মন থমকে দাঁড়িয়ে শুধু নকল নিয়ে খুসী হয় না সে খুঁজে খুঁজে ফেরে অনাবিষ্কৃত রয়েছে যা তাকে! শিল্পীর মন দেহপিঞ্জরের অন্তঃপুরে যাদুঘরের মরা পাখীর মতো দিন রাত সুখে দুঃখে সমভাবে থাকে না—সে বোধ করে স্বপন দেখে স্বপন রচনা করে’ চলে অসংখ্য অদ্ভুত অতি বিচিত্র! নিছক ঘটনা আর নিছক কল্পনা এ দু’য়েরই কথা শাস্ত্রকার লিখলেন। এক দিকে বলা হ’ল “সশ্বাস ইব যচ্চিত্রং তচ্চিত্ৰং শুভলক্ষণম্”, দর্পণে যে প্রতিবিম্ব পড়ে তার চেয়ে সচল সশ্বাস,—রূপে প্রমাণে ভাবে লাবণ্যে সাদৃশ্যে বর্ণিকাভঙ্গে সম্পূর্ণ চিত্র আর কিছুই হ’তে পারে না। কিন্তু সবাই তো এ বিষয়ে এক মত হ’তে পারলে না; এর ঠিক উল্টো রাস্তা ধরে’ একদল শাস্ত্রকার বল্লেন—“অপি শ্রেয়স্করং নৃণাং দেববিম্বমলক্ষণম্। সলক্ষণং সত্যবিম্বং ন হি শ্রেয়স্করং সদা॥” কিছুর প্রতিকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট কথা বলা হ’ল—“মানবাদীনামস্বর্গ্যাণ্যশুভানি চ।” শাস্ত্র পড়ে’ শিল্পী হ’তে চল্লে এই দোটানা সমস্যায় পড়ে’ হাবুডুবু খেতে হবে; নানা মুনির নানা মত! মানুষের শিল্প যে নানা রাস্তা ধরে’ চলেছে তার অন্ধি সন্ধি এত যে তার শেষ নেই, বিদ্যমান এবং অবিদ্যমান ঘটনা এবং অঘটন কল্পনা এই দুই খাত রেখে চলেছে শিল্পের ধারা—কিন্তু এই দুয়েরই গতি কোন্ দিকে—রসসমুদ্রের দিকে, এ দুয়েরই উৎপত্তি কোন্ খানে–রসের উৎসে, সুতরাং ভারত শিল্পই বল আর যে শিল্পই বল রসের সংস্পর্শ নিয়ে তাদের বিচার। শিল্পে বাস্তবিকতা কিম্বা অবাস্তবিকতা কোন্‌টা প্রয়োজনীয় একথার উত্তর শাস্ত্রকার তো দিতে পারে না! শাস্ত্ৰ হ’ল নানা মুনির নানা মতের সমষ্টি এবং নানা শিল্পের নানা পথে পদক্ষেপের হিসাবের খাতা মাত্র, কাজেই শাস্ত্র পড়ে’ শিল্পের স্বরূপ কেমন করে’ ধরা যাবে? সমুদ্র ঘাঁটলে মাছ ওঠে নুন ওঠে মুক্তাও ওঠে কিন্তু হীরক ওঠে না, সেখানে মাটি ঘাঁটতে হয় যে মাটিতে শিল্পী জন্মেছে ও গড়েছে। শাস্ত্র ঘাঁটলে শাস্ত্রের বচন পাই শাস্ত্রজ্ঞান পাই, শিল্পীর রচনা-রহস্য ও শিল্পজ্ঞান শিল্পের মধ্যেই গোপন রয়ে’ যায়। শাস্ত্রকার যখন ছিল না এমন দিনও তো পৃথিবীতে একদিন এসেছিল, সে সময়কার শিল্পী শাস্ত্র না পড়েও শিল্পজ্ঞান লাভ করে গেছে—জগতের সমস্ত আদিম অধিবাসীদের শিল্পকলা এর সাক্ষ্য দিচ্ছে—এই অাদিম শিল্পচর্চা করে’ দেখি মানুষ জলের রেখা, ফলের ডৌল, পাখীর পালক, মাছের আঁষ এমনি নানা জিনিষের স্মৃতি কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে সাজাচ্ছে ঘাটি-বাটি কাপড়-চোপড় অস্ত্ৰ-শস্ত্র সমস্ত জিনিষের উপরে এমন কি মানুষের নিজের গায়ের চামড়ায় পর্যন্ত স্মৃতি ও কল্পনার জাল পড়েছে! মানুষের চিরসহচরী এই কল্পনা ও স্মৃতি, শিল্পের দুই পার্শ্বদেবতা! বিদ্যমান জগৎ বাঁধা জগৎ, আর কল্পনার জগৎ সে অবিদ্যমান, কাজেই বাঁধা জগতের মতো সসীম নয়। অনন্ত প্রসার মানুষের কল্পনার,—তেপান্তর-মাঠের ক্ষীর-সমুদ্রের ইন্দ্রলোক-চন্দ্রলোকের। বিদ্যমান জগৎ নির্দিষ্ট রূপ পেয়ে আমাদের চারিদিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে—তাল, বট, তেঁতুল, কোকিল, ময়ূর, কাক, গরু, বাছুর, মানুষ, হয়, হস্তী, সিংহ, ব্যাঘ্র এরা কালের পর কাল একই রূপ একই ভঙ্গি একই সুর নিয়ে খালি আসা যাওয়া করছে। পৃথিবীটা খুব বড় এবং এখনো মানুষের কাছ থেকে আপনার অনেক রহস্য সে লুকিয়ে রেখেছে, তাই এখনো মানুষ উত্তরমেরু ধবলগিরি অতিক্রম করার কল্পনা করছে, দুদিন পরে যখন এ দুটো জায়গাই মানুষের জানা জগতের মধ্যে ধরা পড়বে তখন মানুষের চাঁদ ধরার কল্পনা সত্য হয়ে উঠবার দিকে যাবে! এমনি বাস্তব এবং কল্পনা, কল্পনা ও বাস্তব এই দুটি পদচিহ্ন রেখে চলেছে ও চলবে মানুষ সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এবং তার পরেও নতুন যুগে যে সব যুগ এখনো মানুষের কল্পনার মধ্যেই রয়েছে! অঘটিত ঘটনা অবিদ্যমান সমস্ত কল্পনা আজ যেগুলো মানুষের মনোরাজ্যের জিনিষ সেগুলো কালে সম্ভব হয়ে উঠবার প্রতীক্ষা করছে না, জোর করে’ একথা কে বলতে পারে? এক যুগের খেয়ালী যা কল্পনা করলে আর এক যুগে সেটা বাস্তব হয়ে উঠলো, এর প্রমাণ মানুষের ইতিহাসে বড় অল্প নেই, কতযুগ ধরে পাখীদের দেখাদেখি মানুষ শূন্যে ওড়ার কল্পনা করে এল, এতদিনে সেটা সত্যি হয়ে উঠলো কিন্তু এতেও মানুষের কল্পনা শেষ হ’ল না, ওড়ার নানা ফন্দি ডানায় বিনা ডানায়, এমনি নানা কল্পনায় মানুষের মন বিদ্যমানকে ছেড়ে চল্লো অবিদ্যমানের দিকে। হঠযোগ থেকে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ইষ্টিম গাড়ি, দুচাকার গাড়ি, শেষে হাওয়া গাড়ি এবং উড়োজাহাজে কল্পনা এসে ঠেকেছে কিন্তু ওড়ার কল্পনা এখনো শেষ হয় নি, রাবণের পুষ্পক রথে গিয়ে ঠেকলেও মানুষ আরো অসম্ভব অদ্ভুত রথের কল্পনা করবে না তা কে বলতে পারে? দেশলাইয়ের কল্পনা চকমকি থেকে এখন মেঘের কোলের বিদ্যুতে গিয়ে ঠেকেছে কিন্তু এখনো নিম্প্রভ আলো তাপহীন আগুন এ সমস্তই অবিদ্যমানের কোলে দুলছে একদিন বিদ্যমান হবার প্রতীক্ষায়। অবিদ্যমান হচ্ছে বিদ্যমান সমস্তের জননী, অজানা প্রসব করছে জানা জগৎ, অসম্ভব চলেছে সম্ভব হ’তে কল্পনার সোপান বেয়ে। “অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, সমস্তই চিহ্নবর্জিত ছিল, অবিদ্যমান বস্তুর দ্বারায় সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন, বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধিদ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তিস্থানে নিরূপণ করিলেন।” আগে সৃষ্টির কল্পনা তবে তো সৃষ্টি! ইউরোপের স্বরগ্রামে শুনেছি আগে নিখাদ স্বরটা একেবারে অজ্ঞাত ছিল হঠাৎ এক খেয়ালী সেই অজানা সুরের কল্পনা ধরে বসলে এবং তারি সন্ধানে মরীচিকালুব্ধের মতো ছুটলো অবিদ্যমান যে সুর তাকে বিদ্যমান করতে চেয়ে! সঙ্গীত তখন ইউরোপে পাদ্রীদের হাতে ধর্মের সেবায় বাঁধা রয়েছে, ছয় সুরের বেশী আর একটা সুরের কল্পনা পাদ্রী সঙ্গীতবেত্তার কাছে অমার্জনীয় ছিল, খেয়ালী লোকটার নির্বাসনদণ্ড ব্যবস্থা হয়ে গেল, সে একটা কাল্পনিক সুরের জন্যে ঘর ছাড়লে, দেশ ছাড়লে, নির্যাতন সইলে, তারপর যে সুর কল্পনায় ছিল তাকে বিদিত হ’ল সে নিজে এবং বিদিত করে’ গেল বিদ্যমান জগতে। এমনি একটার পর একটা সুরের পাখী ধরে গেছে কল্পনার জালে মানুষ, অনাহতকে ধরে গেছে আহতের মধ্যে।

মানুষের সমস্ত কাজে, কর্মে, শিল্পে, সাহিত্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কল্পনাটা প্রথম তারপর বাস্তব,—এই হ’ল রচনার ধারা ও রীতি। কল্পনাটা মানুষের মধ্যে প্রবল শক্তিতে কাজ করে; এই শক্তি সৃষ্টি করার দিকে মানুষের দৈহিক ও মানসিক আর সমস্ত শক্তিকে উদগ্র করে’ দেয়। মাতাল ও পাগলের দেহ বিকল হয়ে গেল, উৎকট কল্পনা তাদের বিকট মূর্তিতে বিদ্যমান হ’ল; কিন্তু যে সুস্থ সাধনের দ্বারায় বিরাট কল্পনা সমস্তকে স্মরণের মধ্যে ধারণ করতে সমর্থ হল সেই বীর হল রূপ ও অরূপ দুই রাজ্যের রাজা, সে হ’ল বীর, সে হ’ল কবি, সে হ’ল শিল্পী, সে হ’ল ঋষি, আবিষ্কর্তা, গুণী, রচয়িতা। কল্পনাপ্রবণতা হ’ল মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক অবস্থা, কেননা দেখি কল্পনা তার আশৈশব সহচরী । খেয়াল জিনিষটা বিশ্বসংসারকে পুরোনো হতে দিচ্ছে না মানুষের কাছে, একই আকাশের তলায় একই ঋতু-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা পৃথিবীতেই চলি-বলি খাই-দাই ঘুমোই, কিন্তু কল্পনায় গড়ে চলি খেলা করি বিচরণ করি আমরা নতুন নতুন জগতে চিরযৌবন, চিরবসন্তের স্বপ্ন নিয়ে। বস্তুজগতের এইটুকু ঘটনার স্মৃতিগুলো বড় হয়ে ওঠে কল্পনায়। মানুষের এত বড় ঐশ্বর্য এই কল্পনা একে হারালে তার মতো দীন ও অধম কে? কোন দিকে অগ্রসর হবার রাস্তা তার বন্ধ হ’ল, কায়ার মায়াহীন প্রাচীরের সুদৃঢ় বন্ধনে সে বন্দী রইলে৷ “সশ্বাস ইব” কিন্তু সশ্বাস মোটেই নয়।

কাব্যে পুনরুক্তি একটা মহৎ দোষ; পুনঃ পুনঃ কেবল পুনরুক্তি সেইখানেই চলে যেখানে উক্তকে সমর্থন করতে হয় একটা কথা বারবার বলে। যে ছবি হয়ে গেছে তাকে আবার এঁকে কি লাভ, জানালা দিয়ে দিনরাত চোখে পড়ছে যে আকাশ ও মাঠ ঘর বাড়ি সেটার সঠিক প্রতিচ্ছবি কি দরকার মানুষের, যদি না সে স্মৃতির সঙ্গে কল্পনাকে এক করে দেখায়। কল্পিত থেকে বঞ্চিত বাস্তবটা হ’ল মানুষের কাটা হাত পায়ের মতো বিশ্ৰী জিনিষ, মৃতদেহ সেও স্মৃতি জাগায় কল্পনা জাগায় কিন্তু আসলের নকল কিম্বা আসলের থেকে বিচ্ছিন্ন যেটা সেটা প্রাণে বাজে না, বিশ্রী রকমে কানে বাজে চোখে বাজে। বিদ্যমান বস্তুর প্রতিকৃতি প্রতিবিম্ব সঠিক নকল ইত্যাদির মধ্যেই যারা আর্টকে বন্ধ করে স্মৃতি ও কল্পনার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চায় কিম্বা অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের সম্পর্ক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উন্মত্তকে অবাধ্যতা দিয়ে ছেড়ে দিতে চায় অনির্দিষ্ট পথে তারা শাস্ত্রকার হ’লেও তাদের কথা শোনায় বিপদ আছে। এমনে লোক আছে যার নেশায় চোখ এমন বুঁদ হয়ে গেছে যে দিন কি রাত, উত্তম কি অধম, বস্তু কি অবস্তু সব জ্ঞান তার লোপ পেয়েছে—টলে’ পড়ার দিকেই যার ঝোঁক; আবার এমনো লোক আছে যার চোখে রঙ্গ রসের নেশা একেবারেই লাগলো না, সে গট্‌ হয়ে বসে আছে সাদা চোখে সাদা-সিধে লোকটি, একজন বকে’ চলেছে প্ৰলাপবাক্য আর একজন কিছুই বলছে না বা বলছে সাদা কথা, —শিল্পজগতে এই দু’জনের জন্যই স্থানাভাষ। নাটকের মধ্যে যেখানে মাতলামি দেখাতে হয় সেখানে একটা সত্যিকার মাতাল এনে ছেড়ে দিলে সে কুকাণ্ড বাধায়, অন্যদিকে আবার যার কোন কিছুতে মত্ততার লেশ নেই তাকে এনে রঙ্গমঞ্চে ছেড়ে দিলেও সেই বিপদ, দুই পক্ষই যাত্রা মাটি করে’ বসে’ থাকে। মাতলামির রং যার চোখে ইচ্ছা মতো আসে যায়, নেশা যার চোখের আলো মনের গতিকে নিস্তেজ করে’ বাস্তব অবাস্তব দুয়ের বিষয়ে অন্ধ ও আতুর করে দেয় না, সেই হয় আর্টিষ্ট, মনকে মনের দিকে কল্পনাকে বাস্তবের স্মৃতির দিকে অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের দিকে অভিনয়ন করেন আর্টিষ্ট ‘সশ্বাস ইব’ স-শে-মি-রা অবস্থায় নয়, মোহগ্ৰস্ত বা জীবন্মৃত নয় কিন্তু রসের দ্বারায় সঞ্জীবিত প্রস্ফুটিত।

শিল্পশাস্ত্র ঘাঁটতেই যদি হয় তবে গোড়াতেই আমাদের দুটো বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে- কোনটা মত এবং কোনটা মন্ত্র এ দুয়ের সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণাটি নিয়ে কাজ করতে হবে। মত জিনিষটা একজনের, দশজনে সেটা মানতে পারে নাও মানতে পারে, একের কাছে যেটা ঠিক অন্যের কাছে সেটা ভুল, নানা মুনির নানা মত। মন্ত্রগুলি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিষ। মত একটা লোকের অভিমতকে ধরে প্রচারিত হল আর মন্ত্র প্রকাশ করলে আপনাকে সব দিক দিয়ে যেটা সত্য সেইটে ধরে। শিল্পশাস্ত্রে মত এবং মন্ত্র দুটোই স্থান পেয়েছে, মতকে ইচ্ছা করলে শিল্পী বর্জন করতে পারেন কিন্তু মন্ত্রকে ঠেলে ফেলা চলে না।

“যথা সুমেরুঃ প্রবরো নগানাং যথাণ্ডজানাং গরুড়ঃ প্রধানঃ।
যথা নরাণাং প্রবরঃ ক্ষিতীশ স্তথা কলানামিহ চিত্রকল্পঃ॥”

খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো সত্য দিয়ে এটা বলা হ’লেও সমস্ত শ্লোকটা কলাবিদ্যার সম্বন্ধে একটা প্রকাণ্ড অহমিকা নিয়ে মত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। যে রাজভক্ত তার কাছে ক্ষিতীশচন্দ্র হলেন শ্রেষ্ঠ কিন্তু এমন অনেক ফটিকচাঁদ আছে রাজাও যার পায়ে মাথা লোটায়। এ ছাড়া চিত্রকলাই সকল কলার শ্রেষ্ঠ কলা একথা একেবারেই অসত্য কেননা গীতকলা কাব্যকলা নাট্যকলা এরা কেউ কমে যায় না! মতের মধ্যে এই একটা মস্ত ফাঁক আছে, মন্ত্রে কিন্তু তা নেই দেখ—শরীরেন্দ্রিয় বর্গস্য বিকারাণাং বিধায়কা ভাবাঃ বিভাবজনিতশ্চিত্তবৃত্তয় ঈরিতাঃ—এ সত্যের দ্বারায় পরখ করা জিনিষ, এ মন্ত্র-শিল্পীকে সুমন্ত্রণ দিচ্ছে ভাব ও তার আবির্ভাব সম্বন্ধে, অতএব এতে কারু দুইমত হবার কথা নয় কিন্তু “দৌর্বল্যং স্থূলরেখত্বং অবিভক্তত্বমেব চ। বর্ণানাং সঙ্করশ্চাত্র চিত্রদোষা প্রকীৰ্ত্তিতাঃ॥” এটা একটা লোকের মত, মন্ত্রের মতো খুব সাচ্চা জিনিষ নয়, এর মধ্যে অনেকখানি সত্য এবং মিথ্যাও লুকিয়ে আছে, দৌর্বল্য, স্থূলরেখত্ব অবিভক্তত্ব বর্ণসঙ্করত্ব হ’ল চিত্রদোষ কিন্তু কিসের দৌর্বল্য কিসের অবিভক্তত্ব টীকা না হলে বোঝা দুষ্কর, তা ছাড়া এসব দোষ যে চিত্রে কোন কাযে আসে না তা নয় এ সবই চাই চিত্রে, বর্ণসঙ্কর না হ’লে মেঘলা আকাশ সূর্যোদয় এমন কি কোন কিছুই আঁকা চলে না, অমিশ্র বর্ণ সে এক ছবি দেয়। মিশ্রবর্ণ সে অন্য ছবি দেয়, ফুলের বোঁটার টান দুর্বল গাছের গুঁড়ির টান সবল দুর্বল স্থূল, সূক্ষ্ম সব রেখা সব বর্ণ ভাব ভঙ্গি মান পরিমাণ সুর এমন কি বেসুর তা তো অনেক সময় দোষ না হয়ে গুণই হয়ে ওঠে গুণীর যাদুমন্ত্রে।

এইবার শিল্পের একটা মন্ত্র দেখ, পরিষ্কার সত্য কথা—“রূপভেদা: প্রমাণানি ভাবলাবণ্যযোজনম্‌॥ সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্ৰং ষড়ঙ্গকম॥” ভারতবর্ষ থেকে ওদিকে আমেরিকা কোন দেশের কোন চিত্রবিদ এর উল্টো মানে বুঝে, ভুল করবে না, কেননা চিত্রকরের কারবারই হল এই ছটার কোনটা কিম্বা এর কোন কোনটাকে নিয়ে। একটা চিত্রে পুরোমাত্রায় এ ছয়টা পাবো না নিশ্চয় কিন্তু দুটো চারটে চিত্র ওল্টালেই বুঝবো কেউ রূপ-প্রধান কেউ প্রমাণ-সর্বস্ব, কেউ ভাবলাবণ্য-যুক্ত, কেউ বর্ণ ও বর্ণিকাভঙ্গে মনোহর, কেউ যড়ঙ্গের দুটো নিয়ে চিত্র, কেউ পাঁচটা নিয়ে হয়েছে ছবি।

মত অপেক্ষা রাখে সমর্থনের, মন্ত্র যা তা নিজেই সমর্থ—প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও সত্যের দ্বারায় বলীয়ান। ধর্মের যেমন-তেমন শিল্পকলাতেও মানুষ মতও চালিয়েছে মন্ত্রও দিয়েছে। তার মধ্যে মত গুলো দেখি কোনটা চলেছে, কোনটা চলেনি এবং মত ধরে কোন শিল্প ম’রলে, কোনটা আধমরা হয়ে রইলে, কিন্তু শিল্পের মূল মন্ত্রগুলো সেই পৃথিবীর আদিমতম এবং নতুনতম শিল্পে সমানভাবে কায করে চল্লো। মত, খণ্ডন হ’ল মহাকলরবের মধ্যে কিন্তু মন্ত্রের সাধন করে চল্লো মানুষ নীরবে, মানবের ইতিহাসে এটা নিত্য ঘটনা, মানুষের গড়া শিল্পের ইতিহাসেও এর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে। সাদা মানুষ, সে কালে মানুষ সম্বন্ধে শক্ত মত নিয়ে এগোয় কিন্তু কালো মানুষ পদে পদে সেই মতের সমর্থন করে চলে না কিন্তু মানুষ যেখানে মানুষের কাছে মন্ত্র নিয়ে এগোয়—মানুষে মানুষে অভেদমন্ত্র দয়ার মন্ত্র প্রেমের মন্ত্র— সেখানে মতভেদ হয় না সাদায় কালোয়, তেমনি শিল্পের বাস্তব ও কল্পনা মানুষি ও মানসী, প্রতিকৃতি ও প্রকৃতি, reality ও ideality এই সব নানাদিকে যে সব মতগুলো আছে তা নিয়ে এর সঙ্গে ওর বিবাদ কিন্তু কলাবিদ শিল্প সাধক বাস্তব জগতের এবং কল্পনা জগতের মধ্য থেকে শিল্পের যে সব মন্ত্র আবিষ্কার করেছে সেগুলো গ্রহণ সম্বন্ধে বিচার বিতর্ক অথবা মতামতের কথা কোন দলের কেউ তোলে না। বৌদ্ধযুগ থেকে আরম্ভ করে মোগল এবং ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত আমাদের কলাবিদ্যা সমস্ত এমন কি কলাবিদদের আকৃতি প্রকৃতি পর্যন্ত নানামতের চাপনে রকম রকম লক্ষণে চিহ্নিত হয়েছে। এই যে আমাদের নানা কলাবিদ্যার নানা আকৃতি ও প্রকৃতির বিভিন্নতা এগুলো কোন এক কালের শাস্ত্রমত বা লোকমত বা ব্যক্তিবিশেষের মতের সঙ্গে মেলালে দেখবো নিখুঁৎ মিলছে না—অজন্তার অতুলনীয় চিত্র সে হয়ে যাচ্ছে চিত্রাভাষ, মোগল শিল্প হয়ে যাচ্ছে যবন-দোষ-দুষ্ট এবং তার পরের শিল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে সকল দোষের আধার। চীন দোষ, জাপান দোষ, ব্রিটন দোষ, জার্মাণ দোষ,—দোষের অন্ত নেই মতের কাছে। কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের মধ্য থেকে শিল্পের মন্ত্রগুলো বেছে নাও এবং সেই সকল মন্ত্র দিয়ে পরখ কর, এক ভারত শিল্পের অসংখ্য অবতারণা ঠিক ধরা যাবে-—ভারত শিল্পের সেই সত্যরূপ যেটি নিয়ে ভারত শিল্প বিশ্বের শিল্পের সঙ্গে এক এবং পৃথক। কোন শিল্পের স্বরূপ শাস্ত্রমতের মধ্যে ধরা থাকে না সেটা শিল্পের নিজের মধ্যেই ধরা থাকে। ভারত শিল্পের কেন সব শিল্পের প্রাণের খোঁজে যে শিক্ষার্থীরা চলবেন তাঁদের এই মত ও মন্ত্রের পার্থক্য প্রথমেই হৃদয়ঙ্গম করা চাই মতকে মন্ত্র বলে ভুল করলে চলবে না। যুদ্ধের সময় দুপক্ষের সেনাপতি মত দেন, কোন পথে কি ভাবে ফৌজ চলবে, ব্যুহ রচনা করবে এবং সেই মতো ম্যাপ প্রস্তুত করে’ নিয়ে ফৌজের চালনা হয়। শিল্পশাস্ত্রকারের মতগুলো এই ম্যাপ, দেশের শিল্প কখন কি মূর্তি ধরেছিল তার প্রথা ও প্রণালীর সুস্পষ্ট ইতিহাস শাস্ত্র থেকে পাওয়া যায় বলে তার মধ্যে কোন একটা পথে যদি আজ আমরা শিল্পকে চালাতে চাই তো এই সব প্রাচীন মত শিল্পে পেটেণ্ট নেওয়ার বেলা খুব কাজে আসবে, দেশের প্রাচীন artএর ইতিহাস লিখতে কাজে আসবে, গত artএর নূতন থিসিস লিখতে কাজে আসবে, এমন কি artist না হলেও art সম্বন্ধে original research লেখার পক্ষেও এই সব মত যথেষ্ট রকম ব্যবহারে লাগবে কেননা এদের copyright বহুদিন শেষ হয়েছে,–কিন্তু শিল্পকে যারা চায় তাদের কাছে এই সব মত বেশী কাজে আসবে না। শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে এমন কি বৈদ্যশাস্ত্রের বৈষ্ণব শাস্ত্রের এক কথায় নিখিল শাস্ত্রের অপার সমুদ্রের তলায় ও শিল্পেরই মধ্যে যে সব মন্ত্রগুলো এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে সেগুলো উপকারে লাগবে। যে জানতে চায় শিল্পকে তাকে মত ও মন্ত্র দুই উদ্ধার করে করে চলতে হয়। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ম্যাপ ধরে চল্লেই যুদ্ধে জিৎ হয় না, এটা পাকা সেনাপতি পাকা সেপাই দু’জনেই বোঝে, ম্যাপের সীমানার পরে যে অনির্দিষ্ট সীমানা তার কল্পনা সেনাপতিও ধরে থাকে সিপাহীও ধরে থাকে এবং বীরত্বের যে একটি মন্ত্র দুঃসাহস তাকে মনে পোষণ করে অগ্রসর হয়, জিতলে পুরস্কার হারলে তিরস্কার!” নূতনকে জয়ের কল্পনা তাদের মনকে দোলায়, ম্যাপে দাগা মতামতের উল্টোপথে অনেক সময়ে তারা চলে মন্ত্রের সাধনে শরীর পাতনে, হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে তারা মন্ত্রণা করে সেনা ও সেনাপতি, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে পথ বিপথ অতিক্রম করে গিয়ে দেয় হানা অজানা পুরীর দরজায়, হঠাৎ দখল হয়ে যায় একটা রাজত্ব যেন মন্ত্রবলে! শিল্পকে পেলে তো কথাই নেই, শিল্পের মন্ত্রগুলো পেলে শিল্প পেতে দেরী হয় না, কিন্তু মতগুলোতে পেয়ে বসলে শাস্ত্রমতে যাকে পাওয়া বলে তাকেই পায় মানুষ, শিল্প রচনাকে পায় না মনোমত মনোগত এ সবের কল্পনাকেও পায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *