অন্তর্যামী

ভীমচাঁদ নিজের বাঁ হাতের উপর সজোরে ডান হাত চাপড়াইয়া তাহার ষোড়শী স্ত্রীর কাছে আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘মানুষের মুখের পানে চেয়ে যদি তার মনের কথাই না জানতে পারলুম ত এ দুটো চোখ বৃথাই রাখি! ওগো আমাকে ফাঁকি দেওয়া সোজা কাজ নয় !’

তাহার স্ত্রী বিনোদিনী, রাগ করিয়া বলিল, ‘ওই অহঙ্কারেই তুমি মাটি হয়ে গেলে! বরং, আমি ত বলি তোমাকে ঠকানোর চেয়ে সোজা কাজ আর এ পৃথিবীতে নেই।’

ভীমচাঁদ মহা অবজ্ঞাভরে হাসিয়া বলিল, ‘ভুল, ভুল, মস্ত ভুল! আমাকে দেখতে বোকার মত, কিন্তু, আসলে তা নয়! আমি একবার যাকে চেয়ে দেখব, তার পেটের কথা টেনে আনব, সে তুমি নিশ্চয় জেনে রেখো।’

‘রেখেচি’ বলিয়া বিনোদিনী ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া শেষে উদাসভাবে বলিল, ‘আর পারলেই ভাল। তা ছাড়া আমার কি! তুমি স্বামী, খাওয়াবে পরাবে—যা ভাল বুঝবে কোরবে। কিন্তু, এই কথা আমিও বলে রাখলুম, তোমার নতুন মা তোমাকে ফাঁকি যদি না দেন ত আমাকে কুকুর বলে ডেকো।’

ভীমচাঁদ এক মুহূর্ত তাহার স্ত্রীর প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সহসা বলিয়া উঠিল, ‘আচ্ছা’ আজই আমি তা জেনে আসচি। নতুন মা’র কি মতলব এক্ষণি ফিরে এসে যদি না বলতে পারি ত, আমার নাম ভীমচন্দ্রই নয়।’ বলিয়া সে বাটীর বাহির হইয়া গেল।

এইখানে একটু গোড়ার কথা বলিয়া রাখি। ভীমের পিতা শিবদাসবাবু সঙ্গতিপন্ন লোক। তাহার স্ত্রী, ছয় বৎসরের শিশু ভীমকে রাখিয়া স্বর্গারোহন করিলে, শিবদাস পত্নীশোক আর সহ্য করিতে না পারিয়া সেই মাসের শেষেই স্বগ্রামস্থা এক দরিদ্র বিধবার বয়স্থা কন্যা সুখদাকে বিবাহ করিলেন এবং মাতা ও কন্যা উভয়কেই নিজের সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত করিলেন। অতঃপর নিরতিশয় দুরন্ত ও অবাধ্য ভীমকে সংসারে রাখা একপ্রকার অসম্ভব হইয়া পড়িল। তাহার মাতুল সংবাদ পাইয়া ভীমকে লইয়া গেলেন, মানুষ করিলেন এবং যথা সময়ে বিবাহ দিয়া পাটের কাজে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।

তাহার পর বহু বৎসর গত হইয়াছে। বৎসর তিনেক পূর্বে ভীমচাঁদ পত্নী বিনোদিনীকে লইয়া বাটী ফিরিয়া আসে। কিন্তু , এবারেও এক পরিবারে বসবাস করার সুবিধা হইল না। বিনোদিনীর সহিত সুখদা ও তাহার মাতার, এবং ভীমের সহিত সুখদার তিন পুত্রের বনিবনাও না হওয়ায় বৃদ্ধ পিতা শিবদাস স্পষ্ট কথা বলিতে বাধ্য হইলেন। ভীম আলাদা বাসা ভাড়া করিল। তখনও সে বেশি কিছু উপার্জন করিতে পারিত না, তাই, একটু দুঃখে-কষ্টেই দিন কাটিতেছিল। আমি এই সময়ের ইতিহাসটাই বলিতে বসিয়াছি।

মাস-খানেক হইল শিবদাস সাংঘাতিক পীড়ায় শয্যাগত হইয়াছেন, তাঁহার জীবনের আশা নাই। ভীম, নিজের কাজকর্ম ফেলিয়া দিবারাত্রি পিতার সেবায় নিযুক্ত রহিয়াছে, শুধু সকালবেলায় ঘণ্টা-খানেকের জন্য নিজের বাসায় ফিরিয়া আসিয়া এ দিকের বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করিয়া যাইতেছে। জনশ্রুতি উঠিল, শিবদাস ভীমের অসাক্ষাতে এক উইল করিয়াছেন, তাহাতে জ্যেষ্ঠপুত্র ভীমের অংশে শূন্য পড়িয়াছে। এই দুঃসংবাদ বিনোদিনী লোকের মুখে শনিতে পাইয়া আজ সকালে স্বামীকে জানাইয়া দিল, এবং তাহারাই উত্তরে অন্তর্যামী ভীমচন্দ্র হাত চাপড়াইয়া আস্ফালন করিয়া কহিল, এমন একটা কাজ তাহার অসাক্ষাতে ঘটিলেও, সে তাহার বিমাতার মুখের দিকে চাহিবামাত্রই বিদিত হইত, কোনমতেই তাহার অগোচর থাকিত না।

ভীম দ্রুতপদে এ বাটীতে আসিয়া এঘর-ওঘর করিয়া সোজা রান্নাঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার বিমাতা সুখদা তখন মৃতকল্প স্বামীর জন্য পথ্য প্রস্তুত করিতেছিলেন, ভীম ডাকিয়া বলিল, ‘মা শোন।’ সুখদা শ্রান্ত ক্লান্ত চোখ তুলিয়া চাহিলেন। ভীম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, ‘বাবা উইল করেচেন নাকি?’ সুখদা একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চিঁচিঁ করিয়া কহিলেন, ‘কি করে জানব বাবা, কি তিনি করেচেন? আমি ত দুঃখে কষ্টেই মারা যাচ্চি—আমার যা হচ্চে তা ভগবানই জানেন।’ ভীম একটুখানি নরম হইয়া বলিল, ‘শুনলুম তোমার মতলবেই উইল হয়েচে, আর তাতে আমার নামগন্ধও নেই।’ সুখদা চোখে আঁচল দিয়া অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে বলিলেন, ‘লোকে ত বলবেই। আমি তোমার সৎমা বৈ ত নই—বেশ ত, বাবা, তিনি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁকেই জিজ্ঞেসা কর না কেন?

ভীমের বুকের ভিতর হইতে সমস্ত গ্লানি ধুইয়া মুছিয়া গেল। বিমাতার কান্না ও কণ্ঠস্বরে আর তাহার লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, এ-সব মিথ্যা রটনা। সে তৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘আমি বিশ্বাস করিনি, মা, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি কোন কথা কাউকে জিজ্ঞেস কত্তে চাইনে—এ সমস্ত মিথ্যে।’ বলিয়া সে বাহিরে চালিয়া গেল। পিতার ঘরে গিয়া আজ মরণাপন্ন পিতৃমুখের দিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মমতার সহিত চাহিয়া রহিল, তাঁহার নাড়ী দেখিয়া, পায়ে হাত বুলাইয়া দিল, একটু গরম দুধ পান করাইয়া দিল। এখন, সব কাজেই তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। বছর-তিনেক পূর্বে যেদিন পিতার স্পষ্ট কথায় সে স্ত্রীকে লইয়া গৃহত্যাগ করিয়া আলাদা বাসা করিয়াছিল, সেদিন পিতার উপর তাহার অত্যন্ত অভিমান হইয়াছিল। সেই অভিমানের জন্য এখন সে মনে মনে ক্ষমা ভিক্ষা করিল এবং মুখ ফিরাইয়া চোখের জল মুছিল। কিন্তু, এখানেও সে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিল না। স্ত্রীকে এই সুসংবাদটা না দেওয়া পর্যন্ত সে ত কিছুতেই সুস্থির হইতে পারে না। ঘরের বাহিরে আসিয়া চটি-জুতা পায়ে দিয়া ভীম চটপট শব্দে বাসার দিকে রওনা হইয়া পড়িল। বিনোদিনী তখন রাঁধিতেছিল, ভীম কবাটের সুমুখে দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল—’ওগো, শুনচ?’

বিনোদিনী চোখ তুলিয়া কহিল, ‘আবার কি?’

ভীম একগাল হাসিয়া ফেলিয়া বলিল—’মিথ্যে মিথ্যে, সব মিথ্যে।’

‘কি মিথ্যে?’

‘এই তোমার উইল করার কথা। বললুম তোমাকে, একি হতে পারে? সারাদিন আমি ও বাড়িতে আছি, আমাকে ফাঁকি দেবে কে? আমি জানতে পারলুম না, আর জানলে যত পাড়ার লোকে?’

বিনোদিনী স্বামীর কথা বিশ্বাস করিল না, প্রশ্ন করিল, ‘তুমি কি জেনে এলে তাই বল না?’ ভীম তেমনি আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘মিথ্যে তাই জেনে এলুম। একটা সম্ভব-অসম্ভব আছে ত! এ কি হতে পারে আমাকে ফাঁকি আর আমি জানলুম না!’ বিনোদিনী নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। ভীম বলিতে লাগিল, ‘গিয়েই বললুম, ‘মা শোনো’—তিনি মুখ তুলতেই আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে রইলুম। ওগো, এটা আমার ঈশ্বরদত্ত শক্তি—যে কোন মানুষ হোক না, তার চোখ দেখে আমি মনের কথা ছাপার অক্ষরের মত পড়ে ফেলতে পারি। পড়েও ফেললুম।’ বিনোদিনী একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বেশ করেচ। আমি বলি বুঝি, সত্যই কিছু জেনে এসেচ।’

ভীম ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া জবাব দিল, ‘আবার সত্যি কি হবে শুনি? উইল হল, আমি জানলুম না, মা জানলেন না আর জানলে এখানে বসে তুমি? মা আমার কেঁদে ফেলে বললেন, বাবা, আমি সৎমা বলেই—আবার কি চাও তুমি?’ বিনোদিনী আর তর্ক করিল না। সে স্বামীকেও চিনিত, তাঁর বিমাতাটিকেও চিনিত। আর একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘হলেই ভাল। আচ্ছা, যাও তুমি স্নান করে এসো, আমার রান্না হয়ে গেছে।’

ভীম, স্ত্রীর ভাব দেখিয়া বুঝিল, সে কিছুই বিশ্বাস করে নাই। তাই ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, ‘আমার কথায় তোমার বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় পরের কথায়। আচ্ছা, তখন টের পাবে—কিন্তু, আমি ত এখানে খেতে পারব না—আমাকে এখনি ফিরে যেতে হবে ‘ বলিয়া ভীমচাঁদ যেমন করিয়া আসিয়াছিল, তেমনি করিয়া চটি-জুতার পটাপট শব্দ করিয়া বাহির হইয়া গেল।

পিতৃশ্রাদ্ধ ভীমচাঁদ মহা আড়ম্বরে সম্পন্ন করিল। সদ্য বিধবা সুখদা কাঁদিয়া কাটিয়া জানাইলেন, লোহার সিন্দুকে কিছু নাই। ভীমচাঁদ জ্যেষ্টপুত্র, সুতরাং সমস্ত কর্তব্য তাহারই, সে স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিয়া, এবং এক পাটের মহাজনের নিকট খত লিখিয়া দু’ হাজার টাকা কর্জ করিয়া সমস্ত ব্যয়ভার নিজেই বহন করিল। শ্রাদ্ধ-শেষে রেজেস্ট্রি-করা উইল বাহির হইল, উকিল সর্বসমক্ষে পড়িয়া শুনাইলেন। তাহাতে শিবদাসবাবু, দ্বিতীয় পক্ষের তিনটি ছেলেকেই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি তিন সমান ভাগে দিয়া গিয়াছেন, ভীমের ভাগ্যে এক কানাকড়িও নাই। ভীম শুষ্ক মুখে অধোবদনে বসিয়া রহিল।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *